শিবাজী/পঞ্চম অধ্যায়
প ঞ্চ ম অ ধ্যা য়
জয়সিংহ ও শিবাজী
১৬৬৪ সালে যুদ্ধ ইত্যাদি
সুরত-লুঠের পর এক বৎসর পর্য্যন্ত মুঘল পক্ষে আর কিছুই কাজ হইল না। সুবাদার কুমার মুয়জ্জম্ (শাহ আলম্) আওরঙ্গাবাদে থাকিয়া আমোদ-প্রমোদে দিন কাটাইতে লাগিলেন। মহারাজা যশোবন্ত সিংহ রাঠোর, সিংহগড় দুর্গ অবরোধ করিয়া শেষে নিষ্ফল হইয়া ফিরিলেন (২৮ মে ১৬৬৪)। শিবাজীর দল নানা স্থানে লুঠতরাজ করিতে লাগিল; আজ মহারাষ্ট্র, কাল কানাড়ায়, পরশু পশ্চিম তীরদেশে। লোকে ভয়ে বিস্ময়ে বলিতে লাগিল, “শিবাজী মানুষ নহেন, তাঁহার বায়বীয় শরীর আছে, ডানা আছে। নচেৎ, তিনি কিরূপে একই সময়ে এত দূর দূর বিভিন্ন স্থানে যাইতে পারিতেছেন?” “তিনি সর্ব্বদাই অসীম ক্লেশ সহ্য করিয়া দ্রুত কুচ করিতেছেন, এবং তাঁহার কর্ম্মচারীদেরও সেইমত চালাইয়া লইয়া যাইতেছেন। সমস্ত দেশময় রাজারা তাঁহার ত্রাসে কম্পমান। দিন দিন তাঁহার শক্তি বাড়িতেছে।” [ইংরাজ-কুঠীর চিঠি]
এই সময়, ২৩এ জানুয়ারি ১৬৬৪, ঘোড়া হইতে পড়িয়া শাহজীর মৃত্যু হইল। তাঁহার যত অস্থাবর সম্পত্তি এবং মহীশূর ও পূর্ব্ব-কর্ণাটকের জাগীর শিবাজীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ব্যঙ্কাজী (অথবা একোজী) অধিকার করিলেন।
উপর্য্যুপরি এইসব ক্ষতি ও লজ্জাকর পরাজয় ভোগ করিয়া, আওরংজীব অনেক ভাবিয়া শিবাজীকে দমন করিবার জন্য মীর্জা রাজা জয়সিংহ কাছোয়া (আম্বের, অর্থাৎ বর্ত্তমান জয়পুর-রাজ্যের অধিপতি)-কে নিযুক্ত করিলেন (৩০ সেপ্টেম্বর ১৬৬৪)। তাঁহার সঙ্গে বিখ্যাত পাঠানবীর দিলির খাঁ, আরব সেনানী দাউদ খাঁ, সুজন সিংহ বুন্দেলা ও অন্যান্য সেনাপতি এবং চৌদ্দ হাজার সৈন্য দেওয়া হইল।
জয়সিংহেব চরিত্র
জয়সিংহ মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের একটি অদ্বিতীয় পুরুষ। রাজপুত বলিলে আমরা সচরাচর বুঝি, কোন অসীমসাহসী, মান্যপ্রিয়, ধন ও স্বার্থে নিস্পৃহ, গোঁয়ারগোবিদ বীর ও ত্যাগী। জয়সিংহ যুদ্ধপটু ভয়হীন তেজী পুরুষ হইলেও সেই সঙ্গে কুটনীতিতে, সভ্যতা-ভব্যতায়, লোকজনকে হাত করিয়া কাজ হাসিল করিবার ক্ষমতাতেও কম পরিপক্ক ছিলেন না। ফলতঃ সম্ভ্রান্ত রাজপুত ও মুঘল—এই দুই শ্রেণীরই সব গুণগুলি তাঁহার মধ্যে একাধারে ছিল। বারো বৎসর বয়সে এই পিতৃহীন বালক মুঘলসেনাবিভাগে প্রবেশ করেন (১৬১৭); তাহার পর জাহাঙ্গীরের শেষকাল এবং শাহজাহানের সমগ্র রাজত্বের ইতিহাস তাঁহার কীর্ত্তিতে উজ্জ্বল। সুদুর আফঘানিস্থানের কান্দাহার হইতে পূর্ব্ব প্রান্তে মুঙ্গের পর্যন্ত, আর উত্তরে অক্শশ্, নদীর তীর হইতে দাক্ষিণাত্যে বিজাপুর পর্যন্ত, সর্ব্বত্রই মুঘল-সৈন্য লইয়া তিনি লড়িয়াছেন এবং সর্ব্বত্রই যশ লাভ করিয়াছেন। রাজনীতির চাল চালিতেও কম দক্ষ ছিলেন না। বাদশাহ সব বিপদে, সব কঠিন কাজে জয়সিংহের উপর নির্ভর করিতেন।
এই ষাট বৎসর বয়সের প্রবীণ নেতা আজ দক্ষিণাত্যের এক জাগীরদারের পুত্রকে দমন করিতে আসিলেন। কিন্তু তাঁহার ভাবনার অন্ত ছিল না। কি মুঘল, কি বিজাপুরী সেনানী, কেহই শিবাজীকে এ পর্য্যত পরাস্ত করিতে পারেন নাই; শায়েস্তা খাঁ, যশোবন্ত পর্য্যন্ত হারিয়া গিয়াছেন। তাহার পর, উত্তর-ভারত হইতে প্রবল সৈন্যদল আসিলে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানদ্বয় মুঘলের ভয়ে শিবাজীর সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, সুতরাং জয়সিংহকে সেদিকেও দৃষ্টি রাখিতে হইবে। তিনি সত্য কথাই বাদশাহকে লিখিলেন, “আমি দিনরাতের মধ্যে এক মুহুর্ত্তের জন্যও বিশ্রাম ভোগ করি না, অথবা যে-কাজ হাতে লইয়াছি তাহার জন্য না ভাবিয়া থাকি না।”
