শিবাজী/ত্রয়ােদশ অধ্যায়

ত্র য়ো দ শ অ ধ্যা য়

শিবাজীর রাজ্য এবং শাসন-প্রণালী

শিবাজীর রাজ্যের বিস্তৃতি এবং বিভাগ

শিবাজী দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর অবিরাম পরিশ্রম এবং নিদ্রাহীন চেষ্টার ফলে যে-রাজ্য গঠন করিয়া যান, তাহার বিবরণ এক কথায় দেওয়া অসম্ভব, কারণ নানা স্থানে তাঁহার স্বত্ব নানা প্রকারের এবং তাঁহার প্রভাব বিভিন্ন পরিমাণের ছিল।

 প্রথম হইল তাঁহার নিজের দেশ; ইহাকে মারাঠীতে “শিব-স্বরাজ” এবং ফারসীতে “পুরাতন-রাজ্য” (মমালিক-ই-কদিমি) বলা হইত। এখানে তাঁহার অধিকার ও ক্ষমতা স্থায়ী এবং সকলেই তাহা মানিয়া চলিত। ইহার বিস্তৃত সুরত শহরের ষাট মাইল দক্ষিণে কোলী দেশ হইতে আরম্ভ করিয়া গোয়ার দক্ষিণে কারোয়ার নগর পর্যন্ত; মাঝে শুধু পশ্চিম উপকুলে পোর্তুগীজদের গোয়া ও দমন প্রদেশ দুইটি বাদ। এই দেশের পূর্বসীমার রেখা বগলানা ঘুরিয়া দক্ষিণ দিকে নাসিক ও প্রণা জেলার মধ্যস্থল ভেদ করিয়া, সাতারা ও কোলাপুর জেলা বেড়িয়া, উত্তর কানাড়ার কুলে গঙ্গাবতী নদীতে গিয়া শেষ হয়। মৃত্যুর দুই বৎসর পূর্ব্বে তিনি পশ্চিম কর্ণাটকে বেলগাঁও-এর পূর্ব্বে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে কোপল প্রভৃতি জেলা অধিকার করেন; এগুলি তাঁহার স্থায়ী লাভ।  এই শিব-স্বরাজ তিন প্রদেশে বিভক্ত এবং তিনজন সুবাদারের শাসনাধীন ছিল:—

 (১) দেশ, অর্থাৎ নিজ মহারাষ্ট্র; পেশোয়ার শাসনে,

 (২) কোঁকন, অর্থাৎ সহ্যাদ্রির পশ্চিমাঞ্চল; অন্নাজী দত্তোর অধীনে,

 (৩) দক্ষিণ-পূর্ব্ব বিভাগ, অর্থাৎ দক্ষিণ-মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমকর্ণাটক; দত্তাজী পণ্ডের শাসনে।

 দ্বিতীয়ত, পূর্ব্ব-কর্ণাটক অর্থাৎ মাদ্রাজে (১৬৭৭-৭৮) দিগ্বিজয়ের ফলে জিঞ্জি বেলুর প্রভৃতি জেলা তাঁহার হাতে আসিয়াছিল বটে, কিন্তু সেখানে তাহার ক্ষমতা তখনও স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে নাই; তাঁহার সৈন্যেরা যতটুকু জমি দখলে রাখিতে বা যেখানে রাজস্ব আদায় করিতে পারিত, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হইত; অন্য সর্ব্বত্র অরাজকতা এবং পুরাতন ছোট ছোট সামন্তদের সংঘর্ষ। মহীশূরে বিজিত স্থান কয়টিও সেই দশা। তাঁহাব মৃত্যুর পূর্ব্ব পর্যন্ত কানাড়া অধিত্যকায়, অর্থাৎ বর্তমান বেলগাঁও ও ধারোয়ার জেলায় এবং সোন্দা ও বিদনুর রাজ্যে, যুদ্ধ চলিতেছিল, সেখানে তার ক্ষমতা নিঃসন্দেহভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।

 তৃতীয়তঃ, এই-সব স্থানের বাহিরে নিকটবর্তী দেশগুলিতে তাঁহার সৈন্যেরা প্রতি বৎসর শরৎকালে গিয়া ছয় মাস বসিয়া থাকিয়া চৌথ আদায় করত। এই কর রাজার প্রাপ্য রাজার রাজস্ব নহে, ইহা ডাকাতদের খুশী রাখিবার উপায় মাত্র। ইহার মারাঠী নাম “খণ্ডনী”। অর্থাৎ “এই টাকা লইয়া আমাকে রেহাই দাও, বাবা!”) হইতেই তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়। কিন্তু চৌথ আদায় করা সত্ত্বেও মারাঠার অপর শত্রুর আক্রমণ হইতে সেই দেশ রক্ষা করা কর্ত্তব্য বলিয়া স্বীকার করিত; তাহারা নিজেরা ঐ দেশ লুটিবে না, এইটুকু মাত্র অনুগ্রহ দেখাইত।

রাজস্ব ও ধনভাণ্ডার

 শিবাজীর সভাসদ কৃষ্ণাজী অনন্ত ১৬৯৪ সালে লিখিয়াছেন যে, তাঁহার প্রভু রাজস্বের পরিমাণ বৎসরে এক কোটি হোণ এবং চৌথ আশী লক্ষ হোণ ধার্য ছিল। হোণ একটি খুব ছোট স্বর্ণমুদ্রা, ইহার দাম প্রথমে চারি টাকা ছিল, পরে পাঁচ টাকা হয়; সুতরাং এই দুই বাবদে শিবাজীর আয় সাত হইতে নয় কোটি টাকার মধ্যে ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদায় হইত অনেক কম, এবং তাহাও সব বৎসরে সমান নহে। তাঁহাব মৃতুর পর তাঁহার ভাণ্ডারে যে ধনরত্ন পাওয়া যায় তাহার পরিমাণ মারাঠা ভাষার সভাসদ-বখরে এবং ফারসী ইতিহাস “তারিখ-ই-শিবাজী"তে বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে। ইহার মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা ছিল ছয় লক্ষ মোহর এবং প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ হোণ, ও সাড়ে বারো খণ্ডী। ওজনের ভাঙ্গা সোনা; রৌপ্যমুদ্রা ছিল ৫৭ লক্ষ টাকা, এবং ৫০ খণ্ডী। ওজনের ভাঙ্গা রূপা; এ ছাড়া হীরা মণিমুক্তা বহু লক্ষ টাকা দামের। (এক খণ্ডী কলিকাতার সাত মণের কিছু কম, ৬৮ মণ]

