শোধ-বোধ/প্রথম অঙ্ক/চতুর্থ দৃশ্য
চতুর্থ দৃশ্য
শশধরের ঘর।
সম্মুখেই বাগান
সতীশ। বাবার শাপ এখনো ছাড়ে নি, মা, এখনো ছাড়েনি। তিনি আমার ভাগ্যের উপরে এখনো চেপে ব’সে আছেন।
বিধু। আমাদেব যা ক’রবাব, তা তো ক’রেচি, গয়াতে তাঁব সপিণ্ডীকরণ হ’য়ে গেলো—তোর মাসীর কল্যাণে ব্রাহ্মণবিদায়েরও ভালো আয়োজন হ’য়েছিল।
সতীশ। সেই পুণ্যফল মাসির কপালেই ফ’ললো। নইলে—
বিধু। তাই তো। নইলে এত বয়সে তাঁর ছেলে হবে, এমন সর্ব্বনেশে কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
সতীশ। অন্যায়। অন্যায়। বাবার সম্পত্তি পেতে পার্তুম, তার থেকে বঞ্চিত হলুম, তার পরে আবার—কি অন্যায়।
বিধু। অন্যায় নয় তো কি? নিজের বোন্পোকে এমন করেও ঠকালে? শেষকালে দয়াল ডাক্তারের ওষুধ তো খাটলো, আমরা কালীঘাটে এত মানত ক’রলুম, তার কিছুই হ’লোনা। একেই বলে কলিকাল। একমনে ভগবান্কে ডাক্—তিনি যদি এখনো—
সতীশ। মা এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিলো, কিন্তু যে রকম অন্যায় হ’লো, তাতে—ঈশ্বরের কাছে—তিনি দয়া করে’ যেন—
বিধু। আহা, তাই হোক্—নইলে তোর উপায় কি হবে, সতীশ? হে ভগবান্, তুমি যেন—
সতীশ। এ যদি না হয়, ঈশ্বরকে আমি আর মান্বো না; কাগজে নাস্তিকতা প্রচার ক’র্বো। কে বলে তিনি মঙ্গলময়।
বিধু। আরে চুপ চুপ, এখন অমন কথা মুখে আন্তে নেই। তিনি দয়াময়, তাঁর দয়া হ’লে কি না ঘট্তে পারে। সতীশ, আজ বুঝি ওদের ওখানে যাচ্চিস্?
সতীশ। হাঁ।
বিধু। তোর সেই সাহেবের দোকানের কাপড় পরিস্ নি যে?
সতীশ। সে সব পুড়িয়ে ফেলেছি।
বিধু। সে আবাব কবে হ’লো?
সতীশ। অনেক দিন। টেনিস্ পার্টিতে নলিনীকে কথা দিয়ে এসেছিলেম।
বিধু। সে যে অনেক দামের!
সতীশ। নইলে পোড়াবার মজুরী পোষাবে কেন? স্বর্ণলঙ্কারও তো অনেক দাম ছিলো।
বিধু। তোমাদের বোঝা আমার কর্ম্ম নয়! যাই, দিদির খোকাকে নাওয়াতে হবে।
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী। শতীশ!
সতীশ। কি মাসিমা!
