ন ব ম অ ধ্যা য়


দক্ষিণ-বিজয়

পূর্ব্ব-কর্ণাটকের রাজ্যগুলি এবং ঐশ্বর্য্য

এক সময়ে বিখ্যাত বিজয়নগর-সাম্রাজ্য কৃষ্ণা নদীর পরপারে সারা দাক্ষিণাত্য জুড়িয়া পূৰ্ব সমুদ্র হইতে পশ্চিম সাগর,—অর্থাৎ মাদ্রাজ হইতে গোয়া-পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ১৫৬৫ খৃষ্টাব্দে দক্ষিণের মুসলমান সুলতানেরা একজোট হইয়া বিজয়নগরের সম্রাটকে যুদ্ধে নিহত করিয়া তাঁহার রাজধানী লুঠ করিলেন। তাঁহার উত্তরাধিকারিগণ রাজধানী একস্থান হইতে অপর স্থানে সরাইতে লাগিল, কিন্তু ঐ যুদ্ধের পর হইতে সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরিল; কতক প্রদেশ মুসলমানেরা কাড়িয়া লইল, আর কতক প্রদেশ স্বাধীন হইল। বিজয়নগরের শেষ সম্রাট (শ্রীরঙ্গ রায়ল) সর্ব্বস্ব হারাইয়া তাঁহার সামন্ত শ্রীরঙ্গপটনের রাজার দ্বারে আশ্রয় মাগিলেন (১৬৫৬)।

 ইতিমধ্যে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানেরা বিজয়নগরের করদরাজাদিগের হাত হইতে বর্ত্তমান মহীশুর দেশ ও মাদ্রাজ উপকুলের প্রায় সমস্তটাই কাড়িয়া লইলেন। পূর্বের একচ্ছত্র সম্রাটের বল ও আশ্রয়, হারাইয়া, নিজ নিজ ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে পূর্ণ কর্তৃত্বের অভিমানে অন্ধ স্বার্থপর প্রাদেশিক হিন্দুরাজারা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে পারিল না। প্রত্যেকে পৃথক পৃথক লড়িয়া সহজেই মুসলমানের কাছে রাজ্য হারাইল অথবা বশ মানিল। এইরূপে ১৬৩৭ হইতে ১৬৫৬ সালের মধ্যে কুতুব শাহ গোলকুণ্ডার দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হইয়া কাড়াপা এবং উত্তর-আর্কট জেলা (পালার নদীর উত্তরের অংশ) এবং মাদ্রাজের সমুদ্রকুল অঞ্চলে শিকাকোল হইতে সাদ্রাজ বন্দর (মাদ্রাজের প্রায় ৫০ মাইল দক্ষিণ) পর্যন্ত দখল করিলেন। ইহার নাম হইল “হায়দারবাদী কর্ণাটক”। ঠিক ইহার দক্ষিণে,—পালার হইতে কাবেরী নদী পর্যন্ত সমভূমি এবং প্রায় সমস্ত মহীশ্বর জুড়িয়া আদিল শাহ রাজ্য বিস্তার করিলেন। তাহার নাম হইল “বিজাপুরী কর্ণাটক”।

 অর্থ শস্য ও লোকসংখ্যায় এই কর্ণাটক দেশ ভারতে প্রায় অতুলনীয় ছিল। জমি অত্যন্ত উর্ব্বরা; স্থানীয় লোকেরা খুব পরিশ্রমী ও শিল্পকার্যে দক্ষ; অনেক মণিমাণিক্যের খনি ও হাতীতে পূর্ণ বন-জঙ্গল হইতে রাজার অগাধ লাভ হইত। এই সব কারণে দেশের আয় দ্রুত বাড়িয়া চলিয়াছিল। এই আয়ের অতি কম অংশই খরচ হইত, কারণ প্রজারা খুব মিতব্যয়ী, কোন প্রকার বিলাসিতা জানিত না; পান্তাভাত ও তেঁতুলের জল, নুন লঙ্কা মিশাইয়া খাইয়া এবং লেংটি পরিয়া বারো মাস কাটাইত। এইরূপে বৎসর বৎসর কর্ণাটকে অগাধ ধন উদ্ধৃত্ত থাকিত; তাহার কতক অংশ বড় বড় মন্দির নির্মাণে ব্যয় হইত; বাকী টাকা মাটির তলে পোঁতা থাকিত। এইজন্য সোনার দেশ বলিয়া যুগে যুগে কর্ণাটক প্রদেশের খ্যাতি ছিল। যুগে যুগে বিদেশী রাজা ও সেনাসামন্তরা এই দেশের অগাধ ধনরত্ন লুঠিয়া লইয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। এবার শিবাজীর দৃষ্টি কর্ণাটকের উপর পড়িল।

কর্ণাটকে বিজাপুরী জাগীরদারদের কলহ ও রাজনীতি

 এই সময়ে (অর্থাৎ ১৬৭৬ সালে) বর্তমান মহীশূর রাজ্যের প্রায় সমস্তটাই বিজাপুরের অধীনে অনেকগুলি খণ্ডে বিভক্ত ছিল; তাহার কতকগুলি ওমরাদের জাগীর, আর কতকগুলি করদ-হিন্দুরাজাদের রাজ্য। ইহাকে “কর্ণাটক বালাঘাট” (অর্থাৎ উঁচু জমি) বলা হইত। আর মহীশূরের পূর্ব্বদিকে বঙ্গ উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত যে সমভূমি, অর্থাৎ মাদ্রাজের আর্কট প্রভৃতি জেলাগুলি, তাহার নাম ছিল “কর্ণাটক পাইনঘাট” (অর্থাৎ নীচু দেশ)। মহীশূরের পাহাড় বাহিয়া এই সমভূমিতে নামিলে উত্তর হইতে দক্ষিণ মুখে যাইবার পথে ক্রমে ক্রমে তিনটি বিজাপুরী ওমরাদের জাগীর পড়ে;—প্রথমে বিখ্যাত জিঞ্জি-দুর্গের অধীনস্থ প্রদেশ।(ইহার শাসনকর্তা নাসির মহম্মদ খাঁ, মৃত উজীর খাওয়াস খাঁর কনিষ্ঠ ভাতা); তাহার পর বলি-কণ্ড-পুরম (যেখানে বানর-রাজ বালি রামচন্দ্রের দর্শনলাভ করেন; ইহার শাসনকর্তা শের খাঁ লোদী, আফঘান উজীর বহলোলের জাতভাই); এবং শেষে কাবেরী পার হইয়া তাঞ্জোর (শিবাজীর বৈমাত্রেয় ভাই ব্যঙ্কাজী, ওরফে একোজী, ১৬৭৫ সালে ইহা দখল করেন)। আরও দক্ষিণে স্বাধীন মাদুরা-রাজ্য। ইহা ভিন্ন বেলুন, আরণি প্রভৃতি বিখ্যাত দুর্গগুলি ভিন্ন ভিন্ন কর্মচারীর হাতে ছিল।

