শেষ লীলা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 সেই সময় আমি আমার বাসায় গমন করিলাম। স্নান-আহার বিশ্রামাদি করিয়া, পুনরায় অপরাহ্ণ চারিটার সময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, কর্ম্মচারী মহাশয় আমার অপেক্ষায় সেই স্থানে বসিয়া আছেন, আরও তিনচারিজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে উপবিষ্ট। বাড়ীর ভাড়াটিয়ামাত্রেই বাড়ীতে উপস্থিত, কর্ম্মচারীগণের নিকট ত্রৈলোক্য বন্ধনাবস্থায় বসিয়া রহিয়াছে।

 আমি সেই স্থানে গমন করিয়া, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যে স্থানে বসিয়াছিলেন, সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম, এবং পূর্ব্বকথিত কর্ম্মচারীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলাম, “এই যে বন্ধনাবস্থায় বসিয়া আছে, এ ত্রৈলোক্য নহে?”

 কর্ম্মচারী। হাঁ।

 আমি। ইহার এ দশা কেন?

 কর্ম্মচারী। হত্যাপরাধে এ ধৃত হইয়াছে।

 আমি। এই কি রাজকুমারীকে হত্যা করিয়াছে?

 কর্ম্মচারী। হাঁ মহাশয়! রাজকুমারীকে হত্যা করা অপরাধে এ ধৃত হইয়াছে।

 আমি। এই হত্যা যে ইহার দ্বারা হইয়াছে, তাহা কি বেশ প্রমাণিত হইয়াছে?

 কর্ম্মচারী। এখন পর্য্যন্ত সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত না হইলেও, এই হত্যা যে ইহার দ্বারা হইয়াছে তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

 আমি। ইহার উপর সন্দেহ হইবার কারণ কি?

 কর্ম্মচারী। যাহার ব্যবসাই কেবল হত্যা করা, তাহার দ্বারা যে এই হত্যা হয় নাই, তাহা আমি কিরূপে বলিতে পারি?

 আমি। হত্যাই যে ইহার ব্যবসা তাহা আপনাকে কে বলিল?

 কর্ম্মচারী। তাহা আর কে বলিবে? কেন আপনি কি জানেন না যে, হত্যা করাই ইহার ব্যবসা। আপনিই ত হত্যাপরাধে ইহাকে চালান দিয়াছিলেন।

 আমি। পূর্ব্বে হত্যাপরাধে আমি ইহাকে চালান দিয়াছিলাম বলিয়াই যে, এই হত্যা ইহা দ্বারা হইয়াছে, তাহা বলা যায় না। পূর্ব্বে আমি ইহার বিরুদ্ধে অনেক লোকের নিকট হইতে অনেক কথা শুনিতে পাই; সেইরূপ কথা শুনিতে শুনিতে আমার মনের গতি খারাপ হইয়া যায়। সেই সময় যেমন ইহার উপর একটী নালিশ হয়, অমনি আমি তাহা বিশ্বাস করিয়া, সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। অনুসন্ধান আর কি করি? ইহার শত্রুপক্ষীয় লোকে যাহা বলে, তাহারই উপর বিশ্বাস করিয়া, হত্যাপরাধে ইহাকে দোষী স্থির করিয়া লই, এবং বিচারার্থ ইহাকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করি। মাজিস্ট্রেট সাহেব ইহাকে দায়রায় পাঠাইয়া দেন। যখন দায়রার বিচারে সাক্ষীগণের উপর জেরা হইতে থাকে, তখনই আমি বুঝিতে পারি যে, ত্রৈলোক্যকে আমি অনর্থক মিথ্যা কষ্ট দিয়াছি। জজসাহেবও সেই মোকদ্দমার ব্যাপার ঠিক বুঝিয়া লন, এবং ইহাকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ জানিয়া অব্যাহতি প্রদান করেন। সেই মোকদ্দমার পূর্ব্বে ত্রৈলোক্যের চরিত্রের উপর আমার যেরূপ বিশ্বাস ছিল, মোকদ্দমার পর হইতে সেই বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। ত্রৈলোক্যের ব্যবসাই হত্যা, এই বিশ্বাস ব্যতীত এই মোকদ্দমায় যদি ইহার উপর আর কোন প্রমাণ না থাকে, তাহা হইলে ইহাকে নিরর্থক আর কষ্ট দিবেন না, এখনই ইহাকে ছাড়িয়া দিন।

