শিবাজী/চতুর্দশ অধ্যায়
চ তু র্দ্দ শ অ ধ্যা য়
ইতিহাসে শিবাজীর স্থান
শিবাজী ও আওরংজীব
পারস্যের রাজা দ্বিতীয় শাহ আব্বাস আওরংকীবকে ধিক্কার দিয়াপত্র লিখিলেন (১৬৬৭)—“তুমি নিজকে রাজার রাজা। শাহানশাহ বাদশাহ) বল অব শিবাজীর মত একটা জামিদারক দুরন্ত করিতে পাবিলে না। আমি সৈন্য লইয়া ভারতবর্ষে যাইতেছি তোমাকে রাজ্য-শাসন শিখাইব।” শিবাজীর স্মৃতি কাঁটার মত আওরংজীবে হৃদয়ে আমবণ বিদ্ধ ছিল। মৃত্যুর পূর্বে বাদশাহ পাত্র বা প্রতি যে শেষ উপদেশ লিখিয়া যান, তাহাতে আছে—“দেশের সব খবর রাখাই রাজকার্য্যর সর্বপ্রধান অঙ্গ। এক দণ্ডের অবহেলা বহুবর্ষ ব্যাপী মনস্তাপের কারণ হয়। এই দেখ, অবহেলাব জন্য হতভাগ্য শিবাজী আমার হাত হইতে পলাইল, আর তাহার ফলে আমাকে আমরণ এই পরিশ্রম ও অশান্তি ভোগ করিতে হইল।”
আশ্চর্য্য সফলতা এবং অতুলনীয় খ্যাতিতে মণ্ডিত হইয়া শিবাজী সেই যুগের ভারতে সর্ব্বত্রই হিন্দুদের পক্ষে এক নূন আশার উষা-তার রূপে দেখা দিলেন। একমাত্র তিনি হিন্দুদেব জাত, ও তিলকের, শিখা ও উপবীতের বক্ষক ছিলেন। আশা ভবে সকলেই তাহাব দিকে চাহিয়া থাকিত, তাহার নাম করিয়া সমগ্র জাতি মাথা তুলত।
মারাঠা রাজ্যে পতনের কারন
তবে কেন শিবাজীর রাজনৈতিক অনুষ্ঠান স্থায়ী হইল না? কেন তাঁহার সৃষ্টি তাঁহার মৃত্যুর আট বৎসণের মধ্যেই ভাঙ্গিতে আরম্ভ হইল? কেন মারাঠারা এক রাষ্ট্র সঙ্ঘ (নেশন) হইতে পারিল না? কেন অন্যান্য ভারতীয় রাজন্য ও জাতির মত তাহাবাও বিদেশীর বিরুদ্ধে ডাইতে অসমর্থ হইল?
ইতিহাসের গভীব চর্চা করিয়া ইহার উত্তর পাওয়া যায়।
প্রথম কারণ —জাতিভেদের বিষ
মারাঠা যখন শিবাজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা-লাভের জন্য খাড়া হয় তখন তারা বিজাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ, তখন তাহারা গরীব ও পরিশ্রমী ছিল, সাদাসিদে ভাবে সংসার চালাইত, তখন তাহাদের সমাজে একতা ছিল, জাত বা শ্রেণীর বিশেষ পার্থক্য বা বিবাদ ছিল না। কিন্তু শিবাজীর অনুগ্রহে রাজত্ব পাইয়া, বিদেশ-লুঠের অর্থে ধনবান হইয়া, তাহাদের মন হইতে সেই অত্যাচার-স্মৃতি এবং তাহাদের সমাজ হইতে সেই সরলতা ও একতা দূর হইল; সাহসের সঙ্গে সঙ্গে অহঙ্কার ও স্বার্থপরতা বাড়িল। ক্রমশঃ সমাজে জাতিভেদের বিবাদ উপস্থিত হইল।
