শোধ-বোধ/প্রথম অঙ্ক/তৃতীয় দৃশ্য
তৃতীয় দৃশ্য
মিস্টার লাহিড়ির বাড়িতে টেনিস্ক্ষেত্র
নলিনী। ও কি সতীশ, পালাও কোথায়?
সতীশ। তোমাদেব এখানে টেনিস্পার্টি জান্তেম না, আমি টেনিসসুট পরে’ আসিনি।
নলিনী। জন্বুলের যত বাছুর আছে, সকলেরই তো এক রঙের চামড়া হয় না, তোমার না হয় ওরিজিন্যাল বলেই নাম র’ট্বে। আচ্ছা, আমি তোমাব সুবিধা করে’ দিচ্ছি। মিষ্টার নন্দী, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
নন্দী। অনুরোধ কেন, হুকুম বলুন না—আমি আপনার সেবার্থে
নলিনী। যদি একেবাবে অসাধ্য বোধ না করেন তো আজকের মতো আপনারা সতীশকে মাপ ক’র্বেন—ইনি আজ টেনিস্সূট্ পরে’ আসেন নি। এত বড়ো শোচনীয় দুর্ঘটনা।
নন্দী। আপনি ওকালতি ক’রলে খুন, জাল, ঘর জ্বালানও মাপ ক’রতে পারি। টেনিসসূট না প’রে এলেই যদি আপনার এত দয়া হয়, তবে আমার এই টেনিসসুট্টা মিষ্টার সতীশকে দান করে’ তাঁর এই— এটাকে কি বলি! তোমার এটা কি সুট্, সতীশ? খিচুরী সুটই বলা যাক — আমি সতীশের এই খিচুড়ী সুট্টা পরে’ রোজ এখানে আসবো। আমার দিকে যদি স্বর্গের সমস্ত সূর্য্য চন্দ্র তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তবু লজ্জা ক’রবো না। সতীশ এ কাপড়টা দান ক’রতে যদি তোমার নিতান্তই আপত্তি থাকে, তবে তোমার দর্জ্জির ঠিকানাটা দিয়ো। ফ্যাশানেবল ছাঁটের চেয়ে মিস লাহিড়িব দয়া অনেক মূল্যবান্।
নলিনী। শোনো, শোনো সতীশ, শুনে রাখো। কেবল কাপড়ে ছাঁট নয়, মিষ্ট কথার ছাঁদও তুমি মিষ্টার নন্দীর কাছে শিখ্তে পার। এমন আদর্শ আর পাবে না। বিলাতে ইনি ডিউক ডাচেস্ ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথাও কন নাই! মিষ্টার নন্দী, আপনাদের সময় বিলাতে বাঙালী ছাত্র কে কে ছিলো?
নন্দী। আমি বাঙালীদের সঙ্গে সেখানে মিশিনি।
নলিনী। শুন্চো সতীশ! বীতিমত সভ্য হ’তে গেলে কত ছোঁয়া বাঁচিয়ে চল্তে হয়। তুমি বোধ হয় চেষ্টা ক’রলে পার্বে। টেনিস সুট সম্বন্ধে তোমার যে বকম সূক্ষ্ম ধর্ম্মজ্ঞান, তাতে আশা হয়। (অন্যত্র গমন)
সতীশ। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) নেলিকে আজ পর্য্যন্ত বুঝতেই পার্লেম না।
চারুবালা নন্দীর কাছে আসিয়া
চারু। মিষ্টার নন্দী, সুশীলের সঙ্গে আমার একটা কথা নিয়ে ঘোর তর্ক হ’য়ে গেছে, আপনাকে তার নিষ্পত্তি করে’ দিতে হবে—আমি বাজি বেখেছি—
নন্দী। যদি আমার উপরেই নিষ্পত্তির ভার থাকে, তা’হলে বাজিতে আপনি নিশ্চয়ই জিত্বেন।
চারু। না, না, আগে কথাটা শুনুন,—তার পরে বিচার করে—
নন্দী। যাদের faith নেই, সেই নাস্তিকরাই সব কথা আগাগোড়া শোনে, বিচার করে—কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে কতকগুলি জিনিষ আছে, শাস্ত্রে যাদের বলে অন্ধ। আমি দেবী-woshipper, অন্ধ ভক্ত।
চারু। আপনার কথা শুন্লেই স্পষ্ট বুঝতে পারি, আপনি অক্সফোর্ডে প’ড়েছেন। এখন আমাদের বাজে কথাটা শুনুন। সুশীল ব’ল্তে চায়, আমার এই শাডির রঙের সঙ্গে আমার এই জুতোর রঙ মানায় না।
নন্দী। সুশীল নিশ্চয় রংকাণা। আপনার সাড়ির সঙ্গে জুতোর চমৎকার ম্যাচ হ’য়েচে। যদি মাপ করেন তো বলি, আপনার এই রুমালটার রঙ—
চারু। এ বুঝি আমার রুমাল? এ যে নেলির,—সে জোর করে’ আমাকে দিলে—বহরমপুর না কোথা থেকে এই ফুলকাটা মুসলমানী ফ্যাশানের রুমাল কিনেচে। আমাকে ব’ল্লে, সাজের মধ্যে অন্তত একটা দিশী জিনিষ থাক্।
নন্দী। I see—মিস্ বোস্, আপনি টেনিসের next setএ পার্টনার ঠিক ক’রেচেন?