অষ্টপ্রধান

 ১৬৭৪ সালে রাজাভিষকের সময় শিবাজীর আটজন মন্ত্রী ছিলেন; সেই উপলক্ষে তাঁহাদের পদের উপাধি ফারসী হইতে সংস্কৃতে বদলান হয়ঃঃ-

 (১) মুখ্যপ্রধান (ফারসী নাম, পেশোয়া); ইনিই প্রধান মন্ত্রী, রাজার প্রতিনিধি ও দক্ষিণ হস্ত-স্বরূপ; নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে মতভেদ হইলে ইনি তাহার নিষ্পত্তি করিয়া রাজকার্য্যের সুবিধা করিয়া দিতেন। কিন্তু অপর সাত প্রধান তার অধীন বা অজ্ঞাবহ ছিল না, সকলেই নিজ নিজ বিভাগে একমাত্র রাজা ভিন্ন আর কাহাকেও প্রভু বলিয়া মানিত না।  (২) অমাত্য (ফারসী, মজমুয়া-দার) অর্থাৎ হিসাব-পরীক্ষক (অডিটর বা একাউণ্ট্যাণ্ট-জেনারেল); তাহার স্বাক্ষর ভিন্ন রাজ্যের আয়ব্যয়ের হিসাবে কাগজ গ্রাহ্য হইত না।

 (৩) মন্ত্রী (ফারসী, ওয়াকিয়া-নবিশ); ইনি রাজার দৈনিক কার্য্যকলাপ এবং দববারের ঘটনার বিবরণ লিখিতেন। যাহাতে রাজাকে গোপনে হত্যা বা বিষ খাওয়াইবার কোনরূপ চেষ্টা না হয়, সেজন্য রাঙ্গাব সঙ্গী, দর্শনপ্রার্থী আগন্তুক ও খাদ্যদ্রব্যের উপর মন্ত্রীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইত।

 (৪) সচিব (ফাবসী, শুরু-নবিস); ইনি সবকারী চিঠিপত্রের ভাষা ঠিক হইল কিনা দেখিয়া দিনে। যাতে জাল রাজপত্রের সৃষ্টি না হয়, সেইজন্য সচিবকে প্রত্যেক ফর্মান ও দানপত্রের প্রথম পংক্তি নিজহস্তে লিখিয়া দিতে হইত।

 (৫) সুমন্ত (ফারসী, দবীর) অর্থাৎ পর-রাজ্য-সচিব (ফরেন সেক্রেটারী); ইনি বিদেশী দূতদের অভর্থনা ও বিদায় করিতেন এবং চরের সাহায্যে অন্যান্য রাজ্যের খবর আনাইতেন।

 (৬) সেনাপতি (ফারসী, সরু ই-নৌবৎ)

 (৭) দানাধ্যক্ষ, অথবা মারাঠী ভাষায় ডাক-নাম “পণ্ডিতরাও"(ফারসী, সদব ও মুহতসিবের পদ মিলাইয়া); ইনি রাজার পক্ষ হইতে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের দক্ষিণা ধার্য্য করিয়া দিতেন, ধর্ম ও জাতসম্পকীয় বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার করিতেন, পাপাচার ও ধর্মভ্রষ্টতার শাস্তি এবং প্রায়শ্চিত্ত বিধির হুকুম দিতেন।

 (৮) ব্যায়াধীশ (ফাবসী, কাজী-উল-কুজাং), অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি (চীফ জাষ্টিস); ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় মামলা ছাড়া অপব সব বিবাদের বিচারভার ইহার হাতে ছিল।  ইহাদের মধ্যে সেনাপতি ছাড়া আর সকলেই জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণ হইলেও (দানাধ্যক্ষ ও ন্যায়াধীশ ভিন্ন) অপর পাঁচজন অনেক সময় সৈন্যদলের নেতা হইয়া যুদ্ধে যাইতেন, এবং ক্ষত্রিয়ের অপেক্ষা কোন অংশে কম বীবত্ব বা রণ-চাতুর্য্য দেখাইতেন না। ফর্মান, দানপত্র, সন্ধিপত্র প্রভৃতি সমস্ত বড বড সরকাবী কাগজে প্রথমে রাজার মোহর, তাহার পর পেশোয়ার মোহর, এবং সর্বনীচে অমাত্য মন্ত্রী সচিব ও সুমন্ত -এই চারি প্রধানের স্বাক্ষর থাকিত।

 বর্ত্তমান যুগে বিলাতে মন্ত্রীসভা (ক্যাবিনেট)ই দেশের প্রকৃত শাসনকর্তা; তাহারা সব বিভাগে নিজ হুকুম চালান, যুদ্ধ সন্ধি রাজস্ব শিক্ষা সর্ববিষয়ে রাজ্যের নীতি স্থির করেন। রাজা তাহাদের মত মানিতে বাধ্য, কারণ তাহাদের পশ্চাতে দেশের অধিকাংশ লোক আছে এবং রাজা তাহাদের উপদেশ অনুসারে কাজ না করিলে তাহারা রাগিয়া পদত্যাগ কবিবেন, জনসাধারণ ক্ষেপিয়া উঠিবে, এবং রাজাকে অপদস্থ (হয়ত পদচ্যুত) হইতে হইবে। কিন্তু শিবাজীর উপর মারাঠী অষ্ট প্রধানদের কোন ক্ষমতাই ছিল না; তাহারা রাজার ফেনী (সেক্রেটারি) মাত্র, বাজার কুম পালন করিতেন, তাঁহাদের কোন উপদেশ শুনা না শুনা রাজার ইচ্চজা প্রধানের। কোন বিষয়েই রাজনীতি বাঁধিয়া দিতে পারিতেন না, এমন কি তাহাদের নীচের কর্মচারীরা পর্যন্ত বিভাগীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজার কাছে আপীল করিতে পারিত। আর এই অষ্ট প্রধানের প্রত্যেকেই স্ব স্ব প্রধান, হিংসাপরবশ,ইংরাজ ক্যাবিনেটের সদস্যদের মত সুশৃঙ্খল, একজোট বাধা দল ছিল না।