বহুদিন ধরিয়া অনুর্বর দরিদ্র মহারাষ্ট্র দেশের অনেক ব্রাহ্মণই শাস্ত্রচর্চা ও যজন-জন ত্যাগ করিয়া হিন্দু মুসলমান রাজসরকারে চাকরি লইয়া অর্থ ও প্রতিপত্তি ভোগ করিয়া আসিতেছিল। মারাঠা জাত, নিরক্ষর, অসি বা হলজীবী; কিন্তু কায়স্থগণ জাতিতেই “লেখক”, তাহারা লেখাপড়া করিয়া সরকারী চাকরি পাইতে লাগিল, ধনে মানে বাড়িতে লাগিল। ইহা দেখিয়া ব্রাহ্মণেরা হিংসায় জ্বলিতে লাগিল, কায়স্থগণকে শূদ্র ও অত্যজ বলিয়া ঘোষণা করিল। উপবীত গ্রহণের অপরাধে কায়স্থ (প্রভু") জাতের অকথ্য কুৎসা প্রচার করিল, তাহাদের নেতাদের একঘরে (গ্রামন্য) করিল।
এমন কি শিবাজীর অভিষেকের সময়ই ব্রাহ্মণেরা একজোটে মারাঠা জাতের ক্ষত্রিয় অস্বীকার করিয়া, বৈদিক ক্রিয়া-কর্মে ও মন্ত্রপাঠ শিবাজীর কোন অধিকার নাই এই বলিয়া বসিল। তাহাদের এইরূপ অহঙ্কার ও গোঁড়ামিতে উত্ত্যক্ত হইয়া শিবাজী একবার (১৬৭৪ সালে) বলেন, “ব্রাহ্মণদের জাতিগত ব্যবসা শাস্ত্রচর্চা ও পূজা উপবাস ও দারিদ্র্যই তাহাদের ব্রত; শাসন-বিভাগে চাকরি করা তাহাদের পাপ। অতএব, সব রাহ্মণ মন্ত্রী ও আমলা, সেনাপতি ও দূতকে চাকরি হইতে মাইয়া দিয়া শাস্ত্রগত কাজে লাগাইয়া রাখা হিন্দু রাজার কর্ত্তব্য। আমি তাহাই করিব।” তখন ব্রাহ্মণেরা কাঁদাকাটি করিয়া তাহার ক্ষমা পায়।
এইরূপে ব্রাহ্মণেরা অধিক ক্ষমতা পাইয়া অব্রাহ্মণদিগের প্রতি সামাজিক অত্যাচার অবিচার করিতে লাগিল। আবার ব্রাহ্মণদের মধ্যেও একতা ছিল না। তাহাদের মধ্যে শ্রেণী (বা শাখা)-বিভাগ এবং কৌলীন্য-অভিমান লইয়া ভীষণ দলাদলি ও বিবাদ বাধিয়া গেল। পেশোয়ারা কোঁকনবাসী (“চিৎপাবন” শাখার) ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাহারা যখন দেশের রাজা তখনও পুণা অঞ্চলে স্থানীয় (“দেশ” শাখার) ব্রাহ্মণেরা কোঁঁকনস্থদিগকে অশুদ্ধ হীন-শ্রেণীর ব্রাহ্মণ বলিয়া ঘৃণা করিত, তাহাদের সঙ্গে পঙক্তি-ভোজন করিত না। আবার চিৎপাবনেরা “কহাডে” শাখার ব্রাহ্মণদের উপর খড়গহস্ত। পেশোয়রা অপর অপর শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের গৌরব খর্ব্ব করিবার জন্য রাজশক্তি প্রয়োগ করিতেন। গোয়া-অঞ্চল-বাসী গৌড় সারস্বত (শেবী)-শাখার ব্রাহ্মণেরা অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও কার্যদক্ষ, কিন্তু তাহাদিগকে আর সব শ্রেণীর ব্রাহ্মণের প্রায় এখানকার বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের মত অবজ্ঞা ও পীড়ন করিত। এইরূপে জাতের সঙ্গে জাত, এমনকি, একই জাতের মধ্যে এক শাখার সঙ্গে অপর শাখা, বিবাদ করিতে লাগিল; সমাজ ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া গেল, রাষ্ট্রীয় একতা লোপ পাইল, শিবাজীর অনুষ্ঠান ধূলিসাৎ হইল। মারাঠারা রাজ্য হারাইয়াছে, তাহাদের ভারতব্যাপী