চারু। না
নন্দী। আমাকে যদি select করেন, তাহলে দেখ্তে পাবেন, আপনার শাড়ির সঙ্গে জুতোর যে রকম ম্যাচ হ’য়েচে, টেনিসে আপনার সঙ্গে আমার তার চেয়ে খারাপ ম্যাচ হবে না।
চারু। আপনাকে পার্টনার পেলে তো জিৎবই। আমি ভেবেছিলেম, next set এ আপনি বুঝি নেলির সঙ্গে engaged.
নন্দী। না, she wanted to be excused.
চারু। ওঃ, বোধ হয় সতীশের সঙ্গে কথা আছে। আমি তো বুঝতে পারিনে সতীশের মধ্যে নলিনী কী যে দেখেচে।
নন্দী। দেখেছে ওর monumental absurdity আর তার চেয়ে absurd ওর—থাক্, সে কথা থাক।
চারু। কিন্তু ওর মত অত বড়ো অযোগ্য লোককে—
নন্দী। অযোগ্যতা হচ্চে শূন্য পেয়ালা, কৃপা দিয়ে ভরা সহজ।
চারু। শুধু কেবল কৃপা! ছিঃ! শ্রদ্ধা কি তার চেয়েও বড়ো নয়? চলুন খেল্তে। কিন্তু আপনি তো জানেন, আমি ভারি বিশ্রী খেলি।
নন্দী। খেলায় আপনি হারতে পারেন; কিন্তু বিশ্রী খেল্তে কিছুতেই পারেন না।
চারু। Thanks.
নলিনী (পুনরায় আসিয়া) কি সতীশ, এখনও যে তোমার মনের খেদ মিট্লো না। টেনিস কোর্ত্তার শোকে তোমার হৃদয়টা যে বিদীর্ণ হ’য়ে গেলো। হায়, হায়, কোর্ত্তাহারা অভাগ হৃদয়ের সান্ত্বনা জগতে কোথায় আছে— দর্জ্জির বাড়ি ছাড়া!
সতীশ। আমার হৃদয়টার ঠিকানা যদি জান্তে, তা’হ’লে খুব বেশি ক’রে তাকে খুঁজে বেড়াতে হ’তো না।
নলিনী। (করতালি দিয়া) Bravo! মিষ্টার নন্দীর দৃষ্টান্তে মিষ্ট কথার আমদানি সুরু হ’য়েছে। উন্নতি হবে ভবসা হ’চ্ছে। এসো একটু কেক খেয়ে যাবে, মিষ্ট কথার পুরস্কার মিষ্টান্ন।
সতীশ। না আজ আর খাবো না, আমার শরীরটা
নলিনী। সতীশ, আমার কথা শোনো,—টেনিস্ কোর্ত্তার খেদে শরীর নষ্ট কোরো না। কোর্ত্তা জিনিষটা জগতের মধ্যে সেরা জিনিষ, কিন্তু এই তুচ্ছ শরীরটা না হ’লে সেটা ঝুলিয়ে বেড়াবার সুবিধা হয় না।
সতীশ। নেলি, আজ তোমাকে একটা খুব বিশেষ কথা বলতে এসেছি—
নলিনী। না, না, বিশেষ কথার চেয়ে সাধারণ কথা আমি ভালোবাসি।
সতীশ। যেমন করে’ হোক্ ব’লতেই হবে, নইলে বাঁচবো না, তার পরে যদি বিদায় করে’ দাও তবে মাথা হেঁট্ করে’ জন্মের মতোই—
নলিনী। সর্ব্বনাশ! সহজে ব’ল্বার কথা পৃথিবীতে এত আছে যে, চমক-লাগানো কথা না ব’ল্লেও সময় কেটে যায়। আমারও ব’ল্বার কথা একটা আছে, তার পরে যদি সময় থাকে, তুমি ব’লো।
সতীশ। আচ্ছা, তাই আগে বলে’ নাও, কিন্তু আমার কথা শুন্তেই হবে।
নলিনী। ব’ল্বার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি, বলে’ নিই, রাগ ক’রো না।
সতীশ। তুমি ডেকেচো বলে’ বাগ ক’রবো, আমি এত বড় savage?