 এই-সব বিজাপুরী ওমরাদের মধ্যে স্বার্থ লইয়া সর্বদাই যুদ্ধ ও রাজ্য কাড়াকাড়ি চলিতেছিল; কেহই উপরিতন সুলতানকে মানিয়া চলিত না, কারণ সুলতান তখন নাবালক এবং উজীরের হাতে পুতুল মাত্র। হিন্দু করদ-রাজারাও তেমনি স্বার্থপর ও একতাহীন। শের খাঁ ফন্দি করিলেন যে তাহার মিত্র—ফরাসী কোম্পানীর পণ্ডিচেরীর কুঠি হইতে গোরা এবং সাহেবদেব হাতে শিক্ষিত দেশী সিপাহী লইয়া তিনি জিঞ্জি অধিকার করিবেন; তাহার পর ক্রমে রাজ্য ও বল বৃদ্ধি করিয়া মাদুরা ও তাঞ্জোরের অগাধ ধনদৌলত লুঠিবেন, এবং শেষে সেই অর্থের জোরে সৈন্যসংখ্যা বাড়াইয়া গোলকুণ্ডা-রাজ্য জয় করিবেন

শিবাজীর কর্ণাটক-অভিযানের পূর্বে অন্য রাজ্যের সহিত সন্ধি

 শের খাঁ ১৬৭৬ সালে জিঞ্জি প্রদেশ আক্রমণ কবিয়া তাহার অনেক অংশ কাড়িয়া লইলেন। জিঞ্জিব অধিকারী নাসির মহম্মদ নিরুপায় হইয়া গোলকুণ্ডার সাহায্য চাহিলেন। এই সময় কুতুব শাহর মন্ত্রী মাদন্না নামক ব্রাহ্মণই ছিলেন সর্বেসর্বা, তাঁহাদের বংশ পরম বৈষ্ণব ও ভক্ত হিন্দু। মাদন্নার প্রাণের বাসনা ছিল মুসলমানের (অর্থাৎ বিজাপুবের) হাত হইতে কর্ণাটক উদ্ধার করিয়া, ১৬৪৮ সালের পূর্বের মত আবার হিন্দুর শাসনে রাখিবেন। শিবাজীর মত ভুবনবিজয়ী বীব ও ভক্ত হিন্দু ছাড়া আর কাহার দ্বারা এই মহাকাব্য সফল হওয়া সম্ভব নহে। সুলতান প্রিয়মন্ত্রীর পরামর্শে বাজি হইলেন। এই শর্তে সন্ধি হইল যে শিবাজী মারাঠা-সৈন্যের সাহায্যে বিজাপুরী কর্ণাটক জয় করিয়া কুতুব শাহকে দিনে, আর নিজে তথাকার রাজকোষে মজুত ও লুঠের টাকা এবং মহীশূরের কতক মহল লইবেন এই অভিযানের সমস্ত ব্যয় কুতুব শাহব, এ ছাড়া কামান ও গোলক এবং পাঁচ হাজার সৈন্য দিয়া তিনি শিবাজীকে সাহায্য করিবেন। শিবাজীর চতুর দূত প্রহ্লাদ নিরাজ মাদন্নার সহিত আলোচনা করিয়া এই বন্দোবস্ত পাকা করিলেন।

 শিবাজী দেখিলেন, কর্ণাটক জয় করা যেরূপ কঠিন কাজ তাহাতে নিজে বাহির না হইলে শুধু সেনাপতি পাঠাইয়া কোনই ফল হইবে না, আর ইহাতে অন্ততঃ এক বৎসর সময় লাগবে। অথচ এই দীর্ঘকাল স্বদেশ ছাড়িয়া সুদূর কর্ণাটকে থাকিল, শত্রুরা সেই সুযোগে তাহার রাজ্যে মহা অনিষ্ট ঘটাইতে পারে এই কারণে শিবাজী মুঘলসরকাবের সহিত ভাব করবার জন্য ব্যগ্র হইলেন। ১৬৭৬ সালের শেষভাগে মুঘল ও বিজাপুরের যেরূপ অবস্থা তাহাতে শিবাজীর খুব সুবিধা হইল। বিজাপুরের নূতন উজীর বংশোল খাঁর আফঘান-দল এবং তাঁহার শত্রু দক্ষিণী ও হাবশী ওমরাদের মধ্যে খুনোখুনী বিবাদ বাধিয়া গিয়াছিল। মুঘল-সুবাদার বাহাদুর খাঁ বহলোলর উপর চটা ছিলেন; তিনি এই সুযোগে দক্ষিণীদের পক্ষ লইয়া বিজাপুব আক্রমণ করিলেন (৩১ মে, ১৬৭৬) এবং এই যুদ্ধে এক বৎসরের অধিক কাল ব্যাপৃত রহিলেন। সে সময়ে কেহই শিবাজীর দিকে তাকাইবার অবসব পাইল না।

 বাহাদুর খাঁ দেখিলেন, বিজাপুর-আক্রমণের পূর্ব্বে শিবাজীকে হাত করিতে না পারিলে, তাঁহার নিজের শাসনাধীন প্রদেশ অরক্ষিত অবস্থায় থাকিবে। আর, শিবাজীও দেখলেন যে যখন তিনি কর্ণাটক লইয়া জড়াইয়া পড়িবেন তখন মুঘল-সুবাদার শত্রুতা করলে মহারাষ্ট্র দেশের খুবই অনিষ্ট হইবে। অতএব “তুমি আমাকে জ্বালাইও না, আমি ‘ছুঁ-ইব না” এই শর্ত্তে দুই পক্ষ বন্ধুত্ব করিলেন। শিবাজীর দূত নিরাজী বাবজী পণ্ডিত গোপনে বাহাদুর খাঁকে অনেক টাকা ঘুষ এবং প্রকাশ্যে বাদশাহের জন্য কিছু টাকা কর বা উপহার দিয়া সন্ধির লেখাপড়া শেষ করিলেন।