মারাঠা-যুদ্ধের জন্য জয়সিংহের বন্দোবস্ত ও ফন্দী
কিন্তু বাধা-বিপত্তিই প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরীক্ষা করে। জয়সিংহ অতিশয় চাতুরী ও দক্ষতার সহিত ভাবী যুদ্ধের সব বন্দোবস্ত করিলেন। প্রথমতঃ তিনি নিজ পক্ষে যথাসম্ভব লোক আনিতে এবং শিবাজীর শত্রুদিগকে উত্তেজিত করিতে লাগিলেন। পুণায় পৌঁছিবার আগেই জানুয়ারি মাসে তিনি মুঘল-রাজ্যের বাসিন্দা দুইজন পোর্তুগীজ কাপ্তেন ফ্রান্সিস্কো এবং ডিওগো ডি মেলো’কে গোয়ার পোর্তুগাল-রাজপ্রতিনিধির নিকট পাঠাইয়া শিবাজীর নৌবল আক্রমণ করিবার জন্য সাহায্য চাহিলেন। জঞ্জিয়ার হাব্শী সর্দ্দার সিদ্দিকেও সেই মর্ম্মে পত্র লেখা হইল। বিদনুর, বাসবপটন, মহীশূর প্রভৃতি প্রদেশে হিন্দু রাজাদে নিকট জয়সিংহের ব্রাহ্মণ-দূতগণ গিয়া অনুরোধ করিল যে, এই সুযোগে তাঁহারা পুরাতন শত্রু বিজাপুর-রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা আক্রমণ করুন। কোঁকনের উত্তরে কোলী-দেশের ছোট ছোট সামন্তদিগকে মুঘলপক্ষে আনিবার জন্য জয়সিংহের তোপখানার ফিরিঙ্গী সেনানী নিকোলো মানুশীকে পাঠান হইল।
দ্বিতীয়তঃ, যাহাদের সঙ্গে শিবাজীর কোন সময়ে শত্রুতা ছিল, সিংহ তাহাদের ডাকিয়া নিজ সৈন্যদলে স্থান দিলেন। মৃত আফজল খাঁর পুত্র এবং চন্দ্র রাও মোরের পুত্র বাজী চন্দ্ররাও পিতৃহত্যার প্রতিহিংসা লইবার এই সুযোগ ছাড়িল না। সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকা এবং মুঘল-রাজ্যে উচ্চ পদলোভের লোভ দেখাইয়া শিবাজীর কোন কোন কর্ম্মচারীকে ভাঙ্গাইয়া আনা হইল।
তাহার পর বিজাপুররাজকে লোভ ও ভয় দেখান হইল; যদি তিনি সত্যসত্যই মুঘলদের সাহায্য করেন তবে বাদশাহ আর তাঁহাকে শিবাজীর গোপন সহায়ক বলিয়া সন্দেহ করিবেন না এবং বার্ষিক করের টাকাও কিন্তু মাফ করিতে পারেন, এই আশ্বাস দেওয়া হইল। কিন্তু জয়সিংহের কৃতিত্বের সর্ব্বোচ্চ দৃষ্টান্ত এই যে, তিনি নিজে যে প্রণালীতে যুদ্ধ চালাইবেন স্থির করিয়াছিলেন তাহাতে বাদশাহর প্রথম আপত্তি কাটাইয়া দিয়া অনুমোদন লাভ করিতে সক্ষম হইলেন। কথাটা বুঝাইয়া দিতেছি। তাঁহার পুণায় পৌছিতে মার্চ্চ মাস আসিল, আর জুলাই হইতে বৃষ্টি আরম্ভ হইলে যুদ্ধ চালান অসম্ভব হইবে; সুতরাং শিবাজীকে পরাস্ত করিতে হইলে ইহার মধ্যবর্ত্তী তিন মাসেই সে কাজটি সম্পূর্ণ করা দরকার, নচেৎ আবার আটমাস বসিয়া থাকিতে হইবে। এজন্য জয়সিংহ স্থির করিলেন, সমস্ত বল সংগ্রহ করিয়া সবেগে মারাঠারাজ্যের কেন্দ্রে প্রচণ্ড আঘাত করিবেন, অন্যত্র যাইবেন না, বা সৈন্য চারিদিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া শক্তি হানি করিবেন না। বাদশাহ তাঁহাকে ধনশালী উর্ব্বর কোঁকন প্রদেশ আক্রমণ করিতে বারবার বলেন, কিন্তু জয়সিংহ দৃঢ়তার সহিত তাহা অস্বীকার করেন এবং এই যুক্তি দেন যে, মহারাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ড পুণা অঞ্চল নিষ্কণ্টক করিয়া হাত করিতে পারিলেই কোঁকন প্রভৃতি দূরের অঙ্গগুলি আপনা হইতে বশে আসিবে।
সর্ব্বশেষে জয়সিংহ বলিলেন যে, যুদ্ধে দুই-তিনজন প্রধানের হাতে মমতা ভাগ করিয়া দিলে, একমাত্র সর্বোচ্চ সেনাপতির কর্ত্ত্রৃত্বে সকলকে না রাখিলে, জয়লাভ অসম্ভব। বাদশাহ এই সৎ যুক্তি মানিয়া লইলেন এবং আজ্ঞা দিলেন যে, সৈন্য-বিভাগের সমস্ত নিয়োগ, কর্ম্মচ্যুতি, উন্নতি অবনতি, রসদ ও তোপ, সন্ধি করা ও ঘুষ দেওয়া,—সকল কাজেই একমাত্র জয়সিংহের হুকুম চলিবে, আওরঙ্গাবাদের সুবাদার কুমার মুয়জ্জমের নিকট কোন বিষয়ে মঞ্জুরী লওয়া বা আপিল করার প্রয়োজন হইবে না।
