শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৭৫)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এক দিন রাজা দুষ্মন্ত রাজকার্যসমাধানান্তে একান্তে আসীন হইয়া, প্রিয়বয়স্য মাধব্যের সহিত কথোপকথনরসে কালযাপন করিতেছেন; এমন সময়ে, হংসপদিকা নামে এক পরিচারিকা সঙ্গীতশালায় অতি মধুর স্বরে এই ভাবের গান করিতে লাগিল, অহে মধুকর! অভিনব মধু লোভে সহকারমঞ্জরীতে তাদৃশ প্রণয় প্রদর্শন করিয়া, এখন, কমলমধু পানে পরিতৃপ্ত হইয়া, উহারে একবারে বিস্মৃত হইলে কেন?
হংসপদিকার গীতি শ্রবণ করিয়া, রাজা অকস্মাৎ যৎপরোনাস্তি উন্মনাঃ হইলেন; কিন্তু, কি নিমিত্ত উন্মনাঃ হইতেছেন তাহার কিছুই অনুধাবন করিতে না পারিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, কেন এই মনোহর গীত শ্রবণ করিয়া আমার চিত্ত এমন আকুল হইতেছে? প্রিয়জনবিরহ ব্যতিরেকে মনের এরূপ আকুলতা হয় না, কিন্তু প্রিয়বিরহও উপস্থিত দেখিতেছি না। অথবা, মনুষ্য, সর্ব্ব প্রকারে সুখী হইয়াও, রমণীয় বস্তু দর্শন কিংবা মনোহর গীত শ্রবণ করিয়া, যে অকস্মাৎ আকুলহৃদয় হয়, বোধ করি, অনতিপরিস্ফুট রূপে জন্মান্তরীণ স্থির সৌহৃদ্য তাহার স্মৃতিপথে আরূঢ় হয়।
রাজা মনে মনে এই বিতর্ক করিতেছেন, এমন সময়ে কঞ্চুকী আসিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, মহারাজ! ধর্ম্মারণ্যবাসী তপস্বীরা, মহর্ষি কণ্বের সন্দেশ লইয়া, আসিয়াছেন, কি আজ্ঞা হয়। রাজা, তপস্বিশব্দ শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র আদর প্রদর্শনপূর্ব্বক কহিলেন, শীঘ্র উপাধ্যায় সোমরতকে বল, অভ্যাগত তপস্বীদিগকে, বেদবিধি অনুসারে সৎকার করিয়া, অবিলম্বে আমার নিকটে লইয়া আইসেন; আমিও ইত্যবকাশে তপস্বিদর্শনযোগ্য প্রদেশে গিয়া রীতিমত অবস্থিতি করিতেছি।
এই আদেশ প্রদান পূর্ব্বক কঞ্চুকীকে বিদায় করিয়া, রাজা অগ্নিগৃহে গিয়া অবস্থিতি করিলেন এবং কহিতে লাগিলেন, ভগবান্ কণ্ব কি নিমিত্ত আমার নিকট ঋষি প্রেরণ করিলেন? কি তাঁহাদের তপস্যার বিঘ্ন ঘটিয়াছে, কি কোনও দুরাত্মা তাঁহাদের উপর কোনও প্রকার অত্যাচার করিয়াছে? কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, আমার মন অত্যন্ত আকুল হইতেছে। পার্শ্ববর্ত্তিনী পরিচারিকা কহিল, মহারাজ! আমার বোধ হইতেছে, ধর্ম্মারণ্যবাসী ঋষিরা মহারাজের অধিকারে নির্বিঘ্নে ও নিরাকুল চিত্তে, তপস্যার অনুষ্ঠান করিতেছেন; এই হেতু, প্রীত হইয়া, মহারাজকে ধন্যবাদ দিতে ও আশীর্বাদ করিতে আসিয়াছেন। এবম্প্রকার কথোপকথন হইতেছে, এনন সময়ে সোমরাত, তপস্বীদিগকে সমভিব্যাহারে করিয়া, উপস্থিত হইলেন। রাজা, দুর হইতে দেখিতে পাইয়া, আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং তাঁহাদের আগমনপ্রতীক্ষায় দণ্ডায়মান রহিলেন। তদ্দর্শনে সোমরাত তপস্বীদিগকে কহিলেন, ঐ দেখুন, সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি, আসন পরিত্যাগপূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইয়া, আপনাদের প্রতীক্ষা করিতেছেন। শার্ঙ্গরব কহিলেন, নরপতিদিগের এরূপ বিনয় ও সৌজন্য দেখিলে সাতিশয় প্রীত হইতে হয় এবং অত্যন্ত প্রশংসা করিতে ও সাধুবাদ দিতে হয়। অথবা ইহার বিচিত্র কি—তরুগণ ফলিত হইলে ফলভরে অবনত হইয়া থাকে; বর্ষাকালীন জলধরগণ বারিভরে নম্র ভাব অবলম্বন করে; সৎপুরুষদিগেরও প্রথা এই, সমৃদ্ধিশালী হইলে অনুদ্ধত স্বভাব হয়েন।