 লেখকেরা, এবং অনেক স্থলে হিসাবরক্ষকেরা সকলেই জাতিতে কায়স্থ ছিলেন (চিটনবিস, ফর্দিনবিস ইত্যাদি)। সৈন্যদের বেতনের শিবাজীর রাজ্য এবং শাসন-প্রণালী হিসাব লিখিত “সবনিস” উপাধিধারী এক শ্রেণীর কর্মচারী। ইহাদের পদ সামান্য হইলেও প্রভাব ছিল খুব বেশী। শিবাজীর কর্মচারীরা (বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ সুদাব, থানাদার প্রভৃতি) অতি নির্লজ্জভাবে পীড়ন করিয়া ঘুষ লইত এবং রাজস্ব আত্মসাৎ করিয়া টাকা জমাইত।

শিবাজীর সৈন্য-সংখ্যা

ইংরাজ-যুগের পূর্ব্বেই আমাদের দেশে দুই রকম অশ্বারোহী সৈন্য ভর্তি করা হইত; যাহারা সম্পূর্ণভাবে রাজার চাকর এবং রাজসরকার হইতে অস্ত্র বর্মও অশ্ব পাইত তাহাদের নাম “পাগ”;আর যে-সব ভাড়াটে অশ্বারোহী নিজেই অস্ত্র বর্ম ও ঘোডা কিনিয়া, ডাক পড়িলে নানা রাজ্যে বেতনের লোভে কাজ করিত, তাহারা “সিলদার”। পাগা সৈন্যদের ফারসী ভাষায় “বার-গৗর” (= ভারবাহ) বলা হইত, ইহা হইতে আমাদের “বরগী” শব্দের উৎপত্তি। যে বৎসর বা যে অভিযানে যত লোক আবশ্যক, হইত, সেই অনুসারে রাজা কম বেশী সিলদার ভাড়া করিতেন।

 রাজ্যস্থাপনের গোড়ার দিকে শিবাজীর অধীনে এক হাজার (অথবা বারে শত) পাগা এবং দুই হাজাব সিলদার অশ্বারোহী ছিল। তাহার পর রাজ্যবিস্তার ও দূর দূর দেশ আক্রমণের ফলে তাঁহার সৈন্যদল ক্রমশঃ বাড়িয়া জীবনের শেষ বৎসরে দাঁড়াইয়াছিল—৪৫ হাজার পাগ। (১৯ জন সেনানীর অধীনে ২৯ দলে বিভক্ত) এবং ৬০ হাজার সিলাদার (৩১ জন সেনানীর অধীনে); আর এক লক্ষ মালে পদাতিক (৩৬ জন সেনানীর অধীনে)। এই পদাতিকগুলি বর্তমান সভ্যজগতের সৈন্যদের মত বারো মাস কুচকাওয়াজ করিত না বা রাজার কাজে সৈন্য-আবাসে আবদ্ধ থাকিত; তাহারা চাষের সময় নিজ গ্রামে গিয়া জমি চাষ করিত, আর বিজয়া দশমীর দিন বিদেশ আক্রমণ করিবার জন্য, অথবা যুদ্ধের আশঙ্কা থাকিলে তাহার আগেই, আবার সৈন্য-নিবাসে আসিয়া জুটিত; তখন তাহাদের অস্ত্র বর্ম্মে সজ্জিত ও ও দলবদ্ধ করিয়া নেতার অধীনে রাখিয়া সৈন্যদল গঠন করা হইত। দুর্গরক্ষী পদাতিকের ইহাদের হইতে পৃথক; তাহারা দুর্গের নীচে চাষ করিবার জন্য জমি পাইত, এবং পরিবারদিগকে দুর্গে (কখন-বা ঐ নীচে গ্রামে) রাখিত। ইহারা বারোমেসে চাকর; ঘর ছাডিয়া দূরে যাইতে হইত না।

 শিবাজীর নিজের ১২৬০ (অন্য মতে তিন শত) হাতা, তিন হাজার উট, এবং ৩৭ হাজার ঘোড়া ছিল।

সৈন্য-বিভাগেব শৃঙ্খলা

 রাজার নিজ অশ্বারোহী (আর্থাৎ পাগা)-র দল এইরূপে গঠিত হইত। ২৫ জন সাধারণ সৈন্যের (বারগার-এর) উপর এক হাবলদার (যেমন সার্জেণ্ট), পাঁচ হাবলাদার (অর্থাৎ ১২৫ জন সাধারণ সওয়ার)-এর উপর এক জুমলাদার (যেমন কাপ্টেন), এবং দশ জুমলাদার (অর্থাৎ, ১২৫০ জন সওয়ার)-এর উপর এক হাজারী (অর্থাৎ কর্ণেল)। তাহার উপর পাঁচ হাজারী (ব্রিগেডিয়ার জেনারাল, এবং সর্বোচ্চ সরু-ইনৌবৎ (কমাণ্ডার-ইন-চীফ)। প্রতি ২৫ জন অশ্বারোহীর জন্য একজন ভিস্তি ও একজন নালবন নির্দিষ্ট ছিল।

 পদাতিক বিভাগে নয়জন সিপাহী বা পাইক’-এর উপর এক নায়ক (কপোল), পাঁচ নায়কের (অর্থাৎ ৪৫ পাইকের) উপর এক হাবলাদার, দুই বা তিন) হাবলদারের উপর এক জুম্লাদার, দশ জুমদার (অর্থাৎ ৯০০-১৩৫০ পাইক)-এর উপর এক হাজারী।

 রাজার শরীর-রক্ষী (গার্ড ব্রিগেড) ছিল দুই হাজার বাছা বাছা মাব্‌লে পদাতিক, খুব জমকাল পোষাক ও ভাল ভাল অস্ত্রে সজ্জিত। প্রত্যেক সৈন্যদল (রেজিমেণ্ট)-এর সঙ্গে হিসাবপরীক্ষক (মজমুয়াদার), সরকার (কারভারি), আয়-লেখক (জমা-নবিস) এক একজন করিয়া থাকিত।

