শিবাজী/অষ্টম অধ্যায়

অ ষ্ট ম অধ্যায়

রাজ্যাভিষেক

অভিষেকের আবশ্যকতা

শিবাজী অনেক দেশ জয় এবং অগাধ ধন সংগ্রহ করিয়াছিলেন, কিন্তু এ পর্য্যন্ত নিজকে ছত্রপতি অর্থাৎ স্বাধীন রাজা বলিয়া ঘোষণা করেন নাই। ইহাতে তাঁহার অনেক অসুবিধা ও ক্ষতি হইতেছিল। প্রথমতঃ, অপর রাজারা তাঁহাকে বিজাপুরের অধীন জমিদার অথবা জাগীরদার মাত্র বলিয়া গণ্য করিতেন; বিজাপুরের কর্ম্মচারীদের চক্ষে তিনি বিদ্রোহী প্রজা মাত্র। আর, অন্যান্য মারাঠী জমিদারবংশও ভোঁশলেদিগকে নিজেদের অপেক্ষা কোন অংশে শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করিত না; বরং তাহাদের মধ্যে অতিপুরাতন ঘরগুলি (যেমন, মোরে, যাদব, নিম্বলকর প্রভৃতি) শাহজী শিবাজীকে ভুঁইফোড় অকুলীন বলিয়া অবজ্ঞা করিত। শিবাজীর প্রজারাও মহাসঙ্কটে পড়িয়াছিল, কারণ যতদিন তিনি ছত্রপতি বলিয়া গণ্য না হন, ততদিন আইন-অনুসারে তাহারা নিজেদের পূর্ব্বেকার রাজার প্রজা, শিবাজীর শাসন মানিতে বাধ্য ছিল না। তাঁহার ভূমিদান এবং নিয়োগপত্র আইন অনুসারে সিদ্ধ হইতে পারিত না।

 সুতরাং শিবাজী নিজের অভিষেক করিয়া ‘ছত্রপতি’ উপাধি লইয়া জগৎকে দেখাইলেন যে তিনি স্বাধীন রাজা, তাঁহার অধীন প্রজাগণ তাঁহাকেই মানিবে, অন্য কোন প্রভুর ক্ষমতা স্বীকার করিবে না। ইহা ভিন্ন মহারাষ্ট্রের সকল উচ্চমনা দেশসেবকই দেশে স্বাধীন হিন্দু রাজত্ব “হিন্দরী স্বরাজ”—স্থাপনের জন্য উৎসুক হইয়াছিল। একমাত্র শিবাজীই এই জাতীয় বাঞ্ছা পূরণ করিতে পারেন।

অভিষেকের আয়োজন

 কিন্তু শাস্ত্র অনুসারে ক্ষত্রিয় ভিন্ন অন্য কোন জাতের লোক হিন্দুরাজা হইতে পারে না; অথচ সে যুগে সমাজে ভোঁশলে বংশকে শুদ্র বলিয়া গণ্য করা হইত। তখন শিবাজীর মুনশী বালাজী আবজী মারাঠা জাতির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত কাশীবাসী বিশ্বেশ্বর ভট্ট (ডাক-নাম গাগা ভট্ট)কে অনেক টাকা দিয়া হাত করিলেন। ভট্ট মহাশয় শিবাজীর ক্ষত্রিয়ত্ব প্রমাণ করিয়া এবং তাঁহার আদি পুরুষ যে সূর্য্যবংশীয় চিতোরের মহারাণার পুত্র—ইহা স্বীকার করিয়া এক পাতি লিখিয়া দিলেন এবং তাঁহার অভিষেক-ক্রিয়ায় প্রধান পুরোহিত হইতে সম্মত হইলেন। গাগা ভট্ট দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত-“চারি বেদ ও ছয়শান্ত্রে যোগাভ্যাস-সম্পন্ন, জ্যোতিষী, মন্ত্রিক, সর্ব্ববিদ্যায় পারদর্শী, কলিযুগের ব্রহ্মদেব” [সভাসদ বখর]। তাঁহার বিরুদ্ধে তর্ক করিতে পারে এমন শক্তি বা সাহস মহারাষ্ট্রে তখন কোন ব্রাহ্মণের ছিল না। সুতরাং শাস্ত্রীয় তর্কে পরাস্ত হইবার ভয়ে এবং মোটা দক্ষিণার লোভে সকলেই শিবাজীর ক্ষত্রিয়ত্ব স্বীকার করিল।