সুকুমারী। কাল যে তোমাকে খোকার কাপড় কিনে আনবার জন্য এত করে’ বল্লেম, অপমান বোধ হ’ল বুঝি।
সতীশ। অপমান কিসের, মাসিমা! কাল লাহিড়ি সাহেবেব ওখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল, তাই—
সুকুমারী। লাহিড়ি সাহেবের ওখানে তোমাব এত ঘন ঘন যাতাযাতের দরকার কি, তা ত ভেবে পাইনে। তারা সাহেব মানুষ, তোমার মত অবস্থার লোকের কি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সাজে? আমি ত শুনলেম, তোমাকে তারা পোঁছে না, তবু বুঝি ঐ বঙীন টাইয়ের উপর টাইপিং প’রে বিলাতি কার্ত্তিক সেজে তাদের ওখানে আনাগোনা করতেই হবে। তোমার কি একটুও সম্মানবোধ নেই। এ দিকে একটা কাজ করতে বল্লে মনে মনে রাগ করা হয়, পাছে ওঁকে কেউ বাডির সরকার মনে করে’ ভুল করে। কিন্তু সরকারও ত ভালো—সে খেটে উপার্জ্জন করে’ খায়।
সতীশ। মাসিমা, আমিও হয় ত অনেক আগেই তা’ পারতেম, কিন্তু তুমিই ত—
সুকুমারী। তাই বটে। জানি, শেষকালে আমারি দোষ হবে! এখন বুঝ্চি, তোমার বাপ তোমাকে ঠিক চিনতেন। আমি আরো ছেলেমানুষ বলে দয়া করে’ তোমাকে ঘরে স্থান দিলেম, জেল থেকে বাঁচালেম, শেষকালে আমারি যত দোষ হ’ল। এ’কেই বলে কৃতজ্ঞতা! আচ্ছা, আমারই না হয় যত দোষ, তবু যে ক’দিন এখানে আমাদের অন্ন খাচ্চ, দরকারমত দুটো কাজই না হয় করে’ দিলে। এমন কি কেউ করে না? এ’তে কি অত্যন্ত অপমান বোধ হয়!
সতীশ। কিছু না, কিছু না, কি কর্তে হবে বল, আমি এখনি কর্চি।
সুকুমারী। আজ তোমার আপিসের ছুটি আছে, তোমাকে দোকানে যেতে হবে। খোকার জন্য সাড়ে সাত গজ রেনবো সিল্ক চাই—আর একটা সেলাব সুট। (সতীশের প্রস্থানোদ্যম) শোন শোন ওর মাপটা নিয়ে যেয়ো। জুতো চাই। (সতীশ প্রস্থানোন্মমুখ) ব্যস্ত হচ্চ কেন—সবগুলো ভালো করে’ শুনেই যাও! আজও বুঝি লাহিড়ি সাহেবের রুটি বিস্কিট খেতে যাবার জন্য প্রাণ ছট্ফট করচে। খোকার জন্য ষ্ট্র-হ্যাট্ এনো—আর তার রুমালও এক ডজন চাই। (সতীশের প্রস্থান। তাহাকে পুনরায় ডাকিয়া) শোন সতীশ, আর একটা কথা আছে। শুন্লেম তোমার মেসোর কাছ থেকে তুমি নুতন সুট কেন্বার জন্য আমাকে না বলে’ টাকা চেয়ে নিয়েছ। যখন নিজের সামর্থ্য হবে, তখন যত খুসি সাহেবিয়ানা কোরো, কিন্তু পরের পয়সায় লাহিড়ি সাহেবদের তাক্ লাগিয়ে দেবার জন্য মেসোকে ফতুর করে’ দিয়ো না। সে টাকাটা আমাকে ফেবৎ দিয়ো। আজকাল আমাদের বড় টানাটানির সময়।
সতীশ। আচ্ছা, এনে দিচ্চি।
সুকুমারী। এখনো দোকান খুল তে দেরী আছে। কিন্তু টাকা বাকি যা থাকে, ফেবৎ দিয়ো যেন। একটা হিসাব রাখ্তে ভুলো না। (সতীশের প্রস্থানোদ্যম) শোন সতীশ—এই ক’টা জিনিষ কিন্তে আবার যেন আড়াই টাকা গাড়ি ভাড়া লাগিয়ে ব’সোনা! ঐ জন্যে তোমাকে কিছু আন্তে ব’ল্তে ভয় করে। দু’পা হেঁটে চ’ল্তে হ’লেই অমনি তোমার মাথায় মাথায় ভাবনা পড়ে—পুরুষ মানুষ এত বাবু হ’লে তো চলে না! তোমার বাবা রোজ সকালে নিজে হেঁটে গিয়ে নতুন বাজার থেকে মাছ কিনে আন্তেন—মনে আছে তো? মুটেকেও তিনি এক পয়সা দেন নাই।
সতীশ। তোমার উপদেশ মনে থাক্বে—আমিও দে’বো না! আজ হ’তে তোমার এখানে মুটে ভাড়া বেহারার মাইনে যত অল্প লাগে, সে দিকে আমার সর্ব্বদাই দৃষ্টি থাকবে। (সুকুমারীর প্রস্থান) সেই চিঠিটা এই বেলা শেষ করি, নইলে সময় পাবো না (চিঠি লিখতে প্রবৃত্ত)।
হরেনের প্রবেশ
হরেন। দাদা, ও কি লিখ্চো, কা’কে লিখ্চো, বলো না?