হনুমন্তে বংশের সাহায্য

 ভাগ্য চিরদিনই উদ্যোগী পুরুষসিংহেব উপর প্রসন্ন। শিবাজীর কর্ণাটক জয়ের পক্ষে এক মহা সহায় জটিল। রঘুনাথ নারায়ণ হনুমন্তে নামক একজন সুদক্ষ অভিজ্ঞ এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ব্রাহ্মণ শাহজীর সময় হইতে ব্যঙ্কাজীর অভিভাবক এবং উজীর হইয়া কর্ণাটক-রাজ্য শাসন করিয়া আসিতেছিলেন। ফলতঃ রঘুনাথ ও তাঁহার ভ্রাতা জনার্দ্দনকে লোকে ঐ দেশের রাজার মতই জ্ঞান করিত। ব্যঙ্কাজী বড় হইয়া নিজহাতে শাসনভার লইলেন এবং রঘুনাথের নিকট হইতে রাজস্বের হিসাব তলব করিলেন। রঘুনাথ এত বৎসরে প্রভুর অগাধ টাকা আত্মসাৎ করিয়াছিলেন; ঈর্ষাবশে অন্যান্য মন্ত্রীরা সে কথা প্রকাশ করিয়া দিল। এতদিন একাধিপত্য করিবার পর, হিসাব দিতে বা হুকুমে চলিতে রঘুনাথ অপমান বোধ করিলেন। তিনি উজীরীতে ইস্তফা দিয়া কাশী যাত্রা করিবার ভাণে তাঞ্জোর হইতে সপরিবারে চলিয়া আসিলেন। এই সংবাদ পাইয়া শিবাজী তাহাকে অতি সমাদরে আহ্বান করিলেন এবং নিজ রাজ্যে চাকরি দিলেন। রঘুনাথ তাহাকে কর্ণাটকের জায়গা জমি ও কর্মচারীদের নাড়ীনক্ষত্র সব বলিয়া দিলেন, এবং নিজ বংশের এতদিনকার প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি দিয়া শিবাজীর কর্ণাটক-আক্রমণে বিশেষ সাহায্য করিতে লাগিলেন।

 পেশোয়াকে নিজ প্রতিনিধি করিয়া বসাইয়া, কোঁকন-প্রদেশের শাসনভার অন্নাজী দত্ত (সুরণীস)-কে দিয়া, এবং উভয়ের অধীনে এক একটি বড় সৈন্যদল রাখিয়া,—১৬৭৭ সালের জানুয়ারি প্রথমে শিবাজী রায়গড় হইতে রওনা হইলেন।

 ইতিমধ্যে তাঁহার দুত প্রহলাদ নিরাজী গোলকুণ্ডা-রাজ কুতুব শাহকে শিবাজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে রাজি করাইয়াছিলেন। প্রথমে সুলতানের ভয় হইয়াছিল পাছে আফজল বা শায়েস্তা খাঁর মত তাহার দশা ঘটে। কিন্তু প্রহলাদ নানাপ্রকার ধর্মশপথ করিয়া তাহাকে বুঝাইলেন যে শিবাজী কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করিবেন না। আর মাদন্নাও সেই মত সমর্থন কবিলেন এবং রাজাকে দেখাইয়া দিলেন যে শিবাজীকে কাছে আনিয়া বন্ধুত্ব পাকা করিতে পারিলে ভবিষ্যতে মুঘলআক্রমণ হইতে গোলকুণ্ডা রক্ষা করার নিশ্চিন্ত উপায় হইবে।

শিবাজীর গোলকোণ্ডা-বাজ্যে প্রবেশ

 নিজ চোখে চোখে সৈন্যদের শৃঙ্খলার সহিত চালাইয়া, প্রত্যহ নিয়মিত কুচ করিয়া শিবাজী এক মাসে হায়দাবাদ শহরে আসিয়া পৌঁছিলেন (ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ)। তিনি কড়া হুকুম জারি করিয়াছিলেন যেন তাহার সৈন্য বা চাকর বাকরের কেহ পথে কোন গ্রামবাসীর জিনিসে হাত না দেয় বা স্ত্রীলোকের মানহানি না করে। প্রথমে দু-চারজন মারাঠা এই নিয়ম ভঙ্গ করিয়াছিল বটে, কিন্তু অপরাধীদের ফাঁসী অথবা হাত-পা কাটিয়া সাজা দেওয়ায় এমন ভয়ের সঞ্চার হইল যে এই পঞ্চাশ হাজার সশস্ত্র লোক এক মাস ধরিয়া অতি শান্ত ও সাধুভাবে বিদেশ পার হইয়া চলিল, কাহারও একগাছি তৃণ বা এক দানা শস্তে হাত দিল না। ইহাতে চারিদিকে শিবাজীর সুনাম ছড়াইয়া পড়িল।

 কুতুব শাহ প্রস্তাব করেন যে তিনি রাজধানী হইতে কয়েক ক্রোশ পথ অগ্রসর হইয়া শিবাজীকে অভ্যর্থনা করিবেন। কিন্তু শিবাজী নম্র ভাবে তাহাকে নিষেধ করিয়া পাঠাইলেন; বলিলেন, “আপনি আমার জ্যেষ্ঠ, এতটা পথ আগুয়ান হইয়া কনিষ্ঠকে সম্মান করা গুরুজনের পক্ষে অনুচিত।” সুতরাং শুধু মাদন্না, তাহার ভ্রাতা আকন্না এবং হায়দাবাদের বড় বড় লোকেরা শহর হইতে পাঁচ-ছয় ক্রোশ বাহিরে আসিয়া শিবাজীকে অভ্যর্থনা করিয়া রাজধানীতে আনিলেন।

হায়দারবাদ নগরে শিবাজীর অভ্যর্থনা

 শিবাজীর অভ্যর্থনার জন্য রাজধানী হায়দারবাদ আজ অতি সুন্দর বেশ ধারণ করিয়াছে। রাস্তা ও গলিগুলি কুঙ্কুম ও জাফরানে লালে লাল। স্থানে স্থানে ফুল পাতা ও নিশানে সজ্জিত খিলান ও ধ্বজদণ্ড তৈয়ারি করা হইয়াছে। লক্ষ লক্ষ নাগরিকেরা ভাল ভাল পোষাক পরিয়া পথের ধারে দাড়াইয়া, আর বারান্দাগুলি সাজগোছ করা মহিলায় ভরা।

 শিবাজীও তাহার সৈন্যগণকে এই দিনের জন্য চমৎকার বেশভূষা পরাইয়াছিলেন। জমকাল পোষাক ও অস্ত্রে তাঁহার সেনানীগণকে ধনী ওমরাদের মত দেখাইতেছিল। বাছা বাছা সিপাহীর পাগড়ীতে মোতির ঝালর ('তোড়া’), হাতে সোনার কড়া, গায়ে উজ্জ্বল বর্ম্ম ও জরির পোষাক।

