বিশ

সেদিন আমাদের ছিল খােলা সভা
আকাশের নীচে,
রাঙা মাটির পথের ধারে।
ঘাসের' পরে বসেছে সবাই।
দক্ষিণের দিকে শালের গাছ সারি সারি-
দীর্ঘ, ঋজু, পুরাতন-
স্তব্ধ দাঁড়িয়ে,
শুক্ল নবমীর মায়াকে উপেক্ষা ক'রে।
দূরে কোকিলের ক্লান্ত কাকলিতে বনস্পতি উদাসীন।
ও যেন শিবের তপােবন-দ্বারের নন্দী,
দৃঢ় নির্মম ওর ইঙ্গিত।

সভার লােকেরা বললে,
‘একটা কিছু শােনাও, কবি,
রাত গভীর হয়ে এল।'
খুললেম পুঁথিখানা,
যত প'ড়ে দেখি
সংকোচ লাগে মনে।
এরা এত কোমল, এত স্পর্শকাতর,
এত যত্নেরে ধন।

এদের কণ্ঠস্বর এত মৃদু,
এত কুষ্ঠিত।

এরা সব অন্তঃপুরিকা;
রাঙা অবগুণ্ঠন মুখের 'পরে,
তার উপরে ফুলকাটা পাড়
সােনার সুতােয়।
রাজহংসের গতি ওদের,
মাটিতে চলতে বাধা।
প্রাচীন কাব্যে এদের বলেছে ভীরু,
বলেছে বরবর্ণিনী।
বন্দিনী ওরা বহু সম্মানে।
ওদের নূপুর ঝংকৃত হয় প্রাচীর-ঘেরা ঘরে,
অনেক দামের আস্তরণে;
বাধা পায় তারা নৈপুণ্যের বন্ধনে।

এই পথের ধারের সভায়
আসতে পারে তারাই
সংসারের বাঁধন যাদের খসেছে-
খুলে ফেলেছে হাতের কাঁকন,
মুছে ফেলেছে সিদুর;
যারা ফিরবে না ঘরের মায়ায়,

যারা তীর্থযাত্রী;
যাদের অসংকোচ অক্লান্ত গতি,
ধূলিধূসর গায়ের বসন,
যারা পথ খুঁজে পায় আকাশের তারা দেখে;
কোনাে দায় নেই যাদের
কারাে মন জুগিয়ে চলবার;
কত রৌদ্রতপ্ত দিনে,
কত অন্ধকার অর্ধরাত্রে
যাদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনি জাগিয়েছে
অজানা শৈলগুহায়,
জনহীন মাঠে,
পথহীন অরণ্যে।
কোথা থেকে আনব তাদের
নিন্দাপ্রশংসার ফাঁদে টেনে।

উঠে দাঁড়ালেম আসন ছেড়ে।
ওরা বললে, ‘কোথা যাও, কবি?'
আমি বললেম,
'যাব দুর্গমে, কঠোর নির্মমে,
নিয়ে আসব কঠিনচিত্ত উদাসীনের গান।'