নলিনী। সকল সময়েই নন্দী সাহেবের চেলাগিরি কোরো না। বলো দেখি, আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে অমন দামি জিনিষ কেন দিলে? সেই তোমার নেকলেস?
সতীশ। নেকলেস? সেটা কি তবে—
নলিনী। ভুল বোঝো না—জিনিষটা খুব ভালো। কিন্তু তুমি যে ঐ টে কেনবার জন্যে—
সতীশ। নেলি, চুপ চুপ, তোমাব মুখে আমি সে কথা শুন্তে পারবো না। কে তোমাকে কী ব’লেচে, সব মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা—
নলিনী। হঠাৎ অমন ক্ষেপে উঠলে? কি মিথ্যে কথা? নেকলেস্টা তুমিই আমাকে দিয়েচো, সে ও কী মিথ্যে কথা?
সতীশ। না, না, হাঁ, তা হ’তেও পারে, এ রকম করে’ দেখ্লে হয় তো—
নলিনী। নেকলেস্ এক রকম করে’ ছাড়া আর ক’রকম করে’ দেখা যায়? কথা উঠ্তে না উঠ্তেই আগে থাকতেই তুমি যেন—
সতীশ। আচ্ছা, তা বলো, কি ব’লছিলে বলো।
নলিনী। কিচ্ছু না, খুব সাদা কথা, অমন দামী জিনিষ আমাকে কেন দিলে?
সতীশ। আচ্ছা বেশ, তা’হ’লে আমাকে ফিরিয়ে দাও।
নলিনী। ঐ দেখ আবার অভিমান।
সতীশ। আমার মতো অবস্থার লোকের অভিমান কিসের? দাও তবে ফিরিয়েই দাও।
নলিনী। অমন সুর করো যদি, তোমার সঙ্গে মন খুলে কথা কওয়াই শক্ত হয়। একটু শান্ত হ’য়ে শোনো আমার কথা। মিষ্টার নন্দী আমাকে নির্ব্বোধের মতো একটা দামি ব্রেস্লেট্ পাঠিয়েছিলেন, তুমি অমনি নির্ব্বুদ্ধিতার সুর চড়িয়ে তার চেয়ে দামি একটা নেক্লেস্ পাঠাতে গেলে কেন?
সতীশ। সেটা বোঝবার শক্তি থাক্লেই তো মানুষেব কোনো মুস্কিল ঘটে না। যে অবস্থায় লোকের বিবেচনাশক্তি থাকে না, সে অবস্থাটা তোমার একেবারে জানা নেই বলে’ তুমি রাগ করো নেলি।
নলিনী। আমার সাত জন্মে জেনে কাজ নেই। কিন্তু ও নেক্লেস্ তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সতীশ। ফিরে দেবে?
নলিনী। দেবো বাহাদুরি দেখাবার জন্য যে দান, আমার কাছে সে দানের মূল্য নেই।
সতীশ। বাহাদুরি দেখাবার জন্যে এমন কথা তুমি ব’ল্লে? অন্যায় ব’ল্ছো, নেলি।
নলিনী। আমি কিছুই অন্যায় ব’ল্চিনে—তুমি যদি আমাকে একটি ফুল দিতে, আমি ঢের বেশি খুসি হ’তেম। তুমি যখন-তখন প্রায়ই মাঝে মাঝে আমাকে কিছু না কিছু দামি জিনিষ পাঠাতে আরম্ভ ক’রেছো। পাছে তোমার মনে লাগে বলে’ আমি এত দিন কিছু বলিনি। কিন্তু ক্রমেই মাত্রা বেড়ে চলেছে, আর আমার চুপ করে’ থাকা উচিত নয়। এই নাও তোমার নেক্লেস্।
সতীশ। আচ্ছ। তবে নিলুম। (হাতে লইয়া অনেকক্ষণ নাড়া’ চাড়া করিয়া ধূলায় ফেলিয়া দিল)
নলিনী। ও কী হ’লো?