পুবন্দর-দুর্গ অবরোধ
দিল্লী হইতে বিদায় লইয়া, সৈন্যসহ দ্রুত কুচ করিয়া, পথের কোথাও অনাবশ্যক একদিনের জন্যও বিশ্রাম না করিয়া জয়সিংহ ৩রা মার্চ্চ পুণায় পৌছিলেন। প্রথমেই পুরন্দর আক্রমণ করা সাব্যস্ত করিলেন।
পুণা শহরের চব্বিশ মাইল দক্ষিণে পুরন্দর-দুর্গ। ইহাকে দুর্গ না বলিয়া সুরক্ষিত মহান্ গিরিসমষ্টি বলিলেই ঠিক হয়। নিজ পুরন্দরের চুড়া সমভূমি হইতে দুই হাজার পাঁচশত ফীট উঁচু; ইহাই বালা-কেল্লা বা উপরের দুর্গ, চারিপাশ খাড়া পাথর কাটা। আর ইহার তিনশত ফীট নীচে পাহাড়ের গা বাহিয়া নীচের দুর্গ (মারাঠ ভাষায় মাচী বলা হয়)। এই মাচীতে সৈন্যদের থাকিবার ঘর ও কার্য্যালয়, কারণ এটি বেশ প্রশস্ত। পূর্ব্বদিকে মাচীর কোণ হইতে এক মাইল লম্বা একটি সরু পাহাড়, তাহার শেষভাগ দেওয়ালে ঘেরা রুদ্রমালা বা বজ্রগড় নামে অপর একটি দুর্গ। এই বজ্রগড় হইতে মাচীর উপর গোলা বর্ষণ করিয়া সহজেই সেখান হইতে শত্রুদের তাড়াইয়া দেওয়া যায়।
পুণায় থাকিবার সময় আবশ্যক মত নানা স্থানে অল্প অল্প সৈন্য দিয়া থানা বসাইয়া জয়সিংহ নিজ পথঘাট রক্ষা করিলেন; তাহার পর ২৩ মার্চ্চ রওনা হইয়া ৩০এ তারিখে পুরন্দরের সামনে আসিয়া পৌঁছিলেন। পরদিন হইতে রীতিমত দুর্গ অবরোধ আরম্ভ হইল। বিভিন্ন বাদশাহী সেনাপতিরা নিজ দলবল সহিত পুরন্দরের নানা দিকে আড্ডা করিয়া মুর্চা খুঁড়িয়া দুর্গের উপর তোপ দাগিবার চেষ্টা করিলেন। দিন-দশের মধ্যেই সৈন্যদের অক্লান্ত চেষ্টায় এবং জয়সিংহের নিয়ত তত্ত্বাবধান এবং উৎসাহদানের ফলে তিনটি খুব বড় কামান একটি উচ্চ পাহাড়ের উপর টানিয়া তোলা হইল এবং রুদ্রমালের বুরুজের উপর ভারি ভারি গোলাবর্ষণ শুরু হইল। তাহার ফলে বুরুজের সামনের দেওয়াল ভাঙ্গিয়া গিয়া একটি প্রবেশের পথ দেখা দিল।
রুদ্রমাল ও বুরুজ জয় হইল
১৩ই এপ্রিল দুপুর বেলা দিলির খাঁ হঠাৎ আক্রমণ করিয়া এই বুরুজটি দখল করিলেন; মারাঠারা হটিয়া গিয়া মধ্যের একটি দেওয়াল-ঘেরা স্থানে আশ্রয় হইল। পরদিন বৈকালে মুঘল ও রাজপুতদের বন্দুকের গুলিতে অতিষ্ঠ হইয়া মারাঠারা সমস্ত রুদ্রমাল ছাড়িয়া দিল। জয়সিংহ তাহাদের প্রাণদান করিলেন। এবং তাহাদের নেতাদের সম্মানসূচক পোষাক দিয়া বাড়ী ফিরিতে অনুমতি দিলেন।
তাহার পর (২৫ এপ্রিল) দায়ূদ খাঁর অধীনে ছয় হাজার সৈন্য দিয়া তাঁহাকে মহারাষ্ট্রের চারিদিকে গ্রাম লুটিতে পাঠাইলেন। আর কুতবুদ্দীন খাঁ এবং লোদী খাঁকেও নিজ নিজ থানা হইতে বাহির হইয়া নিকটের গ্রাম লুটিতে এবং গরুবাছুর কৃষক বন্দী করিতে আজ্ঞা দিলেন। ইহার ফলে শিবাজীর প্রজাদের সমূহ ক্ষতি ও তাঁহার দেশের স্থায়ী অনিষ্ট হইল।
সম্মুখে এবং চারি পাশে এইরূপ বিপদ দেখিয়া মারাঠারা পুরন্দর অবরোধকারীদের তাড়াইয়া দিবার নানা চেষ্টা করিল। মুঘল-প্রদেশের স্থানে স্থানে দ্রুতবেগে আক্রমণ করিল। কিন্তু জয়সিংহ পুরন্দর হইতে নড়িলেন না, দূরে আক্রান্ত স্থানগুলিকে রক্ষা করিবার জন্য কিছু কিছু অশ্বারোহী পাঠাইলেন মাত্র। মুঘলদের অনেক ক্ষতি হইল বটে, কিন্তু আসল কাজ পুরন্দর-অবরোধের কোন বাধা হইল না,সেখানে রসদ আসিতে লাগিল এবং শিবির ও সৈন্যদল নিরাপদ রহিল।
বজ্রগড় জিতিবার পরই দিলির খাঁ সেখান হইতে ঐ লম্বা পর্ব্বত রাহিয়া পশ্চিম দিকে আসিয়া পুরন্দরের উত্তর পূর্ব কোণের উচ্চ বুরুজের (নাম ‘খড়কালা’র) কাছে পৌঁছিয়া নীচের দুর্গের (মাচীর) উপর গোলা ফেলিতে লাগিলেন। মারাঠারা দুই হইবার রাত্রে বাহির হইয়া আসিয়া এইখানের মুর্চাগুলি আক্রমণ করিল বটে, কিন্তু তাহাদের পরাস্ত হইয়া ফিরিতে হইল।