পাগা জুম্‌লাদারের
” মজমুয়াদারের
” হাজারীর
” জমানবিস প্রভৃতি তিনজনের একুন
” পাঁচ-হাজারীর
পদাতিক জুমলাদারের
 ” সবনবিসের
” হাজারীর
 ” সবনবিসের

বার্ষিক বেতন
 
 
 
 
 


 

 ৫০০ হোণ
১০০ হইতে ১২৫”
১,০০০ 
৫০০ 
২,০০০ 
 ১০০ হোণ
 ৪০”
 ৫০০”
১০০ হইতে ১২৫”

শিবাজীর রণনীতি

 তাঁহার সৈন্যগণ বর্ষাকালে নিজ দেশে ছাউনিতে যাইত; সেখানে শস্য, ঘোড়ার আস্তাবলের ব্যবস্থা থাকিত। বিজয়া দশমীর দিন সৈন্যগণ ছাউনি হইতে কুচ করিয়া বাহির হইত, আর সেই সময় সৈন্যদলের ছোটবড় সব লোকের সম্পত্তির তালিকা লিখিয়া রাখা হইত, তাহার পর দেশ লুঠিতে যাইত। আট মাস ধরিয়া লস্কর পরের মুলুকে পেট ভরাইত, চৌথ আদায় করিত। স্ত্রী, দাসী, নাচের বাঈজী সৈন্যদলের সঙ্গে যাইতে পারিত না। যে সিপাহী এই নিয়ম ভঙ্গ করিত তাহার মাথা কাটার হুকুম ছিল। “শত্রুর দেশে স্ত্রীলোক বা শিশুকে ধরিবে না, শুধু পুরুষ মানুষ পাইলে বন্দী করিবে। গরু ধরিবে না, ভার বহিবার জন্য বলদ লইতে পার। ব্রাহ্মণদের উপর উপদ্রব করিবে না, চৌথ দিবার জামিন-স্বরূপ কোনও ব্রাহ্মণকে লইবে না। কেহ কু-কর্ম্ম করিবে না। আট মাস বিদেশে সওয়ারী করিবার পর বৈশাখ মাসে ছাউনিতে ফিরিয়া আসিবে। তখন, নিজ দেশের সীমানায় পৌঁছিলে সমস্ত সৈন্যের জিনিষপত্র খুঁজিযা দেখা হইবে, পূর্বের তালিকার সঙ্গে মিলাইয়া যাহা অতিরিক্ত পাওয়া যায় তাহাব দাম উহাদেব প্রাপ্য বেতন হইতে বাদ দেওয়া যাইবে। বহুমূল্য জিনিষ থাকিলে তাহা বাজসরকারে জমা দিতে হইবে। যদি কোন সিপাহী ধনরত্ন লুকাইয়া রাখে এবং তাহার সর্দার টের পায়, তবে তাহাকে শাসন কবিতে হইবে।

 “সৈন্যদল ছাউনিতে পৌঁছিলে, হিসাব করিয়া লুঠের (সোনা, রূপা) বড় ও বস্ত্রাদি সঙ্গে লইয়া সব সর্দাবে বাজাব দশনার্থ যাইবে। সেখানে হিসাব বুঝাইয়া দিয়া, মালপত্র রাজভাণ্ডারে রাখিয়া, সৈন্যদেব বেতনের হিসাব যাহা প্রাপ্য তাহা রাজকোষ হইতে হইবে। যদি নগদ টাকার বদলে কোন দ্রব্য লইতে ইচ্ছা হয় তাহা হুজুরের কাছে চাহিয়া লইবে। গত অভিযানে যে যেমন কাজ ও কষ্ট সহ্য কবিয়াছে তদনুসারে তাহার পুরস্কার হইবে। কেহ নিয়মবিদ্ধ কাজ করিয়া থাকিলে, তাহার প্রকাশ্য অনুসন্ধান ও বিচার করিয়া তাহাকে দুর করিয়া দেওয়া হইবে। তাহার পর চারি মাস (অর্থাৎ আবার দশহরা পর্যন্ত) ছাউনিতে থাকিবে।” [সভাসদ-বখর]

দুর্গের বন্দোবস্ত

 প্রত্যেক দুর্গ ও থানা তিন শ্রেণীর কর্মচারীর হাতে রাখা ছিল; তাহাদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব বিভাগে প্রধান, প্রত্যেকেই অপর দুইজনের উপর সহিংস সতর্ক দৃষ্টি রাখিত; অতএব তাহাদের পক্ষে একজোটে প্রভুর দুর্গ খন নাশের ষড়যন্ত্র করা সম্ভব ছিল না। এই তিনজন— (১) হাবলাদার, (২) সর-ই-নৌবং, (৩) সবনিস। ইহাদের প্রথম দুইটি জাতে মারাঠা, তৃতীয়টি ব্রাহ্মণ, সুতরাং জাতিভেদের ঝগড়াতে ঐ তিনজনের দল বাঁধার ভয় দূর হইল। দুর্গের রসদ মাল প্রভৃতি একজন কায়স্থ লেখক (কারখানা-নবিস)-এর জিম্মায় থাকিত। বড় বড় দুর্গগুলির দেওয়াল চার-পাঁচ এলাকায় ভাগ করা ছিল, প্রত্যেক এলাকা একজন রক্ষীর (তট-সর-ই নৌবৎ-এর) হাতে। দুর্গের বাহিরে পাওয়াবি ও মুশী (বংশগত চোব)—এই দুই জাতের লোক, চৌকি দিত।

 দুর্গের হাবলদার নীচের অমলাদের নিয়োগ বরখাস্ত করিতে পারিত, সরকারী চিঠিপত্র তাহার নামে শাসিত, এবং সরকারের জন্য লিখিত চিঠিপত্রে নিজের মোহর দিয়া পাঠাই। তাহার কর্তব্য ছিল প্রত্যহ সন্ধ্যায় দুর্গা চাবি বন্ধ করা এবং পাতঃকালে তাহা খোলা। এই ফটকের চাবিগুলি সে সর্বদা সঙ্গে রাখিত, রাত্রে পর্যন্ত বালিসের নীচে গুঁজিয়া ঘুমাইত। সব্বদাই চারিদিকে ঘুরিয়া দুর্গের ভিতরে ও বাহিরে সব ঠিক আছে কিনা দেখিত, আর অসময়ে খবর না দিয়। হঠাৎ গিয়া পাহারাদারেরা ঘুমাইতেছে কি সতর্ক আছে তাহার খোঁজ লইত। সর-ই-নৌবৎ রাত্রের চৌকীদারদের কাজ দেখিত।

