শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৭৫)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

নদীতে স্নান করিবার সময়, রাজদও অঙ্গুরীয় শকুন্তলার অঞ্চলপ্রান্ত হইতে সলিলে ভ্রষ্ট হইয়াছিল, ভ্রষ্ট হইবামাত্র এক অতিবৃহৎ রোহিত মৎস্যে গ্রাস করে। সেই মৎস্য, কয়েক দিবস পরে, এক ধীবরের জালে পতিত হইল। ধীবর, খণ্ড খণ্ড বিক্রয় করিবার মানসে, ঐ মৎস্যকে বহু অংশে বিভক্ত করিয়া, তদীয় উদরমধ্যে অঙ্গুরীয় পাইল। অঙ্গরীয় পাইয়া, পরম উল্লাসিত মনে, সে এক মণিকারের আপণে বিক্রয় করিতে গেল। মণিকার, সেই মণিময় অঙ্গুরীয় রাজনামাঙ্কিত দেখিয়া, ধীবরকে চোর নিশ্চয় করিয়া, নগরপালের নিকট সংবাদ দিল। নগরপাল আসিয়া ধীবরকে পিছমোড়া করিয়া বাঁধিল এবং জিজ্ঞাসিল অরে বেটা চোর! তুই এ অঙ্গুরীয় কোথায় পাইলি, বল। ধীবর কহিল, মহাশয়! আমি চোর নহি। তখন নগরপাল কহিল, তুই বেটা যদি চোর নহিস্, এ অঙ্গুরীয় কেমন করিয়া পাইলি? যদি চুরি করিস্ নাই, রাজা কি সুব্রাহ্মণ দেখিয়া। তোরে দান করিয়াছেন?

 এই বলিয়া, নগরপাল চৌকীদারকে হুকুম দিলে, চৌকীদার তাহাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। ধীবর কহিল, অরে চৌকীদার! আমি চোর নহি, আমায় মার কেন; আমি কেমন করিয়া এই আঙ্গটী পাইলাম বলিতেছি। এই বলিয়া, সে কহিল, আমি ধীবরজাতি, মাছ ধরিয়া বিক্রয় করিয়া জীবিকানির্বাহ করি। নগরপাল শুনিয়া কোপাবিষ্ট হইয়া কহিল, মর্ বেটা, আমি তোর জাতি কুল জিজ্ঞাসিতেছি না কি? এই অঙ্গুরীয় কেমন করিয়া তোর হাতে আসিল বল্। ধীবর কহিল, আজি সকালে আমি শচীতীর্থে জাল ফেলিয়াছিলাম। একটা বড় রুই মাছ আমার জালে পড়ে। কাটিয়া উহার পেটের ভিতর এই আঙ্গটী দেখিতে পাইলাম। তার পর এই দোকানে আসিয়া দেখাইতেছি, এমন সময়ে আপনি আমায় ধরিলেন; আর আমি কিছুই জানি না; আমায় মারিতে হয় মারুন, কাটিতে হয় কাটুন, আমি চুরি করি নাই।

 নগরপাল শুনিয়া আঘ্রাণ লইয়া দেখিল, অঙ্গুরীয়ে তামিষগন্ধ নির্গত হইতেছে। তখন সে সন্দিহান হইয়া চৌকীদারকে কহিল, তুই এ বেটাকে এই খানে সাবধানে বসাইয়া রাখ্। আমি রাজবাটীতে গিয়া এই সকল বৃত্তান্ত রাজার গোচর করি। রাজা সকল শুনিয়া যেমন অনুমতি করেন। এই বলিয়া, নগরপাল অঙ্গুরীয় লইয়া রাজভবনে গমন করিল; এবং কিয়ৎ ক্ষণ পরে, প্রত্যাগত হইয়া চৌকীদারকে কহিল, আরে! ত্বরায়। ধীবরের বন্ধন খুলিয়া দে, এ চোর নয়। অঙ্গুরীয়প্রাপ্তিবিষয় যাহা কহিয়াছে, বোধ হইতেছে তাহার কিছুই মিথ্যা নহে। আর রাজা উহাকে অঙ্গুরীয়মূল্যের অনুরূপ এই মহামূল্য পুরস্কার দিয়াছেন। এই বলিয়া পুরস্কার দিয়া, নগরপাল ধীবরকে বিদায় দিল এবং চৌকীদারকে সঙ্গে লইয়া স্বস্থানে। প্রস্থান করিল।

