শিবাজী/চতুর্থ অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়
পাঁচ বৎসর ধরিয়া যুদ্ধ, ১৬৬০-১৬৬৪
শিবাজীর দক্ষিণ-মহারাষ্ট্রে প্রবেশ
আফজল খাঁর মৃত্যু (১০ই নবেম্বর ১৬৫৯) এবং তাঁহার সৈন্যদল বিধ্বস্ত হইবার পর, শিবাজী দক্ষিণে কোলাপুর জেলায় প্রবেশ করিয়া দেশ লুঠিতে লাগিলেন। ২৮এ নবেম্বর তিনি পন্হালা নামক বিশাল গিরিদুর্গ অধিকার করিলেন। তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য স্থানীয় শাসনকর্ত্তা রুস্তম-ই-জমান বিজাপুররাজের আদেশে অগ্রসর হইলেন; আফজলের পুত্র ফজল খাঁ পিতৃহত্যার প্রতিশোধ লইবার জন্য রুস্তমের সহিত সসৈন্য মিলিত হইলেন। কিন্তু রুস্তম জানিতেন, বিজাপুরের কর্ত্রী-রাণী বড়ী সাহিবা গোপনে তাঁহার উচ্ছেদের চেষ্টায় আছেন, এ অবস্থায় তাঁহার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় শিবাজীর সহিত সদ্ভাব বজায় রাখা;—বিশেষতঃ শিবাজীর বংশের সহিত তাঁহার দুই পুরুষ ধরিয়া বন্ধুত্ব। সুতরাং রুস্তম শিবাজীর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া শুধু লোক দেখাইবার জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে সৈন্য চালনা করিলেন। কোলাপুর শহর হইতে কিছু দূরে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হইল। রুস্তম গা ঢিলা দিয়া পিছনে থাকিলেন; ক্রুদ্ধ ফজল খাঁ যুদ্ধের সমস্ত ভার নিজের উপর লইয়া প্রবল বেগে মারাঠাদের আক্রমণ করিলেন (২৮এ ডিসেম্বর)। তাঁহার অনেক লোক যুদ্ধে মারা গেল, দু’হাজার ঘোড়া ও বারোটী হাতী ধরা পড়িল; পরাস্ত হইয়া ফজল খাঁ বিজাপুরে ফিরিলেন। আর রুস্তম পিছু হটিয়া নিজ জাগীর দক্ষিণ-কানাড়ায় গিয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন।
এই সুযোগে মারাঠারা সহ্যাদ্রি পার হইয়া পশ্চিম দিকে রত্নগিরি জেলায় ঢুকিয়া অবাধে দক্ষিণ-কোঁকনের শহর ও বন্দর লুঠিতে লাগিল। তাহাদের আর একদল পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইয়া বিজাপুর শহরের কাছাকাছি পৌঁছিল।
পনহালায় শিবাজীকে অবরোধ
তখন আদিল শাহর চৈতন্য হইল—তিনি শিবাজীকে দমন করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। সিদ্দি জৌহর নামক একজন হাব্শী ওমরাকে ‘সলাবৎ খাঁ’ উপাধি দিয়া ফজল খাঁর সহিত পনহালা দুর্গ দখল করিতে পাঠান হইল। পনের হাজার সৈন্যসহ জৌহর আসিয়া কোলাপুর শহরে আড্ডা গাড়িলেন এবং শিবাদীকে পনহালাতে অবরুদ্ধ করিলেন (২রা মার্চ, ১৬৬০)। কিন্তু তাঁহার মনে ছিল দুরভিসন্ধি। প্রভুর কাজে মন না দিয়া, তিনি নিজের জন্য স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। চতুর মারাঠা-রাজ ভবিষ্যতে সহায়তা করিবার লোভ দেখাইয়া জৌহরকে হাত করিলেন। লোক দেখাইবার ছলে ছয় মাস ধরিয়া ধীরে ধীরে ঐ দুর্গের অবরোধ-কার্য্য চলিতে লাগিল।
কিন্তু ফজল খাঁ ভুলিবার পাত্র নন। প্রতিশোধ লইবার জনা তিনি নিজ সৈন্যদল লইয়া ক্রমাগত মারাঠাদের আক্রমণ করিতে লাগিলেন। পনহালার পাশেই পবনগড় দুর্গ। নিকটস্থ একটি গিরিশৃঙ্গে কামান বসাইয়া ফজল খাঁ পবনগড়ের উপর গোলা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। পবনগড় রক্ষা করা দুর্ঘট হইল, কিন্তু একবার ইহা বিজাপুরীদের হাতে পড়িলে পনহালার পতনও অবশ্যম্ভাবী।
শিবাজী দেখিলেন অবস্থা সাংঘাতিক, তিনি ফাঁদে পড়িয়াছেন, পলায়নের পথ রুদ্ধ। ১৩ই জুলাই, আষাঢ় কৃষ্ণ-প্রতিপদের রাত্রে পনহালায় কিছু সৈন্য রাখিয়া, অবশিষ্ট লোকজন-সমেত তিনি দুর্গ হইতে গোপনে নামিলেন, পবনগড়ের সম্মুখস্থ বিজাপুরী শিবির আক্রমণ করিলেন, এবং সেই গোলমালের সুযোগে বিশালগড় দুর্গের দিকে পলাইবার ব্যবস্থা করিলেন।
পনহালা হইতে শিবাজীর পলায়ন
কিন্তু বিশালগড় ২৭ মাইল দূরে, পথও অতি দুর্গম, উঁচুনীচু, পাথর-ছড়ান এবং সঙ্কীর্ণ। পরদিন প্রভাত-কিরণে দেখা গেল যে তথায় পৌঁছিতে আরও আট মাইল পথ বাকী আছে। এদিকে রাতেই শিবাজীর পলায়নের সংবাদ এবং তাঁহার পথের ঠিক সন্ধান পাইয়া ফজল খাঁ মাহতাব্ জ্বালাইয়া তাঁহার পিছু পিছু আসিয়াছেন। এখন দিনের আলোতে অসংখ্য শক্রসেনা মারাঠাদের পিষিরা মারিবে।