 কর্ম্মচারী। তাহা হইলে আপনার বিশ্বাস যে, এই হত্যা ত্রৈলোক্যের দ্বারা হয় নাই।

 আমি। আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি যে, এই হত্যা ত্রৈলোক্য কখনও করে নাই।

 কর্ম্মচারী। তবে কে এই হত্যা করিয়া, রাজকুমারীর সমস্ত অলঙ্কার-পত্র চুরি করিয়া লইল?

 আমি। কে যে এই হত্যা করিয়াছে, তাহা আমি ঠিক জানি না; কিন্তু আমি যতদুর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এই হত্যা ত্রৈলোক্য করে নাই। আরও একটু একটু শুনিতে পাইতেছি যে, এই হত্যা কোন লোকের দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে।

 কর্ম্মচারী। তাহা হইলে বলুন না, আপনি কি শুনিয়াছেন, ও কে এই হত্যা করিয়াছে।

 আমি। বলিবার সময় এখনও উপস্থিত হয় নাই। যখন সে সময় হইবে, তখন আপনি তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবেন। এখন ইহাকে ছাড়িয়া দিন, বিনা অপরাধে এরূপ বন্ধনাবস্থায় ইহাকে আর কষ্ট প্রদান করিবেন না।

 আমার কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী মহাশয় ত্রৈলোক্যের বন্ধন মোচন করিয়া দিতে কহিলেন। জনৈক প্রহরী আদেশমাত্র তাহার বন্ধন মোচন করিয়া দিল। আমার কথা শুনিয়া এবং আমার ব্যবহার দেখিয়া ত্রৈলোক্য আরপর যে কি পর্য্যন্ত সন্তুষ্ট হইল, তাহা আর আমি বলিতে পারি না। আমার কৃপায় সে এ যাত্রাও নিষ্কৃতি পাইল, এই ভাবিয়া সে অন্তরের সহিত আমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে করিতে আমার পার্শ্বে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল।

 সেই সময় অপরাপর কর্ম্মচারীগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, “আজ কয়েকদিবস পর্য্যন্ত আপনারা এই বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যে সকল অনুসন্ধান করিয়াছেন, বা তাহাদিগের নিকট হইতে বাহা কিছু অবগত হইতে পারিছেন, তাহা ঠিক নহে। আমি জানিতে পারিয়াছি, ভীত হইয়া তাহারা কেহই প্রকৃত কথা কহে নাই। আমার বিবেচনা হয়, এখন তাহারা প্রকৃত কথা বলিবে। এই বাড়ীর সমস্ত ভাড়াটিয়াগণকে ডাকাইয়া পুনরায় তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন। দেখুন দেখি, এখন তাহারা প্রকৃত কথা বলে কি না? আর পূর্ব্বে তাহারা যে সকল কথা বলিয়াছে, বা আপনারা যাহা লিখিয়া লইয়াছেন, সেই সকল কাগজপত্র আর রাখিবার কোন প্রয়োজন নাই, সেই সকল কাগজপত্র পূর্ব্বেই নষ্ট করিয়া ফেলা আবশ্যক।” এই বলিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে কতকগুলি কাগজ লইয়া, আমি সেই স্থানেই ছিঁড়িয়া ফেলিলাম। সকলে বুঝিতে পারিল যে, যে কাগজে ভাড়াটিয়াগণের জবানবন্দী লেখা হইয়াছিল, আমি সেই সকল কাগজ ছিঁড়িয়া ফেলিলাম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি সেই সকল কাগজে হস্তক্ষেপ করিলাম না, কতকগুলি বাজে কাগজ ছিঁড়িয়া ফেলিলাম মাত্র।