ক্রমে ক্রমে মুঘলদের মুর্চা পুরন্দরের “সাদা বুরুজ”দুটির নিম্নে আসিয়া পেীছিল; কিন্তু তখনও দেওয়াল খাড়া ছিল, তাহার উপর হইতে মারাঠারা নীচে জ্বলন্ত আলকাতরা, বারুদের থলি, বোমা এবং পাথর ফেলিয়া অবরোধকারীদের আর অগ্রসর হইতে দিল না। তখন সিংহ একটি উচু কাঠের রথ প্রস্তুত করিয়া সাদা বুরুজের সামনে খাড়া করিলেন (৩০এ মে); তাহার উপর হইতে কামান দাগা হইবে, এবং বন্দুক ছুঁড়িয়া দেওয়াল হইতে রক্ষাকারীদের হটাইয়া দেওয়া হইবে, আর শত্রুদের গুলি রোধ করিবার জন্য রথের সম্মুখে কাঠের আবরণ থাকিবে।
এই রথ সম্পূর্ণ হইবার আগেই, সন্ধ্যার দুঘণ্টা মাত্র বাকী আছে এমন সময়, দিলির খাঁকে না জানাইয়াই রুহিলা সৈন্যদল “সাদা বুরুজ” আক্রমণ করিল। শত্রুরা তাহাদের মারিতে লাগিল, কিন্তু শীঘ্রই মুঘলপক্ষ হইতে আরও লোক আসায় ভীষণ যুদ্ধের পর মুঘলদের জয় হইল, তাহারা সাদা বুরুজ দখল করিল, মারাঠারা “কাল বুরুজের” পিছনে হটিয়া গিয়া বোমা, পাথর ইত্যাদি ছুঁড়িতে লাগিল। কিন্তু মুঘলেরা নড়িল না। তাহার দুইদিন পরে, মুঘল-তোপের আওয়াজ সহ্য করিতে না পারিয়া মারাঠারা কাল বুরুজও ছাড়িয়া দিল। এইরূপে ক্রমে পাঁচটি বুরুজ এবং একটি কাঠগড়া (ষ্টকেড্) বাদশাহী সৈন্যদের হাতে পড়িল।
পুরন্দরে মারাঠাদের লোকনাশ ও বিপদ
এখন আর পুরন্দর রক্ষা করা অসম্ভব। ইহার পূর্ব্বেই একদিন দুর্গস্বামী মুরার বাজী প্রভু (কায়স্থ) নিজ মাব্লে পদাতিক লইয়া দিলির খাঁর পাঠানদের উপর মরিয়া হইয়া পড়িয়াছিলেন। দুই পক্ষে অনেকে হতাহত হইল; মুরার বাজীর তরবারির সম্মুখে কেহ দাঁড়াইতে পারিল না,অবশেষে ষাটজন মাত্র লোক সঙ্গে লইয়া তিনি দিলির খাঁকে আক্রমণ করিলেন। দিলির তাঁহার বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া চেঁচাইয়া বলিলেন, “সৈন্যগণ। উহাকে কেহ মারিও না। আর মুরার। তুমি ধরা দাও, তোমাকে উচ্চ পদ দিব।” কিন্তু মুরার থামিলেন না, তখন দিলির তাঁহাকে তীর দিয়া বধ করিলেন। মুরারের সঙ্গে তিনশত মাব্লে ধরাশায়ী হইল; পাঠান-পক্ষে পাঁচশতজন। কিন্তু তবুও মারাঠাদের সাহস কমিল না; তাহারা বলিতে লাগিল, “এক মুরার বাজী মারা গিয়েছে ত কি হইল? আমরাও তাহার সমান, যতক্ষণ প্রাণ থাকিবে যুদ্ধ চালাইব।”
কিন্তু জয়সিংহের অধ্যবসায় এবং দুইমাস অবিশ্রান্ত যুদ্ধের ফলে পুরন্দর-রক্ষীদের অনেক বলক্ষয় হইল। যখন রুদ্রমল গেল, পাঁচটি বুরুজ ও একটি কাঠগড়া গেল, তখন সমগ্র দুর্গটি হস্তচ্যুত হইবার দিন ঘনাইয়া আসিল। শিবাজী দেখিলেন, এখন সন্ধি না করিলে মুঘলেরা বলে পুরন্দর অধিকার করিবে এবং সেখানে যে সমস্ত মারাঠা কর্ম্মচারী আশ্রয় লইয়াছিল তাহাদের বধ এবং তাহাদের স্ত্রীলোকদের ধর্ম্মনাশ করিবে। আর বাহিরেও দায়ুদ খাঁ প্রতিদিন তাঁহার গ্রাম ধ্বংস করিতেছেন।
জয়সিংহ পুণায় পৌঁছিবার আগেই শিবাজী ক্রমাগত তাঁহার কাছে ব্রাহ্মণ-দূত ও চিঠি পাঠাইতেছিলেন, কিন্তু জয়সিংহ তাহার কোন উত্তর দেন নাই, কারণ তিনি জানিতেন যে, যতক্ষণ শিবাজীকে বাহুবলে জব্দ করা না যাইবে ততক্ষণ তিনি সত্যসত্যই বশ মানিবেন না। কিন্তু ২০এ মে শিবাজীর পণ্ডিত রাও (অর্থাৎ দানাধ্যক্ষ) রঘুনাথ বল্লাল আসিয়া গোপনে জয়সিংহকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি পাইলে সন্ধি করিতে প্রস্তুত?” মুঘল-প্রতিনিধি উত্তর করিলেন,“শিরাজী স্বয়ং আসিয়া বিনা শর্ত্তে আত্মসমর্পণ করিবেন, তাহার পর তাঁহার প্রতি বাদশাহর অনুগ্রহ দেখান হইবে।”