ভূমির কর ও প্রজাশাসন-প্রণালী

 “দেশের সমস্ত জমি জরিপ করিয়া ক্ষেত্র ভাগ করিবে। আটাশ আঙ্গুলে একহাত, পাঁচ হাত ও পাঁচ মুঠিতে এক কাঠি, বিশ কাঠি লম্বা ও বিশ কাঠি প্রস্থে এক বিঘা, ১২০ বিঘায় এক চাবর। এইরূপে প্রত্যেক গ্রামে জমির কালি মাপ করা হইবে। প্রতি বিঘার ফসল নির্ধারণ করিয়া তাহার দুইভাগ রাজা লইবেন, আর তিন ভাগ প্রজা পাইবে।

 নুতন প্রজা বসতি করাইয়া তাহাদের খাইবার বাবদে এবং গাইবলদ ও বীজশস্য কেনার জন্য টাকা অগ্রিম দিবে, এবং তাহা দুই-চার বৎসরে পরিশোধ করিয়া লইবে। রায়তদের নিকট হইতে ফসল কাটার সময় ফসলের আকারে রাজকর লইবে। “প্রজাগণ জমিদার দেশমুখ ও দেশাইদের আজ্ঞাধীন থাকিবে না; উহারা প্রজাদের উপর কোন কর্তৃত্ব করিতে পারিবে না। অন্যান্য রাজ্যে এই-সব পুরুষানুক্রমিক ভূস্বামী (মিরাসদার)-র ধন ক্ষমতা ও সৈন্যবলে বাড়িয়া প্রায় স্বাধীন হইয়া উঠিয়াছিল; অসহায় প্রজার সব তাহাদের হাতে; তাহারা দেশের রাজাকে অগ্রাহ্য করিত এবং প্রজার দেওয়া রাজকর নিজে খাইয়া রাজসরকাবে অতি কম টাকা জমা দিত। শিবাজী এই শ্রেণীর জমিদারের দর্প চূর্ণ করিলেন। মিরাসদারদের গড় ভাঙ্গিয়া দিয়া, কেন্দ্রস্থানগুলিতে নিজ সৈন্যের থানা বসাইয়া, জমিদারদের হাত হইতে সব ক্ষমতা কাড়িয়া লইয়া, তাহাদের প্রাপ্য আয় নিদিষ্ট হারে বাঁধিয়া দিয়া, প্রজাপীড়নের ও রাজস্ব-লুণ্ঠনের পথ বন্ধ করিয়া দিলেন। জমিদারদের গড-নির্মাণ নিষিদ্ধ হইল। প্রত্যেক গ্রাম-কর্মচারী নিজ ন্যায্য পারিশ্রমিক (অর্থাৎ শস্যের অংশ) ভিন্ন আর কিছু পাইবে না।” [সভাসদ]

 তেমনি জাগীরদারগণও নিজ নিজ জাগীরের মহলে শুধু খাজনা আদায় করিবেন, প্রজাদের উপর ভূস্বামী বা শাসনকর্তার মত কোন প্রকার ক্ষমতা তাহাদের নাই। কোন সৈন্য আমলা বা রায়তকে জমির উপর স্থায়ী সত্ব (মোকাসা) দেওয়া হইত না, কারণ তাহা হইলে তাহারা স্বাধীন হইয়া বিদ্রোহ সৃষ্টি করিত এবং দেশে রাজার ক্ষমতা লোপ পাইত।

 কমবেশী এক লাখ হোণ আদায়ের মহালের উপর একজন সুবাদার (বার্ষিক বেতন চারিশত হোণ) ও একজন মজমুয়দার (বেতন ১০০ হইতে ১২৫ হোণ) রাখা হইত; পালকী খরচ বাবদ সুবাদারকে আরও চারি শত হোণ দেওয়া হইত। এই সমস্ত সুবাদার জাতে ব্রাহ্মণ, এবং পেশোয়ার তত্ত্বাবধানে থাকিত। [সভাসদ]

ধর্ম্ম-বিভাগ

 রাজ্যমধ্যে যেখানে দেব ও দেবস্থান ছিল, শিবাজী তাহাতে প্রদীপ নৈবেদ্য নিত্যস্নান প্রভৃতির যথাযোগ্য বন্দোবস্ত করিতেন। মুসলমান পীরের আস্তানা ও মসজিদে প্রদীপ ও শিরণী সেই সেই স্থানের নিয়ম অনুসারে রাখিবার জন্য অর্থ সাহায্য দিতেন। বাবা ইয়াকুৎ নামক পীরকে ভক্তি করিয়া নিজ খরচে কেশী-নামক শহরে বসাইয়া জমি দান করিলেন। “বেদক্রিয়া-দক্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে যোগক্ষেম ব্রাহ্মণ, বিদ্যাবত্ত, বেদশাস্ত্র-সম্পন্ন জ্যোতিষী, অনুষ্ঠানী, তপস্বী, সৎপুরুষ গ্রামে গ্রামে বাছিয়া তাহাদের পরিবারের সংখ্যা অনুসাবে যে পরিমাণ অন্নবস্ত্র লাগে সেই আয়ের মহাল ঐ গ্রামে গ্রামে দিলেন। প্রতি বৎসর সরকারী আমলারা এই সাহায্য তাহাদের পৌছাইয়া দিত।” [সভাসদ]