 এ দিকে অঙ্গুরীয় হস্তে পতিত হইবামাত্র, শকুন্তলাবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত রাজার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল। তখন তিনি, অত্যন্ত কাতর হইয়া, যৎপরোনাস্তি বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন, এবং শকুন্তলার পুনর্দর্শনবিষয়ে একান্ত। হতাশ্বাস হইয়া সর্ব্ব বিষয়ে নিতান্তু নিরুৎসাহ হইলেন। আহার, বিহার, রাজকার্য্যপর্য্যালোচনা এক বারেই পরিত্যক্ত হইল। শকুন্তলার চিন্তায় একান্ত মগ্ন হইয়া, তিনি সর্ব্বদাই ম্লান বদনে কালযাপন করেন, কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না, কাহাকেও নিকটে আসিতে দেন না; কেবল প্রিয়বয়স্য মাধব্য সর্ব্বদা সমীপে উপবিষ্ট থাকেন। মাধব্য সান্ত্বনাবাক্যে প্রবোধ দিতে আরম্ভ করিলে, তাঁহার শোক সাগর উথলিয়া উঠিত, নয়নযুগল হইতে অবিরত বাষ্পবারি বিগলিত হইতে থাকিত।

 এক দিবস, রাজার চিত্তবিনোদনার্থ, মাধব্য তাঁহাকে প্রমদবনে লইয়া গেলেন। উভয়ে শীতল শিলাতলে উপবিষ্ট হইলে, মাধব্য জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাল বয়স্য! যদি তুমি তপোবনে শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলে, তবে তিনি উপস্থিত হইলে, প্রত্যাখ্যান করিলে কেন? রাজা শুনিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, বয়স্য! ও কথা আর কেন জিজ্ঞাসা কর? রাজধানী প্রত্যাগমন করিয়া, আমি শকুন্তলাবৃত্তান্ত এক বারে বিস্মৃত হইয়াছিলাম। কেন বিস্মৃত হইলাম, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। সে। দিবস, প্রিয়া কত প্রকারে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু আমার কেমন মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছিল, কিছুই স্মরণ হইল না। তাঁহাকে স্বেচ্ছাচারিণী মনে করিয়া, কতই দুর্বাক্য কহিয়াছি, কতই অবমাননা করিয়াছি। এই বলিতে বলিতে, নয়নযুগল অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হইয়া আসিল; বাক‍্শক্তিরহিতের ন্যায় হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর, মাধব্যকে কহিলেন, ভাল আমিই যেন বিস্মৃত হইয়াছিলাম; তোমায় ত সমুদায় কহিয়াছিলাম, তুমি কেন কথাপ্রসঙ্গেও কোনও দিন শকুন্তলার কথা উত্থাপন কর নাই? তুমিও কি আমার মত বিস্মৃত হইয়াছিলে?

 তখন মাধব কহিলেন, বয়স্য! আমার দোষ নাই, তুমি সমুদয় বলিয়া পরিশেষে কহিয়াছিলে, শকুন্তলাসংক্রান্ত যে সকল কথা কহিলাম, সমস্তই পরিহাসমাত্র, বাস্তবিক নহে। আমিও নিতান্তু নির্বোধ, তোমার শেষ কথাই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছিলাম, এই নিমিত্ত আর কখনও সে কথা উত্থাপন করি নাই। বিশেষতঃ, প্রত্যাখ্যানদিবসে আমি তোমার নিকটে ছিলাম না; থাকিলেও বরং যাহা শুনিয়াছিলাম, বলিতাম! রাজা, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া, বাষ্পাকুল লোচনে শোকাকুল বচনে কহিলেন, বয়স্য! কার দোষ দিব, সকলই আমার অদৃষ্টের দোষ! এই বলিয়া অত্যন্ত শোকাভিভূত হইলেন। তখন মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! এরূপ শোকে অভিভূত হওয়া তোমার উচিত নহে। দেখ, সৎপুরুষেরা শোক মোহের বশীভূত হয়েন না। প্রাকৃত জনেরাই শোকে ও মোহে বিচেতন হইয়া থাকে। যদি উভয়ই বায়ুভরে বিচলিত হয়, তবে বৃক্ষে ও পর্ব্বতে বিশেষ কি? তুমি গম্ভীর স্বভাব, ধৈর্য্য অবলম্বন ও শোকাবেগ সংবরণ কর।

