শিবাজী/দ্বাদশ অধ্যায়

দ্বা দ শ অ ধ্যা য়

কানাড়ায় মারাঠা-প্রভাব

কানাড়া দেশ-বর্ণন

 শিবাজী এত ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে অভিযান ও দেশজয় করেন যে তাহার সবগুলির বিস্তৃত বর্ণনা অনাবশ্যক। দক্ষিণ-কোঁকন এবং উত্তর-কানাড়ায় (অর্থাৎ গোয়ার উত্তর ও দক্ষিণের কুলদেশে) তিনি কি করিয়াছিলেন এখানে তাহাই বলা হইবে। বম্বের পশ্চিম-কুলে রত্নগিরি এবং উত্তরকানাড়া জেলায় কতকগুলি বন্দর ছিল,—যথা রাজাপুর, খারেপটন, বিনগুরলা, মালবন, কারোয়ার, মিরজান, ইত্যাদি। ইহার অনেক গুলিতে ইউরোপীয় বণিকদের কুঠ এবং জাহাজ লাগিবার ঘাট ছিল। মহা উর্ব্বর কানাড়া দেশ হইতে মরিচ, এলাচ, মসলিন্ কাপড, রেসম, গালা (লাক্ষা) প্রভৃতি অনেক মূল্যবান মাল এই সব বন্দরের ভিতর দিয়া দেশ-বিদেশে রপ্তানী হইত, আর ইহাতে এদেশে অগাধ ধন জমিত।

 ‘রুস্তম্-ই-জমা’-উপাধিধারী এক বিজাপুরী ওর অধীনে দক্ষিণকোঁকন ও কানাড়া ছিল। শিবাজী কয়েকবার আক্রমণ করিয়া ১৬৬৪ সালের মধ্যে গোয়র উত্তরে সব দেশ, অর্থাৎ রত্নগিরি ও সাবস্ত-বাড়ী, নিজ রাজ্যভুক্ত করিলেন। কিন্তু গোয়ার দক্ষিণ ও পূর্বে বিজাপুরী-রাজ্যে অধিকার বিস্তার করিতে তাঁহাকে অনেক বাধা পাইতে হইয়াছিল; বহু বিলম্বে তিনি এই কার্য্যে আংশিক মাত্র সফল হন। পশ্চিম-কানাড়ার অধিত্যকায় দুইটি বড় হিন্দু রাজ্য ছিল,—বিদনুর এবং সোন্দা। ১৬৬৩ সালে বিজাপুরী সুলতানের আক্রমণে বিদনুরের রাজা কাবু হইয়া পড়েন এবং ৩৫ লক্ষ টাকা নজর দিতে বাধ্য হন। তাহার পব প্রায়ই বিজাপুরী সৈন্য এই দেশে ঢুকিত, এখন মারাঠারাও সেই পথ ধরিল। রুস্তম-ই-জমান শিবাজীর বংশের দুপুরুষের বন্ধু, তিনি কখনও মারাঠাদের বিরুদ্ধে লাগিয়া পড়িয়া যুদ্ধ করিতেন না, বাহিরে লড়াই-এর ভাব দেখাইয়া সুলতানকে ভুলাইতেন মাত্র। একথা দেশের সকলে, এমন কি ইংরাজ-কুঠীর সাহেবেরাও জানিত।