 “লুপ্ত বেদচর্চা শিবাজীর অনুগ্রহে আবার জাগিয়া উঠিল। যে রাহ্মণ ছাত্র এক বেদ কণ্ঠস্থ করিয়াছে তাহাকে প্রতি বৎসর এক মণ চাউল, যে দুই বেদ কণ্ঠস্থ করিয়াছে তাহাকে দুই মণ, ইত্যাদি পরিমাণে দান করা হইত। প্রত্যেক বৎসর তাহার পণ্ডিত রাও শ্রাবণ মাসে ছাত্রদের পরীক্ষা করিয়া তাহাদের বৃত্তি কমবেশী করিয়া দিতেন। বিদেশী পণ্ডিতদের সামগ্রী এবং মারাঠা দেশের পণ্ডিতদেব খাদ্য দক্ষিণ-স্বরূপ দেওয়া হইত। মহাপণ্ডিতদের ডাকিয়া সভা করিয়া নগদ টাকা বিদায় দেওয়া হইত।” [চিটনিস-বখর]

রামদাস স্বামী

 শিবাজীর গুরু রামদাস স্বামী (জন্ম ১৬০৮ মৃত্যু ১৬৮১, খৃঃ) মহারাষ্ট, দেশের অতি বিখ্যাত এবং সর্বজনপূজ্য সাধু-পুরুষ। তাঁহার ভক্তিশিক্ষার বাণী অতি সরল সুন্দর ও পবিত্র। ১৬৭৩ সালে সাতারা-দুর্গ জয় করিবার পর শিবাজী গুরুকে উহার চারি মাইল দক্ষিণে পারলী (অথবা সজ্জনগড়া) এ আশ্রম বানাইয়া দেন। এখনও লোকে বলে যে সাতারার ফটকের উপব চূড়ায় একখানা পাথরের ফলকে বসিয়া শিবাজী পাবলী-স্থিত গুরুর সঙ্গে দৈববলে কথাবার্ত্তা কহিতেন। রামদাস আর আর সন্ন্যাসীব মতই প্রত্যহ ভিক্ষা করিতে যাইতেন। শিবাজী ভাবিলেন, “গুরুকে এত ধন ঐশ্বর্য দান কবি, তিনি ভিক্ষা করেন কেন? তাঁহার কিসে সাধ পূরিবে?” তাহার পরদিন একখানা কাগজে রামদাসের নাম সমস্ত মহারাষ্ট্র রাজ্য ও রাজকোষ দিলাম বলিয়া দানপত্র লিখিত তাহাতে নয় মোহর ছাপিয়া ভিক্ষার পথে গুরুকে ধরিয়া তাহার পায়ের উপর রাখিলেন॥ রামদাস মৃদু হাসিয়া বলিলেন,” বেশ তাই এসব গ্রহণ করলাম। আজ হতে তুমি আমার গোমস্তা মাত্র। এই কাজ। . এই রাজ্য নিজের ভোগসুখের বা স্বেচ্ছাচার করিবার দ্রব্য নহে; তোমার মাথার উপণে এক বড় প্রভু আছেন ওঁহর জমিদাব’ তুমি উহার বিশ্বাসী ভৃত্য হইয়া চালাইতেছ—এই দায়িত্বজ্ঞানে ভবিষ্যতে রাজ্যশাসন করিবে।

 রাজ্যের প্রকৃত স্বত্বাধিকারী যখন এক সন্ন্যাসী, তখন সেই সন্ন্যাসীর গেরুয়া-বস্তু শিবাজীর রাজপতাকা হইল—ইহার নাম “ভাগবে ঝাণ্ডা।”

“সমর্থ” রামদাস স্বামীর জীবন ও শিক্ষা

 ১৬০৮ সালে চৈত্র মাসে শুক্ল নবমীতে সূর্য-উপাসক একটি ব্রাহ্মণবংশে রমদাসের জন্ম, তাঁহার পিতার দেওয়া নাম ‘নারায়ণ। বাল্যকাল হইতেই তাহার প্রাণ ধর্ম্মের দিকে আকৃষ্ট হইল; জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মন্ত্রগ্রহণের সময় তিনিও মন্ত্র লইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলেন। বারো বৎসর বয়সে এই পিতৃহীন বালক মাতার ব্যাকুল অনুরোধে বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু মন্ত্র পড়িবার সময় বিবাহ-সভা হইতে দৌড়িয়া পলাইয়া গেলেন, এবং সংসার ত্যাগ করিলেন। তাহার পর নাসিক নগরের নিকট গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী দুষ্পাঠ্য বারো বৎস ধরিয়া ধর্ম্মশিক্ষা করিবার পর দুষ্পাঠ্য দীক্ষা লইলেন। মহারাষ্ট্রে লোকে বিশ্বাস দুষ্পাঠ্য তাঁহার আজানুলম্বিত বাহু দুষ্পাঠ্য সাধুগণ বিষ্ণুর অপর অবতার দুষ্পাঠ্য কিন্তু রামদাস দুষ্পাঠ্য কে নিজ ধর্ম্মের উপাস্য দেবতা করেন।

 দীক্ষার পর বারো বৎসর ধরিয়া রামদাস দুষ্পাঠ্য প্রবাদ আছে যে স্বপ্নে রামচন্দ্র আবির্ভূত হইয়া তাঁহাকে বলেন দুষ্পাঠ্য ভক্ত সম্প্রদায় গঠন কর।” দুষ্পাঠ্য শেষ করিয়া ৩৬ বৎসর বয়সে (১৬৪৪) রামদাস জন্মভূমিতে ফিরলেন। দুষ্পাঠ্য গ্রামে বসতি করিয়া সেখানে রাম ও হনুমানের দুটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করিলেন (১৬৪৮)। অসাধারণ দক্ষতার সহিত তিনি অল্পদিনেই “রামদাসা” নামে এক নূতন সম্প্রদায় গড়ীয়া তুলিলেন, তাঁহার অনেক শিষ্য হইল, তাহাদের জন্য মঠ স্থাপিত হইল। এই রূপে দশ বৎসর কাটিয়া গেল।

 তাহার পর আরও দশ বৎসব ধরিয়া তিনি দুষ্পাঠ্যগড় দুর্গের নিকট শিবতর-গ্রামে নির্জ্জনবাস ও চিন্তার ফলে ‘দাস-বোধ” নামক পদ্য-গ্রন্থ (২০ সর্গে) রচনা করিয়া তাহাতে নিজের ধর্ম্ম-উপদেশ লিপিবদ্ধ করিলেন। সংস্কৃত ও প্রাচীন মারাঠী সাহিত্যে তাঁহার পাণ্ডিত্য ছিল, এজন্য গ্রন্থখানি বড়ই উপাদেয় হইয়াছে।