সতীশ। ভেবেছিলুম, ওর দাম আছে, ওর কোন দাম নেই।
নলিনী। (তুলিয়া লইয়া) তুমি রাগই করো আর যাই করো, আমার যা ব’লবার, তোমাকে ব’লবোই। আমি তো তোমাকে ছেলেবেলা থেকেই জানি, আমার কাছে ভাঙিয়ো না। সত্য করে’ বলো, তোমার কি অনেক টাকা ধার হয় নি?
সতীশ। (চমকিয়া উঠিযা) কে ব’ললে ধার হ’য়েছে? কে ব’ললে তোমাকে? এক জন কেউ আছে, সে লাগালাগি ক’রচে। তার নাম বলো, আমি তাকে—
নলিনী। আজ তোমার কী হ’য়েছে বলো তো?
সতীশ। ব’লতেই হবে, তোমাকে কে ব’লেছে আমার ধারের কথা? আমি তাকে দেখে নিতে চাই।
নলিনী। কেউ বলে নি। আমি তোমাব মুখ দেখেই বুঝ্তে পারি। আমার জন্য তুমি এমন অন্যায় কেন ক’রচো?
সতীশ। সময়বিশেষে লোকবিশেষের জন্যে মানুষ প্রাণ দিতে ইচ্ছে করে, আজকালকার দিনে প্রাণ দেবার ভদ্র উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না—অন্তত ধার করার দুঃখটুকু স্বীকার ক’র্বাব যে সুখ, তাও কি ভোগ ক’র্তে দেবে না? আমার পক্ষে যা মৃত্যুর চেয়েও দুঃসাধ্য, আমি তোমার জন্য তাই ক’রতে চাই নেলি, এ’কে যদি তুমি নন্দী সাহেবের নকল বলো, তবে আমার পক্ষে মর্মান্তিক হয়।
নলিনী। আচ্ছা, তোমার যা ক’র্বার, তা তো ক’রেচো—তোমার সেই ত্যাগ স্বীকার-টুকু আমি নিলেম-এখন এ জিনিষটা ফিরে নাও।
সতীশ। তবে দাও, তাই দাও। যদি আমার অন্তরের কথাটা বুঝে থাকো, তা’হলে—
নলিনী। থাক থাক অন্তরের কথা অন্দরমহলেই থাক। নেকলেস্টা এই নিয়ে যাও।
সতীশ। (হাতে লইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) সেই ভালো, তবে যাই। (কিছু দূর গিয়া ফিরিয়া আসিয়া) দয়া করো নেলি, দয়া করো—যদি আমাকে ফিরিয়ে নিতে হয়, তবে ওটা গলায় ফাঁস লাগিয়ে দম বন্ধ ক’রে আমার পক্ষে মরা ভালো।
নলিনী। দেনা তুমি শোধ ক’রবে কি করে’?
সতীশ। মা’র কাছ থেকে টাকা পাবো।
নলিনী। ছি ছি, তিনি মনে ক’রবেন, অমার জন্যই তাঁর ছেলের দেনা হ’চ্চে। সতীশ, তোমার এই নেকলেসটা হতে করে’ নেওয়ার চেয়ে ঢের বেশি করে’ নিয়েচি, এই কথাটা তোমাকে বুঝে দেখ্তে হবে। নইলে কখনই তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পার্তুম না। দিলে অপমান করা হ’তো! বুঝতে পার্চো?
সতীশ। সম্পূর্ণ না।
নলিনী। তোমার দান করাকেই আমি বেশি মান দিযেছি বলেই তোমাব দানের জিনিষকে অনায়াসে ত্যাগ ক’র্তে পাবি। মনে করো না, এটা হারিয়ে গেছে, সেই হারানোতে তোমাব দান তো একটুও হারায় না।
সতীশ। ঠিক ব’ল্চো, নেলি?