 তাহার পর কয়েকমাস ধরিয়া মহাব্যয়ে অভিষেকের নানা আয়োজন করা হইল। ভারতবর্ষের সকল প্রদেশেরই পণ্ডিতরা নিমন্ত্রিত হইলেন। সে সময় রাস্তা-ঘাট এবং ভ্রমণের সুবিধা ছিল না বলিয়াই হয়; তথাপি এগার হাজার ব্রাহ্মণ—তাঁহাদের স্ত্রীপুত্র লইয়া পঞ্চাশ হাজার লোক—রায়গড়-দুর্গে উপস্থিত হইল এবং চারি মাস ধরিয়া রাজার খরচে মিঠাই-পক্কান্ন খাইতে থাকিল।

 অভিষেকের পূর্ব্বে আবশ্যক সকল অনুষ্ঠানই সম্পন্ন হইতে লাগিল। প্রথমে শিবাজী নিজ গুরু রামদাস স্বামী এবং মাতা জীজা বাঈকে বন্দনা করিয়া তাঁহাদের আশীর্ব্বাদ লইলেন।

শিবাজী ও সাতকর্ণীব তুলনা

 জীজা বাঈ-এর আজ আনন্দের সীমা নাই। যৌবনের শেষ হইতে স্বামীর অবহেলা সহ্য করিয়া তিনি সন্ন্যাসিনীর মত সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর কাটাইয়াছেন। পুত্রের আজীবন ভক্তিতে তিনি সে দুঃখ ভুলিয়া ছিলেন। আর,সেই পুত্রের পবিত্র চরিত্র, দয়াদাক্ষিণ্য, এবং অজেয় বীরত্বের খ্যাতিতে জগৎ পূর্ণ। আজ তাঁহার পুত্র স্বদেশবাসীদের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করিয়াছে, হিন্দু নরনারীকে অত্যাচারের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছে, সর্ব্বত্র ধর্ম ও ন্যায়ের রাজ্য স্থাপন করিয়াছে; এমন রাজার জননী বলিয়া অজি তিনি দেশপূজ্যা। পনের শত বৎসর পূর্ব্বের এই মহারাষ্ট্র দেশের আর এক রাজ-জননী অন্ধ্ররাজ শ্রীশাতকর্ণীর মাতা গোতমীর ভাষায় তিনিও বিজয়ী ধার্ম্মিক পুত্রের গুণগান করিয়া যেন বলিতেছেনঃ–

 “আমি মহারাণী গোতমী বালশ্রী, রাজরাজ শ্রীশাতকর্ণীর মাতা। আমার পুত্রের মাতৃশুশ্রূষা অবাধ, পৌরজনের সুখ-দুঃখে তাহার সম্পূর্ণ সহানুভূতি, সে শক-যবন-পহলব-ধ্বংসকারী, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের গৃহসম্পদ বাড়াইয়াছে ক্ষহরাত বংশ নিঃশেষ করিয়াছে, চারিবর্ণের মিশ্রণ থামাইয়া দিয়াছে, অনেক যুদ্ধে শত্রুদলকে জয় করিয়াছে, সে সৎপুরুষদিগের আশ্রয়, লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান, দক্ষিণাপথের ঈশ্বর.•••••”[১]  শুধু তাঁহার জীবনের এই পূর্ণ সফলতা দেখাইবার জন্যই যেন ভগবান জীজা বাঈকে এতদিন পর্য্যন্ত বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন, কারণ, শিবাজীর অভিষেকের বারো দিন পরেই তাঁহার আত্মা আশী বৎসর বয়সে পৃথিবী ছাডিয়া চলিয়া গেল।

তীর্থদর্শন ও প্রায়শ্চিত্ত

 তাহার পর শিবাজা তীর্থ-ভ্রমণে বাহির হইয়া চিপ্‌লুন তীর্থে পরশুরামের পূজা করিলেন এবং প্রতাপগড়ে গিয়া নিজ ইষ্ট দেবী ভবানীকে সওয়া মণ ওজনের সানার ছাতা উপহার দিয়া আরাধনা করিলেন। ২৯এ মে রায়গড়ে ফিরিয়া অনেক দিন ধবিয়া প্রত্যহ স্থানীয় দেব-দেবীর পূজায় ব্যস্ত রহিলেন।

 তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণ ক্ষত্রিয়াচার ন করিয়া যে পতিত (বা শূদ্র) হইয়াছিল, তাহার জন্য শিবাজী ২৮মে প্রায়শ্চিত্ত করিলেন; এবং গাগা ভট্ট তাঁহাকে উপবীত পরাইয়া ক্ষত্রিয় করিয়া দিলেন। তখন শিবাজী বলিলেন,“আমি দ্বিজ হইয়াছি; সকল দ্বিজের বেদাধিকার আছে, সুতরাং আমার ক্রিয়াকাণ্ডে বৈদিক মন্ত্র পড়িতে হইবে।” ইহা শুনিয়া সমবেত ব্রাহ্মণেরা বিদ্রোহী হইয়া উঠিল, বলিল, “কলিযুগে ক্ষত্রিয় জাত লোপ পাইয়াছে, এখন ব্রাহ্মণ ভিন্ন আর কেহ দ্বিজ নহে।” তাহারা টাকার লোভে ভোঁশলে বংশকে ক্ষত্রিয় বলিয়া স্বীকার করিয়াছিল, নচেৎ অভিষেক হয় না, আর ব্রাহ্মণেরা এত লক্ষ টাকার দক্ষিণা ও সিধা পায় না। কিন্তু এখন তাহাদের প্রথম মতের ন্যায়সঙ্গত ফল দেখিয়া তাহারা ক্ষেপিয়া উঠিল। স্বয়ং গাগা ভট্টও ভয় পাইলেন, এবং একটা গোঁজামিল দিয়া তাড়াতাড়ি গোলমাল মিটাইয়া ফেলিলেন। অভিষেকে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হইল না, কিন্তু শিবাজী বিবাহে (৩০এ মে) ঐ মন্ত্র ব্যবহার করিলেন।

 এই ব্রাত্য-প্রায়শ্চিত্ত ও উপবীত-ধারণে মহাসমারোেহ ও অগাধ টাকা দান করা হইল; গাগা ভট্ট “মুখ্য অর্দ্ধম্যু” বলিয়া ৩৫ হাজার টাকা পাইলেন; অপর ব্রাহ্মণ-সাধারণের মধ্যে ৮৫ হাজার টাকা বিতরিত হইল।

 পরদিন শিবাজী জ্ঞাত ও অজ্ঞাত স্বকৃত পাপ মোচনের জন্য তুলা করিলেন, অর্থাৎ সোনা-রূপা-তামা প্রভৃতি সপ্ত ধাতু, সূক্ষ্ম বস্ত্র,কর্পূর, লবণ, মশলা, ঘৃত, চিনি, ফল ও খাদ্য প্রভৃতি নানা জিনিস তাঁহার দেহের সমান (দুই মণের কিছু কম) ওজন করিয়া লইয়া, ঐ সমস্ত দ্রব্য এবং নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করা হইল। ইহা ভিন্ন তাঁহার দেশলুণ্ঠনে যে গোব্রাহ্মণ স্ত্রীলোক ও শিশু মারা পড়িয়াছিল সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ শিবাজী আট হাজার টাকা ব্রাহ্মণদের দান করিলেন।

 অভিষেকের আগের দিন শিবাজী সংযম করিয়া রহিলেন। গঙ্গাজলে স্নান করিয়া গাগা ভট্টকে ২৫ হাজার এবং অন্যান্য বড় বড় ব্রাহ্মণদের প্রত্যেককে পাঁচ শত করিয়া টাকা দিলেন।

শিবাজীর অভিষেক-স্নান

 জ্যৈষ্ঠ মাস শুক্ল ত্রয়োদশী (৬ই জুন, ১৬৭৪) অভিষেকের শুভদিন। অতি প্রত্যুষে উঠিয়া শিবাজী প্রথমে মঙ্গলয়ান এবং কুলদেবদেবী—মহাদেব ও ভবানীর—পূজা, কুলগুরু বাল্‌ম ভট্ট, পুরোহিত গাগা ভট্ট এবং অন্যান্য বড় বড় পণ্ডিত ও সাধুগণকে বন্দনা এবং বস্ত্রালঙ্কার দান শেষ করিয়া ফেলিলেন।

