শোধ-বোধ/প্রথম অঙ্ক/দ্বিতীয় দৃশ্য
দ্বিতীয় দৃশ্য
বিধুমুখী ও সতীশ
সতীশ। মা, কোনোমতে টাকাটা পেয়েছি, নেকলেসও নেলির ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাবার সেকালের আমলের সোনার গুড়গুডিটা সিন্দূকেপটির মতি পালের ওখানে যে বাঁধা রেখে এলুম, নিশ্চিন্ত হ’তে পারচিনে।
বিধুমুখী। তোর কোন ভয় নেই, সতীশ। তিনি এ সব জিনিষের পরে কোনো মমতাই রাখেন না। কেবল ওঁব ঠাকুরদাদার জিনিষ বলেই আজ পর্য্যন্ত লোহার সিন্দুকে ছিলো। এক দিনের জন্যে খবরও রাখেন নি। সেটা আছে কী গেছে, সে তাঁর মনেও নেই।
সতীশ। সে আমি জানি। কিন্তু ভারী ভয় হচ্ছে, যারা বন্ধক বেখেছে, তারা হয়তো বাবাকে চিঠি লিখে খোঁজ ক’রবে। তুমি কোনো মতে তোমার গহনাপত্র দিয়ে সেটা খালাস করে’ দাও।
বিধুমুখী। হায়রে কপাল, গহনাপত্র কিছু কী বাকি আছে। সে কথা আর জিজ্ঞাসা করিস্নে। যাই হোক, আমি ভয় করিনে—প্রজাপতি আশীর্ব্বাদে নলিনীর সঙ্গে আগে তোর কোনোমতে বিয়ে হয়ে যাক, তার পরে তোর বাবা যা বলেন, যা করেন, সব সহ্য ক’রতে হবে। কথাবার্ত্তা কিছু এগিয়েচে?
সতীশ। সর্ব্বদা যে রকম লোক ঘিরে থাকে, কথা কবো কখন? জানো তো সেই নন্দী—সে যেন বিলিতি কাঁটা গাছের বেড়া। তার বুলিগুলো সর্ব্বাঙ্গে বিঁধতে থাকে। সেই দৈত্যটার হাত থেকে বাজকন্যা উদ্ধাব করি কী উপায়ে?
বিধুমুখী। আমি মেয়েমানুষ, মেয়ের মন বুঝতে পারি—মনে মনে সে তোকে ভালোবাসে।
সতীশ। সে আমি জানিনে। কিন্তু বরুণ নন্দীব সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রাণ বেরিয়ে গেল। বাবা একটু দয়া ক’রলেই কোনো ভাবনা ছিলো না। কিন্তু—
বিধুমুখী। তোর কী চাই বল না।
সতীশ। ভালো বিলিতি সুট। চাঁদনীর কাপড় প’র্লেই ভরসা কমে যায়, নন্দীর মতো করে’ সজোরে নলিনীর সঙ্গে কথাই কইতে পারিনে। বাড়িসুদ্ধ সব্বাই আমার দিকে এমন ক’রে তাকায় যেন আমার গায়ে কাপডই নেই, আছে নর্দ্দমার পাঁক।
বিধুমুখী। আমি তোর কাপড়ের দুর্দ্দশা তোর মাসীকে আভাসে জানিয়ে রেখেছি। আজ এখনই তাঁর আসবার কথা। আজই হয় তো একটা কিনারা হ’য়ে যাবে।
সতীশ। ঐ যে মেসোমশায়কে নিয়েই তিনি আস্চেন না, যেমন করে’ পাবো আজই যেন—কিন্তু মা, সেই গুড়গুড়ি—বাবা যদি জান্তে পারেন, মেরে ফেল্বেন।
বিধুমুখী। আমি বলি কি— কোনো ছুতোয় সেই নেকলেস্টা যদি নলিনীর কাছ থেকে—
সতীশ। সে কথাও ভেবেছি। তা হ’লেই আমার লজ্জা পূরো হয়। এক একবার মনে করি, সংসারে যত মুস্কিল, সব আমারই! বরুণ নন্দীর বাপ কি কোনো কালে ছিলো না? যে রকম দেখ্চি, একটা কোনো গল্প বলে’ নেকলেস্টা ফিবিয়ে আন্তে হবে, তার পরে আমার নিজের গলায় পর্বার জন্যে গয়না মিল্বে!