প্রাধান্য লোপ পাইয়া, তাহাদের আবার বিজাতির পদানত হইতে হইয়াছে, তবুও তাহাদের চৈতন্য হয় নাই, তাহাদের মধ্যে এই জাতে নাতে বিবাদ আজও চলিয়াছে-জাতিভেদের বিষ এতই ভীষণ। রবীন্দ্রনাথ সত্যই বলিয়াছেন-“শিবাজী যে হিন্দুসমাজকে মোঘল আক্রমণের বিরুদ্ধে জয়মুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, আচারবিচারগত বিভাগ-বিচ্ছেদ সেই সমাজের একেবারে মূলের জিনিষ। সেই বিভাগমূলক ধসমাজকেই তিনি সমস্ত ভারতবর্ষে জয়ী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহাকেই বলে বালির বাঁধ বাঁধা—ইহাই অসাধ্য সাধন।
“শিবাজী এমন কোনো ভাবকে আশ্রয় ও প্রচার করেন নাই যাহ। হিন্দু-সমাজের মূলগত ছিদ্রগুলিকে পরিপূর্ণ করিয়া দিতে পারে। নিজের ধর্ম বাহির হইতে পীড়িত অপমানিত হইতেছে এই ক্ষোভ মনে লইয়া তাহাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিজয়ী করিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক হইলেও তাহা সফল হইবার নহে; কারণ ধর্ম যেখানে ভিতর হইতেই পীড়িত হইতেছে, যেখানে তাহার ভিতরেই এমন সকল বাধা আছে যাহাতে মানুষকে কেবলি বিচ্ছিন্ন ও অপমানিত করিতেছে, সেখানে সেদিকে দৃষ্টিপাত মাত্র না করিয়া, এমন কি, সেই ভেদবুদ্ধিকেই মুখ্যতঃ ধর্ম্মবুদ্ধি বলিয়া জ্ঞান করিয়া, সেই শতদীর্ণ ধর্ম্মসমাজের স্বরাজ্য এই সুবৃহৎ ভারতবর্ষে স্থাপন করা কোনো মানুষেরই সাধ্যায়ত্ত নহে, কারণ তাহা বিধাতার বিধানসঙ্গত হইতে পারে না।”
দ্বিতীয় কাবণ-নেশন-গঠনের চেষ্টার অভাব
মারাঠা-প্রাধান্যের সময় নেশনের শিক্ষা ও অর্থবল, একতা ও সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যম বৃদ্ধি কবিবার কথা স্থিরমনে ভাবা হইত না, তাহার জন্য দৃঢ় চেষ্টা হইত না; সব লোক নির্বিচারে পূর্বপ্রথা অনুসরণ করিত, হিন্দু জগৎ যেন চোখ বুজিয়া কালস্রোতে ভাসিয়া চলিত। আর ইউরোপের জাতিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ভাবিয়া, খাটিয়া, প্রচার করিয়া, অবিরাম উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছিল; এইরূপ এক ক্রমোন্নতিশীল সব জাতিয় সহিত সংঘর্ষ হইবামাত্র বিশাল মারাঠা-সাম্রাজ্য চুর্ণ হইয়া গেল। ইহাই প্রকৃতির বিধান। ইউরোপের সহিত ভারতের এই পার্থক্য আজও রহিয়াছে। ভারত ক্রমশঃ বেশী পিছনে পড়িতেছে, ~রণে বাণিজ্যে, শিল্প, সমবেত চেষ্টায় ইউরোপের তুলনায় দিন দিন অধিকতর ইন ও অসমর্থ হইতেছে। মাবাঠা ইতিহাস হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে,
“দিনের দিন সবে দীন
ভারত হয়ে পবাধীন”