 দুই রাজার মিলনের জন্য নির্দিষ্ট শুভদিনে সেই পঞ্চাশ হাজার মারাঠা-সৈন্য হায়দারবাদে ঢুকিল। তাহাদের বীরত্বের কাহিনী এতদিন দাক্ষিণাত্যে লোকমুখে প্রচাবিত, কত গাথায় (ব্যালাডে) গীত হইয়া আসিতেছিল। আজ লোকে অবাক হইয়া সেই-সব বিখ্যাত বীর নেতা ও সিপাহীদের দিকে তাকাইতে লাগিল; এতদিন তাহাদের নাম শুনিয়া আসিতেছিল, আজ তাহাদের চেহারা দেখিল।

 সকলের চোখে পড়িল সেনাপতি মন্ত্রী ও রক্ষীদের মধ্যস্থলে বীরশ্রেষ্ঠ শিবাজীর প্রতি। তাঁহার শরীর মাঝারি রকমের লম্বা এবং পাতলা। গত বৎসরের অসুখে এবং এই এক মাস ধরিয়া নিত্য কুচ করার ফলে তাহাকে আরও পাতলা দেখাইতেছিল। কিন্তু তাহার গৌরবর্ণ মুখে সদাই হাসি লাগিয়া আছে, তা উজ্জ্বল চোখ দুটি ও চোখাল নাক এদিকে ওদিকে ফিরিতেছে। নগরবাসীর আনন্দে “জয় শিব ছত্রপতির জয়” ধ্বনি করিতে লাগিল। মহিলারা বারান্দা হইতে সোনা-রূপার ফুল বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, অথবা ছুটিয়া আসিয়া তাহার চারিদিকে প্রদীপ ঘুরাইয়া আরতি কারলেন, অভ্যর্থনার শ্লাক ও আশীৰ্বাদ-বাণী উচ্চারণ করিলেন। শিবাজীও দুই পাশের জনতার মধ্যে মোহর ও টাকা ছড়াইতে লাগিলেন, এবং প্রত্যেক পাড়ার প্রধান নাগরিকগণকে খেলা ও অলঙ্কার উপহার দিলেন।

শিবাজী ও কুতুব শাহর সাক্ষাৎ

 এইরূপে শোভাযাত্রা কুতুব শাহর বিচার-প্রাসাদ—দাদমহলের সামনে আসিয়া পৌঁছিল। সেখানে আর-সকলে শান্ত সংযতভাবে রাস্তায় দাঁড়াইয়া রহিল; শুধু শিবাজী পাঁচজন প্রধান কর্মচারীর সহিত সিড়ি বাহিয়া দরবার-গৃহে উঠিলেন। সেখানে কুতুব শাহ প্রতীক্ষা করিতেছিলেন; তিনি দরজা পর্যন্ত উঠিয়া আসিয়া শিবাজীকে আলিঙ্গন করিলেন এবং হাত ধরিয়া লইয়া গিয়া গদীর উপর নিজ পাশে বসাইলেন;, মন্ত্রী মাদন্নাকে ফরাশে বসিতে অনুমতি দেওয়া হইল; আর সকলে দাঁড়াইয়া রহিল। অন্তঃপুরের বেগমেরা দুই পাশের পাথরের জাফরি-কাটা জানালার ফাক দিয়া কুতুহলে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন।

 কুতুব শাহ তিন ঘণ্টা ধরিয়া কথাবার্তা কহিলেন, এবং শিবাজীর মুখে তাহার জীবনের আশ্চর্য ঘটনা ও বীর কীর্তিগুলির বিস্তারিত বিবরণ মুগ্ধ হইয়া শুনিলেন। পরে তিনি স্বহস্তে শিবাজীকে পান আতর দিয়া, এবং মারাঠা মন্ত্রী ও সেনাপতিদের খেলাৎ অলঙ্কার হাতীঘোড় উপহার দিয়া বিদায় করিলেন। স্বয়ং শিবাজীর সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির নীচ তলা পর্যন্ত গেলেন। সেখান হইতে পথে টাকা ছড়াইতে ছড়াইতে শিবাজী বাসাবাড়ীতে পৌঁছিলেন।

 উজীর মাদন্না পণ্ডিত পরদিন শিবাজী ও তাঁহার প্রধান কর্মচারীদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলেন; তাহার মাতা স্বহস্তে অতিথিদের জন্য রান্না করিলেন। ভোজশেষে নানা উপহার পাইয়া মারাঠারা বাসায় ফিরিল।

গোলকুণ্ডা-রাজের সহিত সন্ধি

 তাহার পর কাজের কথা আরম্ভ হইল। অনেক আলোচনার পর শিবাজীর সহিত এই শর্তে সন্ধি হইল -কুতুব শাহ দৈনিক পনের হাজার টাকা এবং নিজ সেনাপতি মীজা মহম্মদ আমিনের অধীনে পাঁচ হাজার সৈন্য, কতকগুলি তোপ এবং গোলা বারুদ দিয়া শিবাজীকে কর্ণাটক জয়ে সাহায্য করিবেন। শিবাজী প্রতিজ্ঞা করিলেন, কর্ণাটকের যে যে অংশ তাহার পিতা শাহজীর ছিল তাহা বাদে জয় করা সমস্ত দেশ কুতুব শাহকে দিবেন। এ ছাড়া তিনি কুতুব শাহর সম্মুখে ধর্ম্মশপথ করিয়া বলিলেন যে মুঘলেরা আক্রমণ করিলেই তিনি গোলকুণ্ডা-রাজ্য রক্ষা করিতে ছুটিয়া আসিবেন। তজ্জন্য কুতুব শাহ পূর্ব প্রতিশ্রুতি-মত বার্ষিক কর পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়মিতভাবে দিতে থাকিবেন বলিয়া আশ্বাস দিলেন।

 গোপনে এই-সব মন্ত্রণা ও বন্দোবস্ত চলিতে লাগিল, আর বাহিরে আমোদ-প্রমোদ তামাশা ও ভোজে মারাঠা এবং নগরবাসীদের সময় সুখে কাটিতে লাগিল। শিবাজী দ্বিতীয়বার কুতুব শাহর সহিত দেখা করিলেন; দুই রাজা প্রাসাদের বারান্দায় পাশাপাশি বসিলেন, আর সমস্ত মারাঠা-সৈন্য কুচ করিয়া তাঁহাদের সামনে দিয়া চলিল; গোলকুণ্ডার সুলতান তাহাদের নানা উপহার দিলেন। শিবাজীর ঘোড়াকে পর্যন্ত একটি মণি ও হীরার মালা গলায় পরাইয়া দেওয়া হইল, কারণ সে-ও তাঁহার যুদ্ধজয়ে সঙ্গী ছিল।