 ইহার পর সেই বাড়ীর কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সকল লোককেই আমি সেই স্থানে ডাকাইলাম, সকলেই আসিয়া আমার নিকট উপবেশন করিল। আমি অন্য আর একজন কর্ম্মচারীকে কহিলাম, “আপনি এখন ইহাদিগের জবানবন্দী পুনরায় লিখিতে আরম্ভ করুন।” আমার কথা শুনিয়া সেই স্থানে যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন, কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণ পুনরায় কিরূপ জবানবন্দী দেয়, তাহাই সকলে নিতান্ত ঔৎসুক্য সহকারে শুনিতে লাগিলেন। আমি এক একজনকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সেই অপর কর্ম্মচারী মহাশয় তাহা লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ভাড়াটিয়াগণ যাহা বলিতে লাগিল, তাহা শুনিয়া অপরাপর কর্ম্মচারীগণ নিতান্ত বিস্মিত হইতে লাগিলেন; ত্রৈলোক্যের মস্তক ঘুরিতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর কাঁপিতে লাগিল; তথাপি কে কি বলে, তা শুনিবার নিমিত্ত সে সেই স্থানে বসিয়া রহিল।

 পুনরায় সেই বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণের যেরূপ ভাবে জবানবন্দী লেখা হইতে লাগিল, তাহার সংক্ষেপ মর্ম্ম এইরূপ:—

 একটী স্ত্রীলোক কহিল,—“আমি হরিকে উত্তমরূপে চিনি, সে ত্রৈলোক্যের পুত্ত্র। তাহার মাতার সহিত সে এই বাড়ীতেই থাকে। কোনরূপ কায-কর্ম্ম করিতে তাহাকে কখনও দেখি নাই, বা শুনি নাই। অথচ বেশ্যালয়ে গমন ও মদ্যাদি পান করিতে তাহাকে প্রায়ই দেখিতে পাই। এই সকল কার্য্যের নিমিত্ত যে সকল অর্থের প্রয়োেজন হয়, তাহা সে কোথা হইতে প্রাপ্ত হয়, তাহা বলিতে পারি না। যে দিবস রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্বদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে রাজকুমারীর সহিত সে নির্জ্জনে কি পরামর্শ করিতেছিল, তাহা আমি দেখিতে পাই, এবং উহারাও আমাকে দেখিতে পাইয়া উভয়ে উভয় দিকে প্রস্থান করে। ইহার পর রাত্রি আন্দাজ বারটা কি একটার সময় আমি কার্য্য বশতঃ আমার গৃহ হইতে বাহির হই। সেই সময় দেখিতে পাই, হরি ধীরে ধীরে তাহার মাতার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া রাজকুমারীর গৃহের দিকে গমন করিতেছে। রাজকুমারীর গৃহের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল না, কেবল ভেজান ছিল মাত্র। হরি সেই দরজা ধীরে ধীরে ঠেলিয়া নিঃশব্দে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। ব্যাপার দেখিয়া আমি সেই সময় অনুমান করিয়াছিলাম, রাজকুমার হরির প্রেমে আশক্ত হইয়াছে, তাই হরি উহার গৃহে গোপনে গমন করিয়া থাকে। আমি পুলিসের ভয়ে এ কথা পূর্ব্বে বলিতে সাহসী হই নাই।”

 অপর আর একটী স্ত্রীলোক কহিল,—রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় আমি আমার গৃহ হইতে বহির্গত হই। আমার গৃহে একটী লোক ছিল, সেই সময় সে আমার গৃহ হইতে চলিয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করায়, সদর দরজা খুলিয়া তাহাকে বাহির করিয়া দিবার নিমিত্ত, আমি তাহার সহিত আমার গৃহ হইতে বহির্গত হই এবং তাহার সহিত সদর দরজা পর্য্যন্ত গমন করিয়া দেখি যে, সদর দরজা খোলা রহিয়াছে। কে যে সেই দরজা খুলিয়া বাহিরে গমন করিয়াছে, সেই সময় তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, সেই দরজা ভিতর হইতে পুনরায় আমি বন্ধ করিয়া দি, এবং আমার গৃহে গিয়া আমি শয়ন করি।”