 রামদাসের পুণ্য-প্রভাবে মোহিত হইয়া শিবাজী ‘শ্রীরাম, জয় রাম, জয় জয় রাম” এই মন্ত্রে তাহার নিকট দীক্ষা লইলেন। গুরু তাঁহাকে সংক্ষেপে অতি মহান্ উপদেশ দিলেন। কিন্তু যখন শিবাজী ভক্তির আবেগে বলিলেন, “আমি আপনার চরণে থাকিয়া সেবা করিব” তখন রামদাস তাহাকে ধমকাইয়া নিষেধ করিলেন, বলিলেন, “ইহার জন্যই কি তুমি আমার কাছে প্রার্থী হইয়া আসিয়াছ? তুমি ক্ষত্রিয়, কর্ম্মবীর, তোমার কর্তব্য দেশ ও প্রজাদের বিপদ হইতে রক্ষা করা, দেবব্রাহ্মণের সেবা করা। তোমার করিবার অনেক কাজ রহিয়াছে। ম্লেচ্ছগণ দেশ ছাইয়া ফেলিয়াছে; তোমার কর্তব্য তাহাদের হাত হইতে দেশ উদ্ধার করা। ইহাই রামচন্দ্রের অভিপ্রায়। ভগবদ-গীতায় অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ স্মরণ কর—যোদ্ধার কর্তব্যের পথে চল, কর্ম্মযোগ সাধনা কর।”

 ১৬৭৩ সালে পারলি-দুর্গ অধিকার করিবার পর শিবাজী সেখানে রামদাস স্বামীকে আনিয়া বসাইলেন, তাহার জন্য মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়া দিলেন, দুর্গের নূতন নাম রাখিলেন সজ্জনগড়, অর্থাৎ “সাধুর গড়”; সন্ন্যাসী ও ভক্তদের ভরণ-পোষণের জন্য নিকটের গ্রামে দেবোত্তর জমি দিলেন।

কর্ম্মযোগের আদর্শ

 রামদাস শিবাজীকে শ্রেষ্ঠ কর্মযোগী বলিয়া সর্বদাই প্রশংসা করিতেন, তাঁহাকে সকলের সম্মুখে রাজার আদর্শ বলিয়া গরিতেন। রামদাস কর্তৃক পদে রচিত শিবাজীর নামে এক পত্র মহারাষ্ট্র দেশে প্রচলিত আছে, তাহাতে গুরু রাজাকে সম্বোধন করিতেছেন-“হে নিশ্চয়ের মহামেরু! বহুলোকের সহায়, অটলপ্রতিজ্ঞ, ইন্দ্রিয়জয়ী, দানবীর, অতুল গুণসম্পন্ন, নরপতি, অশ্বপতি, গজপতি, সমুদ্র ও ক্ষিতির অধীশ্বর, সদা প্রবল বিজয়ী, বিখ্যাত ধার্মিক বীর! •••পৃথিবী তোলপাড় হইয়াছে; ধর্ম্ম লোপ পাইয়াছে। গো-ব্রাহ্মণ, দেব ধর্ম রক্ষা করিবার জন্য নারায়ণ তোমাকে পাঠাইয়াছেন। .. ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য নিজ কীর্ত্তি অমর রাখিও।”

 শিবাজী শেষ-বয়সে রাজকার্য্যে সর্ব্বদা স্বামীর উপদেশ লইতেন। রামদাসের শিক্ষায় ভক্তিযোগ ও কর্ম্মযোগের অনির্ব্বচনীয় সামঞ্জস্য হইয়াছিল। তাঁহার জীবনের দৃষ্টান্ত এবং জটিল রাজনৈতিক সমস্যায় শিবাজীর প্রতি উপদেশ মহারাষ্ট্র-স্বাধীনতার সাধনাকে সিদ্ধির সহজ পথে আনিয়া দেয়। রামদাসের ধর্ম্মশিক্ষাকে ‘ফলিত ভগবদ্গীতা” বলা যাইতে পারে; তাহার শিষ্য গীতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন।

রামদাসে রাজনৈতিক উপদেশ

 শিবাজীর পর যুবক শম্ভুজী যখন রাজা হইলেন, তখন বৃদ্ধ রামদাস মৃত্যু আসন্ন বুঝিয়া নূতন রাজাকে অনেক উপদেশ দিয়া পদ্যে এক পত্র লেখেন। তাহাতে আছে—

বহু লোককে একত্র করিবে,
বিচার করিয়া লোক নিযুক্ত করিবে,
শ্রম করিয়া আক্রমণ করিবে
স্নেচ্ছের উপর। ১৪
যাহা আছে তাহার যত্ন করিবে,
পরে আরও [রাজ্য] যোগ করিবে,
মহারাষ্ট্র-রাজ্য [বিস্তার] করিবে
যত্রতত্র। ১৫
লোকদের সাহস দিবে,
বাজি রাখিয়া তরবারি চালাইবে,
‘চড়িয়া বাড়িয়া’ [ক্রমে অধিকতর] খ্যাতি
লাভ করিবে। ১৬

শিব রাজারে স্মরণ রাখিও,
জীবনকে তৃণ সমান মনে করিও,
ইহলােকে পরলােকে তরিবে
কার্ত্তিরূপে। ১৭
শিব রাজার রূপ স্মরণ কর,
শিব রাজার দৃঢ় সাধনা স্মরণ কর,
শিব রাজার কীর্ত্তি স্মরণ কর
ভূমণ্ডলে। ১৮
শিব রাজার বােলচাল কেমন,
শিব রাজার চলন কেমন,
শিব রাজার বন্ধু করিবার ক্ষমতা কেমন,
সেইমত। ১৯
সকল সুখ ত্যাগ করিয়া,
যােগ সাধিয়া,
রাজ্য-সাধনায় কেমন তিনি
দ্রুত অগ্রসর হইয়াছিলেন। ২০
তুমি তাহারও অধিক করিও;
তবে ত তােমাকে পুরুষ বলিয়া জানা যাইবে
* * *। ২১