বিধুমুখী। সে আবার কী?
সতীশ। এক গাছা দড়ি।
বিধুমুখী। দেখ্, আমাকে আর রোজ রোজ কাঁদাস নে। আমার রক্ত শুকিয়ে গেল, চোখের জলও বাকি নেই। একদিকে তোর বাবা, আব একদিকে তুই—উপরে সবার চাপ আর নীচে আগুন, আমি যে গুমে গুমে—
সতীশের মাসি সুকুমারী ও মেসোমশায় শশধর বাবুর প্রবেশ
এসো দিদি, ব’সো। আজ কোন্ পুণ্যে রায়মশায়ের দেখা পাওয়া গেলো। দিদি না আস্লে তোমার আর দেখা পাবার যো নেই।
শশধর। এতেই বুঝবে তোমাব দিদির শাসন কি কড়া। দিন-রাত্রি চোখে চোখে রাখেন!
সুকুমারী। তাই বটে, এমন রত্ন ঘরে রেখেও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমনো যায় না।
বিধুমুখী। নাক ডাকার শব্দে।
সুকুমারী। সতীশ, ছি ছি, তুই এ কি কাপড় প’রেছিস? তুই কি এই রকম ধুতি পরে’ কলেজে যাস্ না কি? বিধু, ওকে যে লাউঞ্জ সুট্টা কিনে দিয়েছিলাম, সে কি হ’লো?
বিধুমুখী। সে ও কোন্কালে ছিঁড়ে ফেলেছে!
সুকুমারী। তা তো ছিঁড়্বেই। ছেলেমানুষের গায়ে কাপড় কত দিন টেকে! তা তাই বলে’ কি আর নূতন সুট্ তৈরি করাতে নেই! তোদের ঘরে সকলি অনাসৃষ্টি!
বিধুমুখী। জানই তো দিদি, তিনি ছেলের গায়ে সভ্য কাপড় দেখ্লেই আগুন হ’য়ে ওঠেন। আমি যদি না থাক্তেম তো তিনি বোধ হয় ছেলেকে দোলাই গায়ে দিয়ে কোমরে ঘুন্সি পরিয়ে ইস্কুলে পাঠাতেন—মা গো! এমন সৃষ্টিছাড়া পছন্দও কারো দেখিনি।
সুকুমারী। মিছে না! এক বই ছেলে নয়, একটু সাজাতে গোজাতেও ইচ্ছা করে না। এমন বাপও তো দেখিনি। সতীশ আমি তোর জন্য একট কাপড় ব্যাম্জের ওখানে অর্ডার দিয়ে রেখেছি। আহা, ছেলেমানুষেব কি সখ হয় না?
সতীশ। এক সুটে আমার কি হবে, মাসিমা। লাহিড়ি সাহেবের ছেলে আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ে— সে আমাকে তাদেব বাড়ীতে টেনিস খেলায় নিমন্ত্রণ ক’রেছে, আমি নানা ছুতো করে’ কাটিয়ে দিই। আমার তো কাপড় নেই।
শশধর। তেমন জাযগায় নিমন্ত্রণে না যাওয়াই ভালো, সতীশ।
সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা, তোমার আর বক্তৃতা দিতে হবে না। ওর তোমার মতন বয়স যখন হবে, তখন—
শশধর। তখন ওকে বক্তৃতা দেবার অন্য লোক হবে, বৃদ্ধ মেসোর পরামর্শ শোন্বার অবসর হবে না।
সুকুমারী। আচ্ছা, মশায়, বক্তৃতা কর্বার অন্য লোক যদি তোমাদেব ভাগ্যে না জুটত, তবে তোমাদেব কি দশা হ’ত ব’লো দেখি।
শশধর। সে কথা বলে’ লাভ কি। সে অবস্থা চোখ বুঝে কল্পনা করাই ভালো!