এই মহাবিপদে বাজীপ্রভু নামক কায়স্থ-জাতীয় মাব্লে জমিদার নিজ প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়া শিবাজীকে রক্ষা করিলেন। গজপুরের নিকট পথটি অতি সঙ্কীর্ণ, দুদিকেই উঁচু পাহাড় উঠিয়াছে। বাজীপ্রভু বলিলেন, “মহারাজ। আমি অর্দ্ধেক সৈন্য লইয়া এই স্থানটিতে মুখ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া শত্রুসেনাকে দাবাইয়া রাখি। আপনি সেই সুযোেগে অবশিষ্ট রক্ষী লইয়া বিশালগঞ্জে দ্রুত প্রস্থান করুন। তথায় নিরাপদে পৌঁছিলে তোপের আওয়াজ করিয়া আমাকে সে সুসংবাদ দিবেন।”
গজপুরের গিরিসঙ্কট মারাঠা-ইতিহাসের থার্মোপলি। সকাল হইতে পাঁচ ঘণ্টা পর্য্যন্ত বারে বারে প্রবল বিজাপুরী সৈন্যদল বন্যার মত আসিয়া সেই সঙ্কীর্ণ পিরিপথে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতেছে, আর মুষ্টিমেয় মারাঠারা প্রাণপণে লড়িয়া তাঁহাদের হটাইয়া দিতেছে। সাত শত মারাঠা-সৈন্য সেখানে প্রাণ দিল, বাজীপ্রভুও আহত হইয়া রণক্ষেত্রে পড়িয়া গেলেন, তবু যুদ্ধের বিরাম নাই। দ্বিপ্রহর বেলায় পশ্চাতে আট মাইল দূর হইতে তোপধ্বনি শোনা গেল। শিবাজী বিশালগড়ে আশ্রয় পাইয়াছেন। বাজীপ্রভু প্রাণ দিয়া পণ রক্ষা করিলেন। বিজাপুর-পক্ষের কর্ণাটকী বন্দুকচীরা গুলির পর গুলি চালাইয়া ঐ গিরিসঙ্কট জয় করিল, অবশিষ্ট মাব্লেরা মৃত সেনানীর দেহ লইয়া পাহাড়ে পলাইয়া গেল।
সুলতান আলি আদিল শাহ জোহরের বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাইয়া “দুই বিদ্রোহীকেই” দমন করিবার জন্য স্বয়ং রাজধানী হইতে পনহালার দিকে অগ্রসর হইলেন। জৌহর দেখিলেন আর ত ফাঁকি দেওয়া চলে না; তখন তিনি ২২এ সেপ্টেম্বর মারাঠাদের হাত হইতে পনহালা দুর্গ ফিরাইয়া লইয়া সুলতানকে অর্পণ করিলেন।
শায়েস্তা খাঁর পুণা ও চাকন অধিকার
যখন শিবাজীর রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে তাঁহার এই পরাজয় ও ক্ষতি হইতেছিল, ঠিক সেই সময় উত্তর সীমানায় আর এক মহাবিপদ ঘটিল। ২৫এ আগষ্ট ১৬৬০ মুঘলেরা তাঁহার হাত হইতে বিখ্যাত চাকন-দুর্গ কাড়িয়া লইল।
১৬৫৯ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে আওরংজীবের সিংহাসন নিষ্কণ্টক হইল, ভ্রাতাদের বিরুদ্ধাচরণের আর কোন ভয় রহিল না, কারণ সর্ব্বত্রই তাঁহার জয় হইয়াছে। এইবার তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে দৃষ্টি ফিরাইবার অবকাশ পাইলেন। নিজ মাতুল শায়েস্তা খাঁকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করিয়া তাঁহাকে শিবাজীর বিরুদ্ধে পাঠাইলেন।
শায়েস্তা খাঁ যেমন বুদ্ধিমান তেমনি বীর; নেতৃত্বে ও দেশ-শাসনে সমান দক্ষ; বহু যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছেন। ধনে-মানে প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এক মীরজুমলা ভিন্ন কেহই তাঁহার সমকক্ষ ছিল না। তিনি অতি চতুর প্রণালীতে আহমদনগর হইতে (২৫এ ফেব্রুয়ারি, ১৬৬০) কুচ করিয়া পুণা জেলার পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিক ঘুরিয়া, সন্মুখ হইতে মারাঠাদের ক্রমাগত তাড়াইয়া, এবং নিজের পশ্চাতের পথ নিরাপদ রাখিবার জন্য স্থানে স্থানে থানা বসাইয়া, অবশেষে পুণা শহরে আসিয়া পৌঁছিলেন (৯ই মে)। পথে তাঁহার কোন সৈন্য ক্ষয় হয় নাই বলিলেই চলে; মারাঠারা ভয়ে পিছাইয়া গেল, আর যদি-বা যুদ্ধ করিল এমন সুনিপুণভাবে চালিত ও দলবদ্ধ সৈন্যদলের সামনে দাঁড়াইতে পারিল না।
পুণার ১৮ মাইল উত্তরে চাকন-দুর্গ। ইহা হস্তগত করিতে পারিলে মুঘলরাজ্য হইতে দক্ষিণমুখী পথ দিয়া অতি সহজে পুণায় রসদ আনা সম্ভব হইবে। শায়েস্তা খাঁ ২১এ জুন চাকনের বাহিরে পৌঁছিয়া দুর্গ অবরোধ শুরু করিলেন। দুর্গস্বামী ফিরঙ্গজী নরসালা প্রাণপণে লড়িলেন। কিন্তু মুঘলেরা আজ অজেয়। জলকাদা অগ্রাহ্য করিয়া তাহারা দুর্গের চারিদিক খুঁডিয়া মুর্চা বাঁধিতে লাগিল, মাটির নীচ দিয়া দুর্গের দেওয়ালের তলা পর্য্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ করিয়া তাহাতে বারুদ ভরিয়া আগুন দিল (১৪ই আগষ্ট)। সশব্দে চাকন-দুর্গের উত্তর-পূর্ব্ব কোণের বুরুজ ফাটিয়া উড়িয়া গেল। আর সেই সুযোগে মুঘলেরা দুর্গপ্রাকার আক্রমণ করিয়া দুইদিন ধরিয়া মারামারি কাটাকাটির পর সমস্ত চাকন অধিকার করিল (১৫ই আগষ্ট)। শায়েস্তা খাঁ নিজে বীর, কাজেই বীরের আদর করিতে জানিতেন। তিনি ফিরঙ্গজীর গুণে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে বাদশাহী সৈন্যদলে উচ্চপদ দিতে চাহিলেন, কিন্তু প্রভুভক্ত মারাঠা নিমকহারাম হইতে অস্বীকার করিলেন। তখন তাঁহাকে সসম্মানে সৈন্যসহ শিবাজীর নিকট ফিরিয়া যাইতে দেওয়া হইল।