শকুন্তলার দক্ষিণ চক্ষু স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি সাতিশয় শঙ্কিতা হইয়া গৌতমীকে কহিলেন, পিসি! আমার ডানি চোক নাচিতেছে কেন? গৌতমী কহিলেন, বৎসে! শঙ্কিতা হইও না, পতিকুলদেবতারা তোমার মঙ্গল করিবেন। যাহা হউক, শকুন্তলা তদবধি, মনে মনে নানাপ্রকার আশঙ্কা করিতে লাগিলেন ও অত্যন্ত আকুলহৃদয় হইলেন।
রাজা শকুন্তলাকে দেখিয়া কহিতে লাগিলেন, এই অবগুণ্ঠনবতী কামিনী কে? কি নিমিত্তই বা ইনি তপস্বীদিগের সমভিব্যাহারে আসিয়াছেন? পার্শ্ববর্ত্তিনী পরিচারিকা কহিল, মহারাজ! আমিও দেখিয়া অবধি নানা বিতর্ক করিতেছি, কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যা হউক, মহারাজ! এরূপ রূপ লাবণ্যের মাধুরী কখনও কাহারও নয়নগোচর হয় নাই। রাজা কহিলেন, ও কথা ছাডিয়া দাও, পরস্ত্রীতে দৃষ্টিপাত বা পরস্ত্রীর কথা লইয়া আন্দোলন করা কর্তব্য নহে। এ দিকে, শকুন্তলা আপনার অস্থির হৃদয়কে এই বলিয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন, হৃদয়! এত আকুল হইতেছ কেন? আর্য্যপুত্রের তৎকালীন ভাব মনে করিয়া আশ্বাসিত হও, ও ধৈর্য্য অবলম্বন কর।
তাপসেরা ক্রমে ক্রমে সন্নিহিত হইয়া, মহারাজের জয় হউক বলিয়া, হস্ত তুলিয়া, আশীর্বাদ করিলেন। রাজা প্রণাম করিয়া ঋষিদিগকে আসন পরিগ্রহ করিতে কহিলেন! অনন্তর সকলে উপবেশন করিলে, রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন, নির্বিঘ্নে তপস্যা সম্পন্ন হইতেছে? ঋষিরা কহিলেন, মহারাজ আপনি শাসনকর্তা থাকিতে, ধর্ম্মক্রিয়ার বিঘ্নসম্ভাবনা কোথায়? সূর্য্যদেবের উদয় হইলে কি অন্ধকারের আবির্ভাব হইতে পারে? রাজা শুনিয়া কৃতার্থম্মন্য হইয়া কহিলেন, অদ্য আমার রাজশব্দ সার্থক হইল। পরে, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন ভগবান্ কণ্বের কুশল? ঋষিরা কহিলেন, হাঁ মহারাজ! মহর্ষি সর্ব্বাংশেই কুশলী।
এই রূপে প্রথমসমাগমোচিত শিষ্টাচারপরম্পরা পরিসমাপ্ত হইলে, শার্ঙ্গরব কহিলেন, মহারাজ! আমাদের গুরুদেবের যে সন্দেশ লইয়া আসিয়াছি, নিবেদন করি, শ্রবণ করুন, মহর্ষি কহিয়াছেন, আপনি আমার অনুপস্থিতিকালে শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন; আমি, সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ সম্মতি প্রদান করিয়াছি; আপনি সর্ব্বাংশে আমার শকুন্তলার যোগ্য পাত্র; এক্ষণে আপনকার সহধর্মিণী অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন, গ্রহণ করুন। গৌতমীও কহিলেন, মহারাজ! আমি কিছু বলিতে চাই, কিন্তু বলিবার পথ নাই; শকুন্তলাও গুরুজনের অপেক্ষা রাখে নাই; তুমিও তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর নাই; তোমরা পরস্পরের সম্মতিতে যাহা করিয়াছ, তাহাতে অন্যের কথা কহিবার কি আছে।