আমাদের জাতীয় দুর্দ্দশার সত্য কারণ নহে,— নৈতিক অবনতির ফল মাত্র।
তৃতীয় কারন—সুশাসনের স্থায়ী ব্যবস্থার অভাব
মারাঠা বাজত্বে সময় সময় স্থান- বিশেষে সুশাসন ও প্রজার সুখসম্পদের পরিচয় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাহা ব্যক্তিগত এবং অস্থায়ী। কোন বিশেষ রাজা বা মন্ত্রীর গুণে এই সুফল ফলিয়াছিল; আব তিনি চোখ বুজিবা মাত্র আবার আগের সব কি-শাসন ও অরাজকতা ফিরিয়া আসিয়া তাহার কার্য নষ্ট কবিয়া দিত। শিবজির পর শম্ভুজী, মাধব রাও পেশোয়ার পর রঘুনাথ রাও ইহারই দৃষ্টান্ত। এই কারণে মারাঠা - শাসনে দক্ষতার অভাব, ঘুষেব রাজত্ব, এবং হঠাৎ আগাগোড়া পরিবর্তন বড়ই বেশী দেখা যাইত। ইহাতে প্রজার সুখ-সম্পদ নষ্ট হইল, জাতির নৈতিক বল লোপ পাইল।
চতুর্থ কারণ -স্বদেশ অপেক্ষা স্বার্থের টান বেশি
সে যুগের সমাজের অবস্থা এবং লোকের মনে প্রবৃত্তি যেরূপ ছিল তাহাতে জাতি অপেক্ষা নিজবংশ, স্বদেশ অপেক্ষ। পৈত্রিক মৌরসী মহাল (মারাঠী-ভাষায় “বতন”) বেশী মূল্যবান বোধ হইত। দেশে রাজা ও রাজবংশের ঘন ঘন পরিবর্তনের ফলে অনেক স্থলে জমির স্বত্ব বড় অনিশ্চিত এবং গোলমেলে হইয়া উঠিয়াছিল; একই গ্রামের উপর অধিকার দাবি করিত, তিনচার জন ভূস্বামী (যথা, দেশাই, দলবী, সাবত-তাহা ছাড়া দেশের রাজা) এবং পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ করিয়া অথবা বিদেশী আক্রমণকারীর পক্ষে যোগ দিয়া নিজ অধিকার স্থাপিত করিতে চেষ্টা করিত; স্বজাতীয় রাজারা দেশের বিচারালয় এই ব্যক্তিগত স্বার্থের সহায়ক না হইলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে অগ্রাহ্য করিয়া দেশের শত্রুকে ডাকিয়া আনিত। ফলতঃ, “বতন” মারাঠা মাত্রেই প্রাণ ছিল, জন্মভূমি কিছুই না। “বতন” রক্ষা বা বৃদ্ধি করিবার জন্য মারাঠারা কোন পাপ করিতেই কুণ্ঠিত হইত না। নিজের জাত, বা শ্রেণীর অপেক্ষা কোন বৃহত্তর একতার বন্ধন সে যুগের হিন্দুরা কল্পনা করিতে পারিত না। নিজের বংশের বা জাতের স্বার্থ অপেক্ষা দেশের হিত যে বড় ও শ্রেয় তাহা রাজা-প্রজা উচ্চনীচ কেহই বুঝিত না, ভাবিত না। সকলেরই চেষ্টা নিজ ধন ও বল, মর্যাদা ও সামাজিক পদ বৃদ্ধি করা, তাহা স্বরাজেই হউক, আর পরাধীনতা স্বীকার করিয়াই হউক।