শিবাজী-জয়সিংহের সাক্ষাৎ
এই কথা শুনিয়া শিবাজী জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন যে,তাঁহার পুত্র শম্ভুজী আসিয়া বশ্যতা স্বীকার করিলে চলিবে কি? জয়সিংহ উত্তর দিলেন, “না, শিবাজীকে নিজে আসিতে হইবে।” অবশেষে শিবাজী চাহিলেন যে, তিনি সাক্ষাৎ করিতে আসিবার পর সন্ধি হউক বা না হউক, তাঁহাকে নিরাপদে ফিরিয়া যাইতে দেওয়া হইবে বলিয়া জয়সিংহ ধর্ম্ম-শপথ করুন। জয়সিংহ তাহাই করিলেন এবং বলিয়া পাঠাইলেন, শিবাজী যেন অতি গোপনে আসেন, কারণ বাদশাহ রাগিয়া আজ্ঞা দিয়াছেন যে, তাঁহার সহিত সন্ধির কোন কথাবার্ত্তা না বলিয়া নির্ম্মম যুদ্ধ চালাইতে হইবে।
এই বন্দোবস্ত করিয়া ৯ই জুন রঘুনাথ পণ্ডিত নিজ প্রভুর নিকট ফিরিলেন। ১১ই তারিখে বেলা এক প্রহর হইয়াছে, জয়সিংহ নিজ শিবিরে দরবার করিতেছেন, এমন সময় রঘুনাথ আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, শিবাজী শুধু ছয়জন ব্রাহ্মণ সঙ্গে লইয়া পালকী করিয়া অতি নিকটে পৌঁছিয়াছেন। জয়সিংহ তৎক্ষণাৎ তাঁহার মুন্সী উদয়রাজ এবং জ্ঞাতি উগ্রসেন কাছোয়াকে শিবাজীর নিকট পাঠাইয়া দিয়া জানাইলেন, “যদি আপনার সব দুর্গগুলি সমর্পণ করিতে প্রস্তুত থাকেন তবে আসুন, নচেৎ ঐখান হইতেই ফিরিয়া যান।” শিবাজী “আচ্ছা! আচ্ছা!” বলিয়া উহাদের সঙ্গে আসিলেন। শিবির-দ্বারে পৌঁছিলে, জয়সিংহের সর্ব্বপ্রধান সৈনিক কর্ম্মচারী বখ্শী তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া ভিতরে আনিলেন। রাজপুত রাজা স্বয়ং কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া শিবাজীকে আলিঙ্গন করিলেন এবং হাতে ধরিয়া নিজের পাশে গদীর উপর বসাইলেন। তাঁহার রাজপত রক্ষিগণ তরবার ও বল্লম হাতে করিয়া চারিদিকে সতর্ক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, কি জানি যদি বা আবার আফজল খাঁর মত কাণ্ড হয়!
চতুর জয়সিংহ শিবাজীকে শিক্ষা দিবার জন্য একটি অভিনয়ের বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। পূর্ব্বদিন তিনি দিলির খাঁ ও কীরত সিংহকে হুকুম দিয়াছিলেন যে, তাঁহার তাম্বু হইতে সঙ্কেত-চিহ্ন দেখিলেই তাঁহারা মুর্চা হইতে ছুটিয়া অগ্রসর হইয়া পুরন্দরের খড়কালা নামক অংশ দখল করিবেন। শিবাজী পৌঁছামাত্র জয়সিংহ সেই সঙ্কেত করিলেন, আর মুঘলেরা লড়িয়া ঐ স্থানটি দখল করিল, আশীজন মারাঠা মারা গেল, আরও অনেক জখম হইল। এই যুদ্ধ জয়সিংহের তাম্বুর ভিতর হইতে পরিষ্কার দেখা যাইতে লাগিল। শিবাজী ঘটনাটা কি তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইয়া বলিলেন, “আর বৃথা আমার লোকহত্যা করিবেন না, যুদ্ধ বন্ধ করুন, আমি এখনই পুরন্দর ছাড়িয়া দিতেছি।” তখন জয়সিংহ তাঁহার মীরতুজুক বাজীবেগকে পাঠাইয়া দিলির খাঁকে রণে ক্ষান্ত হইতে হুকুম দিলেন; সেই সঙ্গে শিবাজীও নিজ কর্ম্মচারী পাঠাইয়া মারাঠা দুর্গস্বামীকে পুরন্দর সমর্পণ করিতে বলিলেন। দুর্গবাসী জিনিসপত্র গুছাইতে একদিন সময় চাহিল।
পুন্দরের সন্ধির শর্ত
শিবাজী বিছানা আসবাবপত্র কিছুই সঙ্গে না লইয়া একেবারে খালি হাতে আসিয়াছিলেন। সেজন্য জয়সিংহ তাঁহাকে অতিথি করিয়া নিজ দরবার-তাম্বুতে বাসা দিলেন। দুপুর রাত্রি পর্য্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধির শর্ত্ত লইয়া দর কষাকষি চলিতে লাগিল। জয়সিংহ প্রথমে কিছুই ছাড়িবেন না, অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল যে, শিবাজীর তেইশটি দুর্গ এবং তদসংলগ্ন সমস্ত জমি (যাহার বার্ষিক খাজনা চারিলক্ষ হোণ অর্থাৎ বিশ লক্ষ টাকা) বাদশাহ পাইবেন, আর বারোটি দুর্গ (এবং তদসংলগ্ন এক লক্ষ হোণের জমি) শিবাজীর থাকিবে। কিন্তু শিবাজী বাদশাহর প্রজা বলিয়া নিজেকে মানিবেন এবং তাঁহার অধীনে কার্য্য করিবেন।