দক্ষিণ-কোঁকনে শিবাজীর রাজ্য বিস্তার
প্রায় দু’মাস ধরিয়া অবিরাম পরিশ্রমের পর চাকন অধিকার করিতে মুঘলদের ২৬৮ জন সৈন্য হত ও ৬০০ জন আহত হয়। সুতরাং ইহার পর তাহারা আর মারাঠী দুর্গ আক্রমণ করিতে একেবারেই ইচ্ছুক হইল না। শায়েস্তা খাঁ শীঘ্রই পুণায় ফিরিয়া আসিয়া ছাউনি করিলেন।
১৬৬১ সালের প্রথমে তিনি উত্তর-কোঁকন অধিকার করিবার জন্য একদল সৈন্য পাঠাইলেন। ইহাদের নেতা—চার হাজারী মন্সবদার কার্তলব্ খাঁ উজবক্ যখন উম্বখিণ্ড নামক স্থানে পথহীন পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে তোপ মালপত্র ও রসদ লইয়া বিব্রত, শিবাজী সেই সময় দ্রুতবেগে গুপ্তপথে আসিয়া তাঁহাকে ঘেরাও করিলেন, এবং জলাশয়ে যাইবার পথ বন্ধ করিয়া দিলেন। খাঁ তখন শিবির ও সম্পত্তি সমস্তই শিবাজীকে সমর্পণ করিয়া প্রাণ ভিক্ষা লইয়া সৈন্যসহ ফিরিয়া আসিলেন (৩রা ফেব্রুয়ারি, ১৬৬১)।
পনহালা ও চাকন হারাইয়া যে ক্ষতি হইয়াছিল, বিজয়ী শিবাজী এখন তাহা পূরণ করিবার জন্য দক্ষিণ-কোঁকনে প্রবেশ করিলেন। সেনাপতি নেতাজী পালকরের অধীনে একদল মারাঠা মুঘলদিগের বিরুদ্ধে উত্তর দিকে মোতায়েন রহিল। অপরদল লইয়া শিবাজী স্বয়ং বিজাপুরের অধীন দক্ষিণ-কোঁকন (বর্ত্তমান রত্নগিরি জেলা) অধিকার করিলেন। সেখানে শুধু খণ্ডরাজ্যের পর খণ্ডরাজ্য; এমন কোন একজন প্রবল প্রতাপশালী প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা ছিল না যে শিবাজীর গতি রোধ করিতে পারে। শিবাজী এত দ্রুতবেগে অগ্রসর হইলেন যে অনেক স্থানীয় রাজা জমিদার আত্মরক্ষার আয়োজনের অবসর পাইল না,—তাড়াতাড়ি সব ছাড়িয়া প্রাণ লইয়া পলাইয়া গেল। আর সকলে কর দিয়া তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিল।
এইরূপে জঞ্জিরা হইতে খারেপটন পর্য্যন্ত পশ্চিম-সমুদ্রের কূলবর্ত্তী সমস্ত অঞ্চল তাঁহার হাতে পড়িল। সর্ব্বত্রই তাঁহার পক্ষ হইতে লুটপাট অথবা চৌথ আদায় চলিতে লাগিল। এই প্রদেশটি তীর্থবহুল, তাহার মধ্যে পরশুরামক্ষেত্র অতি বিখ্যাত। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে যাত্রীরা এখানে তীর্থ-পর্য্যটনে আসে। এদেশে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের বাসই অধিক। শিবাজীর সৈন্যগণের দ্রুত গতি, অজেয় শক্তি, লুটপাট এবং কঠোর পীড়নের সংবাদে ভদ্র রাহ্মণ পরিবার, গরিব গৃহস্থ ও প্রজা সকলেই দেশ ছাড়িয়া পলাইতে লাগিল। চাষবাস বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হইল। তখন শিবাজী তীর্থক্ষেত্রে গিয়া অনেক পূজা করিলেন,ব্রাহ্মণদের দান দিলেন, এবং প্রজাদের আশ্বাস দিয়া নিজ নিজ গৃহে ও কার্য্যে ফিরাইয়া আনিলেন। এই নূতন শাসন-স্থাপনে সাহায্য পাইবার আশায় শিবাজী শৃঙ্গারপুর-রাজ্য অধিকার করিবার পর তথাকার প্রভাবশালী ও অভিজ্ঞ ভূতপূর্ব্ব মন্ত্রী এবং (কার্য্যতঃ সর্ব্বেসর্ব্বা) পিলাজী শির্কেকে অর্থ ও ক্ষমতা দিয়া স্বপক্ষে আনিলেন, এমন কি তাঁহার সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধও স্থাপন করিলেন। এইরূপে পল্লীবন ও শৃঙ্গারপুর-রাজ্য এবং দাভোল, সঙ্গমেশ্বর, রাজাপুর প্রভৃতি সমৃদ্ধিশালী শহর-বন্দর স্থায়িভাবে শিবাজীর হাতে আসিল। ঐ প্রদেশের অন্যান্য অগণিত নগর হইতে চৌথ আদায় হইল।
কিন্তু মে মাসে মুঘলেরা উত্তর-কোঁকনে কল্যাণ শহর (রাজধানী) অধিকার করিল এবং তাহা নয় বৎসর পর্য্যন্ত নিজের দখলে রাখিল। ইহার পর প্রায় দুই বৎসর কাল (মে ১৬৬১-মার্চ্চ ১৬৬৩) মুঘল-মারাঠা যুদ্ধ মন্দবেগে চলিতে লাগিল, কোন পক্ষেই বিশেষ কোন কীর্ত্তি অথবা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকর জয়-পরাজয় হইল না। দ্রুতগামী মারাঠা-অশ্বরোহিগণ মাঝে মাঝে মুঘল-রাজ্য লুট করিতে লাগিল বটে, কিন্তু মোটের উপর মুঘলেরা নিজ অধিকার বজায় রাখিতে এবং কখন কখন পাল্টিয়া মারাঠা গ্রামের উপর চড়াও হইতে সমর্থ হইল।
রাত্রে শায়েস্তা খাঁর উপর আক্রমণ
কিন্তু ইহার পরেই শিবাজী এমন একটি কাণ্ড করিলেন যাহাতে মুঘল-রাজদরবারে হাহাকার উঠিল এবং তাঁহার যাদুবিদ্যার খ্যাতি ও অমানুষিক ক্ষমতার আতঙ্ক সমগ্র ভারতে ছড়াইয়া পড়িল। তিনি রাত্রে শায়েস্তা খাঁর অগণিত সৈন্য-বেষ্টিত তাঁবুর মধ্যে ঢুকিয়া খুন-জখম করিয়া নিরাপদে ফিরিয়া আসিলেন (৫ই এপ্রিল, ১৬৬৩)।