 তাহার পর শুদ্ধ শ্বেতবস্ত্র পরিয়া, মালা চন্দন স্বর্ণালঙ্কার ধারণ করিয়া অভিষেক-স্নানের জন্য নির্দ্দিষ্ট স্থানে গেলেন। সেখানে দুই ফুট লম্বা চওড়া ও উঁচু এক সোনার চৌকীতে বসিলেন। তাহার পাশে বসিলেন রাণী সোইরা বাঈ, সহধর্ম্মিণী বলিয়া রাণীর আঁচল শিবাজীর আঁচলে গির বাঁধিয়া দেওয়া হইল। কিছু পশ্চাতে যুবরাজ শম্ভুজী বসিলেন। আট কোণে আটটি সুবর্ণ কলস এবং আটটি ছোট ভাঁড় ভরিয়া গঙ্গা প্রভৃতি সপ্ত মহানদী ও অন্যান্য বিখ্যাত নদ-নদী-সমুদ্র এবং তীর্থস্থলের জল আনিয়া রাখা হইয়াছিল। প্রত্যেক কলসের কাছে অষ্টপ্রধানের এক একজন দাড়াইয়া। তাঁহারা ঠিক মুহুর্তে ঐ জল শিবাজী, রাণী ও রাজপুত্রের মাথায় ঢালিয়া দিলেন; আর শ্লোক-পাঠ ও মঙ্গলবাদে আকাশ কাঁপিয়া উঠিল। ষোলজন সধবা ব্রাহ্মণী সুশোভন বস্ত্র পরিয়া সোনার থালায় পঞ্চ-প্রদীপ লইয়া তাঁহার মাথার চারিদিকে ঘুরাইয়া মঙ্গল আরতি করিলেন।

 তাহার পর ভিজা কাপড় ছাড়িয়া, রাজার যোগ্য জরির কাজ করা লাল বস্ত্র এবং মণিমুক্তাহীরা বসান নানাপ্রকার উজ্জ্বল অলঙ্কার পরিয়া, গলায় ফুলের মালা ও মাথায় মুক্তার অসংখ্য ঝালরে সজিত পাগড়ী দিয়া, শিবাজী নিজ ঢাল তলোয়ার তীর ও ধনুকের “অস্ত্রপূজন” করিলেন, এবং এই উপলক্ষে আবার ব্রাহ্মণদের চরণ বন্দনা (তথা দক্ষিণা দান) করিলেন।

সিংহাসন-গৃহের সজ্জা

 অবশেষে তিনি সিংহাসন-গৃহে ঢুকিলেন। এই ঘরের সজ্জায় অগাধ ধনরত্ন ঢালিয়া দেওয়া হইয়াছিল। ছাদের নীচে জরির শামিয়ানা খাটান, তাহা হইতে লহরে লহরে মুক্তার মালা ঝুলিতেছিল। মেঝেতে মখমল বিছান: মধ্যস্থলে বহু পরিশ্রমে প্রস্তুত অশেষ কারুকার্যে শোভিত, “অমূল্য নবরত্নে খচিত” এক প্রকাণ্ড সোনার সিংহাসন। সিংহাসনের তলদেশ সোনার চাদর দিয়া মোড়া; আট কোণে আটটি স্তম্ভ, মণিবসান সোনার পাতে জড়ান। আর এই আটটি থামের মাথায় চমকে জরির চাঁদোয়া বাঁধা, তাহার স্থানে স্থানে মুক্তার গুচ্ছ হীরক পদ্মরাগ প্রভৃতি ঝুলিতেছে। রাজার বসিবার গদী ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর মখমল দিয়া ঢাকা। গদীর পশ্চাতে রাজছত্র।


 সিংহাসনের দুই পাশে নানা প্রকার রাজচিহ্ন সোনার জল করা বল্লম হইতে ঝুলিতেছিল,—যেমন, ডানদিকে দুইটি প্রকাণ্ড মাছের মাথা (মুঘলদিগের মাহী মুরাতিব), বামে ঘোড়ার লেজের চামর (তুর্কীজাতীয় রাজচিহ্ন) এবং ওজনের মানদণ্ড (ইহা ন্যায়বিচারের চিহ্ন, প্রাচীন পারস্য-রাজ্য হইতে লওয়া)। রাজদ্বারের বাহিরে দুইদিকে পাতায় মুখ ঢাকা জলের ঘট সাজান, এবং তাহার পর দুটি হস্তিশাবক ও দুটি সুন্দর ঘোড়া; তাহাদের সাজ ও লাগাম সোনা ও মণি দিয়া কাজ করা।