তবে এক বিষয়ে শিবাজীকে অপমান হইতে রক্ষা করা হইল। তাঁহাকে নিজে মন্সবদার হইয়া সৈন্য লইয়া বাদশাহর বা দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির দরবারে হাজির হইতে হইবে না, তাঁহার পুত্র পাঁচ হাজারী জাগীরের অনুযায়ী (প্রকৃতপক্ষে দুই হাজার) সৈন্য লইয়া উপস্থিত থাকিবেন। উদয়পুরের মহারাণাকেও এই অনুগ্রহ দেখান হইত। জয়সিংহ জানিতেন যে, বেশী কড়াকড়ি করিলে শিবাজী হতাশ হইয়া বিজাপুরের সঙ্গে যোগ দিবেন।
পরস্পরের সন্ধিতে আর একটি গোপনীয় শর্ত্ত ছিল। কোঁকন অর্থাৎ পশ্চিমঘাট এবং সমুদ্রের মধ্যবর্ত্তী অতি লম্বা সরু কিন্তু ধনজনপূর্ণ প্রদেশ বিজাপুরের অধীন ছিল। শীঘ্রই বাদশাহ বিজাপুর-রাজ্য আক্রমণ করিবেন। তখন শিবাজী বিজাপুরের হাত হইতে তলভূমি (তল্-কোঁকন বা বিজাপুরী পাইন্-ঘাট)-র চারি সরু হোণ আয়ের জমি এবং অধিত্যকা (অর্থাৎ বিজাপুরী বালাঘাট -এর পাঁচলক্ষ হোণ আয়ের জমি নিজ সৈন্য দ্বারা কাড়িয়া লইবেন, এবং বাদশাহ ইহাতে তাঁহার অধিকার স্বীকার করিবেন, কিন্তু তজ্জন্য শিবাজী তাঁহাকে চল্লিশ লক্ষ হোণ (অর্থাৎ দুই কোটি টাকা) তের কিস্তিতে সেলামী দিবেন। এইরূপে জয়সিংহের কুটনীতির ফলে শিবাজী ও আদিল শাহর মধ্যে স্থায়ী কলহের বীজ রোপিত হইল।
শিবাজী মুঘলরাজের বাধ্যতা স্বীকার করিলেন
দিলির খাঁ প্রাণপণ পরিশ্রম এবং রক্তপাত করিয়া পুরন্দরের অনেক অংশ দখল করিয়াছেন, আর এদিকে শিবাজী আসিয়া চুপ করিয়া দুর্গটি জয়সিংহের হাতে হাড়িয়া দিয়া খাঁকে গৌরব হইতে বঞ্চিত করিলেন। তিনি রাগিয়া বলিলেন যে, সন্ধিতে রাজি হইবেন না, শেষ অবধি মারাঠাদের ধ্বংস করিবেন। সুতরাং জয়সিংহ পরদিন (১২ই জুন) শিবাজীকে হাতীতে চড়াইয়া নিজ কর্ম্মচারী রাজা রায়সিংহ শিশোদিয়ার সহিত দিলির খাঁর নিকট পাঠাইয়া দিলেন। এই নম্রতায় দিলির খাঁ আপ্যায়িত হইলেন। তিনি শিবাজীকে নানা উপহার দিয়া সঙ্গে করিয়া জয়সিংহের তাঁবুতে ফিরাইয়া আনিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া রাজপুত রাজার হাতে সঁপিয়া দিলেন। মুঘল সৈন্যগণ হাতীর উপর শিবাজীকে দেখিয়া বুঝিল যে, সত্যসত্যই তাহাদের সম্পূর্ণ জয় হইয়াছে।
তাহার পর জয়সিংহ শিবাজীকে খেলাৎ পরাইয়া তাঁহার কোমরে নিজের তরবারি বাঁধিয়া দিলেন, কারণ শিবাজী সন্ধি করিবার জন্য নিরস্ত্র হইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি ভদ্রতার খাতিরে কিছুক্ষণ তরবারিটা পরিয়া পরে কোমর হইতে খুলিয়া জয়সিংহের সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন, “আমি বাদশাহর বাধ্য কিন্তু অস্ত্রহীন দাস হইয়া তাঁহার কাজ করিব।”
এইদিন মারাঠারা পুরন্দর-দুর্গ ছাড়িয়া দিল; তাহাদের চারি হাজার সৈন্য এবং তিন হাজার স্ত্রীলোক বালক ও চাকর বাহির হইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু সমস্ত অস্ত্র গোলা বারুদ ও সম্পত্তি বাদশাহর জব্ৎ হইল। অপরাপর দুর্গ সমর্পণ করিবার জন্য শিবাজী মুঘল-কর্ম্মচারীদের সহিত নিজ চাকর পাঠাইয়া দিলেন। ১৪ই জুন, জয়সিংহের নিকট হইতে একটি হাতী ও দুইটি ঘোড়া উপহার পাইয়া শিবাজী বিদায় লইলেন। ১৮ই তারিখে তাঁহার পুত্র শম্ভুজী রাজগড় হইতে আসিয়া জয়সিংহের শিবিরে পৌঁছিলেন।
এইরূপে জয়সিংহ আশ্চর্য্য জয়লাভ করিলেন।