 তৃতীয় ভাড়াটিয়া কহিল,—“যে দিবস রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই দিবস অতি প্রত্যূষে আমি গাত্রোত্থান করিয়া, আমার বাবুর সহিত সহিত আমি সদর দরজা পর্য্যন্ত গমন করি। সেই সময় সদর দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। সেই দরজা আমি খুলিয়া দিলে, আমার বাবু এই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান। সেই সময় সেই দরজা আমি পুনরায় বন্ধ করিবার বাসনা করিয়া যেমন উহা বন্ধ করিবার চেষ্টা করি, সেই সময় হরি বাহির হইতে আসিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে। সেই সময় তাহার অবস্থা দেখিয়া, আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। উহাকে দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, ও যেন সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়াছে, আর উহার মনে যেন কি একটী ভয়ানক চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ইহার পূর্ব্বে আমাদিগের সহিত যখন হরির সাক্ষাৎ হইত, সেই সময় দুই একটী কথা না বলিয়া, সে কখনও প্রস্থান করিত না। কিন্তু সে দিবস আমার সহিত কোন কথা না বলিয়া, যেন নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সে তাহার মাতার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল।”

 চতুর্থ ভাড়াটিয়া কহিল,—“যে দিবস রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্ব রাত্রিতে আমিই সকলের শেষে সদর দরজা বন্ধ করিয়া আপন গৃহে গিয়া শয়ন করিয়াছিলাম। আমি যখন সদর দরজা বন্ধ করি, তখন বোধ হয়, রাত্রি বারটা। সেই সময় হরিকে দেখিতে পাই, সে তাহার মাতার গৃহের সম্মুখে বারান্দার উপর চুপ করিয়া বসিয়াছিল। ওরূপ সময় ওরূপ স্থানে আমি হরিকে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও বসিতে দেখি নাই; সুতরাং আমার মনে একটু সন্দেহ হয়। মনে করি, বোধ হয়, তাহার কোনরূপ অসুখ হইয়া থাকিবে। এই ভাবিয়া আমি হরিকে জিজ্ঞাসা করি, “এমন সময় এরূপ ভাবে তুমি বাহিরে বসিয়া রহিয়াছ কেন?” আমার কথায় হরি কোনরূপ উত্তর প্রদান করে নাই; সুতরাং তাহার ব্যবহারে আমি একটু বিরক্ত হইয়া তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই, আমার গৃহে গিয়া শয়ন করিয়াছিলাম।

 পঞ্চম ভাড়াটিয়া কহিল,—রাত্রি আন্দাজ বারটা কি একটার সময় আমার নিদ্রাভঙ্গ হইয়া যায়। আমি আমার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, আমার গৃহের সম্মুখের বারান্দার উপর আসিয়া উপবেশন করি। সেই সময় রাজকুমারীর গৃহ হইতে কেমন একরূপ গোঁ গোঁ শব্দ আসিয়া আমার কর্ণে প্রবেশ করে। আমি উঠিয়া ধীরে ধীরে রাজকুমারীর গৃহের নিকট গমন করি, এবং তাহার গৃহের দরজা ঠেলিয়া দেখি, উহা ভিতর হইতে বন্ধ। বেড়ার ফাক দিয়া দেখিতে পাই, উহার গৃহে একটী প্রদীপ জ্বলিতেছে, মেঝেয় পাটির উপর রাজকুমারী চিৎ হইয়া রহিয়াছে, হরি তাহার বুকের উপর বসিয়া রহিয়াছে, রাজকুমারী অল্প অল্প গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে অন্য এক ভাবের উদয় হইল। আমি মনে মনে সবিশেষ লজ্জিত হইয়া আমার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তৎপরে আমার গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া, আমি আমার বিছানায় শয়ন করিলাম।”