নলিনী। ঠিক ব’ল্চি। আমি যেমন সহজে এটি তোমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্চি, তেমনি সহজে তুমি এটি আমার হাত থেকে ফিরে নাও। তা’হলে আমি ভারি খুসি হবো।
সতীশ। খুসি হবে? তবে দাও। (নেকলেস্ লইয়া) কিন্তু যে হাত দিয়ে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে, সেই হাতেই তুমি আর এক জনের ব্রেস্লেট্ প’রেচো, সে যেন আমাকে—
নলিনী। ওতে কন্যার হাত নেই সতীশ, আছে কন্যাকর্ত্তার হাত। বাবা বিশেষ করে ব’লেছিলেন, আজ—
সতীশ। আচ্ছা, ঐ ব্রেস্লেট্ চিরদিনই তোমার হাতে থাকে—এই নেক্লেস্ কেবল কিছুক্ষণের জন্যে গলায় পরো, তার পরে আমি নিয়ে যাবো।
নলিনী। প’র লে বাবা রাগ ক’রবেন।
সতীশ। কেন?
নলিনী। তাহলে এই ব্রেস্লেট্ পরার দাম কমে’ যাবে।—ফের মুখ গম্ভীর ক’র্চো?
সতীশ। কথাটা কি খুব প্রফুল্ল হবার মতো?
নলিনী। নয় তো কি? তোমার কাছে যে আমি এত খুলে কথা বলি, তার কোনো দাম নেই? অকৃতজ্ঞ! মিষ্টার নন্দীর সঙ্গে আমি এমন করে’ কইতে পার্তুম? এবাব কিন্তু টেনিস্ কোর্ট থেকে যাও।
সতীশ। কেন যেতে ব’ল্চো, নেলি? এখানে আমাকে মানায় না?
নলিনী। না, মানায় না।
সতীশ। চাঁদনির কাপড় পরি বলে’?
নলিনী। সে একটা কারণ বই কি?
সতীশ। তুমি আমাকে এমন কথা ব’ল্লে?
নলিনী। আমি যদি তোমাকে সত্যি কথা বলি, খুসি হোয়ো, অন্যে ব’ল্লে রাগ ক’র্তে পারো।
সতীশ। তুমি আমাকে অযোগ্য বলে’ জানো, এতে আমি খুসি হবো?
নলিনী। এই টেনিস কোর্টের অযোগ্যতাকে তুমি অযোগ্যতা বলে’ লজ্জা পাও? এতেই আমি সব চেয়ে লজ্জা বোধ করি। তুমি তো তুমি, এখানে স্বয়ং বুদ্ধদেব এসে যদি দাঁড়াতেন, আমি দুই হাত জোড় করে’ পায়ের ধূলো নিয়েই তাঁকে ব’ল্তুম, ভগবান্, লাহিড়িদের বাড়ির এই টেনিস্ কোর্টে আপনাকে মানায় না, মিষ্টার নন্দীকে তার চেয়ে বেশী মানায়। শুনে কি তখনই তিনি হার্ম্মানের বাড়ি ছুট্তেন টেনিস সুট্ অর্ডার দিতে?
সতীশ। বুদ্ধদেবের সঙ্গে—
নলিনী। তোমার তুলনাই হয় না, তা জানি। আমি ব’লতে চাই, টেনিস্ কোর্টের বাইরেও একটা মস্ত জগৎ আছে—সেখানে চাঁদনীর কাপড় পরেও মনুষ্যত্ব ঢাকা পড়ে না। এই কাপড় পরে’ যদি এখনি ইন্দ্রলোকে যাও তো উর্ব্বশী হয় তো একটা পারিজাতের কুঁড়ি ওর ‘বাটন হোল’এ পরিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবে না—অবিশ্যি তোমাকে যদি তার পছন্দ হয়।
সতীশ। বাটন্ হোল তো এই র’য়েচে, গোলাপের কুঁড়িও তোমার খোঁপায়—এবারে পছন্দর পরিচয়টা কি ভিক্ষে করে’ নিতে পারি?