বিজাপুর-আক্রমণে শিবাজীর সহায়তা ও কীর্ত্তি
পুরন্দরের সন্ধির শর্ত্তগুলি জানিয়া এবং শিবাজী নিজ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ মাত্রায় পালন করিয়াছেন এই সংবাদ পাইয়া, বাদশাহ অত্যন্ত তুষ্ট হইয়া সব প্রার্থনা মঞ্জুর করিলেন এবং নিজ পাঞ্জা-অঙ্কিত (অর্থাৎ হাতের আঙ্গুলগুলি সিন্দুরে ডুবাইয়া কাগজের উপর ছাপ দেওয়া) এক ফর্ম্মান্ (বা বাদশাহর নিজের জবানীতে লিখিত ও সহি করা পত্র) এবং একপ্রস্থ খেলাৎ শিবাজীর জন্য পাঠাইয়া দিলেন। এগুলি ৩০এ সেপ্টেম্বর জয়সিংহের শিবিরের নিকট পৌছিল। শিবাজী জয়সিংহের আহ্বানে কয়েক মাইল হাঁটিয়া অগ্রসর হইয়া বাদশাহী ফর্ম্মানকে পথে অভ্যর্থনা করিলেন এবং পত্রখানি মাথার উপর ধরিলেন। (ইহাই সে যুগের প্রথা ছিল।) সন্ধির পর হইতে এই সাড়ে তিন মাস শিবাজী অস্ত্রধারণ ত্যাগ করিয়াছিলেন, কারণ তিনি বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া অপরাধী হইয়াছেন, যতক্ষণ পর্য্যন্ত বাদশাহর ক্ষমা না পাওয়া যায় ততক্ষণ জেলখানার কয়েদীর মত তাঁহাকে নিরস্ত্র থাকিতে হইবে। এখন ফর্ম্মান পাইবামাত্র জয়সিংহ তাঁহাকে জোর করিয়া নিজের একখানি মণিখচিত তরবারি এবং ছোরা পরাইয়া দিলেন।—যেন শিবাজীর বিদ্রোহের প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হইল।
ইহার পর জয়সিংহ নিজ বিজয়ী সেনা লইয়া বিজাপুর-রাজ্য আক্রমণ করিবেন। কথা ছিল, শিবাজী নিজ পুত্রের মন্সবের দুই হাজার অশ্বারোহী এবং অতিরিক্ত সাত হাজার মাব্লে পদাতিক লইয়া স্বয়ং জয়সিংহের সহায়তা করিবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে দুই লক্ষ টাকা অগ্রিম দেওয়া হইল। অবশেষে ২০ নবেম্বর ১৬৬৫ জয়সিংহ বিজাপুর অভিযানে রওনা হইলেন। শিবাজী এবং তাহার সেনাপতি নেতাজী পালকরের অধীনে নয় হাজার মারাঠা-সৈন্য মুঘলদলের মধ্যবিভাগের বাম পাশে স্থান পাইল।
যাইতে যাইতে শিবাজীর ডাকে বিনাযুদ্ধে, বিজাপুরের অধীন কয়েকটি দুর্গ পাওয়া গেল (যথা—ফল্টন্, থাথ্বড়া, খাটাব এবং মঙ্গলভিড়ে)। এই শেষ স্থান হইতে বিজাপুর শহর বাহান্ন মাইল দক্ষিণে। ইহার অর্দ্ধেক পথ পার হইতেই বিজাপুরী সৈন্যদল মুঘলদের গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইল। কয়েক বার অতি ভীষণ যুদ্ধ হইল। শিবাজী ও নেতাজী প্রাণপণে মুঘলপক্ষে লড়িলেন, আর শত্রুদের দলে শিবাজীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ব্যঙ্কাজী বীরত্ব দেখাইলেন। একদিন শিবাজী ও জয়সিংহের পুত্র কীরত সিংহ এক হাতীতে চড়িয়া মুঘল-অগ্রবাহিনী সৈন্য লইয়া বিজাপুরীদল ভেদ করিলেন, আর একদিন নেতাজী অদম্য সাহসে মুঘল-সৈন্যের ফিরিবার সময় পশ্চাদ্ভাগ শত্রু-আক্রমণ হইতে রক্ষা করিলেন।
এইরূপে অগ্রসর হইয়া ২৯এ ডিসেম্বর জয়সিংহ বিজাপুর-দুর্গের দশ মাইল উত্তরে পৌঁছিলেন। কিন্তু এখানে তাঁহার গতিরোধ হইল, এখান হইতে সাত দিন পরে তাঁহাকে বাধ্য হইয়া ফিরিতে হইল। বিজাপুর-রাজসভার কর্ম্মচারী ও ওমরাহদের মধ্যে ঝগড়ায় সুযোগে তিনি তাহাদের অনেককে ঘুষ দিয়া হাত করিয়াছিলেন, সুতরাং এই সময় রাজধানী হঠাৎ আক্রমণ করিলে মদ্যপায়ী অকর্ম্মণ্য যুবক রাজা কোনই বাধা দিতে পারিবেন না, বিনা অবরোধে বিজাপুর-দুর্গ অধিকার করা যাইবে এই আশায় জয়সিংহ বড় বড় তোপ এবং দুর্গজয়ের অন্যান্য উপকরণ সঙ্গে আনেন নাই। কিন্তু কাছে পৌঁছিয়া তিনি শুনিলেন যে, আদিল শাহর বীর সেনানীগণ দুর্গরক্ষার সমস্ত জোগাড় করিয়া, বিজাপুরের চারিদিকে সাত মাইল পর্য্যন্ত গাছ কাটিয়া জলাশয় শুকাইয়া গ্রাম ক্ষেত উৎসন্ন করিয়া মুঘলদের অগ্রসর হইবার পথ রোধ করিয়াছেন। আর একদল বিজাপুরী সৈন্য তাঁহার পশ্চাতে গিয়া বাদশাহী প্রদেশে প্রবেশ করিয়া লুঠ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তখন জয়সিংহ হতাশ হইয়া ৫ই জানুয়ারি ১৬৬৬, পশ্চাৎ ফিরিলেন, এবং ক্রমে নিজ সীমানায় পরেণ্ডা দুর্গের কাছে পৌঁছিলেন। এইরূপে বিজাপুর-অভিযান সম্পূর্ণ বিফল হইল।