 আর একদিন কুতুব শাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কয় শত হাতী আছে?” শিবাজী তাহার হাজার হাজার মাবুলে পদাতিক সৈন্য দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “ইহারাই আমার হাতী।” তখন সুলতানের একটি প্রকাশ মত্ত হস্তীর সহিত মাবুলে সেনাপতি যসাপ্পজী কঙ্ক তরবারি লইয়া যুদ্ধ করিলেন, এবং উহাকে কিছুক্ষণ ঠেকাইয়া রাখিয়া শেষে এক কোপে উহার শুভ কাটিয়া ফেলিলেন। হাতী পরান্ত হইয়া পলাইয়া গেল।

 এইরূপে এক মাস কাটাইবার পর টাকা ও মালপত্র লইয়া শিবাজী মার্চ মাসের প্রথমে হায়দারবাদ ত্যাগ করিলেন। দক্ষিণ দিকে গিয়া কৃষ্ণা নদীর তীরে “নিবৃত্তি সঙ্গমে” (ভবনাশী নদীর সহিত মিলন ক্ষেত্রে) তীর্থস্নান ও পূজা স্নানাদি করিয়া, সৈন্যদের অনন্তপুরে পাঠাইয়া দিলেন, এবং নিজে অল্প রক্ষী ও কর্মচারী সঙ্গে লইয়া দ্রুতবেগে শ্রীশৈল দর্শনে চলিলেন।


শিবাজীর শ্রীশৈল দর্শন

 এই স্থান কর্মুল নগর হইতে ৭০ মাইল পূর্ব দিকে। এখানে কৃষ্ণা নদী হইতে হাজার ফুট উচু এক অধিতাকার জনহীন বনের মধ্যে মল্লিকার্জুন শিবের মন্দির—ইহা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটি লিঙ্গ। মন্দিরটি পঁচিশ ছাব্বিশ ফীট উচু দেওয়াল দিয়া ঘেরা; ইহার চারিদিকে অতি বিস্তৃত আঙ্গিনা। বড় বড় সমচতুষ্কোণ পাথর দিয়া এই দেওয়াল গাঁথা, আর তাহার গায়ে হাতী, ঘোড়া, বাঘ, শিকারী, যোদ্ধা, যোগী, এবং রামায়ণ ও পুরাণের দৃশ্য অতি সুন্দরভাবে খোদাই করা। শিবমন্দিরটিও সমচতুষ্কোণ। বিজয়নগরের দিগ্বিজয়ী সম্রাট কৃষ্ণদেব রায়ের অর্থে মন্দিরের চারিদিকের দেওয়াল ও ছাদ আগাগোড়া সোনার জল করা পিতলের চাদরে মোড়া (১৫১৩)। ঐ বংশের এক সম্রাজ্ঞী উপর হইতে নীচে কৃষ্ণার জলধারা পর্যন্ত হাজার ফীটেরও বেশী দীপথ, পাথরের শান বাঁধাইয়া দিয়াছিলেন। তাহার নীচে ঘাটের নাম “পাতাল গঙ্গা”; আর কিছু ভাটীতে “নীলগঙ্গা” নামে পার-ঘাট; এই দুটিই বিখ্যাত স্নানের তীর্থ। শিবমন্দিরের কাছে একটি হোট দুর্গা-মন্দির।

 শিবাজী শ্রীশৈলে উঠিয়া পূজা স্নান দান লক্ষ ব্রাহ্মণ ভোজন ইত্যাদি কার্য্যে এখানে নবরাত্রি (অর্থাৎ চৈত্র শুক্লপক্ষের প্রথম নয়দিবস, ২৪ মার্চ হইতে ১ এপ্রিল, ১৬৭৭) যাপন করিলেন। এই তীর্থস্থানের শান্ত স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য, রম্য নির্জ্জনতা, এবং ধর্মভাব জাগাইবার স্বাভাবিক শক্তি দেখিয়া তিনি আনন্দে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। এটা যেন তাঁহার নিকট দ্বিতীয় কৈলাস বা শিবের স্বর্গ বলিয়া বোধ হইল। মরিবার এমন উপযুক্ত স্থান এবং সময় আর মিলিবে না ভাবিয়া শিবাজী স্থির করিলেন, তিনি দেবী-প্রতিমার চরণে নিজমাথা কাটিয়া দিয়া দেহ ত্যাগ করিবেন। প্রবাদ আছে, ভগবতী স্বয়ং আবির্ভূত হইয়া, শিবাজীর উদ্যত তরবারি ধরিয়া ফেলিয়া তাহাকে থামালেন এবং বলিলেন, “বৎস! এই উপায়ে তোমার মোক্ষ হইবে না। একাজ করিও না। তোমার হাতে এখনও অনেক বড় বড় কর্তব্যভার রহিয়াছে।” তাহার পর দেবী অদৃশ্য হইলেন, শিবাজীও ক্ষান্ত হইলেন।

জিঞ্জি অধিকার

 এপ্রিল মাসের ৪ঠা ৫ই অনন্তপুরে ফিরিয়া শিবাজী সসৈন্য দ্রুত মাদ্রাজ প্রদেশের দিকে চলিলেন। ভারত-বিখ্যাত তিরুপতি পৰ্বতের মন্দির দেখিয়া পূর্ব্ব-কুলের সমভূমিতে নামিলেন, এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাদ্রাজ শহরের সাত মাইল পশ্চিমে পেচ্ছাপোল নগরে পৌঁছিলেন। এখান হইতে তাহার অগ্রগামী সৈন্য-পাঁচ হাজার অশ্বারোহী, দ্রুত জিঞ্জি-দুর্গে উপস্থিত হইল। তাহার মালিক নসির মহম্মদ খাঁ বার্ষিক পঞ্চাশ হাজার টাকা আয়ের জাগীর এবং কিছু নগদ টাকা পাইবার প্রতিশ্রুতি লাভ করিয়া তৎক্ষণাৎ এই অজেয় দুর্গ মারাঠাদের হাতে ছাড়িয়া দিল (১৩ই মে)। শিবাজী শীঘ্রই সেখানে আসিয়া পৌঁছিলেন এবং জিঞ্জি নিজ দখলে রাখিয়া উহার দেওয়াল পরিখা বুরুজ প্রভৃতি এত দৃঢ় করিলেন যে “ইউরোপীয়গণও তাহা করিলে গর্ব্ব অনুভব করিত।”

 সেখান হইতে রওনা হইয়া শিবাজী ২৩ মে বেলুর-দুর্গ অবরোধ করিলেন। ইহাও জিঞ্জির মত দুর্জ্জয় গড়। ইহার শাসনকর্তা হাবশী আবদুল্লা খা ঁআদিল শাহর বিশ্বাসী কর্মচারী; সে মারাঠাদের সব গোলাবাজী ও আক্রমণ তুচ্ছ করিয়া মহাবিক্রমের সহিত চৌদ্দ মাস লভিল, শেষে যখন দেখিল যে প্রভুর নিকট হইতে কোন সাহায্য আসিবে না, আর তাহার দুর্গরক্ষী সৈন্যদের মধ্যে পদাতিকের সংখ্যা ১,৮০০ হইতে দুইশত এবং অশ্বারোহীর সংখ্যা ৫০০ হইতে এক শততে দাড়াইয়াছে—তখন আবদুল্লা শিবাজীকে দুর্গ ছাড়িয়া দিল (২১ আগষ্ট ১৬৭৮)। এজন্য তাহাকে দেড় লক্ষ টাকা নগদ এবং বার্ষিক সেই পরিমাণ আয়ের জাগার দিবার শর্ত্ত হইল।