নলিনী। আবার ভুলে যাচ্চ, এটা স্বর্গ নয়, এটা টেনিস্ কোর্ট।
সতীশ। এটা যে স্বর্গ নয়, সেইটে ভুল তে পারিনে ব’লেই তো—
নলিনী। এইবার তো নন্দীর সুর লাগ্চে গলায়—
সতীশ। তার একটিমাত্র কারণ—আমি টেনিস্ কোর্টেরই যোগ্য হ’তে চাই। উর্ব্বশীর হাতের পারিজাতের কুঁড়ির পরে আমার একটুও লোভ নেই।
নলিনী। বড় দুঃসাধ্য তোমার তপস্যা, সতীশ—স্বর্গে তোমার কম্পিটিশন কার্ত্তিককে নিয়ে চাঁদকে নিয়ে—এখানে আছেন স্বয়ং মিষ্টার নন্দী। পেরে উঠ্বে না, কন্যাকর্ত্তাদের সব দামি দামি অর্কিড, ওঁরি ‘বাটন্ হোলে’ গিয়ে পৌঁচচ্ছে। ছেড়ে দাও আশা।
সতীশ। অর্কিডের আশা ছেড়েছি, কিন্তু ঐ গোলাপের কুঁড়ি—
নলিনী। ওটা বাবা যখন দোকান থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন, তখন কামনা ক’রেছিলেন, ওর সদ্গতি হয় যেন—
সতীশ। অর্থাৎ—
নলিনী। ঐ অর্থাতের মধ্যে অনেকখানি অর্থ আছে।
সতীশ। আর আমি যে তোমার স্তব করে’ মরি, তার মধ্যে যতটা শব্দ আছে, ততটা অর্থ নেই?
নলিনী। যদি কিছু থাকে, সে কন্যাকর্ত্তাদের অমর লোকের উপযুক্ত নয়।
সতীশ। অতএব আমাকে সদ্য স্বর্গপ্রাপ্তির চেষ্টা ক’র্তে হবে। চ’লেম তবে সেই তপস্যায়।
নন্দীর প্রবেশ
নন্দী। Hallo সতীশ বাবু। ও কি ও! সেই নেক্লেস টা নিয়ে চ’লেচো যে। সে দিন তো এল্বাম নিয়ে সরে’ প’ড়েছিলে, আজ নেক্লেস্?, Bravo! you know how to eat pudding and yet to keep it।
সতীশ। বুঝ্তে পার্চিনে আপনার কথা।
নন্দী। আমরা যা দিই, তা ফিরে নিই নে, তার বদলেও কিছু ফিরে পাই নে। দেবার হাত নেবার হাত দুই হাতই খালি থাকে। You are lucky, বিনা মূলধনে ব্যবসা ক’রে এত enormous profit!
নলিনী। ও কি সতীশ, হাতের আস্তিন গুটচ্চো যে, মারামারি ক’রবে না কি? তা’হ’লে মাঝের থেকে আমার নেক্লেস্টা ভাঙ্বে দেখ্চি। দাও ওটা গলায় পরে’ নিই। (নেকলেস লইয়া গলায় পরা) অমনি নেবোনা, সতীশ, এর দাম দেব। (গোলাপের কুঁডি সতীশের ‘বাটন হোল্’ এ পরাইয়া দেওয়া) নিষ্টাব নন্দী, আপনার ব্রেস্লেট্ আপনি নিয়ে যান।
নন্দী। কেন?
নলিনী। এর দাম আমার কাছে নেই।
নন্দী। বিনা দামেই তো আমি—
নলিনী। আপনার খুব দয়া। কিন্তু আমার তো আত্ম সম্মান আছে। এসো সতীশ, তোমাদের দু’জনের লড়াই দেখ্বার সময় আমার নেই। তার চেয়ে এসো বেড়াতে বেড়াতে গল্প করি, সময়টা কাট্বে ভালো।
চারুবালার প্রবেশ
চারু। মিষ্টার নন্দী, আপনার নৈবেদ্য দেখ্তে পাচ্চি, কিন্তু সামনে দেবতা নেই যে।
নন্দী। কে ব’ল্লে নেই?