সতীশ। যা, যা, তোর সে খববে কাজ কি, তুই খেলা কর্গে যা!
হরেন। দেখি না কি লিখ্চো—আমি আজকাল প’ড়্তে পারি।
সতীশ। হরেন, তুই আমাকে বিবক্ত করিস নে বল্চি—যা তুই।
হরেন। ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকাব বা, সয়ে আকার সা, ভালবাসা। দাদা কি ভালবাসার কথা লিখ্চো, বলো না। কাঁচা পেয়ারা?
সতীশ। আঃ হরেন, অত চেঁচাসনে ভালবাসার কথা আমি লিখিনি।
হরেন। অ্যাঁ, মিথ্যা কথা ব’ল্চো। ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকার সয়ে আকার ভালবাসা। আচ্ছা, মাকে ডাকি, তাঁকে দেখাও।
সতীশ। না, না, মাকে ডাক্তে হবে না! লক্ষ্মীটি, তুই একটু খেলা কর্তে যা, আমি এইটে শেষ করি।
হরেন। এটা কি দাদা! এ যে ফুলের তোড়া! আমি নেবো।
সতীশ। ওতে হাত দিস্নে—হাত দিস্নে, ছিঁড়ে ফেল্বি।
হবেন। না, আমি ছিঁড়ে ফেলবো না, আমাকে দাও না!
সতীশ। খোকা, কাল তোকে অনেক তোড়া এনে দেবো, এটা থাক্।
হরেন। দাদা, এটা বেশ, আমি এইটেই নেবো।
সতীশ। না, এ আর এক জনের জিনিষ, আমি তোকে দিতে পারবোনা।
হরেন। অ্যাঁ, মিথ্যে কথা! আমি তোমাকে লজঞ্জুস্ আন্তে বলেছিলেম, তুমি সেই টাকায় তোড়া এনেছ—তাই বই কি, আরেকজনের জিনিষ বই কি।
সতীশ। হরেন, লক্ষ্মী ভাই, তুই একটুখানি চুপ কর, চিঠিখানা শেষ করে’ ফেলি। কাল তোকে আমি অনেক লজঞ্জুস্ কিনে এনে দেব।
হরেন। আচ্ছা, তুমি কি লিখ্চো, আমাকে দেখাও।
সতীশ। আচ্ছা দেখাবো, আগে লেখাটা শেষ করি।
হরেন। তবে আমিও লিখি। (শ্লেট লইয়া চীৎকাব স্বরে) ভয়ে আকার ভা,—
সতীশ। চুপ চুপ, অত চীৎকার করিস্ নে!—আঃ থাম্ থাম্!
হরেন। তবে আমাকে তোড়াটা দাও।
সতীশ। আচ্ছা নে, কিন্তু খবরদার ছিঁড়িস নে!—ও কি ক’র্লি! যা বারণ ক’র্লেম, তাই, ফুলটা ছিঁড়ে ফেল্লি। এমন বদ ছেলেও তো দেখিনি! (তোড়া কাড়িয়া লইয়া চপেটাঘাত করিয়া) লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার। যা এখান থেকে—যা ব’ল্চি! যা!