এই অগণিত শোকসমূহ নিজের স্বার্থ অপেক্ষা কোন মহত্তর উদ্দেশ্য, নিজের ইচ্ছা অপেক্ষা কোন মহত্তর চালনা-শক্তি মানিত না। তাহারা, জীবনের শৃঙ্খলাকে সুখের অন্তরায় এবং নিয়ম-পালনকে দাসত্ব বলিয়া ভাবিত। যদি দেশে সকলেই নিজ নিজ খেয়াল দমন করিয়া এক সর্বব্যাপী বিধি ও সর্বোচ্চ কর্তাকে মানিয়া লয়, তবেই সে জাতি একতাবদ্ধ ও অজেয় শক্তিশালী হইতে পারে, সভ্যতার দ্রুত উন্নতি করিতে পারে। এই জন-সমষ্টির নিয়মানুবর্তিতা (ইংরাজীতে যাহাকে ‘ডিসিপ্লিন’ বা ‘রেন অব ল বলে) যে জাতির নাই তাহারা স্বাধীন হইতে পারে না-স্বেচ্ছাচারীহইয়া, অনাচার অরাজকতা করিয়া শেষে কোনও মহত্তর জাতির নিকট হীনতা-শ্রীকারে বাধ্য হয়, নিজেদের পরাধীনতার শুল নিজেরাই গড়ে। জগতের ইতিহাস যুগে যুগে এই সত্যই প্রচার করিতেছে। অন্যান্য মারাঠা নেতারা এইরূপ উচ্ছৃঙ্খল, স্বার্থে অন্ধ, জাতীয়তার কর্তব্যজ্ঞানহীন ছিল বলিয়াই, শিবাজীর সমস্ত চেষ্টার ফল তাঁহার অবর্তমানে পণ্ড হইল; তিনি যে মহৎ কাজের সূচনা করিয়া যান তাহ স্থায়ী করা, জাতীয় দেহ গড়িয়া তোলা সম্ভব হইল না।
পঞ্চম কারণ-অর্থনৈতিক অবনতি
মারাঠা-শাসনের প্রধান দোষ ছিল অর্থনীতির অবহেলা। কৃষিবাণিজ্যের উন্নতি, প্রজা ও দোকানদারদিগকে অত্যাচার হইতে রক্ষা ও ঘুষ বন্ধ করা, সুনিম্মিত ও সুরক্ষিত পথঘাট, বিচারালয়ে বিবাদের সত্বর সুবিচার, স্থায়িভাবে দেশের ধন-বৃদ্ধি এবং তাহার দ্বারা রাজ্যের শক্তির উন্নতি,—ইহার কোনটির দিকেই রাজা-উজারের দৃষ্টি ছিল না। তাহাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল “মুলুগিরি” অর্থাৎ পর-রাজ্য লুঠ করিয়া ধন-দৌলত আনা; তাহাতেই তাহাদের সমস্ত চিন্তা, সমস্ত চেষ্টা, সমস্ত লোকবল ব্যয় হইত। ইহার ফলে মারাঠারা অন্য সব লোকের-হিন্দু মুসলমান, রাজপুত জাঠ, কানাড়ী বাঙ্গালী,—দক্ষিণ প্রাপ্ত হইতে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র ভারত জুড়িয়া রাজা-প্রজার, পীড়ক[১]ও শত্রু হইল, - জগতে এক জনও বন্ধ রাখিল না। এই অন্ধ ও অসৎ রাজনীতি অনুসরণের ফলে মারাঠাদের পতনের জন্য সকলেই ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিল। আর, তাহাদেরবারংবার লুণ্ঠনের ফলে দেশের সর্বত্রই ধনাগম বন্ধ হইল, কৃষি বাণিজ্যে দ্রুত অবনতি হইতে লাগিল, অনেক উর্বর ক্ষেত্র জঙ্গলে পরিণত এবং সমৃদ্ধ শহর দন্ধ ভগ্ন জনহীন হইল; লোকে অর্থ সঞ্চয় করিবার, অর্থ বুদ্ধি করিবার চেষ্টা ছাড়িয়া দিল। শেষে এমন হইল যে মারাঠারা আসিয়া পূর্বের চৌথের দশমাংশও পাইত না। কেবলমাত্র রাজ্য-লুঠের বলে যে জাতি বলীয়ান হইবার চেষ্টা করে তাহার অর্থবল এইরূপ মরীচিকা মাত্র।
ষষ্ঠ কারণ—সত্যপ্রিয়তার ও রাষ্ট্রীয় বলের অভাব