ঘোরপডে-উচ্ছেদ এবং সাবস্ত-বাড়ী অধিকার

 ১৬৬৪ সালের এপ্রিল মাসে বিজাপুরী ওমরারা আবার বিদনুর আক্রমণ করিল কারণ, সেখানে রাজপরিবার-মধ্যে কলহ ও খুনোখুনি আরম্ভ হইয়াছিল। সেই সুযোগে শিবাজী ঐ বৎসরের কয়েক মাস যাবৎ এই প্রদেশের ভিতর দিয়া ইচ্ছামত দেশলুঠ ও নগর-অধিকার করিয়া ঘুরিতে লাগিলেন। অক্টোবব ও নবেম্বর মাসে বহলোল খাঁর সহিত তাঁহার দুইবার যুদ্ধ হয়;প্রথমটায় তাঁহার হার, এবং দ্বিতীয়টায় জিত হয়। এই সময় তিনি মুদহোল গ্রাম আক্রমণ করিয়া তথাকার জমিদার ঘোরপডে বংশ প্রায় নির্ম্মূল করিয়া দেন। মারাঠ প্রবাদ এই যে, যখন (১৬৪৮ সালে) বিজাপুরী উজীর জিঞ্জির নিকট শাহজীকে কয়েদ করেন, তখন বাজী ঘোরপড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া শাহজীর পলায়নে বাধা দিয়া তাহাকে ধরাইয়া দেয়, এবং সে জন্য শাহজী শিবাজীকে পত্র লেখেন—“যদি তুমি আমার পুত্র হও, তবে এই দুষ্কার্য্যের জন্য ঘোরপড়ের উপর প্রতিহিংসা লইও।” কিন্তু এই গল্প বিশ্বাসের অযোগ্য, কারণ মুদহোল-জয়ের দশ মাস আগে শাহজীর মৃত্যু হইয়াছিল।  ১৬৬৪ ডিসেম্বর মাসে শিবাজী রত্নগিরি জেলার দক্ষিণ-পূর্ব্ব অংশ, বর্তমান সাবন্ত-বাড়ী জমিদারী, দখল করেন। এখানকার ছোট ছোট দেশাই (জমিদার)-গুলি বিজাপুরের অধীন ছিল; তাহারা শিবাজীর ভয়ে সর্বস্ব ছাড়িয়া প্রথমে জঙ্গলে পরে গোয়াতে আশ্রয় লইল, এবং সেখানে বসিয়া নিজ নিজ রাজ্য ফিরিয়া পাইবার বিফল চেষ্টায় অনেক বার সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছিল। তজ্জন্য শিবাজী রাগিয়া পত্র লেখায়, পোর্তুগীজ-রাজপ্রতিনিধি শেষে এইসব দেশাইকে নিজ এলাকা হইতে বাহির করিয়া দিলেন (মে ১৬৬৮)। ইহার পর কুডালের দেশাই লখম সাবন্ত(বর্তমান সাব-বাড়ী-রাজ্যের আদিপুরুষ এবং জাতিতে ভোসলে) শিবাজীর বশ্যতা স্বীকার করিয়া তাঁহার অধীনে জাগীরদার হইয়া নিজ জমিদারী ফিরিয়া পাইলেন, কিন্তু তাহাকে দুর্গ নির্মাণ করিতে ও নিজের সৈন্য রাখিতে নিষেধ করা হইল।

 রুস্তম-ই-জমান গোপনে শিবাজীর সহায়ক হওয়ায়, এমন কি মারাঠাদের সহিত একজোটে নিজ রাজার প্রজাদের নিকট হইতে লুঠকরা সম্পত্তি ভাগাভাগি করায়, ঐ প্রদেশে শিবাজীর বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার মত কেহই রহিল না, সর্ব্বত্রই ধনী ও বণিকের। মারাঠাদের ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল, ঘরবাডী ছাড়িয়া পাইল, ঐ দেশের অত বড় ও বিখ্যাত বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হইয়া গেল। কোন স্থানই তাঁহার গ্রাস হইতে রক্ষা পাইত না।

বসরুব এবং কাবোয়ার লুণ্ঠন

 বিদরের প্রধান বন্দর বসরুর (ম্যাপের Barcelore); এটা হিন্দুর রাজ্য, ইহার রাজা শিবাজীর নিকট কোন অপরাধ করেন নাই, এবং মহারাষ্ট্রের ত্রিসীমার কাছেও যাইতেন না। কিন্তু বাণিজ্যের ও শিল্পবিক্রয়ের ধনে ঐ অঞ্চলে বসরুর অতুলনীয় ঐশ্বর্য্যশালী হইয়া উঠিয়াছিল। অতএব শিবাজী ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৬৬৫ সালে, ৮৮খানা জাহাজে সৈন্য চড়াইয়া রত্নগিরি জেলার তীর হইতে রওনা হই। হঠাৎ বসরুবে আসিয়া হাজির হইলেন। এখানে যে তাঁহার আগমন হইবে তাহা কেহ স্বপ্নেও ভাবে নাই, সুতরাং অত্মরক্ষার জন্য কেই প্রস্তুত ছিল না। মারাঠারা একদিনের অবাধ লুঠই অগণিত ধনরত্ন পাইল পরদিন ঐ শহর ছাড়িয়া। শিবাঙ্গী সমুদ্র তীবে গোকর্ণ নামক ভাব বিখ্যাত তীর্থে নামিয়া তথাকার শিবমন্দিবের সামনে স্নান পূজাদি পুণ্যক্রিয়া সারিলেন। তাহার পর হাত গুলিকে দেশে পাঠাইয়া দিয়া, নিজে চাবি হাজার পদাতিকের সঙ্গে উত্তবাদকে কুচ কবিয়া আঙ্কোল হইযা কাবোয়ার নগরে[](পৌঁছিলেন)।