শিবাজীর উপর মুসলমান সৈন্যদের আক্রোশ
এই আশাভঙ্গ হওয়াতে মুঘল-সৈন্যদলের মধ্যে মহাগণ্ডগোল উপস্থিত হইল। সকলেই এই পরাজয় ও ক্ষতির জন্য জয়সিংহকে দোষ দিতে লাগিল। দিলির খাঁ আগে হইতেই জয়সিংহকে অমান্য করিতেন। এখন তিনি বলিতে লাগিলেন যে, শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতায় বিজাপুর জয় করা ঘটিল না, শিবাজীকে মারিয়া ফেলিতে হইবে; শিবাজী আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, দ্রুত কুচ করিয়া অগ্রসর হইলে দশ দিনের মধ্যেই ঐ দুর্গ মুঘলদের হাতে আসিবে, এখন কেন তাহা হইল না? ইহার পূর্ব্বেও পুরন্দরের সন্ধির পর দিলির খাঁ অনেকবার জসিংহকে অনুরোধ করিয়াছিলেন, “এই সুযোগে শিবাজীকে খুন করিয়া ফেলুন; অন্ততঃ আমাকে সে কাজটা করিতে অনুমতি দিন। আমি এই পাপের সমস্ত ভার নিজের উপর লইব, কেহই আপনাকে দোষী করিবে না।”
জয়সিংহ দেখিলেন যে, উন্মত্ত মুসলমান সেনানীদের হাত হইতে শিবাজীর প্রাণ রক্ষা করা কঠিন। অমনি পথ হইতে ১১ই জানুয়ারি শিবাজীকে নিজ সৈন্যসহ বিজাপুর-রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশটি আক্রমণ করিতে পাঠাইয়া দিলেন, মুখে বলিলেন যে এইরূপে শত্রুসেনা ভাগ হইয়া যাইবে, মুঘলদিগের উপর তাহাদের সমস্ত আক্রমণটা পড়িবে না। জয়সিংহের পাশ হইতে রওনা হইবার পাঁচদিন পরে শিবাজী পনহালা-দুর্গের কাছে পৌছিলেন, এবং রাত্রি এক প্রহর থাকিতে হঠাৎ দুর্গ আক্রমণ করিলেন। কিন্তু দুর্গের সৈন্যগণ আগেই টের পাইয়া সজাগ ছিল, তাহারা মহাবিক্রমে যুদ্ধ করিল। শিবাজীর পক্ষে এক হাজার মারাঠা হতাহত হইয়া পড়িল। তাহার পর সূর্য্য উঠিল; পর্ব্বতের গা বাহিয়া যে মারাঠারা চড়িতেহিল তাহাদের স্পষ্ট দেখা গেল, এবং তাহাদের উপর ঠিক গুলি ও পাথর আসিয়া পড়িতে লাগিল (১৬ জানুয়ারি)। তখন শিবাজী হার মানিয়া চৌদ্দ ক্রোশ দূরে নিজ দুর্গ খেল্নায় ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু ঐ অঞ্চলে তাঁহার লোকদের লুটপাট বন্ধ করিবার জন্য ছয় হাজার বিজাপুরী সৈন্য এবং দুইজন বড় সেনাপতি সেখানে আবদ্ধ হইয়া রহিলেন।
মারাঠা সৈন্যদলে শিবাজীর পরেই নেতাজী পালকর সর্ব্বপ্রধান অধ্যক্ষ। তাঁহার উপাধি “সেনাপতি” এবং তিনি শিবাজীর বংশের এক কন্যাকে বিবাহ করেন। লোকমুখে তাঁহাকে “দ্বিতীয় শিবাজী” বলা হইত। বিজাপুর হইতে চার লক্ষ হোণ ঘুষ পাইয়া তিনি এই সময় হঠাৎ মুঘলপক্ষ ছাড়িয়া আদিল শাহর সঙ্গে যোগ দিলেন, এবং মুঘল অধীন গ্রাম শহর লুটিতে লাগিলেন। জয়সিংহ আর কি করেন? তিনি পাঁচ হাজারী মনসব, বিস্তৃত জাগীর, এবং নগদ আটত্রিশ হাজার টাকা দিয়া নেতাজীকে আবার নিজের দলে ফিরাইয়া আনিলেন (২০ মার্চ্চ ১৬৬৬)। ইহার পূর্ব্বে চারিদিকে বিপদ ঘনাইয়া আসিতেছে দেখিয়া জয়সিংহ বাদশাহকে লিখিয়াছিলেন যে, এই সময়ে সাক্ষাৎ করিবার জন্য ডাকিলে শিবাজীকে মুঘল-রাজধানীতে পাঠাইয়া দিয়া, তিনি দাক্ষিণাত্যে অনেকটা নিশ্চিত হইতে পারেন। আওরংজীব সম্মত হইলেন। তখন সিংহ অনেক আশা-ভরসা ও স্তোকবাক্য দিয়া শিবাজীকে বাদশাহর দরবারে যাইবার জন্য রাজি করাইলেন।