মারাঠাদের মধ্যে বীর ও যোদ্ধা অনেক ছিল বটে, কিন্তু তাহাদের নেতারা রাজনীতির ক্ষেত্রে কৌশল ও প্রতারণাই বেশী অবলম্বন কবিতেন। তাহা বুঝিতেন না যে, মিথ্যা কথা দু'একবাব চলে চিরকাল চলে না। কথা রক্ষা না করিলে, বিশ্বাসঘাতক হইলে, সত্য ব্যবহার না করিলে, কোন রাজাই টিকিতে পাবে না। মারাঠা সেনাপতি ও মন্ত্রী লাভের সুযোগ পাইলেই সন্ধি ভঙ্গ করিতেন, নিজ কথাব বিপরীত আচরণ করিতেন—ইহাতে কিছুমাত্র লজ্জিত হইতেন না। কেহই তাহাদের উপর নির্ভব করিতে, বিশ্বাস করিতে পারিত না।
রাজ্য রক্ষা করিতে হইলে যুদ্ধ ও (কৗশল (ডিপ্লোম্যাসি) দুই-ই আবশ্যক, এবং যুদ্ধও সময় বুঝিয়া, পূর্ব প্রস্তুত হইয়া, করা উচিত। কিন্তু মারাঠা রাজনীতি ছিল প্রত্যেক বৎসর কোন-না কোন প্রদেশে অভিযান পাঠান। এই বাৎসরিক যুদ্ধ কিছু অর্থ লাভ হইত বটে, কিন্তু সৈন্যনাশ ও শত্রুবৃদ্ধি হইয়া তদপেক্ষা অধিক ক্ষতি করিত। এই সব দুরদৃষ্টিহীন অভিযান এবং কূট পররাষ্ট্র নীতি ও ষডযন্ত্র অনুসবণের ফলে মারাঠা রাজশক্তি ক্রমেই দুর্বল হইয়া পডিতে লাগিল। আর সেই সময় সুদক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিদেশী বণিকেরা স্থিরবুদ্ধিতে পদে পদে অগ্রসর হইযা, ক্রমশঃ নিজ শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি কবিয়া, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ভারতের সাধ্বভৌম প্রভু হইল, মারাঠা জাতি ইংরাজের অধীন হইল। ইহা প্রকৃতির অনিবার্য্য বিধান।
শিবাজীর চরিত্র
তিনি নিজে নিষ্ঠাবান ভক্ত হিন্দু ছিলেন, ভজন ও কীর্ত্তন শুনিবার জন্য অধীর হইতেন, সাধু-সন্ন্যাসীর পদসেবা করিতেন, গোব্রাহ্মণের পালক ছিলেন। অথচ, যুদ্ধ-যাত্রায় কোথাও একখানি কোরাণ পাইলে তাহা নষ্ট বা অপবিত্র না করিয়া সযত্নে রাখিয়া দিতেন এবং পরে কোন মুসলমানকে তাহা দান করতেন; মসজিদ ও ইসলামী মঠ (খাকা) দেখিলে তাহা আক্রমণ না করিয়া ছাড়িয়া দিতেন। গোড়। মুসলমান ঐতিহাসিক খাফি খাঁ শিবাজীর মৃত্যুর বর্ণনায় লিখিয়াছেন, “কাফির জেহন্নমে গেল”; কিন্তু তিনিও শিবাজীর সৎ চরিত্র, পরস্ত্রীকে মাতার সমান জ্ঞান, দয়া-দাক্ষিণ্য এবং সর্ব্ব ধর্ম্মে সমান সম্মান প্রভৃতি দুর্লভ গুণের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন। শিবাজীর রাজ্য ছিল “হিন্দবী স্বরাজ”, অথচ অনেক মুসলমান তাহার অধীনে চাকরি পাইয়াছিল [দৃষ্টান্তের জন্য আমার ইংরাজী শিবাজীর ৩য় সংস্করণের ৪০২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]।
সর্ব্ব জাতি, সর্ব ধর্ম-সম্প্রদায়, তাঁহার রাজ্যে নিজ নিজ উপাসনার স্বাধীনতা এবং সংসারে উন্নতি করিবার সমান সুযোগ পাইত। দেশে শান্তি ও সুবিচার, সুনীতির জয় এবং প্রজার ধনমান রক্ষা হাই দান। ভারতবর্ষের মত নানা বর্ণ ও ধর্মের লোক লইয়া গঠিত দেশে, শিবাজীর অনুসৃত এই রাজনীতি অপেক্ষা অধিক উদার ও শ্রেয় কিছুই কল্পনা করা যাইতে পারে না।