বিধু। সতীশ বুঝি হরেনকে কাঁদিয়েচে, দিদি টের পেলে সর্ব্বনাশ হবে। হরেন, বাপ আমার, কঁদিস নে, লক্ষ্মী আমার, সোনা আমার।
হরেন। (সরোদনে) দাদা আমাকে মেরেচে।
বিধু। আচ্ছা, চুপ কর, চুপ কব, আমি দাদাকে খুব করে’ মার্বো এখন।
হরেন। দাদা ফুলের তোড়া কেড়ে নিয়ে গেলো
বিধু। আচ্ছা, সে আমি তার কাছ থেকে নিয়ে আস্চি! (হরেনের ক্রন্দন) এমন ছিঁচকাঁদুনে ছেলেও তো আমি কখনো দেখিনি। দিদি আদর দিয়ে ছেলেটির মাথা খাচ্চেন। যখন যেটি চায়, তখন সেটি তাকে দিতে হবে। দেখোনা, একেবাবে নবাবপুত্র! ছি ছি, নিজের ছেলেকে কি এমনি ক’রেই মাটি ক’র্তে হয়! (সতর্জ্জনে) খোকা, চুপ কর ব’ল্চি, ঐ হাম্দোবুড়ো আস্চে।
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী। বিধু, ও কি ও! আমার ছেলেকে কি এমনি করেই ভূতের ভয় দেখাতে হয়। আমি চাকর বাকরদের বারণ করে’ দিয়েচি, কেউ ওর কাছে ভূতের কথা ব’ল্তে সাহস করে না।—আর তুমি বুঝি মাসি হ’য়ে ওর এই উপকার ক’র্তে ব’সেচো! কেন বিধু, আমার বাছা তোমার কি অপরাধ ক’রেচে। ওকে তুমি দু’টি চক্ষে দেখ্তে পার না, তা আমি বেশ বুঝেচি! আমি বরাবর তোমার ছেলেকে পেটের ছেলের মতো মানুষ ক’র্লেম আর তুমি বুঝি আজ তারই শোধ নিতে এসেচো।
বিধু। (সরোদনে) দিদি, এমন কথা বলো না। আমার কাছে সতীশ আর তোমার হরেনে প্রভেদ কি আছে!
হরেন। মা, দাদা আমাকে মেরেচে!
বিধু। ছি ছি খোকা, মিথ্যা ব’ল্তে নেই। দাদা তোর এখানে ছিলোই না, তা মার্বে কি করে’।
হরেন। বাঃ—দাদা যে এইখানে বসে’ চিঠি লিখছিলো—তাতে ছিল ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল।
সুকুমারী। তোমরা মায়ে পোয়ে মিলে আমার ছেলের সঙ্গে লেগেচো বুঝি। ওকে তোমাদের সহ্য হচ্চে না। ও গেলেই তোমরা বাঁচো। আমি তাই বলি, খোকা রোজ ডাক্তার কবিরাজেব বোতল বোতল ওষুধ গিল্চে, তবু দিন দিন এমন রোগা হ’চ্চে কেন। ব্যাপারখানা আজ বোঝা গেলো।
সতীশ ও নলিনীর প্রবেশ
সতীশ। এ কি, তুমি যে এ বাড়িতে?
নলিনী। শশধর বাবু বাবাকে কি একটা আইনের কাজে ডেকেচেন। আমি তাঁর সঙ্গে এসেছি।
সতীশ। আমি তোমার কাছে শেষ বিদায় নিতে চাই নেলি।
নলিনী। কেন, কোথায় যাবে?
সতীশ। জাহান্নামে।
নলিনী। যে লোক সন্ধান জানে, সে তো ঘরে বসেই সেখানে যেতে পারে। আজ তোমার মেজাজটা এমন কেন? কলারটা বুঝি ঠিক্ হাল ফেশানের হয় নি।
সতীশ। তুমি কি মনে কর, আমি কেবল কলারের কথাই দিন-রাত্রি চিন্তা করি।
নলিনী। তাই তো মনে হয়। সেই জন্যই তো হঠাৎ তোমাকে অত্যন্ত চিন্তাশীলের মতো দেখায়।
সতীশ। ঠাট্টা কোরো না নেলি, তুমি যদি আজ আমার হৃদয়টা দেখ্তে পেতে—
নলিনী। তা হ’লে ডুমুরের ফুল এবং সাপের পাঁচ পাও দেখ্তে পেতাম!
সতীশ। আবার ঠাট্টা! তুমি বড়ো নিষ্ঠুব। সত্যই বল্চি নেলি, আজ বিদায় নিতে এসেছি।
নলিনী। দোকানে যেতে হবে?
সতীশ। মিনতি কর্চি নেলি, ঠাট্টা করে’ আমাকে দগ্ধ করো না। আজ আমি চিরদিনের মতো বিদায় নেবো!
নলিনী। কেন, হঠাৎ সে জন্য তোমার এত বেশি আগ্রহ কেন?
সতীশ। সত্য কথা বলি, আমি যে কত দরিদ্র, তা তুমি জান না!
