শেষ সপ্তক/ছয়
ছয়
দিনের প্রান্তে এসেছি
গোধূলির ঘাটে।
পথে পথে পাত্র ভরেছি
অনেক কিছু দিয়ে।
ভেবেছিলেম চিরপথের পাথেয় সেগুলি;
দাম দিয়েছি কঠিন দুঃখে।
অনেক করেছি সংগ্রহ মানুষের কথার হাটে,
কিছু করেছি সঞ্চয় প্রেমের সদাব্রতে।
শেষে ভুলেছি সার্থকতার কথা,
অকারণে কুড়িয়ে বেড়ানােই হয়েছে অন্ধ অভ্যাসে বাঁধা;
ফুটো ঝুলিটার শূন্য ভরাবার জন্যে
বিশ্রাম ছিল না।
আজ সামনে যখন দেখি
ফুরিয়ে এল পথ,
পাথেয়ের অর্থ আর রইল না কিছুই।
যে প্রদীপ জ্বলেছিল মিলনশয্যার পাশে
সেই প্রদীপ এনেছিলেম হাতে করে।
তার শিখা নিবল আজ,
সেটা ভাসিয়ে দিতে হবে স্রোতে।
সামনের আকাশে জ্বলবে একলা সন্ধ্যার তারা।
যে বাঁশি বাজিয়েছি
ভােরের আলােয়, নিশীথের অন্ধকারে,
তার শেষ সুরটি বেজে থামবে
রাতের শেষ প্রহরে।
তার পরে?
যে জীবনে আলাে নিবল,
সুর থামল,
সে যে এই আজকের সমস্ত কিছুর মতােই
ভরা সত্য ছিল,
সে কথা একেবারেই ভুলবে জানি-
ভােলাই ভালো।
তবু তার আগে কোনাে-এক দিনের জন্য
কেউ-একজন
সেই শূন্যটার কাছে একটা ফুল রেখাে,
বসন্তের যে ফুল একদিন বেসেছি ভালাে।
আমার এতদিনকার যাওয়া-আসার পথে
শুকনাে পাতা ঝরেছে,
সেখানে মিলেছে আলােক ছায়া,
বৃষ্টিধারায় আম-কাঁঠালের ডালে ডালে
জেগেছে শব্দের শিহরণ,
সেখানে দৈবে কারাে সঙ্গে দেখা হয়েছিল
জল-ভরা ঘট নিয়ে যে চলে গিয়েছিল
চকিত পদে।
এই সামান্য ছবিটুকু
আর সব-কিছু থেকে বেছে নিয়ে
কেউ-একজন আপন ধ্যানের পটে এঁকো
কোনাে-একটি গােধূলির ধূসর মুহূর্তে।
আর বেশি কিছু নয়।
আমি আলাের প্রেমিক;
প্রাণবঙ্গভূমিতে ছিলুম বাঁশি-বাজিয়ে।
পিছনে ফেলে যাব না একটা নীরব ছায়া
দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে।
যে পথিক অস্তসূর্যের
স্লায়মান আলাের পথ নিয়েছে
সে তো ধুলাের হাতে উজাড় করে দিলে
সমস্ত আপনার দাবি;
সেই ধুলাের উদাসীন বেদীটার সামনে
রেখে যেয়াে না তােমার নৈবেদ্য-
ফিরে নিয়ে যাও অন্নের থালি
যেখানে তাকিয়ে আছে ক্ষুধা,
যেখানে অতিথি বসে আছে দ্বারে,
যেখানে প্রহরে প্রহরে বাজছে ঘণ্টা
জীবনপ্রবাহের সঙ্গে কালপ্রবাহের
মিলের মাত্রা রেখে।