 ষষ্ঠ স্ত্রীলোক বা বিধু কহিল,—“যে দিবস প্রাতঃকালে রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্ব রজনী আন্দাজ একটা কি দেড়টার সময় আমি আমার গৃহ হইতে বাহিরে গমন করিয়াছিলাম। সেই সময় রাজকুমারীর গৃহ হইতে অল্প গোঁ গোঁ শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করে। কিসের শব্দ তাহা আমি কিছুই বুঝিতে না পারিয়া, কিয়ৎক্ষণ আমার গৃহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকি। তাহার পরই দেখিতে পাই, হরি রাজকুমারীর গৃহ হইতে বাহিরে গমন করে, এবং দ্রুতপদে সদর দরজার নিকট গমন করিয়া, সেই দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। যে সময় সে রাজকুমারীর গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া যায়, সেই সময় তাহার হস্তে সাদা রুমাল, বা সাদা নেকড়ায় বাঁধা ছোটগোছের একটী পুঁটুলি ছিল। এখন আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, সেই পুঁটুলির মধ্যে রাজকুমারীর গৃহ হইতে অপহৃত অলঙ্কারগুলি ভিন্ন আর কিছুই ছিল না।

 সেই বাড়ীতে যতগুলি ভাড়াটিয়া ছিল, সকলেই কিছু না কিছু হরির বিপক্ষে বলিল। কেবলমাত্র প্রিয় কহিল,—“আমি ইহার কিছুই অবগত নহি, বা হরির বিপক্ষে আমি এ পর্য্যন্ত কোন কথা শুনি নাই।”

 আমরা ত্রৈলোক্যকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। সাক্ষীগণ যেরূপ জবানবন্দী দিতে লাগিল, ত্রৈলোক্য সেই স্থানে বসিয়া স্থিরভাবে তাহা শ্রবণ করিতে লাগিল, এবং মধ্যে মধ্যে একটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিতে লাগিল।

 এইরূপে সমস্ত সাক্ষীর জবানবন্দী হইয়া গেল। তখন কর্ম্মচারী মাত্রেই এক বাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “এখন এই মোকদ্দমার উদ্ধার হইল, এখন উত্তমরূপে জানিতে পারা গেল যে, এই হত্যা কাহার দ্বারা হইয়াছে। রাজকুমারীর গৃহ হইতে অপহৃত অলঙ্কার পাওয়া যাউক, বা না যাউক, এই সকল সাক্ষীর সাক্ষ্যে যে হরির ফাঁসি হইবে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।”

 এ পর্য্যন্ত হরিও সেই স্থানে উপস্থিত থাকিয়া, সকল কথা শ্রবণ করিতেছিল। কর্ম্মচারীগণের কথা শেষ হইবার পর, আমি কহিলাম, “এখন আর হরিকে এরূপ ভাবে রাখা উচিত নহে। হত্যাকারীকে যেরূপ ভাবে রাখা হইয়া থাকে, ইহাকেও এখন সেইরূপ ভাবে রাখা কর্ত্তব্য।” >

 আমার কথা শেষ হইবামাত্রই একজন কর্ম্মচারী উঠিয়া হরিকে ধরিলেন, ও তাহার হাতে হাতকড়ি পরাইলেন; তৎপরে বস্ত্র দ্বারা পুনরায় উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া দুইজন প্রহরীর হস্তে তাহাকে অর্পণ করিলেন।

 হরির মুখ দিয়া কোন কথাই বাহির হইল না। কেবল তাহার চক্ষু দিয়া বেগে জলধারা বহিতে লাগিল, এবং সজলনয়নে মধ্যে মধ্যে এক একবার কেবল ত্রৈলোক্যের মুখের দিকে তাকাইয়া বলিতে লাগিল, “মা! আমি তোমার পায়ে হাত দিয়া দিব্য করিয়া বলিতে পারি, আমি ইহার কিছুই জানি না। রাজকুমারীকে আমি হত্যা করি নাই, বা তাহার অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি কোন দ্রব্যই আমি অপহরণ করি নাই। আমি সমস্ত রাত্রি বাড়ীতেই ছিলাম, একবারের নিমিত্ত আমি বাড়ীর বাহিরে গমন করি নাই।”

 আমরা হরির কথায় কর্ণপাতও করিলাম না। অধিকন্তু তাহাকে কহিলাম, রাজকুমারীর গহনাগুলি তুমি কোথায় রাখিয়া আসিয়াছ, তাহা এখনও বলিয়া দেও। নতুবা আমাদিগের হস্তে তোমার যন্ত্রণার শেষ থাকিবে না।”