শকুন্তলা, মনে মনে শঙ্কিতা ও কম্পিতা হইয়া, এই ভাবিতে লাগিলেন, না জানি আর্য্যপুত্র এখন কি বলেন। রাজা দুর্ব্বাসার শাপপ্রভাবে শকুন্তলাপরিণয়বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বিস্মৃত হইয়াছিলেন, সুতরাং শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, এ আবার কি উপস্থিত! শকুন্তলা এক বারে ম্রিয়মাণ হইলেন। শার্ঙ্গরব কহিলেন, মহারাজ! লৌকিক ব্যবহার বিলক্ষণ অবগত হইয়াও, আপনি এরূপ কহিতেছেন কেন? আপনি কি জানেন না যে, পরিণীতা নারী যদিও অত্যন্ত সাধুশীলা হয়, সে নিয়ত পিতৃকুলবাসিনী হইলে, লোকে নানা কথা কহিয়া থাকে; এই নিমিত্ত, সে পতির অপ্রিয় হইলেও, পিতৃপক্ষ তাহাকে পতিকুলবাসিনী করিতে চাহে।
রাজা কহিলেন, কই আমি ত ইঁহার পাণিগ্রহণ করি নাই। শকুন্তলা শুনিয়া, বিষাদসাগরে মগ্ন হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, হৃদয়! যে আশঙ্কা করিতেছিলে, তাহাই ঘটিয়াছে। শার্ঙ্গরব, রাজার অস্বীকারশ্রবণে, তদীয় ধূর্ত্ততা আশঙ্কা করিয়া যৎপরোনাস্তি কুপিত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! জগদীশ্বর আপনাকে ধর্ম্মসংস্থাপনকার্য্যে নিয়োজিত করিয়াছেন। অন্যে অন্যায় করিলে, আপনি দণ্ডবিধান করিয়া থাকেন। এক্ষণে আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, রাজা হইয়া অনুষ্ঠিত কার্য্যের অপলাপে প্রবৃত্ত হইলে, ধর্ম্মদ্রোহী হইতে হয় কি না? রাজা কহিলেন, আপনি আমায় এত অভদ্র স্থির করিতেছেন কেন? শার্ঙ্গরব কহিলেন, মহারাজ! আপনকার অপরাধ নাই, যাহারা ঐশ্বর্য্য মদে মত্ত হয়, তাহাদের এইরূপই স্বভাব ও এইরূপই আচরণ হইয়া থাকে। রাজা কহিলেন, আপনি অন্যায় ভর্ৎসনা করিতেছেন, আমি কোনও ক্রমে এরূপ ভর্ৎসনার যোগ্য নহি।
এই রূপে রাজাকে অস্বীকারপরায়ণ ও শকুন্তলাকে লজ্জায় অবনতমুখী দেখিয়া, গৌতমী শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎসে! লজ্জিত হইও না; আমি তোমার মুখের ঘোমটা খুলিয়া দিতেছি, তাহা হইলে মহারাজ তোমায় চিনিতে পারিবেন। এই বলিয়া, তিনি শকুন্তলার মুখের অবগুণ্ঠন খুলিয়া দিলেন। রাজা তথাপি চিনিতে পারিলেন না, বরং পূর্ব্বাপেক্ষায় সমধিক সংশয়ারূঢ় হইয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন শর্ঙ্গরব কহিলেন, মহারাজ! এরূপ মৌনভাবে রহিলেন কেন? রাজা কহিলেন, মহাশয়! কি করি বলুন; অনেক ভাবিয়া দেখিলাম, কিন্তু ইহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি বলিয়া কোনও ক্রমেই স্মরণ হইতেছে না; সুতরাং, কি প্রকারে ইহারে ভার্য্যা বলিয়া পরিগ্রহ করি; বিশেষতঃ, ইনি এক্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন।