শিবাজীর সিংহাসনে অধিবেশন ও ছত্রধাবণ

 নির্দিষ্ট মুহূর্তে শিবাজী পূজ্যগণকে নমস্কার করিয়া সিংহাসনের সিঁড়ি বাহিয়া উঠিয়া গদীতে বসিলেন। অমনি মুঠা মুঠা রত্নখচিত সোনার পদ্ম ও অন্যান্য সোনা-রূপার ফুল সভাসদগণের মধ্যে ছড়াইয়া দেওয়া হইল। আবার ষোলজন সধবা ব্রাহ্মণী সু-বাস পরিয়া সোনার পঞ্চপ্রদীপ তাঁহার চারিদিকে ঘুরাইয়া অমঙ্গল দূর করিলেন। সমবেত ব্রাহ্মণগণ উচ্চৈঃস্বরে শ্লোক আওড়াইয়া রাজাকে আশীর্বাদ করিলেন, শিবাজী নতশিরে তাহার প্রত্যুত্তর দিলেন। জনসাধারণ আকাশ ফাটাইয়া চেঁচাইতে লাগিল—“জয়, শিবরাজের জয়। শিব ছত্রপতির জয়!” একসঙ্গে সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়া উঠিল; আর, বাহিরে মহারাষ্ট্র দেশের সব দুর্গ হইতে ঠিক সেই মুহুর্তে তোপের আওয়াজ করা হইল। দেশ জানিল যে নিজের রাজা পাইয়াছে।


 প্রথমে অধ্বর্য্যু গাগা ভট্ট, তাহার পর অষ্টপ্রধান ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ অগ্রসর হইয়া রাজাকে আশীর্বাদ করিলেন। শিবাজীর মাথার উপর রাজছত্র ধরা হইল। তিনি সকলকে গণনাতীত ধন দিলেন। “দানপদ্ধতিঅনুযায়ী ঘোড়শ মহাদান ইত্যাদি দানগুলি সম্পন্ন করিলেন।” সিংহাসনের আট কোণে অষ্টপ্রধান অর্থাৎ মন্ত্রিগণ দাঁড়াইয়া ছিলেন; তাদের পদের পারসিক ভাষার নাম বদলাইয়া সংস্কৃত নাম দেওয়া হইল,—যেমন পেশোয়ার বদলে “মুখ্যপ্রধান”। শিবাজীর উপাধি হইল—“ছত্রপতি”। সেইদিন হইতে “রাজ্যাভিষেক শক” নামে এক নূতন বৎসর গণনা শুরু করা হইল; ইহাই পরে সমস্ত মারাঠা সরকারী কাগজ পত্রে ব্যবহৃত হইত।

 সিংহাসন অপেক্ষা কিছু নীচু তিনটি আসনে যুবরাজ শম্ভঙ্গী, গাগা ভট্ট ও পেশোয়া মোবেশ্বর ত্র‍্যম্বক পিঙ্গলে বসিনে। বাকী মন্ত্রীরা দুই লাইন করিয়া সিংহাসনের দুই পাশে দাঁড়াইয়া রহিলেন; তাহাদের পশ্চাতে কায়স্থ “লেখক” নীল প্রভু (পারসনিস) এবং বাবা অবজী। (চিটনিস) স্থান পাইলেন। অন্যান্য দরবারীরা যথাক্রমে আরও দূরে দাঁড়াইল।

 এই সব কাজে বেলা আটটা হইয়া গেল। তখন ইংরাজ-দুত হেনরি স্মকসিগুেনকে নিয়াজী রাবজী (শিবাজার ন্যায়াধীশ) সিংহাসনের সামনে লইয়া গেলেন। দূত মাথা নত করিলেন, আর তাহার দোভাষী নারায়ণ শেনবী ইংরাজ কোম্পানীর উপহার একটি হীরার আংটি উচু করিয়া ধরিয়া শিবাজীকে দেখাইলেন। রাজা তাহাদের আরও কাছে ডাকিয়া খেলাৎ পরাইয়া বিদায় দিলেন।