 প্রিয়বয়স্যের প্রবোধবাক্য শ্রবণ করিয়া, রাজা কহিলেন, সখে! আমি নিতান্ত অবোধ নহি, কিন্তু মন আমার কোনও ক্রমে প্রবোধ মানিতেছে না; কি বলিয়াই বা প্রবোধ দিব। প্রত্যাখ্যানের পর, প্রিয়া প্রস্থানকালে, সাতিশয় কাতরতা প্রদর্শনপূর্ব্বক, আমার দিকে যে বারংবার বাষ্পপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন, সেই কাতর দৃষ্টিপাত আমার বক্ষঃস্থলে বিষদিগ্ধ শল্যের ন্যায় বিদ্ধ হইয়াছে। আমি সেই সময়ে তাঁহার প্রতি যে ক্র‌ুরের ব্যবহার করিয়াছি, তাহা মনে করিয়া, আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে; মরিলেও আমার এ দুঃখ যাবে না।

 মাধব্য, রাজাকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া, আশ্বাসপ্রদানার্থে কহিলেন, বয়স্য! অত কাতর হইও না; কিছু দিন পরে পুনরায় শকুন্তলার সহিত সমাগম হইবেক। রাজা কহিলেন, বয়স্য! আমি এক মুহুর্ত্তের নিমিত্তেও সে আশা করি না। আর আমি প্রিয়ার দর্শন পাইব না। এ জন্মের মত আমার সকল সুখ ফুরাইয়া গিয়াছে। নতুবা তৎকালে আমার তেমন বুদ্ধি ঘটিল কেন? মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! কোনও বিষয়েই নিতান্ত হতাশ হওয়া উচিত নয়। ভবিতব্যের কথা কে বলিতে পারে? দেখ, এই অঙ্গুরীয় যে পুনরায় তোমার হতে আসিবে, কাহার মনে ছিল।

 ইহা শুনিয়া, অঙ্গুরীয়ে দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক রাজা উহাকে সচেতন বোধে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, অঙ্গুরীয়! তুমিও আমার মত হতভাগ্য, নতুবা প্রিয়ার কমনীয় কোমল অঙ্গুলীতে স্থান পাইয়া, কি নিমিত্ত পুনরায় সেই দুর্লভ স্থান হইতে ভ্রষ্ট হইলে? মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! তুমি কি উপলক্ষে তাঁহার অঙ্গুলীতে অঙ্গুরীয় পরাইয়া দিয়াছিলে? রাজা কহিলেন, রাজধানীপ্রত্যাগমনকালে, প্রিয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে আমার হস্তে ধরিয়া কহিলেন, আর্যপুত্র! কত দিনে আমায় নিকটে লইয়া যাইবে? তখন আমি এই অঙ্গুরীয় তাঁহার কোমল অঙ্গুলীতে পরাইয়া দিয়া কহিলাম, প্রিয়ে! তুমি প্রতিদিন আমার নামের এক একটি অক্ষর গণিবে; গণনাও সমাপ্ত হইবে, আমার লোক আসিয়া তোমায় লইয়া যাইবে। প্রিয়ার নিকট সরল হৃদয়ে এই প্রতিজ্ঞা করিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু মোহান্ধ হইয়া এক বারেই বিস্মৃত হই।