 এই বন্দরে ইংরাজদের একটি বড় কুঠী ছিল তাঁহারা ভয়ে শিবাজীর রাজ্যে নানাস্থানে বেতনভোগী চর রাখিয়া তাঁহার গতিবিধি ও অভিসন্ধির পাক। খবর আগে হইতে অনাইত। এখন শিবাজীর এদিকে আগমনের সংবাদ পাইবামাত্র তারা কোম্পানীর টাকাকড়ি ও মাল একখানা ছোট ভাড়াটে জাহাজে বোঝাই করিয়া কুঠী ছাডিয়া তাহাতে আশ্রয় লইল। সেই রাত্রে বহলোল খাঁর অনুচব শের খাঁ(হাবশী), প্রভুর মাতাব মক্কা-যাত্রার জন্য জাহাজ ঠিক করিতে এই বন্দরে উপস্থিত হইলেন, এবং পৌঁছিবার পর প্রথম শুনিলেন যে শিবাজীও সেখানে আসিয়াছেন। তিনি তাড়াতাড়ি নিজ বাসা দুর্গের মত ঘিরিয়া, সঙ্গের পাঁচ শত বক্ষ-সৈন্যকে চারিদিকে দাঁড় করাইয়া, মাল ও টাকা সুরক্ষিত করিয়া, শিবাজীকে সেই রাত্রেই সংবাদ পাঠাইলেন যে তিনি যেন ঐ শহরে না ঢুকেন, কারণ ঢুকিতে চেষ্টা করিলে শের খাঁ যতক্ষণ প্রাণ থাকিবে তাঁহার সঙ্গে লড়বেন। শের খার সাহস এবং নেতৃত্বের যশ কাহারও অজানা ছিল না। আর বহলোলও বিজাপুরের সর্বশ্রেষ্ঠ ওমরা। এই সব কারণে শিবাজী শের খাঁকে আক্রমণ করতে সাহসী হইলেন না, এবং কারোয়ার শহরের কোন ক্ষতি না করিয়া কিছু দূরে নদীতীরে শিবির ফেলিলেন।

 এখান হইতে পরদিন (২৩ ফেব্রুয়ারি) দূত পাঠাইয়া তিনি শের খাঁকে জানাইলেন, “হয় ইংরাজদের ধরিয়া আমার হাতে দাও, না হয় তুমি শহর ছাড়িয়া চলিয়া যাও, আমি ওখানে গিয়া ইংরাজদের উপর প্রতিহিংসা লইব, কারণ তাহারা আমার চিরশত্রু!” শের খাঁ কি উত্তর দিবেন ইংরাজদের জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন। তাহারা জানাইল, “আমাদের কাছে এই জাহাজে বারুদ ও গোলা ভিন্ন আর কোন ধনদৌলৎ নাই। শিবাজী আসিয়া তাহা লইয়া যাইতে পারেন, যদি তিনি মনে করেন যে তাহাতে টাকার মত কাজ দিবে।” এই উত্তর শুনিয়া শিবাজী অত্যন্ত রাগিয়া বলিলেন, “যাইবার আগে ইংরাজদের দেখিয়া লইব।” স্থানীয় বণিকেরা তখন ভয়ে চাঁঁদা[]তুলিয়া তাহাকে কিছু নজর দিল। তাহা লইয়া শিবাজী ঐদিন চলিয়া গেলেন; যাইবার সময় বলিতে লাগিলেন, “শের খাঁ এবার আমার হোলীর সময়ের শিকার মাটি করিয়াছে। তাহার পর ভীমগড় (১৪ মার্চ) হইয়া শিবাজী দেশে ফিরিলেন, কারণ এই মাসেই জয়সিংহ তাঁহার আশ্রয় পুরন্দর-দুর্গ আক্রমণ করেন।