রাজার এই বচনবিন্যাস শ্রবণ করিয়া, শকুন্তলা মনে মনে কহিতে লাগিলেন, হায়, কি সর্ব্বনাশ! এক বারে পাণিগ্রহণেই সন্দেহ! রাজমহিষী হইয়া, অশেষ সুখসম্ভোগে কালহরণ করিব বলিয়া, যত আশা করিয়াছিলাম, সমুদায় এক কালে নির্মূল হইল। শার্ঙ্গরব কহিলেন, মহারাজ! বিবেচনা করুন, মহর্ষি কেমন মহানুভবতা প্রদর্শন করিয়াছেন। আপনি তাঁহার অগাচরে তদীয় অনুমতিনিরপেক্ষ হইয়া তাঁহার কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন; তিনি, তাহাতে রোষ বা অসন্তোষ প্রদর্শন না করিয়া, বরং সন্তোষ প্রদর্শন করিয়াছেন এবং কন্যারে আপনার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন। এক্ষণে প্রত্যাখ্যান করিয়া, তাদৃশ সদাশয় মহানুভাবের অবমাননা করা মহারাজের কোনও মতেই কর্ত্তব্য নহে। আপনি, স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া, কর্তব্যনির্ধারণ করুন।
শারদ্বত শর্ঙ্গরব অপেক্ষা উদ্ধতস্বভাব ছিলেন। তিনি কহিলেন, অহে শর্ঙ্গরব! স্থির হও, আর তোমার বৃথা বাগ্জাল বিস্তার করিবার প্রয়োজন নাই। আমি এক কথায় সকল বিষয়ের শেষ করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি শকুন্তলার দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিলেন, শকুন্তলে! আমাদের যাহা বলিবার বলিয়াছি; মহারাজ এইরূপ কহিতেছেন; এক্ষণে তোমার যাহা বক্তব্য থাকে বল, এবং যাহাতে উঁহার প্রতীতি জন্মে, এরূপ কর। তখন শকুন্তলা অতি মৃদু স্বরে কহিলেন, যখন তাদৃশ অনুরাগ এতদৃশ ভাব অবলম্বন করিয়াছে, তখন আমি পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণ করাইয়া কি করিব; কিন্তু আত্মশোধন আবশ্যক, এই নিমিত্ত কিছু বলিতেছি। এই বলিয়া, রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আর্যপুত্র! এইমাত্র কহিয়া কিঞ্চিৎ স্তব্ধ হইয়া কহিলেন; যখন পরিণয়েই সন্দেহ জন্মিয়াছে, তখন আর আর্য্যপুত্রশব্দে সম্ভাষণ করা অবিধেয়। এই বলিয়া পুনর্বার কহিলেন, পৌরব! আমি সরলহৃদয়া, ভাল মন্দ কিছুই জানি না। তৎকালে তপোবনে তাদৃশী অমায়িকতা দেখাইয়া, ও ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া, এক্ষণে এরূপ দুর্বাক্য কহিয়া প্রত্যাখ্যান করা তোমার উচিত নহে।
রাজা শুনিয়া কিঞ্চিৎ কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, ঋষিতনয়ে! যেমন বর্ষাকালীন নদী তীরতরুকে পাতিত ও আপনার প্রবাহকেও পঙ্কিল করে, সেইরূপ তুমি আমায় পতিত ও আপন কুলকেও কলঙ্কিত করিতে উদ্যত হইয়াছ। শকুন্তলা কহিলেন, ভাল, যদি তুমি, যথার্থই পরিণয়ে সন্দেহ করিয়া, পরস্ত্রীবোধে পরিগ্রহ করিতে শঙ্কিত হও, কোনও অভিজ্ঞান দর্শাইয়া তোমার শঙ্কা দুর করিতেছি। রাজা কহিলেন, এ উত্তম কল্প, কই কি অভিজ্ঞান দেখাইবে, দেখাও। শকুন্তলা রাজদত্ত অঙ্গুরীয় অঞ্চলের কোণে বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন; এক্ষণে ব্যস্ত হইয়া অঙ্গুরীয় খুলিতে গিয়া দেখিলেন, অঞ্চলের কোণে অঙ্গুরীয় নাই। তখন তিনি বিষণ্ণা ও ম্লানবদনা হইয়া, গৌতমীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। গৌতমী কহিলেন, বোধ হয়, আল্গা বাঁধা ছিল, নদীতে স্নান করিবার সময় পড়িয়া গিয়াছে।
রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, স্ত্রীজাতি অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতি, এই যে কথা প্রসিদ্ধ আছে, ইহা তাহার এক উত্তম উদাহরণ।
শকুন্তলা রাজার এইরূপ ভাব দর্শনে ম্রিয়মাণ হইয়া কহিলেন, আমি দৈবের প্রতিকূলতা বশতঃ অঙ্গুরীয়প্রদর্শনবিষয়ে অকৃতকার্য্য হইলাম বটে; কিন্তু এমন কোনও কথা বলিতেছি যে, তাহা শুনিলে অবশ্যই তোমার পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণ হইবেক। রাজা কহিলেন, এক্ষণে শুনা আবশ্যক; কি বলিয়া আমার প্রতীতি জন্মাইতে চাও, বল। শকুন্তলা কহিলেন, মনে করিয়া দেখ, এক দিন তুমি ও আমি দুজনে নবমালিকামণ্ডপে বসিয়া ছিলাম। তোমার হস্তে একটি জলপূর্ণ পদ্মপত্রের ঠোঙা ছিল। রাজা কহিলেন, ভাল, বলিয়া যাও, শুনিতেছি। শকুন্তলা কহিলেন, সেই সময়ে আমার কৃতপুত্র দীর্ঘাপাঙ্গ নামে মৃগশাবক তথায় উপস্থিত হইল। তুমি উহারে সেই জল পান করিতে আহ্বান করিলে। তুমি অপরিচিত বলিয়া সে তোমার নিকটে আসিল না; পরে আমি হস্তে করিলে, আসিয়া অনায়াসে পান করিল। তখন তুমি পরিহাস করিয়া কহিলে, সকলেই সজাতীয়ে বিশ্বাস করিয়া থাকে; তোমরা দুজনেই জঙ্গলা, এজন্য ও তোমার নিকটে আসিল। রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, কামিনীদিগের এইরূপ মধুমাখা প্রবঞ্চনাবাক্য বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদিগের বশীকরণমন্ত্রস্বরূপ। গৌতমী শুনিয়া কিঞ্চিৎ কোপ প্রদর্শন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! এ জন্মাবধি তপোবনে প্রতিপালিত, প্রবঞ্চনা কাকে বলে জানে না। রাজা কহিলেন, অয়ি বুদ্ধতাপসি! প্রবঞ্চনা স্ত্রীজাতির স্বভাবসিদ্ধ বিদ্যা, শিথিতে হয় না; মানুষের কথা কি কহিব, পশু পক্ষীদিগেরও বিনা শিক্ষায় প্রবঞ্চনানৈপুণ্য দেখিতে পাওয়া যায়। দেখ, কেহ শিখাইয়া দেয় না, অথচ কোকিলারা, কেমন প্রবঞ্চনা করিয়া, স্বীয় সন্তানদিগকে অন্য পক্ষী দ্বারা প্রতিপালিত করিয়া লয়। শকুন্তলা কষ্ট হইয়া কহিলেন; অনার্য্য! তুমি আপনি যেমন, অন্যকেও সেইরূপ মনে কর। রাজা কহিলেন, তাপসকন্যাে! দুষ্মন্ত গোপনে কোনও কর্ম্ম করে না; যখন যাহা করিয়াছে, সমুদায়ই সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ আছে। কই কেহ বলুক দেখি, আমি তোমার পাণিগ্রহণ করিয়াছি। শকুন্তলা কহিলেন, তুমি আমাকে স্বৈচ্ছাচারিণী করিলে। পুরুবংশীয়ের অতি উদারস্বভাব এই বিশ্বাস করিয়া, যখন আমি মধুমুখ পাষাণহৃদয়ের হস্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছি, তখন আমার ভাগ্যে যে এই ঘটিবেক ইহা বিচিত্র নহে। এই বলিয়া অঞ্চল মুখে দিয়া শকুন্তলা রোদন করিতে লাগিলেন।