রায়গড়ে শোভাযাত্রা

 সর্বশেষে হাতীতে চড়িয়া শিবাজী সদলবলে রায়গড়ের রাস্তা বাহিয়া শোভাযাত্রা করিয়া চলিলেন। আগে দুই হাতীর উপর দুই রাজ পতাকা-“জরী পতাকা” (জরির) এবং “ভাগবে ঝাণ্ডা” (অর্থাৎ রামদাস সন্ন্যাসীর গেরুয়া বস্ত্রের খণ্ড)। শহরবাসীরা নিজ নিজ বাড়ী ও রাস্তা নানারূপে সাজাইয়া রাখিয়াছিল; সর্বত্রই ঘরে ঘরে সধবারা প্রদীপ ঘুরাইয়া রাজার আরতি করিল, তাঁহার মাথার উপর খই ও ফুল ও দুর্বা ছিটাইতে লাগিল। তাহার পর রায়গড় পাহাড়ের সব মন্দিরে গিয়া প্রত্যেক স্থানে পূজা দিয়া দান-ধ্যান করিয়া, শিবাজী অবশেষে বাড়ী ফিরিলেন। তখন বেলা দুপুর।

অভিষেকের ব্যয়

 পরদিন ব্রাহ্মণদের দক্ষিণাদান এবং কাঙ্গালী-বিদায় আরম্ভ হইল। ইহা শেষ হইতে বারো দিন লাগিল, এবং সে পর্যন্ত সকলেই রাজার সিধা পাইতে থাকিল। সাধারণ ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা তিন হইতে পাঁচ টাকা, ব্রাহ্মণী ও শিশুদের দুই এক টাকা বরাদ্দ ছিল। এই দানে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা ব্যয় হইল।

 অভিষেকের দুই দিন পরে বর্ষা নামিল, আর দশ-এগার দিন ধরিয়া সেই বৃষ্টি মুষলধারে চলিল। আগন্তুকেরা বিদায় লইয়া পলাইবার পথ পায় না। ১৮ই জুন বৃদ্ধা জীজা বাঈ পূর্ণ সুখ-সম্পদের মধ্যে জীবন শেষ করিলেন। তাঁহার ২৫ লক্ষ হোণের সম্পত্তি শিবাজী পাইলেন। এই অশৌচ শেষ হইলে শিবাজী দ্বিতীয়বার সিংহাসনে বসিলেন।

 কৃষ্ণাজী অনন্ত সভাসদ বাড়াইয়া বলিয়াছেন যে অভিষেকের ব্যয় সাত কোটি দশ লক্ষ টাকা হইয়াছিল। কিন্তু সর্ব্বসমেত পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ধরিলে বোধ হয় সত্য হয়।[২]

আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল

 অভিষেকের ধূমধামে শিবাজীর রাজভাণ্ডার প্রায় খালি হইয়া গিয়াছিল। তাই তাঁহাকে আবার লুঠ করিতে বাহির হইতে হইল। ইহার ঠিক এক মাস পবেই, অর্থাৎ জুলাই-এর মাঝামাঝি, একদল মারাঠা অশ্বারোহী দূরে একটি স্থান আক্রমণ করিবে এরূপ ভাব দেখানতে, মুঘল সুবাদার বাহাদুর খাঁ পেড়গাঁও-এ নিজ শিবির রাখিয়া সৈন্যসহ পঞ্চাশ মাইল দূরে উহাদের বাধা দিতে গেলেন। আর সেই অবসরে অপর একদল সাত হাজার মারাঠা-সৈন্য অন্যপথ দিয়া দ্রুত আসিয়া হঠাৎ আক্রমণ করিয়া, পেড়গাঁও-এর অরক্ষিত মুঘল-শিবির অবাধে লুঠ করিয়া এক কোটি টাকা এবং দুই শত ভাল ভাল বাদশাহী ঘোডা লইয়া শিবিরে আগুন ধরাইয়া দিয়া চম্পট দিল। শীতকাল আসিলে মারাঠারা কয়েক মাস ধরিয়া কোলী-দেশ, অরঙ্গাবাদ, বগলানা ও খাদেশ লুঠ করিয়া বেড়াইল; জানুয়ারি ১৬৭৫-এর শেষে কোলাপুর হইতে সাডে সাত হাজার টাকা আদায় করিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি মুঘলেরা কল্যাণ শহর পুড়াইয়া দিয়া চলিয়া গেল।