 এই আক্রমণের সময় বিজাপুরী দক্ষিণ-কেঁকনের অনেকটা (অর্থাৎ বিনগুরলা ও কুড়াল) শিবাজীর হাত হইতে উদ্ধার করিল। কানাড়ার উপকুলে করোয়ার প্রভৃতি স্থান দুই পক্ষের দ্বারাই লুঠ হইতে লাগিল।

ফোণ্ডা দুর্গ অধিকার

 গোয়ার পূর্ব্ব-সীমানার নিকট বিজাপুর-রাজ্যের সর্ব্বপ্রধান দুর্গ ফোণ্ডা ১৬৬৬ সালের প্রথম ভাগে শিবাজী একদল সৈন্য পাঠাইয়া ফোণ্ডা অবরোধ করেন, কিন্তু বিজাপুরীদের অরও সৈন্য আসিয়া শিবাজীর লোকদের তাড়াইয়া দিয়া ঐ দুর্গ বাঁচাইল। তাহারা এই অঞ্চলে আরও চারটি দুর্গ শিবাজীর হাত হইতে উদ্ধার করিল। (মার্চ, ১৬৬৬)।

 তার পর সাত বৎসর ধরিয়া শিবাজীর দৃষ্টি এদিকে পড়ে নাই। ১৬৭৩ সালের এপ্রিল মাসে তাঁহার সৈন্যরা কানাড়ার অধিত্যকায় ঢুকিয়া অনেক নগর ও দুর্গ লুঠিল। তাহার সেনাপতি প্রতাপ রাও হুবলীর ইংরাজ-কুঠী হইতে চল্লিশ হাজার টাকার কোম্পানীর মাল ছাড়া কর্মচারীদের নিজ সম্পত্তিও লইয়া গেল। কিন্তু বিজাপুর হইতে মুজফফর খাঁ চারি হাজার অশ্বারোহী লইয়া আসিয়া পড়ায় মারাঠারা হুবলী ছাড়িয়া পলাইল; তাড়াতাড়িতে তাহারা রাস্তায় বস্তা বস্তা লুঠের মাল ফেলিয়া দিয়া গেল।

 এই বৎসর বিজয়া দশমীর দিন (১০ই অক্টোবর ১৬৭৩) শিবাজী পঁচিশ হাজার সৈন্য লইয়া দেশ-জয়ে বাহির হইলেন; সঙ্গে বিশ হাজার বড় বড় থলিয়া লইলেন, তাহাতে লুঠের জিনিষ ভরিয়া আনা হইবে। এই অভিযানে তিনি কানাড়া অবধি অগ্রসর হন, কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বহলাল ও শর্জা খাঁর নিকট পরাস্ত হইয়া দেশে ফিরিলেন।

 বিজাপুরের দরবারে ক্রমেই গোলমাল ও নৈতিক অবনতি বাড়িতে লাগিল; তাহাতে দুরবর্ত্তী প্রদেশগুলির অত্যন্ত দুরবস্থা হইল, সেগুলি রক্ষা করিবার শক্তি বিজাপুরের রহিল না। সেই সুযোগে শিবাজী ১৮৭৫ সালে কানাড়া উপকূল স্থায়িভাবে দখল করিলেন।

 নয় হাজার সৈন্য লইয়া ৮ই এপ্রিল শিবাজী ফোণ্ডা দুর্গের অবরোধ শুরু করিয়া দিলেন। দুর্গস্বামী মহম্মদ খাঁ একমাস ধরিয়া মহা বীরত্ব ও সহিষ্ণুতার সহিত লড়িলেন। শিবাজী দুর্গ-প্রাকারের নীচে চারিটি সুড়ঙ্গ খুঁডিলেন; কিন্তু মহম্মদ খাঁ তাহার সবগুলি নষ্ট করিয়া দিলেন। তখন শিবাজী এক মাটির দেওয়াল তুলিয়া দুর্গের বাহিরে চারিদিক ঘেরিয়া ফেলিলেন; মারাঠা সৈন্য তাহার আড়ালে নিরাপদে থাকিয়া গুলি চালাইতে লাগিল; তিনি পরিখার এক জায়গায় ভরাট করিয়া দুর্গ দেওয়াল অবধি পথ করিলেন। আধ সের ওজনের পাঁচশত সোনার বালা গড়াইয়া বলিলেন, যে-যে সৈন্য দুর্গ-দেওয়ালে চড়িতে পারিবে তাহাদের উহা দেওয়া হইবে। অবশেষে কোন সাহায্য না পাওয়ায় একমাস পরে (৬ই মে) ফোণ্ডার পতন হইল। আশেপাশের মহালগুলি দখল করিতে শিবাজীকে সাহায্য করিবেন—এই শর্তে মহম্মদ খাঁ এবং চার-পাঁচজন প্রধানকে প্রাণদান করা হইল; দুর্গের আর সব লোককে বধ করা হইল। অল্পদিনের মধ্যে দক্ষিণে গঙ্গাবতী নদী পর্যন্ত ঐ জেলার সমস্তটা শিবাজীর অধিকারে আসিল।