নলিনী। সে জন্য তোমার ভয় কিসের। আমি তো তোমার কাছে টাকা ধার চাইনি।
সতীশ। তোমার সঙ্গে আমার বিবাহেব সম্বন্ধ হ’য়েছিল—
নলিনী। তাই পালাবে? বিবাহ না হ’তেই হৃৎকম্প!
সতীশ। আমার অবস্থা জান্তে পেরে মিষ্টার লাহিড়ি আমাদের সম্বন্ধ ভেঙে দিলেন।
নলিনী। অমনি সেই অপমানেই কি নিরুদ্দেশ হ’য়ে যেতে হবে। এত বড়ো অভিমানী লোকের কারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ বাখা শোভা পায় না। সাধে আমি তোমার মুখে ভালবাসার কথা শুন্লেই ঠাট্টা ক’রে উড়িয়ে দি।
সতীশ। নেলি, তবে কি এখনো আমাকে আশা রাখ্তে বলো!
নলিনী। দোহাই সতীশ, অমন নভেলি ছাঁদে কথা বানিয়ে বলো না, আমার হাসি পায়। আমি তোমাকে আশা রাখ্তে ব’ল্বো কেন? আশা যে রাখে, সে নিজের গরজেই রাখে, লোকের পরামর্শ শুনে রাখে না।
সতীশ। সে তো ঠিক কথা। আমি জান্তে চাই, তুমি দারিদ্র্যকে ঘৃণা করো কি না?
নলিনী। খুব করি, যদি সে দারিদ্র্য মিথ্যার দ্বারা নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা কবে।
সতীশ। নেলি, তুমি কি কখনো তোমার চিরকালের অভ্যস্ত আরাম ছেড়ে গরীবের ঘরের লক্ষ্মী হ’তে পারবে?
নলিনী। নভেলে যে রকম ব্যারামের কথা পড়া যায়, সেটা তেমন করে চেপে ধরলে আরাম আপনি ঘরছাড়া হয়।
সতীশ। সে ব্যারামের কোনো লক্ষণ কি তোমার—
নলিনী। সতীশ, তুমি কখনো কোনো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হ’তে পারলে না। স্বয়ং নন্দী সাহেবও বোধ হয় অমন প্রশ্ন তুলতেন না। তোমাদের এক চুলও প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।
সতীশ। তোমাকে আমি আজও চিন্তে পারলেম না নেলি।
নলিনী। চিন্বে কেমন করে’? আমি তো তোমার হাল ফেশানের টাই নই—কলার নই—দিনরাত যা নিয়ে ভাবো, তাই তুমি চেনো।
সতীশ। আমি হাত যোড় করে’ ব’ল্চি নেলি, তুমি আজ আমাকে এমন কথা ব’লো না। আমি যে কি নিয়ে ভাবি, তা তুমি নিশ্চয় জানো।
নলিনী। ঐ যে বাবা ডাকচেন। তাঁর কাজ হ’য়ে গেছে। যাই!
সুকুমারী ও শশধরের প্রবেশ
সুকুমারী। দেখ, তোমাকে জানিয়ে রাখ্চি, আমার হরেনকে মার্বার জন্যেই ওরা মায়ে পোয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।
শশধর। আঃ, কি বলো। তুমি কি পাগল হ’য়েছো নাকি?
সুকুমারী। আমি পাগল, না, তুমি চোখে দেখ্তে পাও না।
শশধর। কোনটাই আশ্চর্য্য নয়, দুটোই সম্ভব। কিন্তু—
সুকুমারী। আমাদের হরেনেব জন্ম হ’তেই দেখনি ওদেব মুখ কেমন হ’য়ে গেছে। সতীশের ভাবখানা দেখে বুঝতে পার না।
শশধর। আমার অত ভাব বুঝ্বার ক্ষমতা নেই, সে তো তুমি জানোই।
সুকুমারী। সতীশ যখনই আড়ালে পায়, তোমার ছেলেকে মারে, আবার বিধুও তার পিছনে পিছনে এসে খোকাকে জুজুর ভয় দেখায়।
শশধর। ঐ দেখ, তোমরা ছোটো কথাকে বড়ো ক’রে তোলো। যদিই বা সতীশ খোকাকে কখনো—
সুকুমারী। সে তুমি সহ্য় ক’রতে পারো, আমি পারবো না—ছেলেকে তো তোমার গর্ভে ধর্তে হয়নি।
শশধর। সে কথা আমি অস্বীকাব ক’রতে পাববো না। এখন তোমার অভিপ্রায় কি শুনি।
সুকুমারী। শিক্ষা সম্বন্ধ তুমি তো বড়ো বড়ো কথা বলো, একবাব তুমি ভেবে দেখ না, আমরা হরেনকে যে ভাবে শিক্ষা দিতে চাই, তার মাসি তাকে অন্যরূপ শেখায়—সতীশের দৃষ্টান্তটিই বা তার পক্ষে কি রকম, সেটাও তো ভেবে দেখ্তে হয়।
শশধর। তুমি যখন অত বেশি করে’ ভাবচো, তখন তার উপরে আমার আর ভাববার দরকাব কি আছে! এখন কর্ত্তব্য কি বলো?