 তখন মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! এ অঙ্গুরীয় কেমন করিয়া রোহিত মৎস্যের উদরে প্রবিষ্ট হইল? রাজা করিলেন, শুনিয়াছি, শচীতীর্থে স্নান করিবার সময়, প্রিয়ার অঞ্চল প্রান্ত হইতে সলিলে ভ্রষ্ট হইয়াছিল। মাধব্য কহিলেন, হাঁ সম্ভব বটে, সলিলে মগ্ন হইলে রোহিত মৎস্যে গ্রাস করে। রাজা অঙ্গুরীরে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, আমি এই অঙ্গুরীয়ের যথোচিত তিরস্কার করিব। এই বলিয়া কহিলেন, অরে অঙ্গুরীয়! প্রিয়ার কোমল করপল্লব পরিত্যাগ করিয়া, জলে মগ্ন হইয়া, তোর কি লাভ হইল বল্? অথবা, তোরে তিরস্কার করা অন্যায়; কারণ, অচেতন ব্যক্তি কথনও গুণগ্রহণ করিতে পারে না; নতুবা, আমিই কি নিমিত্ত প্রিয়ারে পরিত্যাগ করিলাম? এই বলিয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে শকুন্তলাকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন প্রিয়ে! আমি তোমায় অকারণে পরিত্যাগ করিয়াছি, অনূতাপানলে আমার হৃদয় দগ্ধ হইয়া যাইতেছে, দর্শন দিয়া প্রাণরক্ষা কর।

 রাজা শোকাকুল হইয়া এইরূপ বিলাপ করিতেছেন, এমন সময়ে চতুরিকানাম্নী পরিচারিকা এক চিত্রফলক আনয়ন করিল। রাজা চিত্তবিনোদনার্থে ঐ চিত্রফলকে স্বহস্তে শকুন্তলার প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিত করিয়াছিলেন। মাধব্য দেখিয়া বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে কহিলেন, বয়স্য! তুমি চিত্রফলকে কি অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়াছ! দেখিয়া কোনও মতে চিত্র বোধ হইতেছে না। আহা মরি, কি রূপ লাবণ্যের মাধুরী! কি অঙ্গসৌষ্ঠব! কি অমায়িক ভাব! মুখারবিন্দে কি সলজ্জ ভাব। প্রকাশ পাইতেছে! রাজা কহিলেন, সখে! তুমি প্রিয়াকে দেখ নাই, এই নিমিত্ত আমার চিত্রনৈপুণ্যের এত প্রশংসা করিতেছ। যদি তাঁহারে দেখিতে, চিত্র দেখিয়া কখনই সন্তুষ্ট হইতে না। তাঁহার অলৌকিক রূপ লাবণ্যের কিঞ্চিৎ অংশমাত্র এই চিত্রফলকে আবির্ভূত হইয়াছে। এই বলিয়া, পরিচারিকাকে কহিলেন, চতুরিকে! বর্ত্তিকা ও বর্ণপাত্র লইয়া আইস; অনেক অংশ চিত্রিত করিতে অবশিষ্ট আছে।

 এই বলিয়া, চতুরিকাকে বিদায় করিয়া, রাজা মাধব্যকে কহিলেন, সখে! আমি, স্বাদুশীতলনির্মলজলপূর্ণ নদী পরিত্যাগ কারয়া, এক্ষণে শুষ্ককণ্ঠ হইয়া মৃগতৃষ্ণিকায় পিপাসা শান্তি করিতে উদ্যত হইয়াছি; প্রিয়াকে পাইয়া পরিত্যাগ করিয়া, এক্ষণে চিত্রদর্শন দ্বারা চিত্তবিনোদনের চেষ্টা পাইতেছি। মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! চিত্রফলকে আর কি লিখিবে? রাজা কহিলেন, তপোবন ও মালিনীনদী লিখিব; যে রূপে হরিণগণকে তপোবনে সচ্ছন্দে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে এবং হংসগণকে মালিনীনদীতে কেলি করিতে দেখিয়াছিলাম, সে সমুদয়ও চিত্রিত করিব; আর প্রথমদর্শনদিবসে প্রিয়ার কর্ণে শিরীষপুষ্পের যেরূপ আভরণ দেখিয়াছিলাম, তাহাও লিখিব।

 এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে প্রতিহারী আসিয়া রাজহস্তে এক পত্র সমর্পণ করিল। রাজা পাঠ করিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন। মাধব্য জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য! কোথাকার পত্র, পত্র পাঠ করিয়া, এত বিষন্ন হইলে কেন। রাজা কহিলেন, বয়স্য! ধনমিত্র নামে এক সাংযাত্রিক সমুদ্রপথে বাণিজ্য করিত। সমুদ্রে নৌকা মগ্ন হইয়া তাহার প্রাণ বিয়োগ হইয়াছে। সে ব্যক্তি নিঃসন্তান। নিঃসন্তানের ধনে রজার অধিকার। এই নিমিত্ত, অমাত্য আমায় তাহার সমুদয় সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে লিখিয়াছেন। দেখ, বয়স্য! নিঃসন্তান হওয়া কত দুঃখের বিষয়! নামলোপ হইল, লোপ হইল, এবং বহু কষ্টে বহু কালে উপার্জ্জিত ধন অন্যের হস্তে গেল। ইহা অপেক্ষা আক্ষেপের বিষয় আর কি হইতে পারে! এই বলিয়া, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, আমার লোকান্তর হইলে, আমারও নাম, বংশ ও রাজ্যের এই গতি হইবেক।

 রাজার এইরূপ আক্ষেপ শুনিয়া, মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! তুমি অকারণে এত পরিতাপ কর কেন? তোমার সন্তানের বয়স অতীত হয় নাই। কিছু দিন পরে, তুমি অবশ্যই পুত্রমুখ নিরীক্ষণ করিবে। রাজা কহিলেন, বয়স্য! তুমি আমায় মিথ্যা প্রবোধ দাও কেন? উপস্থিত পরিত্যাগ করিয়া অনুপস্থিত প্রত্যাশা করা মূঢ়ের কর্ম্ম। আমি যখন, নিতান্ত বিচেতন হইয়া, প্রিয়াকে পরিত্যাগ করিয়াছি, তখন আর আমার পুত্রমুখনিরীক্ষণের আশা নাই।

 এই রূপে কিয়ৎ ক্ষণ বিলাপ করিয়া, রাজা অপুত্রতানিবন্ধন শোক সংবরণপূর্ব্বক প্রতিহারীকে কহিলেন, শুনিয়াছি ধনমিত্রের অনেক ভার্য্যা আছে, তন্মধ্যে কেহ অন্তঃসত্ত্বা থাকিতে পারেন। অমাত্যকে এ বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে বল। প্রতিহারী কছিল, মহারাজ! অযোধ্যানিবাসী শ্রেষ্ঠীর কন্যা ধনমিত্রের এক ভার্য্যা। শুনিয়াছি, শ্রেষ্ঠীকন্যা অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন। তখন রাজা কহিলেন, তবে অমাত্যকে বল, সেই গর্ভস্থ সন্তান ধনমিত্রের সমস্ত ধনের উত্তরাধিকারী হইবেক।

 এই আদেশ দিয়া প্রতিহারীকে বিদায় করিয়া, রাজা মাধব্যের সহিত পুনর্বার শকুন্তলাসংক্রান্ত কথোপকথন আরম্ভ করিতেছেন, এমন সময়ে ইন্দ্রসারথি মাতলি, দেবরথ লইয়া, তথায় উপস্থিত হইলেন। রাজা, দেখিয়া আহ্লাদিত হইয়া, মাতলিকে, স্বাগত জিজ্ঞাসা পুরঃসর, আসন পরিগ্রহ করিতে বলিলেন। মাতলি আসন পরিগ্রহ করিয়া কহিলেন, মহারাজ! দেবরাজ যদর্থে আমায় আপনকার নিকটে পাঠাইয়াছেন নিবেদন করি, শ্রবণ করুন। কালনেমির সন্তান দুর্জয় নামে কতকগুলা দুর্দান্ত দানব দেবতাদিগের বিষম শত্রু হইয়া উঠিয়াছে; কতিপয় দিবসের নিমিত্ত দেবলোকে গিয়া, আপনাকে দুর্জয় দানবদলের দমন করিতে হইবেক। রাজা কহিলেন, দেবরাজের এই আদেশে সবিশেষ অনুগৃহীত হইলাম; পরে মাধব্যকে কহিলেন, বয়স্য! অমাত্যকে বল আমি কিয়ৎ দিনের নিমিত্ত। বেদকার্য্যে ব্যাপৃত হইলাম; আমার প্রত্যাগমন পর্য্যন্ত তিনি একাকী সমস্ত রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা করুন।

 এই বলিয়া সসজ্জ হইয়া, রাজা ইন্দ্ররথে আরোহণপূর্ব্বক দেবলোকে প্রস্থান করিলেন।