চাকন-দুর্গ জয় করিবার পর শায়েস্তা খাঁ পুণায় ফিরিয়া আসিলেন। এখানে তাঁহার আবাস হইল শিবাজীর বাল্যকালের বাড়ী “লালমহল”। তাহার চারিদিকে তাঁবু খাটাইয়া এবং কানাৎ, অর্থাৎ পর্দ্দার বেড়া দিয়া, পরিবারবর্গ ও চাকর-বাকরের থাকিবার স্থান করা হইল। রক্ষিগণের ঘর তাহার নিকটেই। সৈন্য-সামন্তেরা পুণা গ্রামের নানা অংশে আশ্রয় লইল। কিছু দূরে দক্ষিণে সিংহগড়ে যাইবার পথের ধারে শায়েস্তা খাঁর সর্বোচ্চ কর্ম্মচারী মহারাজা যশোবন্ত সিংহ দশ হাজার সৈন্য লইয়া আড্ডা গাড়িলেন।
এমন সুরক্ষিত ও সুসজ্জিত শত্রু-ব্যূহ ভেদ করিতে হইলে অত্যন্ত সাহস বুদ্ধি ও ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন। শিবাজীর যে পূর্ণমাত্রায় এই-সকল গুণ ছিল, তাহা তাঁহার পাকা বন্দোবস্ত হইতে বেশ বুঝা যায়। এক সহস্র সাহসী রণদক্ষ সেনা নিজের সঙ্গে লইলেন, আর পেশোয়া ও সেনাপতির অধীনে এক এক হাজার করিয়া মাব্লে পদাতিক অশ্বারোহীর দুইটি দলকে মুঘল-শিবিরের দক্ষিণে ও বামে আধ ক্রোশ দূরে লুকাইয়া রাখিলেন।
এরূপই বন্দোবস্ত করিয়া শিবাজী সিংহগড় হইতে বাহির হইয়া সন্ধ্যার সময় পুণার নিকট পৌঁছিলেন। বাহিরে নিজ দলের ছয় শত সৈন্য রাখিয়া, পেশোয়া মোরো পন্ত ও সেনাপতি নেতাজীকে অপর দুইপাশে মোতায়েন করিয়া, অবশিষ্ট চারিশত বীরের সহিত তিনি মুঘল-শিবিরের সীমার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। মুসলমান প্রহরীরা জিজ্ঞাসা করিল, “কে তোমরা?” শিবাজী উত্তর দিলেন, “আমরা বাদশাহর দক্ষিণী সৈন্য, নির্দ্দিষ্ট স্থানে হাজির থাকিবার জন্য যাইতেছি।” প্রহরী আর দ্বিরুক্তি করিল না। তাহার পর পুণার এক নির্জ্জন কোণে চুপ করিয়া কয়েক ঘণ্টা কাটাইয়া, শিবাজী মধ্যরাত্রে শায়েস্তা খাঁর বাসগৃহের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বাল্যকাল হইতেই এখানকার পথঘাট তাঁহার সুপরিচিত।
তখন রমজান মাস। এই মাসে মুসলমানেরা দিবাভাগ উপবাসে কাটাইয়া রাত্রে আহার করে। সারা দিন উপবাসের পর প্রথম রাতে গুরু ভোজন করিয়া নবাবের বাড়ীর সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। শুধু জনকয়েক পাচক জাগিয়া—সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে খাইবার খানা রাঁধিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহারা কোন শব্দ করিবার পূর্ব্বেই মারাঠারা গিয়া তাহাদের কাটিয়া ফেলিল। এই রান্নাঘরটি বাহিরে, ইহার গায়েই অন্দরমহলের চাকরদিগের থাকিবার ঘর, মধ্যে একটি দেওয়াল খাড়া। পূর্ব্বে এই দেওয়ালে একটি ছোট দরজা ছিল, শায়েস্তা খাঁ সেই দরজার ফাঁক ইট দিয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। শিবাজীর সঙ্গীরা শাবল দিয়া দরজার ইটগুলি খুলিতে লাগিল। সেই শব্দে ওপাশের, অর্থাৎ অন্দরমহলের, চাকরেরা জাগিয়া উঠিল এবং খাঁকে জানাইল যে বোধ হয় চোরে সিঁধ কাটিতেছে। এই সামান্য কারণে নিদ্রার ব্যাঘাত করায় খাঁ চটিয়া, ধমক দিয়া তাহাদের তাড়াইয়া দিলেন।
ইট সরাইয়া ক্রমে দেওয়ালের ছিদ্র মানুষ ঢুকিবার মত বড় করা হইল। প্রথমেই শিবাজী নিজে তাঁহার রক্ষী চিম্নাজী বাপুজীকে লইয়া অন্দরমহলে প্রবেশ করিলেন, পিছু পিছু চলিল তাঁহার দুই শত সৈন্য। বাকী দুইশত বীর বাবাজী বাপুজীর অধীনে ছিদ্রের বাহিরে খাড়া রহিল। তরবারি ও ছোরা দিয়া কানাৎ কাটিয়া পথ করিয়া সদলে শিবাজী তাঁবুর পর তাঁবু পার হইয়া শেষে শায়েস্তা খাঁর শয়নকক্ষে গিয়া হাজির। তাঁহাদের দেখিয়া অন্দরের স্ত্রীলোকেরা ভয়ে খাঁকে জাগাইল। কিন্তু খাঁ তরবারি ধরিবার আগেই শিবাজী তাঁহার উপর লাফাইয়া পড়িয়া এক কোপে তাঁহার হাতের আঙ্গুল কাটিয়া দিলেন। এই সময় অন্দরের এক চতুর দাসী বুদ্ধি করিয়া ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিল; মারাঠারা অন্ধকারেই তলোয়ার চালাইতে লাগিল। দু’জন মারাঠা অন্ধকারে পথ দেখিতে না পাইয়া জলের চৌবাচ্চায় পড়িয়া গেল। এই গোলমালের সুযোগে দাসীরা খাঁ-সাহেবকে নিরাপদ স্থানে সরাইয়া ফেলিল। কিন্তু অন্দরমহলে শিবাজীর লোকজন পুরাদমে সংহার-কার্য্য চালাইতে লাগিল, ছয়জন বাঁদী হত এবং আটজন আহত হইল।