শিবাজী-পরিবার

 শিবাজীর আট বিবাহ—

 ১। সই বাঈ (নিম্বলকরের কন্যা); মৃত্যু ৫ সেপ্টেম্বর ১৬৬৯ তাঁর পুত্র শম্ভুজী।

 ২। সয়িরা বাই (শির্কের কন্যা); শিবাজীকে বিষ খাওয়াইয়া মারিয়া ছিলেন এই অপবাদ দিয়া শম্ভুজী তাঁহার প্রাণবধ করেন। তাঁহার পুত্র রাজারাম।

 ৩। পুতলা বাঈ (মোহিতের কন্যা); স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জ্জন করেন।

 ৪। সাকোয়াব বাঈ (গাইকোয়াড়দেব কন্যা); বিবাহ ১৬৫৬ সালে। ১৬৮৯ সালে মুঘলেরা রায়গড় অধিকার করিবার পর বন্দী। ইঁহাকে অনেক বৎসর আওরংরজাবের শিবিরে থাকিতে হয়।

 ৫। কাশী বাঈ। মৃত্যু ১৬৭৪ মার্চ্চ মাসে।

 ৬ ৭। দুইজন স্ত্রী, ১৬৭৪ সালের মে মাসে শিবাজীর অভিষেকের পূর্ব্বে বৈদিক মন্ত্রসহ ইঁহাদের বিবাহ হয়।

 ৮। একজন স্ত্রী, ৮ই জুন ১৬৭৪ সালে বিবাহ হয়।


 শিবাজীব দুই পুত্র ও তিন কন্যা ছিল, যথা।

 ১। শম্ভুজী, জন্ম ১৪ই মে ১৬৫৭, সিংহাসনলাভ ২৮ জুন ১৬৮০ আওবংজীব কর্ত্তৃক প্রাণবধ ১১ মার্চ্চ ১৬৮৯।

 ২। রাজারাম, জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৬৭০, সিংহাসন-অধিরোহণ ৮ই ফেব্রুয়ারী ১৬৮৯, মৃত্যু ২ মার্চ্চ ১৭০০।

 ৩। সখু বাঈ, মহাফজী নিম্বলকরের স্ত্রী।

 ৪। অম্বিকা বাঈ, হবজী মহাডিকের স্ত্রী।

 ৫। রাজকুমারী বাঈ, গণোজীরাজ শির্কের স্ত্রী।

শিবাজীর আকৃতি ও ছবি

 শিবাজীর বয়স যখন ৩৭ বৎসর তখন (অর্থাৎ ১৬৬৪ সালে) সুরতের জনকত কইংরাজ তাঁহাকে দেখিয়া এইরূপ বর্ণনা লিখিয়াছেন —“তাঁহার দৈর্ঘ্য মাঝামাঝি রকমের, কিন্তু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি বেশ পরিমাণ-সই। তাঁহার চলন-ফেরন সতেজ জীবন্ত; মুখে মৃদুহাসি লাগিয়াই আছে; চক্ষুদুটি তীক্ষ উজ্জ্বল, সবদিকে ঘুবিতেছে। তাহার বর্ণ সাধারণ দক্ষিণীদের অপেক্ষা গৌর।” ফরাসী-পর্যটক তেভেননা ইহার দুই বৎসর পরে লেখেন,—“এই রাজার আকার হোট, বর্ণ ফরসা, চক্ষুটি প্রচুর তেজঃপূর্ণ এব চঞ্চল।”

 শিবাজীব তিনখানি বিশ্বাসযোগ্য ছবি আছে; এগুলি যে তাহার সময়ে আঁকা, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়।

 (১) লণ্ডন ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত প্রতিকৃতি। ইহা একজন ডচ, ভদ্রলোক আওরংজীবের জীবদ্দশায় (অর্থাৎ ১৭০৭ এর পূর্বে) ভারতবর্ষে ক্রয় করেন।

 (২) হল্যাণ্ডে রক্ষিত প্রতিকৃতি। ১৭৭২ সালে ডাচ-দূত বাদশাহর নিকট লাহোরে যাইবার সময় ইহা ক্রয় করেন। ১৭২৪ সালে ভ্যালেণ্টিন ইহার এক এনগ্রেভিং তাহার পুস্তকে প্রকাশ করেন। এই ছবির একটি অতি সুন্দর (এবং কতক পরিবর্তিত) স্টীল এনগ্রেভিং অর্ম তাহার Historical Fragments গ্রন্থে ১৭৮২ সালে ছাপেন, এবং তাহাই নানাস্থলে পুনর্মুদ্রিত হইয়া ভারতে সর্বত্র পরিচিত হইয়াছে।

 (৩) কুমার মুয়জ্জমের চিত্রকর মীর মহম্মদ অশ্বপৃষ্ঠে শিবাজীর যে চিত্র আঁকিয়া ১৬৮৬ সালে মানুশীকে উপহার দেয়, তাহা এখন প্যারিসের রাষ্ট্রীয় পুস্তকাগারে রক্ষিত আছে। ইহার সুন্দর প্রতিলিপি আভিনসম্পাদিত Storia do Mogor গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আছে, এবং দুখানা খারাপ অনুকরণ (বোধ হয় উড-কাট) ১৮২১ এবং ১৮৪৫ সালে দুইখানি ফরাসী গ্রন্থে মুদ্রিত হয়। কিন্তু দক্ষতার অভাবে এই চিত্রকর শিবাজীর মুখে তাহার চরিত্রের বিশেষত্বটুকু ফুটাইয়া তুলিতে পারে নাই।

 বম্বের মিউজিয়মে এবং পুণার ইতিহাস-মণ্ডলের হন্তে শিবাজীর দুইখানাছবি আছে; প্রথমটিতে শিবাজী অসিহস্তে দণ্ডায়মান, দ্বিতীয়টিতে তিনি অশ্বারোহণ তরবারি দিয়া সিংহ-শিকারে নিযুক্ত (মিনিএচার)। এগুলি মুঘল-যুগের হইলেও আঁকিবার কাল ঠিক নির্ণয় করা যায় না।

 সব ছবিগুলিতেই শিবাজীর মুখ একই গঠনের, কিন্তু প্রথম দুইখানি ছবিতে তাহার তেজপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ঠিক প্রকাশ পাইয়াছে।