তখন শার্ঙ্গরব কহিলেন, অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া কর্ম্ম করিলে, পরিশেষে এইরূপ মনস্তাপ পাইতে হয়। এই নিমিত্ত সকল কর্ম্মই, বিশেষতঃ যাহা নির্জনে করা যায়, সবিশেষ পরীক্ষা না করিয়া করা কর্ত্তব্য নহে? পরস্পরের মন না জানিয়া বন্ধুতা করিলে, সেই বন্ধুতা অবশেষে শত্রুতাতে পর্য্যবসিত হয়। শার্ঙ্গরবের তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া রাজা কহিলেন, কেন আপনি, স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিয়া, আমার উপর অকারণে এরূপ দোষারোপ করিতেছেন? শার্ঙ্গরব কিঞ্চিৎ কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, যে ব্যক্তি জন্মাবচ্ছিন্নে চাতুরী শিখে নাই, তাহার কথা অপ্রমাণ, আর যাহারা পরপ্রতারণা বিদ্যা বলিয়া শিক্ষা করে, তাহাদের কথাই প্রমাণ হইবে? তখন রাজা শার্ঙ্গরবকে কহিলেন, মহাশয়! আপনি বড় যথার্থবাদী। আমি স্বীকার করিলাম, প্রতারণাই আমাদের বিদ্যা ও ব্যবসায়; কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, ইহারে প্রতারণা করিয়া আমার কি লাভ হইবেক? শার্ঙ্গরব কোণে কম্পিতকলেবর হইয়া কহিলেন, নিপাত! রাজা কহিলেন, পুরুবংশীয়েরা নিপাত লাভ করে, এ কথা অশ্রদ্ধেয়।
এই রূপে উভয়ের বিবাদারম্ভ দেখিয়া, শারদ্বত কহিলেন, শার্ঙ্গরব! আর উত্তরোত্তর বাকৃছলে প্রয়োজন নাই। আমরা গুরুর নিয়োগ অনুষ্ঠান করিয়াছি; এক্ষণে ফিরিয়া যাই চল। এই বলিয়া রাজাকে কহিলেন, মহারাজ! ইনি তোমার পত্নী, ইচ্ছা হয় গ্রহণ কর, ইচ্ছা হয় ত্যাগ কর; পত্নীর উপর পরিণেতার সর্ব্বতোমুখী প্রভুতা আছে। এই বলিয়া শার্ঙ্গরব, শারদ্বত ও গৌতমী তিন জনে প্রস্থানোন্মুখ হইলেন।
শকুন্তলা, সকলকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া, অপূর্ণ লোচনে কাতর বচনে কহিলেন, ইনি ত আমার এই করিলেন, তোমরাও আমায় ফেলিয়া চলিলে, আমার কি গতি হইবেক। এই বলিয়া তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। গৌতমী কিঞ্চিৎ থামিয়া কহিলেন, বৎস শার্ঙ্গরব! শকুন্তলা কঁদিতে কাঁদিতে। আমাদের সঙ্গে আসিতেছে; দেখ, রাজা প্রত্যাখ্যান করিলেন, এখানে থাকিয়া আর কি করিবে বল? আমি বলি, আমাদের সঙ্গেই আসুক। শার্ঙ্গরব শুনিয়া, সরোষ নয়নে মুখ ফিরাইয়া, শকুন্তলাকে কহিলেন, আঃ পাপীয়সি! স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিতেছ? শকুন্তলা ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। তখন শার্ঙ্গরব শকুন্তুলাকে কহিলেন, দেখ, রাজা যেরূপ কহিতেছেন, যদি তুমি যথার্থ সেরূপ হও, তাহা হইলে তুমি স্বেচ্ছাচারিণী হইলে; তাত কণ্ব আর তোমার মুখাবলোকন করিবেন না। আর যদি তুমি মনে মনে আপনাকে পতিব্রতা বলিয়া জান, তাহা হইলে পতিগৃহে থাকিয়া দাসীবৃত্তি করাও তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ। অতএব এই খানেই থাক, আমরা চলিলাম।