এদিকে শিবাজীর অপর দুইশত সঙ্গী বাহিরের রক্ষীগৃহে ঢুকিয়া নিদ্রিত ও অর্ধনিদ্রিত প্রহরীদের হত্যা করিল, আর বিদ্রুপ করিয়া বলিতে লাগিল, “তোরা বুঝি এমনি করিয়া ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া পাহারা দিস্?” তাহার পর নহবতের ঘরে ঢুকিয়া বলিল, “খাঁ-সাহেবের হুকুম, খুব জোরে বাজাও।” তখন জয়ঢাক, তুরী ভেরী ও করতালের শব্দের সহিত মারাঠাদের চীৎকার মিশিয়া এক তাণ্ডব ব্যাপার সৃষ্টি করিল। অন্দর হইতে আর্ত্তনাদ এবং মারাঠাদের হুঙ্কার শুনিয়া মুঘল-সৈন্যগণ বুঝিতে পারিল তাহাদের সেনাপতিকে শত্রু আক্রমণ করিয়াছে। অমনি চারিদিকে সাজ সাজ রব উঠিল।
শায়েস্তা খাঁর পুত্র আবুল ফৎ সকলের আগে পিতাকে বাঁচাইবার জন্য ছুটিলেন। কিন্তু একাকী কি করিবেন? তিনিও শত্রুহস্তে নিহত হইলেন। একজন মুঘল-সেনানীর বাসা ছিল অন্দরমহলের পাশেই। মারাঠারা অন্দরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়াছে দেখিয়া, তিনি দড়ি বাহিয়া অন্দরের আঙ্গিনায় লাফাইয়া পড়িলেন; শত্রুরা অবিলম্বে তাঁহাকেও হত্যা করিল। এইরূপে শায়েস্তা খাঁর এক পুত্র, ছয়জন বাঁদী ও চল্লিশজন রক্ষী হত এবং নিজে, দুই পুত্র ও আটজন বাঁদী আহত হইল। মারাঠাদের পক্ষে শুধু ছয়জন লোক মারা যায় এবং চল্লিশজন জখম হয়।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এ-সব কাণ্ড ঘটিয়া গেল। এদিকে শিবাজী দেখিলেন, শত্রু এখন সজাগ—রণসজ্জা করিতেছে, তাঁহার আর বিলম্ব করা উচিত নয়। তিনি নিজ অনুচরদের একত্র করিয়া শিবির হইতে দ্রুত বাহির হইয়া পড়িলেন এবং যশোবন্তের তাঁবুগুলির পাশ দিয়া সোজা দক্ষিণে সিংহগড়ে চলিয়া গেলেন। মুঘলেরা তাঁহাকে ধরিবার জন্য সমস্ত শিবিরের মধ্যে অন্ধকারে এদিক-ওদিক বৃথা খুঁজিতে লাগিল। তাহারা স্বভাবতঃই ভাবিয়াছিল যে মারাঠারা সংখ্যায় অন্তত দশ-বিশ হাজার হইবে।
শায়েস্তা খাঁর দুঃখ ও শাস্তি
১৬৬৩ সালের ৫ই এপ্রিল তারিখে এই ঘটনা ঘটে। পরদিন প্রাতে সমস্ত মুঘল-কর্ম্মচারীরা সেনাপতির শোকে সমবেদনা জানাইবার জন্য তাঁহার দরবারে উপস্থিত হইলেন। ইঁহাদের মধ্যে যশোবন্ত সিংহ ছিলেন, তাঁহার অধীনে দশ হাজার সৈন্য এবং তাঁহার শিবির শিবাজীর পথে, অথচ তিনি শত্রুর আসা-যাওয়ার সময় কোন বাধাই দেন নাই এবং পশ্চাদ্ধাবনও করেন নাই। তাঁহার কপট দুঃখের কথাগুলি শুনিয়া শায়েস্তা খাঁ বলিলেন, “আঁ। আপনি বাঁচিয়া আছেন দেখিতেহি। কাল রাত্রে যখন শত্রু আমাকে আক্রমণ করে, আমি ভাবিয়াছিলাম আপনি তাহাদের বাধা দিতে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছেন, তবেই ত তাহারা আমার কাছে পৌঁছিতে পারিয়াছে।”
ফলতঃ,দেশের সর্ব্বত্র লোকেরা বলাবলি করিতে লাগিল যে, শিবাজী যশোবন্তের সহিত যুক্তি করিয়া এই কাণ্ড করিয়াছেন। ইংরাজ-বণিকেরাও এই দুর্নামের কথা লিখিয়া গিয়াছে। কিন্তু শিবাজী নিজের অনুচরদিগকে বলিতেন, “আমি যশোবন্তেরর কথায় এ কাজ করি নাই, আমার পরমেশ্বর আমাকে ইহা করাইয়াছেন।”
মহারাষ্ট্রে থাকা মোটই নিরাপদ নহে দেখিয়া, লজ্জা ও শোকে অভিভূত শায়েস্তা খাঁ আওয়ঙ্গাবাদে উঠিয়া আসিলেন। তাঁহার অসাবধানতা ও অকর্ম্মণ্যতার ফলেই এই বিপদ ঘটিয়াছে ভাবিয়া বাদশাহ শাস্তিস্বরূপ মাতুল শায়েস্তা খাঁকে বাঙ্গলায় বদলি করিলেন, কারণ তখন বাঙ্গলার নাম ছিল “রুটিপূর্ণ নরক”। বাঙ্গলা যাইবার পথে বাদশাহের সহিত দেখা করিতে পর্য্যন্ত শায়েস্তা খাঁকে নিষেধ করা হইল। ১৬৬৪ সালের জানুয়ারীর প্রথমে কুমার মুয়জ্জম্ (শাহ আলম্) দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হইয়া রাজধানী আওরঙ্গাবাদে পৌঁছিলেন এবং শায়েস্তা খাঁ বাঙ্গলার দিকে রওনা হইলেন। এই বদলির সুযোগে শিবাজী অবাধে মনের সুখে সুরত বন্দর লুঠ করিলেন (৬-১০ই জানুয়ারী)।
সুরত বন্দরের বর্ণনা