মারাঠাদের কর্ণাটক লুণ্ঠন

 শিবাজীর সৈন্যদল দ্রুতবেগে কুচ করিয়া বন্যার মত মাদ্রাজ প্রদেশের সমভূমি ছাইয়া ফেলিল। চারিদিকে যাহা পাইল গ্রাস করিল; কেহই তাহাদের সম্মুখে দাঁড়াইতে সাহসী হইল না। শুধু গোটা-কয়েক দুর্গ জলবেষ্টিত দ্বীপের মত কিছুদিনের জন্য স্বাধীনভাবে খাডা রহিল। প্রথমে এক হাজার মারাঠা-অশ্বারোহী দুই দিনের পথ আগে আগে চলিল; তাহার পিছনে অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া শিবাজী স্বয়ং আসিলেন; আর সর্বপশ্চাতে চাকর-বাকর এবং সিংহের পিছু পিছু শৃগালের পালের মত লুঠের লোভে আগত স্থানীয় ছোট জমিদার, ডাকাতের সর্দার, এবং জঙ্গলী জাতের দলপতি ("পলিগর”) ঘুরিতে লাগিল। টাকা আদায়ের জন্য শিবাজীর কঠোর পীড়ন এবং তাহার সৈন্যদের বিক্রম ও নিষ্ঠুরতার সংবাদ আগে আগে চলিল। পথ হইতে বড়লোকেরা যে যেখানে পারিল পলাইল, কেহ বনে কেহ-বা সাহেবদের সুরক্ষিত বন্দরে স্ত্রীপুত্র ও ধনরত্ন সহ আশ্রয় লইল।  এদিকে শিবাজীর টাকার বড় দরকার। তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া, কুতুবশাহী সরকারকে জিঞ্জি না দিয়া নিজ দখলে রাখায়, গোলকুণ্ডারাজ্যের নিকট হইতে দৈনিক পনের হাজার টাকার সাহায্য বন্ধ হইয়া গেল। তখন শিবাজী ঐ অঞ্চলের সব বড় বড় শহরে চিঠি পাঠাইয়া দশ লক্ষ টাকা ঋণ চাহিলেন; অবশ্য এই ঋণ-পরিশোধের আশা ছিল না, আর তাহা চাহিবার মত দুঃসাহস কাহারই বা? শিবাজী তখন ঐ দেশের ধনী লোকদের নামধাম ও তাহাদের ধনদৌলতের একটা তালিকা করিলেন। তাঁহার চৌথ-আদায়ের তহসিলদারগণ দেশ ছাইয়া ফেলিল। বিশ হাজার ব্রাহ্মণ এই সব চাকরির আশায় তাহার সঙ্গে আসিয়াছিল। তাহারা অতি নির্লজ্জভাবে লোকদের শেষ কড়িটি পর্যন্ত কাড়িয়া লইল-ন্যায়বিচার দয়া-মায়ার ধার ধারিল না। (ফ্রাঁসোয়া মাতঁর ডায়েরি)। ইংরাজ ফরাশী ও ডচ কুঠীর বণিকেরা বার-বার দূত এবং উপহার পাঠাইয়া শিবাজীকে তুষ্ট রাখিলেন।

শের খাঁ লোদীর পবাজয়

 জিঞ্জি প্রদেশের দক্ষিণে শের খাঁ লোদীর প্রকাণ্ড জাগীর, কাবেরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি যুদ্ধে একেবারেই অপারক; চতুর দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ মন্ত্রীদের পরামর্শে সব কাজ চালাইতেন। ইহারা তাঁহাকে বুঝাইয়া দিল যে শিবাজীর সৈন্যবল কিছুই না, কিন্তু তাহার বন্ধু ও সহায়ক পণ্ডিচেরীর শাসনকর্তা ফ্রাঁসোয়া মার্তা সাহেব তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে এ শত্রু বড় ভীষণ। শের খাঁ নিজ সৈন্য (চার হাজার অশ্বারোহী ও তিন-চার হাজার পেয়াদা ধরণের ভীরু অকেজো পদাতিক) লইয়া ১০ই জুন হইতে তিরুবাড়ীতে (কাডালোরের ১৩ মাইল পশ্চিমে) মারাঠাদের পথ রোধ করিয়া বসিয়া থাকিলেন। ২৩ মে শিবাজী জিঞ্জি হইতে বেলুরে পৌঁঁছিয়া, তথায় এক মাস থাকিয়া ঐ দুর্গ অবরোধের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া হয় হাজার অশ্বারোহী সহ ২৬ জুন তিরুবাড়ীতে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র শের খাঁ নিজ সৈন্যদল সাজাইয়া আক্রমণে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু মারাঠারা নিজ স্থানে স্থির নিঃশব্দভাবে দাঁঁড়াইয়া শত্রুর অপেক্ষা করিতে লাগিল। এই দৃশ্য দেখিয়া শের খাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হইল; তিনি দেখিলেন বড়ই বিপদ। অমনি নিজ সেনাদের ফিরিতে হুকুম দিলেন। তাহারা ইহাতে আরও ভীত এবং বিশৃঙ্খল হইয়া পডিল। ঠিক সেই সুযোগে শিবাজী ঘোড়া ছুটাইয়া আসিয়া তাহাদের উপর পড়িলেন; সকলে ছত্রভঙ্গ হইয়া উদ্ধশ্বাসে পলাইল।