শিবাজীর প্রতিভা ও মৌলিকতা
লোক দেখিবামাত্র তাহাদের চরিত্র ও ক্ষমতা ঠিক বুঝিয়া, প্রত্যেককে তাহার যোগ্যতার অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত করাই প্রকৃত বাজার গুণ। শিবাজীর এই আশ্চর্য গুণ ছিল। আর, তাহার চরিত্রের আকর্ষণী-শক্তি ছিল চুম্বকের মত-দেশের যত সৎ লক্ষ মহৎ লোক তাহার নিকট আসিয়া জুটিত; তাহাদের সহিত বন্ধুভাবে ব্যবহার করি, তাহাদের সন্তুষ্ট রাখিয়া, তাহাদের নিকট হইতে তিনি আন্তরিক ভক্তি এবং একান্ত বিশ্বাস ও সেবা লাভ করিতেন। এইজন্যই তিনি সর্বদা সন্ধি-বিগ্রহে, শাসন ও রাজনীতিতে এত সফল হন। সৈনাদের সঙ্গে সদাসর্বদা মিলিয়া মিশিয়া, তাহাদের দুঃখ-কষ্টের ভাগী হইয়া ফরাসী সৈন্যমধ্যে নেপোলিয়নের ন্যায় তিনি একাধারে তাহাদের বন্ধু ও উপাস্য দেবতা হইয়া পড়েন।
সৈন্য-বিভাগের বন্দোবস্তে-শৃঙ্খলা, দূরদর্শিতা, সব বিষয়ের সূক্ষ্ণাংশের প্রতিদৃষ্টি, স্বহস্তে কর্মের নানা সূত্র একত্র ধরিবার ক্ষমতা, প্রকৃত চিন্তাশক্তি এবং অনুষ্ঠান-নৈপুণ্য—এই সকল গুণের তিনি পরাকাষ্ঠা দেখান। দেশের প্রাকৃতিক অবস্থার ও তাহার সৈন্যগণের জাতীয় স্বভাবের উপযোগী কোন্ প্রণালীর যুদ্ধ সর্বাপেক্ষাফলপ্রদ হইবে, নিরক্ষর শিবাজী শুধু প্রতিভার বলেই তাহা আবিষ্কার ও অবলম্বন করেন।
শিবাজীর প্রতিভা যে কত মৌলিক, কত বড়, তাহা বুঝিতে হইলে মনে রাখিতে হইবে যে তিনি মধ্যযুগের ভারতে এক অসাধ্য সাধন কেন। তাহার আগে কোন হিন্দই মধ্যাহ্ন-সূর্যের মত প্রখর দীপ্তিশালী শক্তিমান মুঘল-সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাড়াইতে সমর্থ হয় নাই; সকলেই পরাজিত নিষ্পেষিত হইয়া লোপ পাইয়াছিল। তাহা দেখিয়াও এই সাধারণ জাগীরদারের পুত্র ভয় পাইল না, বিদ্রোহী হইল, এবং শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করিল। ইহার কারণ—শিবাজীর চরিত্রে সাহস ও স্থির চিতার অপূর্ব সমাবেশ হইয়াছিল; তিনি নিমিষে বুঝিতে পারিতেন, কোন ক্ষেত্রে কতদুর অগ্রসর হওয়া উচিত, কোথায় থামিতে হইবে-সময় কোন নীতি অবলম্বন করা শ্রেয়,—এই লোক ও অর্থবলে ঠিক কি কি করা সম্ভব। ইহাই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিভার পরিচায়ক। এই কার্যদক্ষতা ও বিষয়-বন্ধিই তাঁহার জীবনের আশ্চর্য সফর সবপ্রধান কারণ।