ভারতের পশ্চিমে সাগর-কুল হইতে বাৱে মাইল দূরে তাপ্তী নদীর তীরে সুরত নগর। অনেক আগে এখানে বড় বড় জাহাজের যাতায়াত হিল, কিন্তু এখন নদীর মুখ এই শহর হইতে ছয় সাত ক্রোস পশ্চিমে সরিয়া গিয়াছে, কাজেই সমুদ্রগামী জাহাজগুলি সেই মুখের কাছে, সুহায়িলী (ইংরাজী Swally Hole) নামক স্থানে নোঙ্গর করিয়া থাকে, আর অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ ও নৌকা নদী উজাইয়া সুরতে আসে। তবুও, সুরত মুঘল-ভারতে সর্ব্বপ্রধান বন্দর ছিল। বাণিজ্যের মাশুলের আয়ে এবং ধনরত্নে এক দিল্লী ভিন্ন আর কোন নগর ইহার সমকক্ষ ছিল না। প্রাচীন হিন্দুযুগে ইহার কিছু উত্তরে নর্ম্মদার মুখের কাছে ভারুকচ্ছ (বর্ত্তমান ভরোচ, প্রাচীন গ্রীক নাম বার্গজা) শ্রেষ্ঠ বন্দর বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেদিন চলিয়া গিয়াছে। ইহা ভিন্ন সুরত হইতে মক্কা-মদিনার যাত্রী লইয়া জাহাজ হাড়িত; এজন্য ইহার নাম ছিল “ইসলামের পুণ্য তীর্থের দ্বার”। এখান হইতেই ভারতীয় মুসলমানগণ আরব দেশের জন্য তীর্থযাত্রা করিতেন।
সুরতের দুই অংশ, একটি দুর্গ ও অপরটি শহর। দুর্গটি ছোট ও সুরক্ষিত। কিন্তু শহরটি চারি বর্গমাইল বিস্তৃত, ধনেজনে পরিপূর্ণ। লোকসংখ্যা দুই লক্ষ; বাণিজ্য-দ্রব্যের মাশুল হইতে রাজকোষে বৎসরে বারো সক্ষ টাকা আয় হইত, অর্থাৎ আমদানী জিনিসের মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ছিল। এ সময়ে শহরের চারিদিকে প্রাচীর ছিল না, শুধু স্থানে স্থানে বাহির হইতে আসিবার রাস্তার মুখে সামান্য রকমের ফটক এবং কোথাও কোথাও শুস্ক পরিখা ছিল, তা সহজেই পার হওয়া যাইত।
সুরত শহরের ধনরত্নের তুলনা ভারতের অন্যত্র পাওয়া কঠিন। এই নগরে এক বহরজী বোরার সম্পত্তির পরিমাণই আশী লক্ষ টাকা, তাহার পর হাজী সাইদ্ বেগ ও অন্য বণিকদের ত কথাই নাই। অথচ শহর রক্ষার বন্দোবস্ত মোটই ছিল না। শহরের শাসনকর্ত্তা পাঁচশত রক্ষী সৈন্যের বেতন রাজদরবার হইতে পাইতেন বটে, কিন্তু লোকজন রাখিতেন না,টাকাটা নিজের সুখের জন্য ব্যয় করিতেন। নগরবাসিগণও শান্তিপ্রিয়, দুর্ব্বল এবং ভীরু, অধিকাংশই অহিংস জৈন, শুচিবাইগ্রস্ত অগ্নি-উপাসক পারসী, অথবা অর্থপ্রিয় দোকানী এবং নিরীহ গুজরাতী কারিগর। ইহারা আত্মরক্ষার জন্য কি যুদ্ধ করিবে? মহাধনী ভারতীয় বণিকগণও নিজ সম্পত্তির সহস্রাংশ ব্যয় করিয়া চৌকিদার এবং সিপাহী রাখার আবশ্যকতা অনুভব করেন নাই। ____ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহর পক্ষে ইনাএৎ খাঁ সুরত বন্দরের শাসনকর্ত্তা ছিল; লোকটি যেমন অর্থলোভী তেমনই কাপুরুষ ও অকর্ম্মণ্য। কিন্তু দুর্গটি একজন সৈনিক কর্মচারীর হাতে ছিল, সে ইনাএৎ-এর অধীনতা স্বীকার করিত না।
ইংরাজ কুঠীর আশ্চর্য্য আত্মরক্ষা
মঙ্গলবার, ৫ই জানুয়ারি, প্রাতে সুরতবাসিগণ সভয়ে শুনিল দুইদিন পূর্ব্বে শিবাজী সসৈন্য আটাশ মাইল দক্ষিণে পৌঁছিয়াছেন, এবং সুরতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হইতেছেন। অমনি শহরময় শোরগোল উঠিল আতঙ্কে লোকজন পলাইতে সুরু করিল। যে পারিল স্ত্রীপুত্র লইয়া নদী পার হইয়া দূরবর্ত্তী গ্রামগুলিতে আশ্রয় লইল। ধনী লোকেরা দুর্গের অধ্যক্ষকে ঘুষ দিয়া সপরিবারে তথায় স্থান পাইলেন; তাহাদের মধ্যে শহরের রক্ষক ইনাএৎ খাঁ সর্ব্বপ্রথম।
অথচ মুষ্টিমেয় ইউরোপীয় দোকানদার এই সময়ে আশ্চর্য্য সাহস দেখাইয়া নিজ ধন প্রাণ মান বাঁচাইতে সক্ষম হইল। সুরতের ইংরাজ ও ডচ্ বণিকগণ নিজ নিজ কুঠীতে অস্ত্র লইয়া দাঁড়াইয়া শিবাজীর সমস্ত সৈন্যবলকে হটাইয়া দিল। তাহাদের কুঠীগুলি সাধারণ খোলাবাড়ী,— দুর্গ নহে, চারিদিকে সীমানা-ঘেরা দেওয়াল পর্য্যন্ত ছিল না। ইংরাজ-কুঠীর প্রধান, স্যার জর্জ অকসিণ্ডেন, ইচ্ছা করিলে সহজেই সুহায়িলীতে পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইতে পারিতেন, কিন্তু তাহা না করিয়া স্বয়ং সুরতে থাকিয়া যুদ্ধের নেতৃত্ব লইলেন। সত্বর ছয়টি ছোট ছোট কামান সংগ্রহ করিয়া, সুহায়িলী হইতে জাহাজী গোরা আনিয়া, মোট একশত পঞ্চাশ জন ইংরাজ এবং ষাটজন পিয়নকে সুরতের কুঠী রক্ষা করিবার জন্য সজ্জিত করা হইল। চারিটি কামান ছাদের উপর বসান হইল, তাহার গোলা পাশের দুটি রাস্তা এবং নিকটবর্ত্তী হাজী সাইদ বেগের বাড়ীর উপর পড়িতে পারিত। আর দুইটি তোপ সদর-দরজার পিছনে বসান হইল, এবং ঐ দরজায় এমন করিয়া দুটি ছিদ্র করা হইল যাহাতে তাহার মধ্য দিয়া কামানের মুখ বাহির হইতে পারে এবং রাস্তা হইতে কুঠীতে আসিবার পথে যে ঢুকিবে তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া যায়। তাড়াতাড়ি কয়েক দিনের জন্য খাদ্য ও জল আনিয়া মজুত করা হইল। ইংরাজদের কেহ সীসা দিয়া গুলি প্রস্তুত করিতে সুরু করিল, কেহ অপর যুদ্ধ-সামগ্রী তৈয়ারে মন দিল, কেহ বা কুঠীর দেওয়াল মেরামত করিয়া দৃঢ়তর