সুকুমারী। আমি বলি, সতীশকে তুমি বলো, পুরুষ মানুষ পরের পয়সায় বাবুগিরি করে, সে কি ভালো দেখ্তে হয়। আর যার সামর্থ্য কম, তার অত লম্বা চালেই বা দরকার কি?
শশধর। মন্মথ সেই কথাই ব’লতো। আমরাই তো সতীশকে অন্যরূপ বুঝিয়েছিলেম। এখন ওকে দোষ দিই কি করে’?
সুকুমারী। না—দোষ কি ওর হ’তে পারে। সব দোষ আমারি। তুমি তো আর কারো কোন দোষ দেখ্তে পাও না—কেবল আমার বেলাতেই—
শশধর। ওগো, রাগ করো কেন—আমিও তো দোষী।
সুকুমারী। তা হ’তে পারে। তোমার কথা তুমি জানো। কিন্তু আমি কখনো ওকে এমন কথা বলিনি যে, তুমি তোমার মেসোর ঘরে পায়ের উপব পা দিয়ে গোঁফে তা দাও আর লম্বা কেদারায় বসে’ বসে’ আমার বাছার উপর বিষদৃষ্টি দিতে থাকো।
শশধর। না, ঠিক ঐ কথাগুলো তুমি তাকে মাথার দিব্য দিযে শপথ করিয়ে নাওনি—অতএব তোমাকে দোষ দিতে পারিনে। এখন কি ক’রতে হবে বলো।
সুকুমারী। সে তুমি যা ভালো বোঝো, তাই করো। কিন্তু আমি ব’লচি, সতীশ যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকবে, খোকাকে কোন মতে বাইরে যেতে দিতে পারবো না। ও তো আমারই আপন বোনের ছেলে। কিন্তু আমি ওকে এক মুহূর্ত্তের জন্য বিশ্বাস করিনে—এ আমি তোমাকে স্পষ্টই ব’ললেম।
সতীশের প্রবেশ
সতীশ। কাকে বিশ্বাস কর না মাসিমা! আমাকে? আমি তোমার খোকাকে সুযোগ পেলে গলা টিপে মার্বো, এই তোমার ভয়? যদি মারি, তবে তুমি তোমার বোনের ছেলের যে অনিষ্ট ক’রেচো, তার চেয়ে ওর কি বেশি অনিষ্ট করা হবে? কে আমাকে ছেলেবেলা হ’তে নবাবের মতো সৌখীন করে’ তুলেচে এবং আজ ভিক্ষুকের মতো পথে বের কল্লে? কে আমাকে পিতার শাসন থেকে বিশ্বের লাঞ্ছনার মধ্যে টেনে আনলে? কে আমাকে—
সুকুমারী। ওগো শুন্চো? তোমার সাম্নে আমাকে এমনি করে’ অপমান করে? নিজের মুখে বলে কি না, খোকাকে গলা টিপে মার্বে? ও মা, কি হবে গো। আমি কালসাপকে নিজের হাতে দুধকলা দিয়ে পুষেচি।
সতীশ। দুধকলা আমারও ঘরে ছিলো—সে দুধকলা আমার বক্ত বিষ হয়ে উঠতো না—তা থেকে চিরকালের মতো বঞ্চিত করে’ তুমি যে দুধকলা আমাকে খাইয়েচো, তাতে আমার বিষ জমে উঠেচে। সত্য কথাই ব’ল্চো, এখন আমাকে ভয় করাই চাই—এখন আমি দংশন ক’র্তে পাবি।
বিধুমুখীর প্রবেশ
বিধু। কি সতীশ, কি হ’য়েচে, তোকে দেখে যে ভয় হয়! অমন করে’ তাকিয়ে আছিস্ কেন? আমাকে চিনতে পাবচিস্ নে? আমি তোর মা, সতীশ!