 শের খাঁ তিরুবাড়ীর ছোট দুর্গে ছুটিয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। কাঙালোরে আশ্রয় লইবার ইচ্ছায় রাত্রে তিনি সেখান হইতে বাহির হইলেন। কিন্তু মারাঠারা টের পাইয়া তাড়া করিয়া তাহাকে অকাল-নায়কের জঙ্গলে তাড়াইয়া দিল। চন্দ্র অস্ত গেলে অন্ধকারের আড়ালে বন হইতে বাহির হইযা শের খাঁ একশত মাত্র সওয়ার লইয়া (২৭ জুন) বাইশ মাইল দূরে বোনগির-পটন নামক একটি ছোট দুর্গে (ভেলার নদীর উত্তর তীরে) ঢুকিলেন। কিন্তু তাহার পাঁচ শত ঘোড়া, দুইটি হাতী, বিশটা উট এবং তাঁবু ঢাক পতাকা ও মালের বলদ মারাঠার কাড়িয়া লইল। ইহার পর কয়েক দিনের মধ্যেই শের খাঁর রাজ্যের অনেক শহর ও দুর্গ শিবাজী অবাধে দখল করিলেন। অবশেষে ৫ই জুলাই খাঁ সন্ধি করিয়া শিবাজীকে নিজের সমস্ত দেশ ছাড়িয়া দিলেন এবং নিজের মুক্তির জন্য এক লক্ষ টাকা দিতে প্রতিজ্ঞা করিলেন। এই টাকা না দেওয়া পর্যন্ত নিজপুত্র ইব্রাহিম খাঁকে জামিন-স্বরূপ শিবাজীর হাতে রাখিলেন। শিবাজী প্রতিজ্ঞা করিলেন যে শের খাঁকে পরিবারসহ অবাধে ঐ দুর্গ হইতে বাহির হইতে এবং কাডালোরে রক্ষিত তাঁহার সম্পত্তি লইয়া যাইতে দিবেন।[১]

শিবাজী ও ব্যঙ্কাজীর সাক্ষাৎ ও কলঙ্ক

 শিবাজী এখান হইতে আরও দক্ষিণে কুচ করিয়া কোলে নদী (অর্থাৎ কাবেরীর মুখের কাছে সর্ব্ব-উত্তর শাখা)র তীরে তিরুমল-বাড়ী নামক স্থানে ১২ই জুলাই পৌঁছিয়া বর্ষা কাটাইবার জন্য সৈন্যদেরশিবির গাডিলেন। ব্যঙ্কাজীর রাজধানী তাঞ্জোর শহর এখান হইতে দশ মাইল মাত্র দক্ষিণে, মধ্যে শুধু কোলেরুণ নদী। এখানে বসিয়া মাদুরার রাজার নিকট হইতে কর আদায়ের চেষ্টা হইতে লাগিল, এক কোটি টাকা চাওয়া হইল, কিন্তু শেষে ত্রিশ লক্ষে রফা হইল। স্থির হইল, এই টাকা পাইলে শিবাজী আর মাদুরা আক্রমণ করিবেন না।

 ইতিমধ্যে শিবাজী তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ব্যঙ্কাজীকে দেখা করিবার জন্য ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাঁহার অনুরোধে প্রথমে ব্যঙ্কাজীর মন্ত্রীরা শিবাজীর সহিত আলোচনা করিতে আসিল, এবং শিবাজীর তিনজন মন্ত্রী ও নিমন্ত্রণপত্র লইয়া তাহারা নিজ প্রভুর কাছে ফিরিয়া গেল। শিবাজীর অভয়বাণীতে আশ্বস্ত হইয়া ব্যঙ্কাজী দু হাজার অশ্বারোহীর সহিত জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিরুমল-বাড়ীতে পৌছিলেন। শিবাজী তাহাকে অভ্যর্থনা করিলেন এবং কয়েক দিন ধরিয়া ভোজ ও উপহার বিনিময় চলিল। তাহার পর কাজের কথা উঠিল। শাহজী মৃত্যুকালে যে সব ধনসম্পত্তি এবং কর্ণাটকে জাগীর রাখিয়া যান তাহার সমস্তই ব্যঙ্কাজীর হাতে পড়িয়াছিল; পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে, শিবাজী এখন তাঁহার বারো আনা দাবি করিলেন। ব্যঙ্কাজী সিকিমাত্র লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে অস্বীকার করিলেন; তখন শিবাজী রাগিয়া তাহাকে খুব ধমকাইলেন এবং নজরবন্দী করিয়া রাখিলেন। ব্যঙ্কাজী দেখিলেন, ধনসম্পত্তি সব সঁপিয়া না দিলে মুক্তি পাওয়া দুরূহ। কিন্তু তিনি শিবাজীরই ভাই বটে; গোপনে জোগাড়যন্ত্র ঠিক কবিয়া এক রাত্রে শৌচের ভাণ করিয়া নদীতীরে এক নির্জন স্থানে গেলেন। সেখানে তাহার পাঁচজন অনুচর একটি ভেলা লইয়া প্রস্তুত ছিল। ব্যঙ্কাজী তাহাতে লাফাইয়া উঠিয়া নদী পার হইয়া নিজ রাজ্যে পৌঁছিলেন (২৩ জুলাই)।

 পরদিন রাতে এই সংবাদ পাইয়া শিবাজী মহা চটিয়া বলিলেন, “ও পলাইল কেন? আমি কি উহাকে ধরিতে যাইতেছিলাম? *** পলাইবার কথা নয়। আমি যাহা চাহিয়াছিলাম, দিবার ইচ্ছা না থাকিলে বলিলেই পারিত। অতি কনিষ্ঠ ত কনিষ্ঠ, বুদ্ধিও ছেলেমানুষের মত দেখাইল।” ব্যঙ্কাজীর মন্ত্রিগণ প্রভুর খবর পাইয়া পলাইবার উদ্যোগ করিল, তাহাদের ধরিয়া শিবাজীর কাছে আনা হইল। কয়েকদিন আটক থাকিবার পর তিনি তাদের খালাস করিয়া খেলাৎ ও উপহার দিয়া তাঞ্জোরে পাঠাইয়া দিলেন; নচেৎ এই নিষ্ফল নির্যাতনে তাহার দুর্নাম ভিন্ন কোনই লাভ হইত না। শিবাজী কোলেরুণের উত্তরে শাহজরি সমস্ত জাগীর নিজে দখল করিলেন।

শিবাজী শিবিবেব বর্ণনা

 ফরাসী-দূত জারমায়্যাঁ সাহেব তিরুমল-বাড়ীতে শিবাজীর শিবির দেখিয়া এই বর্ণনা লিখিয়া গিয়াছেন:—

 “তাহার শিবিরে কোন রকম ধূমধাম নাই, ভারী মালপত্র বা স্ত্রীলোকের ঝঞ্জাট নাই। সমস্ত শিবিরে দুটি মাত্র তাম্বু, তাহাও আকারে ছোট এবং মোটা সাধারণ কাপড়ে তৈয়ারি; একটায় থাকেন শিবাজী, অপরটায় তাঁহার পেশোয়া। মারাঠা-অশ্বারোহীদের মাসিক বেতন দশ টাকা করিয়া, এবং তাহাদের ঘোড়া ও সইস রাজাই দেন। প্রতি দুইজন সৈন্যের জন্য তিনটি করিয়া ঘোড়া রাখা হয়, এইজন্য তাহারা খুব দ্রুত চলিতে পারে। শিবাজী গুপ্তচরদের মুক্তহস্তে টাকা দেন, আর তাহারা তাঁহাকে সত্য খবর দিয়া দেশ-জয়ে বিশেষ সহায়তা করে।”