চাক। সাকার দেবতার কথা বল্চি, নিরাকারের খবর জানিনে।
নন্দী। পূজা যদি নেন, তা’হ’লে করকমলে—
চারু। আপনি মাঝে মাঝে চোখে ভুল দেখেন না কি? আমি তো—
নন্দী। হাঁ, ভুল ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছই—
চারু। তার পরে redirected হ’য়ে—
নন্দী। ঘুরে আস্তে হয়।
চারু। আজ আপনার কপালে তারি ছাপ দেখ্তে পাচ্চি।
নন্দী। ছাপের সংখ্যা আর বাড়াবেন না, তাহলে কলঙ্কের চিহ্নটাই জাগ্বে, ঠিকানাটাই প’ড়্বে চাপা।
চারু। আপনার মতো আলাপ ক’রতে আমি কাউকে শুনিনি— চমৎকার কথা কইতে পারেন।
নন্দী। শুধু যে কেবল কানে শোনা কথাই আমার সম্বল, তা নয়, হাতে সোনাও জোগাতে পারি, এইটে প্রমাণ ক’রতে দিন।
চারু। আপনি বাংলাতেও pun ক’রতে পারেন—ক্ষমতা আছে। কিন্তু মিষ্টার নন্দী, ও ব্রেস্লেট্ তো নেলির—
নন্দী। সেইটেই তো হ’য়েছিলো মস্ত ভুল। শোধ্রাবাব opportunity যদি না দেন, তা’হ’লে উদ্ধার হবে কি ক’রে?
চারু। ঐ নেলি আস্চে, চলুন আমরা ঐ দিকে যাই।
নেলি ও সতীশের প্রবেশ
নলিনী। যথেষ্ট হ’য়েছে সতীশ, আজ যদি মিষ্টি কথা ব’ল্বার চেষ্টা করো, তা’হ’লে কিন্তু রসভঙ্গ হবে।
সতীশ। আচ্ছা, আমাকে যদি একেবারে চুপ করিয়ে রাখ্তে চাও, তা’হ’লে ঐ গানটা আমাকে শোনাও।
নলিনী। কোন্টা?
সতীশ। সেই যে “উজাড় করে দাও হে আমার সকল সম্বল।”
নেলির গান
উজাড় করে’ লও হে আমার সকল সম্বল।
শুধু ফিরে চাও ফিরে চাও ওহে চঞ্চল।
চৈত্র রাতের বেলায়
না হয় এক প্রহরের খেলায়
আমার স্বপন-স্বরূপিণী প্রাণে দাও পেতে অঞ্চল।
যদি এই ছিলো গো মনে,
যদি পরম দিনের স্মরণ ঘুচাও চরম অযতনে।
তবে ভাঙা খেলার ঘরে
না হয় দাঁড়াও ক্ষণেক তরে,
ধূলায় ধূলায় ছড়াও হেলায় ছিন্ন ফুলের দল।
লাহিড়ি সাহেবের প্রবেশ
লাহিড়ি। নেলি, এই দিকে এসো। শুনে যাও। (জনান্তিকে) সতীশের বাপ মারা গেছেন।
নলিনী। সে কি কথা?
লাহিড়ি। মাদ্রাজে। সে-ও আজ তিন দিন হ’লো। Heartএর weakness থেকে।
নলিনী। সতীশ জানে না?
লাহিড়ি। না মন্মথ বাড়ির লোককে কাছে ডাক্তে মানা ক’রেছিলেন। সেখানে ওঁর বাড়ির ঠিকানাও কেউ জান্তো না। দৈবাৎ পূজোর ছুটিতে এক জন বাঙালী উকীল সেখানে ছিলো, মৃত্যুশয্যায় সেই তাঁর উইল তৈরী ক’রেছে। সে আজ এসে পৌঁছেচে। আমাকে সে জানে—আমার কাছেই প্রথম এসেছিলো, আমি মন্মথর বাড়িতে তাকে এইমাত্র রওনা ক’রে দিলুম। তুমি সতীশকে শীঘ্র সেখানে পাঠিয়ে দাও।
নলিনী। সতীশ, চা প’ড়ে র’য়েচে, খেয়ে নাও।
সতীশ। আমার ইচ্ছে ক’রচে না।
নলিনী। আমার কথা শোনো, শুধু চা নয়, কিছু খাও। এই নাও রুটি।
সতীশ। মনে বেখো নেলি, গরীব বলেই আমার দানের দাম অনেক বেশি।
নলিনী। দেখো, ও কথা আজ থাক। কাল হবে। এখন তুমি খেয়ে নাও।
সতীশ। তাড়া দিচ্চ কেন—আমার তো আপিস নেই।
নলিনী। চুপ চুপ, কথা কোয়ো না, খাও। আরেকটু খাও। এই নাও।
সতীশ। আর পারচিনে—আমাব হ’য়েচে। আমার খাবার রুচি চ’লে গেছে।
নলিনী। আচ্ছা, তা’হ’লে এসো—শোনো। তোমাকে দরজা পর্য্যন্ত পৌঁছিয়ে দিই।
সতীশ। আমার এমন সৌভাগ্য তো আর কখনো—
নলিনী। চুপ চুপ। চ’লে এসো।
লাহিড়ি ও লাহিড়ির জায়ার প্রবেশ
লাহিড়ি জায়া। সতীশের বাপ হঠাৎ মারা গেছে?