 কিন্তু কানাড়া অধিত্যকায় অনেক যুদ্ধের পরও শিবাজীর অধিকার স্থায়ী হইল না। বিদনুরের রাণী মারাঠা-রাজাকে কর দিতে সম্মত হইলেন। তাহার পর বিদনুর-সোলার মধ্যে যুদ্ধ, বিজাপুর ওমরাদের হস্তক্ষেপ, মারাঠা-সৈন্যের লুঠ ইত্যাদিতে দেশটা অশান্তি ও ক্ষতি ভোগ করিতে লাগিল।

পোর্তুগীজদেr সহিত শিবাজীর সম্বন্ধ

 শিবাজীর রাজ্যের পশ্চিম সীমানার পাশেই পাতুগীজদের ভারতীয় প্রদেশ—উত্তরে দামন জেলা, মধ্যে বম্বে-থানাবাই (Bassein) চৌল, দক্ষিণে গোযা-বার্দেশ-ষষ্ঠি (Salette)।[]

 অনেক ছোট ছোট বিষযে, প্রধানতঃ পোর্তুগীজদের ভারত-সাগরে একাধিপত্য এবং সর্বোচ্চ প্রভুত্বের দাবি লইয়া, শিবাজীব সহিত গোয়া সরকাবের বিবাদ বাধে, কিন্তু তাহা কখনও যুদ্ধ অবধি গড়ায় নাই, কারণ পোর্তুগিজদের সৈন্য ও অর্থবল বড় কম, তাহাদের স্থানীয় দেশ সৈন্য (কানাড়া) অত্যন্ত ভীরু, এবং গোরা সৈন্য (প্রকৃওপক্ষে মিশ্রজাতীয় ফিরিঙ্গি)-গুলি আসল ইউরোপীয়দের অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট। এইজন্য পোর্তুগীজ গভর্ণর নানা উপায়ে ও কথার চালাকিতে শিবাজীকে ভুলাইয়া, শান্ত রাখেন। দুইবার (১৬৬৭ এবং ১৬৭০ সালে। তাহাদের মধ্যে লিখিত সন্ধি হইয়া উপস্থিত বিবাদের নিষ্পত্তি হয়।

চৌবে উৎপত্তি

 রামনগরের কোলী-জাতীয় রাজারা ঐ দেশের পশ্চিমে সমুদ্রকুলের অনেক গ্রাম হইতে লুঠ না করার মূল্য-স্বরূপ বার্ষিক টাকা পাইতেন। এই টাকাকে সাধারণ কথায় ‘চৌথ’ বলা হইত, কিন্তু ইহা সর্বত্রই রাজকরের ঠিক চৌখা, অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ ছিল না; কোন গ্রামে খাজানার দশমাংশ, কোন গ্রামে অষ্টমাংশ, কোন গ্রামে বংশ ইত্যাদি; দুই-এক জায়গায় চতুর্থাংশ। এই রাজাদের “চৌথিয়া-রাজা” বলিয়া ডাক-নাম ছিল। পোর্তুগীজ দামন জেলার (অর্থাৎ বম্বের উত্তরে) কতকগুলি গ্রাম তাঁহাদের এই চৌথ দিত। ১৬৭৬ সালে শিবাজী যখন কোলী দেশ স্থায়িভাবে অধিকার করিলেন, তখন কোলী-রাজাদের স্বত্ব অনুসারে ঐসব গ্রাম হইতে তিনিও চৌথ দাবি করিলেন। গোয়ার গভর্ণর নানা ওজরে সময় কাটাইয়া স্পষ্ট উত্তর দিতে যথাসম্ভব বিলম্ব করিলেন। শেষে শিবাজী যুদ্ধ করিবেন বলিয়া শাসাইলেন, কিন্তু শিবাজীর অকালমৃত্যুতে এই যুদ্ধ পরে তাহার পুত্র চালাইয়াছিলেন।