করিল। প্রত্যেক লোককে নিজের নির্দ্দিষ্ট স্থান চিনাইয়া দেওয়া হইল, তাহাদের তত্ত্বাবধানের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক নেতা (কাপ্তেন) নিযুক্ত হইল। কাজের জন্য শৃঙ্খলা, সুন্দর ব্যবস্থা, এবং আগে হইতেই ভাবিয়া উপায় ঠিক করিয়া রাখা হইল। বুধবার প্রাতে অক্সিণ্ডেন তাঁহার দুইশত অনুচর লইয়া ঢাক তুরী বাজাইয়া শহরের মধ্য দিয়া কুচ করিয়া আসিলেন এবং প্রকাশ্যভাবে বলিতে লাগিলেন, “এই কয়টি লোক লইয়াই আমি শিবাজীর গতি রোধ করিব। ডচেরাও তাহাদের কুঠী রক্ষার জন্য সজিত হইল; এবং এই-সব আয়োজন দেখিয়া কতকগুলি তুর্কী ও আরমানী-বণিক নিজ নিজ সম্পত্তি একটি সরাই-এ লইয়া গিয়া তাহাকে দুর্গে পরিণত করিল। আর “ভারত? শুধু ঘুমাইয়া” রহিল।
শিবাজীর প্রথম সুরত লুণ্ঠন
বাছা বাছা দ্রুতগামী অশ্বে চারি হাজার সৈন্য চড়াইয়া শিবাজী বম্বের কাছ হইতে গোপনে বেশে অগ্রসর হইয়া সুরতের নিকট পৌছিলেন, পথে দুইজন কোলী রাজা লুঠের ভাগ পাইবার লোভে ছয় হাজার সৈন্য লইয়া তাঁহার সঙ্গে যোগ দিলেন। বুধবার (৬ই জানুয়ারি ১৬৬৪) দুপুর বেলা শিবাজী সুরত শহরের বাহিরে আসিয়া পৌঁছিলেন, এবং “বুর্হানপুর দরজার” সিকি মাইল দূরে একটি বাগানে নিজ তাম্বু খাটাইলেন। মারাঠা অশ্বরোহিগণ অমনি অরক্ষিত অর্ধজনশূন্য শহরে ঢুকিয়া বাড়ীঘর লুঠ করিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া দিতে লাগিল। একদল শহরের মধ্য হইতে দুর্গের দেওয়াল লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িতে লাগিল, ভয়ে দুর্গরক্ষী বীরগণ কেহই মাথা তুলিল না, বা শহর-লুঠে বাধা দিল না।
বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি এই চারিদিন ধরিয়া শহর অবাধে লুণ্ঠিত হইল। মারাঠারা প্রত্যহ নূতন নূতন পাড়ায় ঘর জ্বালাইয়া দিতে লাগিল। সে সময় সুরতে পাকা বাড়ী দশ-বিশটার অধিক ছিল না, বাকী হাজার হাজার বাড়ীতে কাঠের খুঁটি, বাঁশের দেওয়াল, খড় বা খোলার চাল, এবং মাটির মেঝে। এ হেন স্থানে মারাঠাদের অগ্নিকাণ্ড সহজেই “রাত্রিকে দিনের মত উজ্জ্বল এবং ধুমবৃষ্টি দিনকে রাত্রির মত অন্ধকার করিয়া তুলিল—সূর্যের মুখ ঢাকিয়া দিল।” [ইংরাজ পুরোহিতের বিবরণ]
ডচ্ কুঠীর কাছে সুরতের—সুরতের কেন, সমস্ত এশিয়াখণ্ডের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধনী বহরঙ্গী বোরার প্রাসাদ অরক্ষিত জনশূন্য দেখিয়া, মারাঠার তিনদিন তিনরাত্রি ধরিয়া তাহার মেঝে খুঁড়িয়া লুঠ করিল, সমস্ত ধনরত্ন এবং আটাশ সের মোতির বোঝা লইয়া অবশেষে ঘরে আগুন দিয়া প্রস্থান করিল। ইংরাজ-কুঠীর নিকটে আরও একজন মহাধনী হাজী সাইদ বেগের বাড়ীতে ঢুকিয়া, তাহারা সারা দিনরাত্রি দরজা-বাক্স ইত্যাদি ভাঙ্গিয়া যত পারিল টাকা সরাইল। গুদামে ঢুকিয়া পারদের পিপা ভাঙ্গিয়া তাহা মাটিতে ছড়াইয়া দিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার বৈকালে যখন পঁচিশজন মারাঠা-সৈন্য ইংরাজ কুঠীর নিকটস্থ একটি ঘরে আগুন লাগাইতে উদ্যত, সেই সময় ইংরাজেরা কুঠী হইতে বাহির হইয়া মারিয়া তাড়াইয়া দেওয়ায়, সাইদ বেগের বাড়ীর মারাঠা দলও ভয়ে সরিয়া পড়িল। পরদিন ইংরাজেরা কয়েকজন নিজের লোক পাঠাইয়া ঐ বণিকের বাড়ী রক্ষার ভার লইল। এইরূপ ধনের খনি হাত-ছাড়া হওয়াতে শিবাজী চটিয়া ইংরাজ-কুঠিতে বলিয়া পাঠাইলেন, “হয় আমাকে তিন লক্ষ টাকা দাও, না হয় হাজী সাইদের বাড়ী লুঠিতে দাও। নতুবা আমি স্বয়ং আসিয়া, তোমাদের সকলের গলা কাটিব এবং কুঠী ভূমিসাৎ করিয়া দিব।” সুচতুর ইংরাজ-নেতা উত্তর দিবার জন্য কিছু সময় চাহিয়া লইয়া শনিবার প্রাতঃকাল (অর্থাৎ চতুর্থ দিন) পর্য্যন্ত কাটাইলেন, তাহার পর শিবাজীকে খবর পাঠাইলেন—“আমরা দুইটি শর্ত্তের কোনটিতেই রাজি নহি; আপনি যাহা করিতে পারেন করুন; আমরা প্রস্তুত আছি, পলাইব না। যে সময় ইচ্ছা এই কুঠী আক্রমণ করুন। আর, এই কুঠী লইবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, বলিতেছেন; বেশ ত, যখন আসিবার ইচ্ছা করিয়াছেন তাহার এক প্রহর আগেই আসিবেন।” শিবাজী আর কিছুই করিলেন না; তিনি সুরত হইতে অবাধে এক কোটির অধিক টাকা পাইয়াছেন, তবে আর কেন দুই-এক লাখের জন্য স্থির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইংরাজদের তোপের মুখে নিজ সৈন্য নষ্ট করিবেন?