মুঘল, বিজাপুর ও শিবাজী

 ১৬৭৫ সালের মার্চ হইতে মে—এই কয়মাস ধরিয়া শিবাজী আবার মুঘল বাদশাহর বশ্যতা স্বীকার করিতে ইচ্ছুক এইরূপ ভাণ করিয়া সন্ধির আলোচনায় সুবাদার বাহাদুর খাকে ভুলাইয়া রাখিলেন, এবং সেই অবসরে কোলাপুর (মার্চ, এবং বিখ্যাত ফোণ্ডা দুর্গ (জুলাই মাসে) অধিকার করিলেন। তাহার পর কার্য্য সিদ্ধি হওয়ায় বাহাদুর খাঁর দুতকে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিলেন।

রাগে লজ্জায় বাহাদুর খাঁ শিবাজীকে জব্দ করিবার জন্য বিজাপুরের উজীর খাওয়াস খাঁর সহিত জোট করিলেন। কিন্তু ১১ই নভেম্বর বিজাপুরের আফঘান-দল খাওয়াস খাঁকে বন্দী করিয়া রাজ্যের কর্তৃত্ব কাড়িয়া লইল; বাহাদুরের ইচ্ছা বিফল হইল।

 ১৬৭৬ সালের প্রথমেই শিবাজী বিশেষ অসুস্থ হইয়া পড়েন। সাতারায় তিন মাস চিকিৎসার পর, মার্চের শেষে তিনি আরোগ্যলাভ করেন। এদিকে খাওয়াসের পতনের পর হইতেই বিজাপুরে আফঘান ও দক্ষিণী ওমরাদের মধ্যে ভীষণ গৃহ-বিবাদ বাধিল। বাহাদুর খাঁ নূতন উজীর আফঘান-নেতা বহলোল খাঁকে আক্রমণ করিবার জন্য রওনা হইলেন (৩১ মে ১৬৭৬)। অমনি বহলোল শিবাজীর সহিত সন্ধি করিলেন; তাহার শর্ত হইল যে, বিজাপুর-সরকার শিবাজীকে নগদ তিন লক্ষ টাকা এবং প্রতি বৎসর এক লক্ষ হোণ (অর্থাৎ পাঁচ লক্ষ টাকা) কর দিবে এবং তাহার জয় করা প্রদেশগুলিতে তাহার অধিকার মানিয়া লইবে; আর মুঘলেরা আক্রমণ করিলে শিবাজী নিজ সৈন্য দিয়া আদিলশাহী রাজ্য রক্ষা করিবেন। কিন্তু বিজাপুরে ঘরোয়া বিবাদ ও নিত্য পরিবর্ত্তনের মধ্যে এ সন্ধি বেশী দিন টিকিল না। তাহাতে শিবাজীর কোনই ক্ষতি হইল না। তিনি অন্যত্র এক বহু ধনশালী দেশ জয় করিতে চলিলেন; তাহার নাম পূর্ব্ব-কর্ণাটক, অর্থাৎ মাদ্রাজ অঞ্চল।

  1. মহাদেব্যা গোতমী বালশ্রী মাতুঃ রাজরাজস্য শ্রীশাতকর্ণেঃ গোতমীপুত্রস্ব-অবিপন্ন মাতৃশুশ্রূষাকবস্য-পৌবজন নির্বিশেষ সমসুখদুঃখস্য-শকযবন-পল্‌হব-নিসূদনস্য-দ্বিজাবর-কুটুম্ব-বিবর্দ্ধনস্য-খখবাত বংশ-নিরবশেষকাবস্য-বিনিবর্ত্তিত-চাতুর্বর্ণ সংকরস্য-অনেক সমরাবজীত শত্রু-সংঘন্য-সৎপুরুষাণাম্ আশরস্য-শ্রিয়া অধিষ্ঠানস্য—দক্ষিণাপথেশ্বরস্য•••••[Epigraphia India, iii, 60. নাসিক-গুহার শিলালিপির সংস্কৃত অনুবাদ}
  2. সভাসদ বলেন, সিংহাসনে ৩২ মণ শোনা (দাম ১৪ লক্ষ টাকা)এবং যাহা যাহা হীয়া ও মণিমুক্তা লাগিয়াছিল। প্রধানেরা প্রত্যেকে এক লক্ষ হোণ (অর্থাৎ পাঁচ লক্ষ টাকা) নগদ এবং হাতী ঘোড় বস্ত্র অলঙ্কার বখশীষ পাইয়াছিলেন। গাগা ভট্টকে “অপরিমিত দ্রব্য” দেওয়া হইল, ইত্যাদি।