সতীশ। মা, তোমাকে মা ব’ল্বো কোন্ মুখে? মা হয়ে কেন তুমি আমাকে জেল থেকে ফিরিয়ে আন্লে? সে কি মাসির ঘরের চেয়ে ভয়ানক?
শশধর। আঃ সতীশ! চলো চলো—কি ব’কচো, থামো।
সুকুমারী। নাও তোমরা বোঝাপড়া করো—আমার কাজ আছে।
শশধর। সতীশ, একটু ঠাণ্ডা হও! তোমার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, সে কি আমি জানিনে? তোমার মাসি রাগের মুখে কি ব’লচেন, সে কি অমন করে’ মনে নিতে আছে? দেখো, গোড়ায় যা ভুল হ’য়েচে, তা এখন যতটা সম্ভব প্রতিকার করা বাবে, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
সতীশ। মেসোমশায়, প্রতীকারের আর কোন সম্ভাবনা নেই। মাসিমার সঙ্গে আমার এখন যেরূপ সম্পর্ক দাঁড়িয়েচে, তাতে তোমার ঘরের অন্ন আমার গলা দিয়ে আর গ’ল্বে না। এত দিন তোমাদের যা খরচ করিয়েচি, তা যদি শেষ কড়িটি পর্য্যন্ত শোধ করে’ দিতে না পারি, তবে আমার মরেও শান্তি নাই। প্রতিকার যদি কিছু থাকে তো সে আমার হাতে, তুমি কি প্রতিকাব ক’রবে?
শশধর। না, শোনো সতীশ—একটু স্থির হও। তোমার যা কর্ত্তব্য, সে তুমি পরে ভেবো, তোমার সম্বন্ধে আমরা যে অন্যান্য ক’রেচি, তার প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকেই ক’র্তে হবে। দেখো, আমার বিষয়ের এক অংশ আমি তোমাকে লিখে দেবো, সেটাকে তুমি দান মনে করো না, সে তোমার প্রাপ্য। আমি সমস্ত ঠিক করে’ রেখেচি—পর্শু শুক্রবারে রেজেষ্ট্রী ক’রে দেবো।
সতীশ। (শশধরের পায়ের ধূলা লইয়া) মেসোমশায়, কি আর ব’ল্বো—তোমার এই স্নেহে—
শশধব। আচ্ছা, থাক্ থাক্! ওসব স্নেহ ফ্নেহ আমি কিছু বুঝি নে, রসকস আমার কিছুই নেই। যা কর্ত্তব্য, তা কোন রকমে পালন কর্ত্তেই হবে, এই বুঝি। সাড়ে আট্টা বাজ্লো, তুমি আজ কোরিন্থিয়ানে যাবে বলেছিলে, যাও। সতীশ, একটা কথা তোমাকে বলে’ রাখি। দানপত্রখানা আমি মিষ্টার লাহিড়িকে দিয়েই লিখিয়ে নিয়েচি। ভাবে বোধ হ’লো, তিনি এই ব্যাপারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হ’লেন—তোমার প্রতি যে টান নেই, এমন তো দেখা গেল না। এমন কি, আমি চলে’ আস্বার সময় তিনি আমাকে ব’ল্লেন, সতীশ আজকাল আমাদের সঙ্গে দেখা কর্তে আসে না কেন? আরো একটা সুখবর আছে সতীশ, তোমাকে যে আপিসে কাজ করিয়ে দিয়েছি, সেখানকার বড়ো সাহেব তোমার খুব সুখ্যাতি ক’র্ছিলেন।
সতীশ। সে আমার গুণে নয়। তোমাকে ভক্তি করেন বলেই আমাকে এত বিশ্বাস কবেন।
শশধর। ওরে বামচরণ, তোর মা ঠাকুরাণীকে একবার ডেকে দে তো।
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী। কি স্থিব ক’র্লে?