মারাঠাদের সুরতে অত্যাচার ও খুন
সুরত-লুণ্ঠনের ফলে অগণিত ধন লাভ হইল। বহু বৎসরেও এই সময়ের মত অর্থ রত্ন ইত্যাদি শহরে সংগৃহীত হয় নাই। মারাঠারা সোনা, রূপা, মোতি হীরা ও রত্ন ভিন্ন আর কিছুই ছুঁইল না।
মারাঠারা সুরতবাসীদের ধরিয়া আনিয়া কোথায় তাহারা নিজ নিজ ধন-সম্পত্তি লুকাইয়া রাখিয়াছে তাহার সন্ধানের জন্য কোন প্রকার নিষ্ঠুর পীড়নই বাকী রাখিল না; চাবুক মারা হইল, প্রাণ বধের ভয় দেখান হইল, কাহারও এক হাত কাহারও বা দুই হাত কাটিয়া ফেলা হইল, এবং কতক লোকের প্রাণ পর্য্যন্ত লওয়া হইল। “মিষ্টার এণ্টনি স্মিথ (ইংরাজ-বণিক) স্বচক্ষে দেখিলেন যে, শিবাজীর শিবিরে একদিনে ছাব্বিশজনের মাথা এবং ত্রিশজনের হাত কাটিয়া ফেলা হইল; বন্দীদের যে-কেহ যথেষ্ট টাকা দিতে পারিল না তাহার অঙ্গহানি বা প্রাণবধের আজ্ঞা হইল। শিবাজীর লুঠের প্রণালী এইরূপ, প্রত্যেক বাড়ী হইতে যাহা সম্ভব লইয়া, গৃহস্বামীকে বলা হইল যে যদি বাড়ী বাঁচাইতে চাও ত তাহার জন্য আরও কিছু দাও। কিন্তু যে-মুহূর্ত্তে সেই টাকা আদায় হইল, অমনি নিজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া ঘরগুলি পুড়াইয়া দিলেন।” [সুরত কুঠীয় পত্র] একজন বুড়া বণিক আগ্রা হইতে চল্লিশটি বলদ বোঝাই করিয়া কাপড় আনিয়াছিল, কিন্তু তাহা বিক্রয় না হওয়ায়, নগদ টাকা দিতে না পারিয়া সে ঐ সমস্ত মাল শিবাজীকে দিতে চাহিল; তবুও তাহার ডান হাত কাটিয়া তাহার কাপড়গুলি পুড়াইয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইল। অথচ একজন ইহুদী মণি-বিক্রেতা বেশ বাঁচিয়া গেল; সে আমার কিছু নাই বলিয়া কাঁদিতে লাগিল; মারাঠারাও ছাড়িবে না, তাহাকে বধ করিবার হুকুম হইল; তিন তিনবার তরবারি তাহার মাথার চারিদিকে ঘুরাইয়া ঘাড়ে ছোঁয়ান হইল, কিন্তু সে কিছুই দিতে না পারিয়া যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় বসিয়া আছে এরূপ ভাণ করিল; অবশেষে আশা নাই দেখিয়া শিবাজী তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। ইংরাজকুঠীর কর্ম্মচারী এণ্টনি স্মিথ ডচ্ ঘাটে নামমাত্র বন্দী হইয়া তিন দিন শিবাজীর শিবিরে আবদ্ধ ছিলেন; অন্যান্য বন্দীর সহিত তাঁহার ডান হাত কাটার হুকুম হইল; কিন্তু তিনি উর্দ্দু ভাষায় চেঁচাইয়া শিবাজীকে বলিলেন, “কাটিতে হয় আমার মাথা কাট, হাত কাটিও না।” তখন মারাঠারা তাঁহার মাথায় টুপী খুলিয়া দেখিল যে, তিনি ইংরাজ; দণ্ডাজ্ঞা রদ হইল। পরে তিনশত পঞ্চাশ টাকা দিয়া তিনি মুক্ত হন। স্মিথ চোখে দেখিয়া শিবাজী-সম্বন্ধে একটি সুন্দর বর্ণনা লিখিয়া গিয়াছেন।
শিবাজীকে খুন করিবার ষড়যন্ত্র
ভীরু ইনাএৎ খাঁ দুর্গের মধ্যে লুকাইয়া থাকিয়া শিবাজীকে খুন করিবার এক ফন্দী আঁটিল। বৃহস্পতিবারে সন্ধির প্রস্তাবের ভাণ করিয়া সে একজন বলিষ্ঠ যুবক কর্ম্মচারীকে শিবাজীর নিকট পাঠাইল। সে যাহা দিতে চাহিল তাহা এত অসম্ভবরূপে কম যে, শিবাজী ঘৃণার সঙ্গে বলিলেন, “তোমার প্রভু স্ত্রীলোকের মত ঘরের মধ্যে লুকাইয়া রহিয়াছে। সে কি মনে করে আমিও স্ত্রীলোক যে তাহার এই হাস্যকর প্রস্তাবে সন্মত হইব?” যুবকটি উত্তর দিল, “আমরা স্ত্রীলোক নহি। আপনাকে আরও কিছু বলিবার আছে।” এই বলিয়াই সে কাপড়ের মধ্য হইতে লুকান ছোরা বাহির করিয়া সবেগে শিবাজীর দিকে ছুটিয়া গেল। একজন মারাঠা শরীর-রক্ষক তরবারির এক কোপে তাহার হাত কাটিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু যুবক বেগ থামাইতে পারিল না, হাতের সেই রক্তাক্ত কাটা কব্জা দিয়া শিবাজীকে আঘাত করিয়া দুজনে মাটিতে জড়াইয়া পড়িয়া গেল। শিবাজীর দেহে রক্তের দাগ দেখিয়া মারাঠারা চেঁচাইল—“সব বন্দীদের প্রাণ বধ কর” কিন্তু শীঘ্রই খুনী যুবককে হত্যা করা হইল, শিবাজী উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং বন্দীদের নিয়ে সামনে আনিতে বলিলেন। তাহার পর তাহাদের মধ্যে চারিনকে বধ করিয়া এবং চব্বিশজনের হাত কাটিয়া ফেলিয়া ক্ষান্ত হইলেন।
ইংরাজদের প্রশংসা ও পুরস্কার
রবিবার ১০ই জানুয়ারি রাতে দশটার পর মারাঠারা হঠাৎ সুরত হইতে চলিয়া গেল, এবং সন্ধ্যার মধ্যেই বারো মাইল দূরে পৌঁছিল, কারণ শিবাজী খবর পাইয়াছিলেন যে, একদল মুঘল-সৈন্য সুরতে আসিতেছে। এই দল ১৭ই তারিখে পৌঁছিলে, তবে ইনাএৎ খাঁ দুর্গের বাহিরে আসিতে সাহস পাইল। নগরবাসিগণ তাহাকে দেখিয়া ছি ছি করিতে লাগিল, কেহ বা কাদামাটি ছুঁড়িতে লাগিল। ইহাতে ইনাএতের পুত্র রাগিয়া একজন নির্দ্দোষ হিন্দু বানিয়াকে হত্যা করিল।
মুঘল-সৈন্যদল পৌঁছিবার পর ইংরাজবণিকগণ তাহার নেতাদের সঙ্গে দেখা করিলেন। শহরবাসীদের মুখে আর ইংরাজদের প্রশংসা ধরে না, তাহারা চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল, “এই সাহেবেরা নিজের কুঠীর আশপাশে আমাদের অনেকের বাড়ী রক্ষা করিয়াছেন। বাদশাহ ইহাদের পুরস্কার দিন।” নবাগত সেনাপতিও ইংরাজদের খুব ধন্যবাদ দিলেন। অক্সিণ্ডেন সাহেবের হাতে একটা পিস্তল ছিল, তিনি অমনি তাহা সেনাপতির সামনে রাখিয়া বলিলেন, “আমরা এখন অস্ত্র হাড়িয়া দিতেছি, কারণ ভবিষ্যতে আপনিই শহর রক্ষা করিবেন।” সেনাপতি শুনিয়া খুশী হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা, আমি ইহা লইলাম, কিন্তু আপনাকে এক খেলাৎ, অশ্ব ও তরবারি উপহার দিব।” চতুর বণিকরা উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে, না। ওসব জিনিস সৈন্যদের সাজে; আমরা বণিক মাত্র, বাণিজ্যের সুবিধা ভিন্ন আর কোন পুরস্কার আমরা চাহি না।” .
বাদশাহ সুরতের দুর্দ্দশায় ব্যথিত হইয়া এক বৎসরের জন্য সকলেরই মাশুল মাফ করিলেন, এবং তাহার উপর ইংরাজ ও ডচ্দের পুরস্কার স্বরূপ তাহাদের আমদানী দ্রব্যের মাশুল শতকরা এক টাকা কমাইয়া দিলেন। [এই অনুগ্রহ নবেম্বর ১৬৭৯ অবধি চলিয়াছিল।]