মিষ্টার লাহিড়ি। হাঁ।
জায়া। কে যে ব’ল্লে সমস্ত সম্পত্তি অনাথ আশ্রমে দিয়ে গেছে, কেবল সতীশের মা’র জন্য জীবিতকাল পর্য্যন্ত ৭৫ টাকা মাসহারা বরাদ্দ। এখন কি করা যায়!
লাহিড়ি। এত ভাবনা কেন তোমার?
জায়া। বেশ লোক যা হোক্ তুমি। তোমার মেয়ে যে সতীশকে ভালবাসে, সেটা বুঝি তুমি দুই চক্ষু খেয়ে দেখতে পাও না! তোমার নেলি এ দিকে লঙ্কার ধোঁয়া দিয়ে নন্দীকে দেশছাড়া করে দিয়েছে। নন্দী তো ভয়ে ওর কাছেই ঘেঁষতে চায় না। জানো বোধ হয়, চারুর সঙ্গে সে engaged.
লাহিড়ি। সে দিন টেনিস কোর্টেই সেটা বোঝা গিয়েছিলো।
লাহিড়ি জায়া। এখন উপায় কি ক’রবে?
লাহিড়ি। আমি তো মন্মথর টাকার উপর কোনো দিন নির্ভর করি নি!
জায়া। তবে কি ছেলেটির উপর নির্ভর করে’ বসেছিলে? অন্নবস্ত্রটা বুঝি অনাবশ্যক?
লাহিড়ি। সম্পূর্ণ আবশ্যক। সতীশের একটি মেসো আছে বোধ হয় জান।
জায়া। মেসো তো ঢের লোকেরই থাকে, তাতে ক্ষুধা শান্তি হয় না
লাহিড়ি। এই মেসোটি আমার মক্কেল—অগাধ টাকা।— ছেলেপুলে কিছুই নেই—বয়সও নিতান্ত অল্প নয়। সে তো সতীশকেই পোষ্যপুত্র নিতে চায়।
জায়া। মেসোটি তো ভালো। তা চট্পট্ নিক্ না। তুমি একটু তাড়া দাও না।
লাহিড়ি। তাড়া আমাকে দিতে হবে না, তাব ঘরের মধ্যেই তাড়া দেবার লোক আছে। সবই প্রায় ঠিকঠাক এখন কেবল একটা আইনের খট্কা উঠেছে—এক ছেলেকে পোষ্যপুত্র লওয়া যায় কি না—তা ছাড়া সতীশেব আবার বয়স হ’য়ে গেছে।
জায়া। আইন তো তোমাদেরই হাতে— তোমরা চোখ বুজে একটা বিধান দিয়ে দাও না।
লাহিড়ি। ব্যস্ত হয়ো না—পোষ্যপুত্র না নিলেও অন্য উপায় আছে।
জায়া। আমাকে বাঁচালে। আমি ভাব ছিলেম সম্বন্ধ ভাঙি কি ক’রে। আবার আমাদের নেলি যে বকম জেদালো মেয়ে, সে যে কি করে’ ব’সতো বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে’ গবীবের হাতে তো মেয়ে দেওয়া যায় না। ঐ দেখ, তোমাব মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে।
লাহিড়ি। কিন্তু নেলি যে সতীশকে ভালবাসে, সে তো দেখে মনে হয় না। ও তো সতীশকে নাকের জলে চোখের জলে করে। এক সময়ে আমি ভাব তুম, নন্দীর ওপরেই ওর বেশি টান।
জা। তোমার মেয়েটির ঐ স্বভাব—সে যাকে ভালবাসে, তাকেই জ্বালাতন করে। দেখ না বিড়ালছানাটাকে নিযে কি কাণ্ডটাই করে! কিন্তু আশ্চর্য্য এই, তবু তো ওকে কেউ ছাড়্তে চায় না।
নলিনীর প্রবেশ
নলিনী। মা, একবাব সতীশবাবুর বাড়ি যাবে না? তাঁর মা বোধ হয় খুব কাতর হ’য়ে প’ড়েছেন। বাবা, আমি একবার তাঁর কাছে যেতে চাই।