শিবাজীর রাজ্য লোপ পাইয়াছে; তাহার বংশধরগণ আজ জমিদার মাত্র। কিন্তু মারাঠা জাতিকে নবজীবন দান তাঁহার অমর কীর্তি। তাহার জীবনের চেষ্টার ফলে সেই বিক্ষিপ্ত পরাধীন জাতি এক হইল, নিজ শক্তি বুঝিতে পারিল, উন্নতির শিখরে পেীছিল। ফলত, শিবাজী হিন্দু জাতির সর্বশেষ মৌলিক গঠন-কর্তা এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কর্মবীর। তাহার শাসন-পদ্ধতি, সৈন্য-গঠন, অনুষ্ঠান-চনা সবই নিজের সৃষ্টি। রণজিৎ সিংহ বা মাহাদী সিন্ধিয়ার মত তিনি ফরাসী সেনাপতি বা শাসনকর্তার সাহায্য লন নাই। তাহার রাজ্য-ব্যবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়াছিল, এবং পেশোয়াদের সময়েও আদর্শ বলিয়া গণ্য হইত।
নিরক্ষর গ্রাম্য বালক শিবাজী কত সামান্য সম্বল লইয়া, চারিদিকে কত বিভিন্ন পরাক্রান্ত শত্রুর সঙ্গে মুখিয়া, নিজেকেসঙ্গে সঙ্গে সময় মারাঠা জাতিকে—স্বাধীনতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন, তাহা এই গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে। সেই আদি যুগের পাল সাম্রাজ্যের পর শিবাজী ভিন্ন অপর কোন হিন্দুই এত উচ্চশ্রেণীর ক্ষমতা দেখাইতে পারেন নাই।
একতাহীন, নানা রাজ্যে বিচ্ছিন্ন, মুসলমান রাজার অধীন, এবং পরের চাকর মারাঠাদের ডাকিয়া আনিয়া শিবাজী প্রথমে নিজ কার্যের দ্বারা দেখাইয়া দিলেন যে তাহারা নিজেই নিজের প্রভু হইয়া যুদ্ধ করিতে পারে। তাহার পর, স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়া তিনি প্রমাণ করিলেন যে বর্ত্তমান কালের হিন্দুরাও রাষ্ট্রের সব বিভাগের কাজ চলাইতে পারে; শাসন-প্রণালী গড়িয়া তুলিতে, জলে-স্থলে যুদ্ধ করিতে, দেশে সাহিত্য ও শিল্প পুষ্টি করিতে, বাণিজ্য-পোত গঠন ও পরিচালন করিতে, ধর্ম্মরক্ষা করিতে, তাহারা সমর্থ; জাতীয় দেহকে পূর্ণতা দান করিবার শক্তি তাহাদের আছে।
শিবাজীর চরিত-কথা আলোচনা করিয়া আমরা এই শিক্ষা পাই যে, প্রয়াগের অক্ষয় বটের মত হিন্দুজাতির প্রাণ মৃত্যুহীন, কত শত বৎসরের বাধা-বিপত্তির ভার ঠেলিয়া ফেলিয়া আবার মাথা তুলিবার, আবার নুতন শাখাপল্লব বিস্তার করিবার শক্তি তাহাদের মধ্যে নিহিত আছে। ধর্ম্মরাজ্য স্থাপন করিলে, চরিত্রবলে বলীয়ান হইলে, নীতি ও নিয়মানুবর্তিতাকে অন্তরের সহিত মানিয়া লইলে, স্বার্থ অপেক্ষা জন্মভূমিকে বড় বিশে, বাগাড়ম্বর অপেক্ষা নীরব কার্য্যকে সাধনার লক্ষ্য করিলে,জাতি অমর আজেয় হয়।
সমাপ্ত
- ↑ একজন বাঙ্গালী কবি সংস্কৃতে বগীদিগকে “কৃপায় কৃপণ, গর্ভবতী ও শিশুর পীড়ক” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন (১৭৪৩ সাল)।