এই রূপে তপস্বীদিগকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া, রাজা শার্ঙ্গরবকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহাশয়! আপনি উহাকে মিথ্যা প্রবঞ্চনা করিতেছেন কেন? পুরুরংশীয়েরা প্রাণান্তেও পরবনিতাপরিগ্রহে প্রবৃত্ত হয় না; চন্দ্র কুমুদিনীকেই প্রফুল্ল করেন, সুর্য্য কমলিনীকেই উল্লাসিত করিয়া থাকেন। তখন শার্ঙ্গরব কহিলেন, মহারাজ! আপনি, পরকীয় মহিলা আশাঙ্কা করিয়া, অধর্ম্মভয়ে শকুন্তলাপরিগ্রহে পরাঙ্মুখ হইতেছেন; কিন্তু ইহাও অসম্ভাবনীয় নহে, আপনি পূর্ব্ববৃত্তান্ত বিস্মৃত হইয়াছেন। ইহা শুনিয়া, রাজা পার্শ্বোপবিষ্ট পুরোহিতের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, মহাশয়কে ব্যবস্থা জিজ্ঞাসা করি, পাতকের লাঘব গৌরব বিবেচনা করিয়া, উপস্থিত বিষয়ে কি কর্ত্তব্য বলুন। আমিই পূর্ব্ববৃত্তান্ত বিস্মৃত হইয়াছি, অথবা এই স্ত্রী মিথ্যা বলিতেছেন; এমন সন্দেহস্থলে, আমি দারত্যাগী হই, অথবা পরস্ত্রীস্পর্শপাতকী হই।
পুরোহিত শুনিয়া, কিয়ৎ ক্ষণ বিবেচনা করিয়া, কহিলেন, ভাল, মহারাজ! যদি এরূপ করা যায়। রাজা কহিলেন, কি, আজ্ঞা করুন। পুরোহিত কহিলেন, ঋষিতনয়া প্রসবকাল পর্য্যন্ত এই স্থানে অবস্থিতি করুন। যদি বলেন, এ কথা বলি কেন? সিদ্ধ পুরুষেরা কহিয়াছেন, আপনার প্রথম সন্তান চক্রবর্ত্তিলক্ষণাক্রান্ত হইবেন। যদি মুনিদৌহিত্র সেইরূপ হল, ইঁহাকে গ্রহণ করিবেন; নতুবা ইহার পিতৃসমীপগমন স্থিরই রহিল। রাজা কহিলেন, যাহা আপনাদের অভিরুচি। তখন পুরোহিত কহিলেন, তবে আমি ইঁহাকে প্রসবকাল পর্য্যন্ত আমার আলয়ে লইয়া রাখি। পরে, তিনি শকুন্তলাকে বলিলেন বৎসে! আমার সঙ্গে আইস। শকুন্তলা পৃথিবি! বিদীর্ণ হও আমি প্রবেশ করি, আর আমি এ প্রাণ রাখিব না; এই বলিয়া রোদন করিতে করিতে, পুরোহিতের অনুগামিনী হইলেন।
সকলে প্রস্থান করিলে পর, রাজা, নিতম্ভ উন্মনাঃ হইয়া, শকুন্তলার বিষয়ই অনন্য মনে চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে, কি আশ্চর্য ব্যাপার! কি আশ্চর্য ব্যাপার! এই আকুল বাক্য রাজার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। তখন তিনি কি হইল। কি হইল! বলিয়া, পার্শ্ববর্ত্তিনী প্রতিহারীকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পুরোহিত, সহসা রাজসমীপে আসিয়া, বিস্ময়োৎফুল লোচনে আকুল বচনে কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! বড় এক অদ্ভুত কাণ্ড হইয়া গেল। সেই স্ত্রী, আমার সঙ্গে যাইতে যাইতে, অপ্সরাতীর্থের নিকট আপন অদৃষ্টকে ভর্ৎসনা করিয়া, উচ্চৈঃ স্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিল; অমনি এক জ্যোতিঃপদার্থ, স্ত্রীবেশে সহসা আবির্ভূত হইয়া, তাহাকে লইয়া অন্তর্হিত হইল। রাজা কহিলেন, মহাশয়! যাহা প্রত্যাখ্যাত হইয়ছে, সে বিষয়ের আলোচনায় আর প্রয়োজন নাই; আপনি অবাসে গমন করুন। পুরোহিত, মহারাজের জয় হউক বলিয়া আশীর্বাদ করিয়া, প্রস্থান করিলেন। রাজাও শকুন্তলাবৃত্তান্ত লইয়া অত্যন্ত আকুল হইয়াছিলেন, অতএব সভাভঙ্গ করিয়া শয়নাগারে গমন করিলেন।