 ব্যঙ্কাজীকে ফিরাইয়া আনিবার আশা নাই দেখিয়া শিবাজী ২৭এ জুলাই তিরুমল-বাডী ছাডিয়া আবার উত্তরে আসিলেন। পথে বলি-কণ্ড পুরম চিদাম্বরম্ ও বৃদ্ধাচল (বিখ্যাত তীর্থ দুটি) দর্শন করিয়া ক্রমে ৩রা অক্টোবর মাদ্রাজ হইতে দুই দিনের পথে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইতিমধ্যে আরণি প্রভৃতি অনেক দুর্গ তাঁহার হাতে পড়িল।

কর্ণাটকে নুতন বাজের বন্দোবস্ত

 এখন তিনি খবর পাইলেন যে, একমাস আগে আওরংজীবের হুকুমে মুঘল-সুবাদার বিজাপুর-রাজের সহিত জোট করিয়া গোলকুণ্ডা-রাজ্য আক্রমণ করিয়াছেন, কারণ কুতুব শাহ শিবাজীর মত বিদ্রোহীর সহিত মিত্রতা করিয়াছেন। এদিকে শিবাজীও দশমাস হইল নিজ রাজ্য হাতিয়া আসিয়াছেন, সেখানে রাজকর্ম তত ভাল চলিতেছে না। সুতরাং তাঁহার দেশে ফেরাই স্থির হইল।

 নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চার হাজার অশ্বারোহী সঙ্গে লইয়া তিনি কর্ণাটকের সমভূমি ছাড়িয়া মহীশূরের অধিত্যকায় চড়িলেন,এবং সেখানে পিতার জাগীরের মহালগুলি দখল করিবার পর মহারাষ্ট্রে ফিরিলেন। তাহার অধিকাংশ সৈন্যই আপাততঃ কর্ণাটকে রহিল, কারণ সেই অঞ্চলে তিনি যে রাজ্য জয় করিয়াছিলেন তাহা অতীব বিস্তীর্ণ ও ধনশালী। ইহা দৈর্ঘ্যে ১৮০ মাইল, প্রস্থে ১২০ মাইল, এবং ইহার মধ্যে ৮৬টা দুর্গ হিল। বার্ষিক খাজানা ৪৬ লক্ষ টাকার অধিক। এই নূতন রাজ্য জিডি ও বেলুরের জেলাগুলি সইয়া গঠিত। ইহার সদর অফিস জিঞ্জিদুর্গে। শাহজীর দাসীপুত্র শাজীকে ইঁহার শাসনকর্তা, রঘুনাথ হনুমন্তেকে দেওয়ান এবং হাম্বীর রাও মোহিতেকে সেনাপতি নিযুক্ত করিয়া শিবাজী চলিয়া গেলেন। রঙ্গো নারায়ণ মহীশ্বরের অধিত্যকায় বিজিত মহালগুলির শাসনকর্তা হইলেন।

 ইতিমধ্যে ব্যঙ্কাজী কর্ণাটকে পিতার দাগীর উদ্ধার করিবার জন্য চারিদিকে ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন, কিন্তু কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অবশেষে ১৬ই নবেম্বর ১৬৭৭ তিনি কোলেরুণ পার হইয়া চৌদ্দ হাজার সৈন্যসহ শান্তাজীর বারো হাজার সেনাকে আক্রমণ করিলেন॥ সারাদিন যুদ্ধ করিবার পর শান্তাজী হার মানিয়া এক ক্রোশ পশ্চাতে পলাইয়া গেলেন। কিন্তু রাত্রে যখন ব্যঙ্কাজীর বিজয়ী সেনাগণ ক্লান্ত হইয়া নিজ শিবিরে ফিরিয়া, ঘোড়র জীন খুলিয়া বিশ্রাম করিতেছিল, তখন শান্তাজী নিজ পরাজিত সৈন্যদের আবার একত্র করিয়া, তাহাদের নূতন উৎসাহে মাতাইয়া সুস্থ ঘোড়ায় চড়াইয়া, এক ঘোর পথ দিয়া আসিয়া হঠাৎ ব্যঙ্কাজীর শিবিরের উপর পড়িলেন। ব্যঙ্কাজীর দল আত্মরক্ষা করিতে পারিল না, অনেকে মারা গেল, বাকী সকলে নদী পার হইয়া তাঞ্জোরে পলাইল। তিনজন প্রধান সেনানী বন্দী হইল। শত্রুপক্ষের এক হাজার ঘোয্রা তাঁবু ও মালপত্র শান্তাজীর হাতে পড়িল।

ব্যঙ্কাজীব সহিত শেষ নিষ্পত্তি

 দুই ভাই-এর মধ্যে আরও কিছুদিন ধরিয়া ছোটখাট যুদ্ধ এবং লুঠপাট চলিল; দেশের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হইয়া উঠিল। অবশেষে শিবাজী দেখিলেন, তাঁহার অত সৈন্য এবং বড় বড় সেনাপতিদের কর্ণাটকে আর বেশি দিন ভইইনাটজ্র আর টকে আর বেশী দিন আটকাইয়া রাখিলে মহারাষ্ট্র দেশরক্ষা করা কঠিন হইবে। তিনি তখন ব্যঙ্কাজীর সহিত সন্ধি করিলেন। ব্যঙ্কাজী তাহাকে নগদ ময়লক্ষ টাকা দিলেন, তাহার বদলে শিবাজী কর্ণাটকের উত্তরাংশে জিঞ্জি ও বেলুর প্রদেশ নিজ অধিকারে রাখিয়া, বাকী সব দেশ (অর্থাৎ কোলেরুণের উত্তয়রে কয়েকটি মহাল এবং তাহার দক্ষিণে সমন্ত জোর-রাজ্য) ভ্রাতাকে ছাড়িয়া দিলেন। কিছুদিন পরে মহীশূরের জাগীরগুলিও ব্যঙ্কাজী ফিরিয়া পাইলেন। এইরূপে শান্তি স্থাপিত হওয়ায়, হাম্বীর রাও শিবাজীর অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিলেন; কর্ণাটক রক্ষার জন্য রঘুনাথ হনুমন্তে দশ হাজার স্থানীয় ফৌজ নিযুক্ত করিলেন।

 কর্ণাটক হইতে যে ধনরত্ন লাভ হইল তাহা কল্পনার অতীত।

  1. অবশেষে ১৬৭৮ সালের এপ্রিল মাসে রাজ্যহীন নিঃসম্বল শের খা মাইয়া বাজে রে আয় লইলেন।