 সাবন্তবাড়ীর লখম সাবন্ত এবং অন্যান্য দেশাই, শিবাজীর আক্রমণে নিজ রাজ্য ছাড়িয়া গোয়ায় পলাইয়া গিয়া, সেখান হইতে তাহার নিযুক্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে-সব ষড়যন্ত্র করিত, তাহার শাস্তি দিবার জন্য ১৭ই নবেম্বর ১৬৬৭ একদল মারাঠা-সৈন্য গোয়ার অধীন বার্দেশ জেলায় ঢুকিয়া কতকগুলি প্রজা ও গরু ধরিয়া লইয়া যায়। কিন্তু এই বিবাদ দূত পাঠাইয়া বন্ধুভাবে মিটমাট করা হইল; বন্দীরা খালাস পাইল; এবং গভর্ণর দেশাইদের পোর্তুগীজ-সীমানার বাহির করিয়া দিলেন (১৬৬৮)।

গোয়া-অধিকারের বিফল চেষ্টা

 গোয়ার পূর্বদিক পাহাড়ে ঘেরা; তাহার মধ্যে দুএকটি সরু উঁচু পথ ভিন্ন যাওয়া যায় না। পশ্চিমে ও দক্ষিণে সমুদ্র ও খড়ী, প্রবল জাহাজ ও তোপ না থাকিলে সেইদিক দিয়া গোয়াবআক্রমণ করা অসম্ভব। ১৬৬৮ সালের অক্টোবর মাসে শিবাজী এই গোয়া প্রদেশে ঢুকিবার এক ফন্দী করিলেন। তিনি চারি পাঁচশত মারাঠা-সৈন্যকে ছোট ছোট দলে ভাগ করিয়া নানা ছদ্মবেশে ক্রমে ঐ গিরিসঙ্কট দিয়া গোয়া-রাজ্যে পাঠাইয়া দিলেন, এবং শিখাইয়া দিলেন যে যখন এইরূপে হাজার লোক একত্র হইবে, তখন তাহারা একত্রে হঠাৎ উঠিয়া পোর্তুগীজ রক্ষীদের মারিয়া একটা পাহাডের পথ ("ঘাটি”) দখল করিবে, এবং সেই পথ দিয়া শিবাজী সদলবলে ঐ রাজ্যে ঢুকিয়া দেশটা জয় করিবেন। কিন্তু হয় কেহ ষড়যন্ত্রটা ফাঁস করিয়া দিল, অথবা পোর্তুগীজ গভর্ণরের সন্দেহ এমনি জাগিয়া উঠিল। তিনি তাঁহার এলাকাভুক্ত শহরগুলিতে কড়া খানাতল্লাশ করিয়া ঐ লুকান মারাঠা সৈন্যগুলিকে গেরেফতার করিলেন এবং মারের চোটে তাহাদের নিকট হইতে সব কথা বাহির করিয়া লইলেন। তাহার পর শিবাজীর দূতকে ডাকিয়া স্বহস্তে তাহার কানে দুই-তিন ঘুষি দিয়া তাহাকে ও বন্দী মারাঠা সৈন্যদের গোয়া-রাজ্য হইতে দূর করিয়া দিলেন।

  1. এই শহব এখন বম্বে প্রদেশের একটি তালুকের সদর। এখানে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজ করিতেন, এবং রবীন্দ্রনাথ প্রথম বয়সে এখানে তাঁহার প্রবাসের সুখ-স্মৃতি লিখিয়াছেন।
  2. এই চাঁঁদায় ইংরাজের ৯ শত টাকা দিয়াছিল, কারণ কারোয়ার শহরে তাহাদের সম্পত্তির মূল্য ছিল চল্লিশ হাজার টাকা।
  3. ইহার মধ্যে বম্বে-দ্বীপ ১৬৬৮ সালে ইংলণ্ড-রাজাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। আবাব তেমনি বর্ত্তমান পোর্তুগিজ-ভারতে অনেক গান, যথা—ফোণ্ডা, বিচোলী, পেড়লে, সাকলী-শিবাজীর মৃত্যুর পঞ্চাশ বৎসর পরে পোর্তুগিজদের দখলে আসে।