শশধর। একটা চমৎকার প্ল্যান ঠাউরেচি।
সুকুমারী। তোমার প্ল্যান যত চমৎকার হবে, সে আমি জানি। যা হো’ক, সতীশকে এ বাড়ি থেকে বিদায় ক’রেচো তো?
শশধর। তাই যদি না ক’র্বো, তবে আর প্ল্যান কিসের? আমি ঠিক ক’রেচি, সতীশকে আমাদের তরফ মাণিকপুর লিখে পড়ে’ দেবো—তা হলেই সে স্বচ্ছন্দে নিজের খরচ চালিয়ে আলাদা হ’য়ে থাকতে পার্ বে। তোমাকে আর বিবক্ত ক’র্ বে না।
সুকুমারী। আহা, কি সুন্দর প্ল্যানই ঠাউরেচো। সৌন্দর্য্যে আমি একেবারে মুগ্ধ! না, না, তুমি অমন পাগলামি ক’র্তে পারবে না, আমি বলে’ দিলেম।
শশধর। দেখো, এক সময়ে তো ওকেই সমস্ত সম্পত্তি দেবার কথা ছিলো।
সুকুমারী। তখন তো আমার হরেন জন্মায় নি। তা ছাড়া তুমি কি ভাবো, তোমার আর ছেলেপুলে হবে না?
শশধর। সুকু, ভেবে দেখো, আমাদের অন্যায় হচ্ছে। মনেই করো না কেন, তোমার দুই ছেলে।
সুকুমারী। সে আমি অতশত বুঝিনে—তুমি যদি এমন কাজ করো, তবে আমি গলায় দড়ি দিয়ে ম’রবো—এই আমি বলে গেলেম।
সতীশের প্রবেশ
শশধর। কি সতীশ, থিয়েটারে গেলে না?
সতীশ। মেসোমশায়, আব থিয়েটার না। এই দেখ, দীর্ঘকাল পরে মিষ্টার লাহিড়ির কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েচি। তোমার দানপত্রের ফল দেখ। সংসারের উপর আমার ধিক্কার জন্মে গেছে মেসোমশায়! আমি তোমার সে তালুক নেবো না।
শশধর। কেন সতীশ?
সতীশ। নিজের কোনো মূল্য থাকে, তবে সেই মূল্য দিয়ে যতটুকু পাওয়া যায়, ততটুকুই ভোগ ক’রবো। তা ছাড়া তুমি যে আমাকে তোমার সম্পত্তির অংশ দিতে চাও, মাসিমার সম্মতি নিয়েছো তো?
শশধর। না, সে তিনি—অর্থাৎ বুঝেছো সে একরকম করে হবে। হঠাৎ তিনি রাজি না হ’তে পারেন, কিন্তু— যদিই বা,—
সতীশ। তুমি তাঁকে ব’লেছো?
শশধর। হাঁ, বলেছি বই কি? বিলক্ষণ। তাঁকে না ব’লেই কি আর—
সতীশ। তিনি রাজি হ’য়েছেন?
শশধর। তাঁকে ঠিক বাজি বলা যায় না বটে, কিন্তু ভালো করে’ বুঝিয়ে—ধৈর্য্য ধরে’ থাকলেই—
সতীশ। বৃথা চেষ্টা মেসোমশায়। তাঁর নারাজিতে তোমার সম্পত্তি আমি নিতে চাই নে। তুমি তাঁকে বোলো, আজ পর্য্যন্ত তিনি যে অন্ন খাইয়েছেন, তা উদ্গাব না করে’ আমি বাঁচবো না। তাঁর সমস্ত ঋণ সুদশুদ্ধ শোধ করে’ তবে আমি হাঁফ ছাড বো।
শশধর। সে কিছুই দরকার নেই সতীশ। তোমাকে ববঞ্চ কিছু নগদ টাকা গোপনে—
সতীশ। না মেসোমশায়, আর ঋণ বাড়াবো না। মাসিমাকে বোলো, আজই এখনি তাঁর কাছে হিসাব চুকিয়ে তবে জল গ্রহণ ক’রবো।