শেষ সপ্তক/আমি
আমি
এই-যে সবার সামান্য পথ, পায়ে হাঁটার গলি,
সে পথ দিয়ে আমি চলি
সুখে দুঃখে লাভে ক্ষতিতে,
রাতের আঁধার দিনের জ্যোতিতে।
প্রতি তুচ্ছ মুহূর্তেরই আবর্জনা করি আমি জড়াে,
কারও চেয়ে নইকো আমি বড়ো।
চলতে পথে কখনাে বা বিঁধেছে কাঁটা পায়ে,
লাগছে ধুলাে গায়ে;
দুর্বাসনার এলােমেলাে হাওয়া,
তারি মধ্যে কতই চাওয়া পাওয়া,
কতই বা হারানো,
খেয়া ধরে ঘাটে আঘাটায়
নদী-পারানো।
এমনি করে দিন কেটেছে, হবে সে দিন সারা
বেয়ে সর্বসাধারণের ধারা।
শুধাও যদি সব-শেষে তার রইল কী ধন বাকি,
স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি তা কি!
জানি, এমন নাই কিছু যা পড়বে কারাে চোখে,
স্মরণ-বিস্মরণের দোলায় দুলবে বিশ্বলােকে।
নয় সে মানিক, নয় সে সােনা-
যায় না তারে যাচাই করা, যায় না তারে গােনা
এই দেখাে-না- শীতের রােদে দিনের স্বপ্নে বােনা
সেগুন-বনে সবুজ-মেশা সোনা,
শজনে গাছে লাগল ফুলের রেশ,
হিমঝুরির হৈমন্তী পালা হয়েছে নিঃশেষ।
বেগনি-ছায়ার-ছোঁওয়া-লাগা স্তব্ধ বটের শাখা
ঘাের রহস্যে ঢাকা।
ফলসা গাছের ঝরা পাতা গাছের তলা জুড়ে
হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে।
গােরুর গাড়ি মেঠো পথের তলে,
উড়তি ধুলােয় দিকের আঁচল ধূসর ক'রে চলে।
নীরবতার বুকের মধ্যখানে
দূর অজানার বিধুর বাঁশি ভৈরবী সুর আনে
কাজ-ভােলা এই দিন
নীল আকাশে পাখির মতাে নিঃসীমে হয় লীন।
এরই মধ্যে আছি আমি,
সব হতে এই দামি।
কেননা আজ বুকের কাছে যায় যে জানা,
আরেকটি সেই দোসর আমি উড়িয়ে চলে বিরাট তাহার ডানা
জগতে জগতে
অন্তবিহীন ইতিহাসের পথে।
ওই-যে আমার কুয়ােতলার কাছে
সামান্য ওই আমের গাছে
কখনাে বা রৌদ্র খেলায় কভু শ্রাবণধারা,
সাৱা বরষ থাকে আপনহারা
সাধারণ এই অরণ্যানীর সবুজ আবরণে,
মাঘের শেষে যেন অকারণে
ক্ষণকালের গোপন মন্ত্রবলে
গভীর মাটির তলে
শিকড়ে তার শিহর লাগে-
শাখায় শাখায় হঠাৎ বাণী জাগে
‘আছি আছি এই-যে আমি আছি'।
পূষ্পোচ্ছ্বাসে ধায় সে বাণী স্বর্গলােকের কাছাকাছি
দিকে দিগন্তরে।
চন্দ্র সূর্য তারার আলাে তারে বরণ করে।
এমনি করেই মাঝে মাঝে সােনার কাঠি আনে
কভু প্রিয়ার মুখ চোখে কভু কবির গানে
অলস মনের শিয়রেতে কে সে অন্তর্যামী-
নিবিড় সত্যে জেগে ওঠে সামান্য এই আমি।
যে আমিরে ধূসর ছায়ায় প্রতিদিনের ভিড়ের মধ্যে দেখা
সেই আমিরে এক নিমেষের আলােয় দেখি একের মধ্যে একা
সে-সব নিমেষ রয় কি না রয় কোনােখানে,
কেউ তাহাদের জানে বা না’ই জানে,
তবু তারা জীবনে মাের দেয় তাে আনি
ক্ষণে ক্ষণে পরম বাণী
অনন্তকাল যাহা বাজে
বিশ্বচরাচরের মর্মমাঝে
‘আছি আমি আছি’-
যে বাণীতে উঠে নাচি
মহাগগনসভাঙ্গনে আলােকঅপ্সরী
তারার মাল্য পরি।
১১।১ [১৯]৩৪
ছত্রিশ-সংখ্যক কবিতা তুলনীয়