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য। কর্ত্তাবাবু লোহার সিন্দুকের চাবি চেয়েছেন।
সতীশ। (কানে কানে) সর্ব্বনাশ, মা, সর্ব্বনাশ। গুড়গুড়ির খোঁজ প’ড়েচে।
বিধু। একটু চুপ কর তুই। কেন বে, চাবি কেন?
ভৃত্য। কাল কোথায় যাবেন, চেক বইটা চান।
বিধু। আচ্ছা, একটু সবুর ক’রতে বল, চাবি নিয়ে এখনি যাচ্ছি।
সতীশ। মা, লোহার সিন্দুক খুললেই তো—
বিধু। একটু থাম। আমাকে একটু ভাবতে দে।
সতীশ। (নেপথ্যের দিকে চাহিয়া) না, না, এখানে আসতে হবে না, আমি যাচ্ছি।
সুকুমারী। সতীশ ব্যস্ত হ’য়ে পালাল কেন, বিধু?
বিধুমুখী। থালায় করে’ তার জলখাবার আন ছিলো কি না, ছেলের তাই তোমাদের সামনে লজ্জা।
সুকুমারী। আহা, বেচারার লজ্জা হ’তে পারে। ও সতীশ, শোন শোন।
সতীশের প্রবেশ
তোর মেশো মশায় তোকে পেলেটির বাড়ী থেকে আইস্ক্রিম্ খাইয়ে আন্বেন, তুই ওঁর সঙ্গে যা। ওগো, যাও না—ছেলেমানুষকে একটু—
সতীশ। মাসিমা, সেখানে কী কাপড় পরে’ যাবো?
বিধুমুখী। কেন, তোর তো চাপ্কান আছে।
সতীশ। চাপকান তো পেলেটির খানসামাদেরও আছে। বেমালুম দলে মিশে যাব।
সুকুমারী। আর যাই হোক বিধু, তোব ছেলে ভাগ্যে পৈতৃক পছন্দটা পায় নি, তাই রক্ষা। বাস্তবিক, চাপকান দেখ্লেই খান্সামা কিম্বা যাত্রাদলের ছেলে মনে পড়ে। এমন অসভ্য কাপড় আব নেই।
শশধর। এ কথাগুলো—
সুকুমারী। চুপি চুপি ব’লতে হবে? কেন ভয় ক’রতে হবে কা’কে? মন্মথ নিজের পছন্দ মতো ছেলেকে সাজ কবাবেন আর আমবা কথা কইতেও পাবো না?
শশধর। সর্ব্বনাশ! কথা বন্ধ ক’রতে আমি বলি নে। কিন্তু সতীশের সামনে এ সমস্ত আলোচনা—
সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা বেশ! তুমি ওকে পেলেটির ওখানে নিয়ে যাও।
সতীশ। (জনান্তিকে) মা, লোহাব সিন্দুকের চাবি বাবাকে কিছুতেই দিয়ো না—বরঞ্চ আমার সেই ঘডির কথাটা তুলে ওঁর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে ভুলিয়ে রেখো।
সুকুমারী। এই যে মন্মথ আসচেন। এখনি সতীশকে নিয়ে বকাবকি করে’ অস্থির করে’ তুলবেন। আয় সতীশ, তুই আমার সঙ্গে আয়—আমরা পালাই।
মন্মথের প্রবেশ
বিধু। সতীশ ঘড়ি ঘড়ি করে’ ক’দিন আমাকে অস্থিব করে’ তুলেছিলো। দিদি তাকে একটা রূপোর ঘড়ি দিয়েছেন। আগে থাক্তে বলে’ রাখ্লেম, তুমি আবার শুন্লে রাগ ক’র্বে।
মন্মথ। আগে থাকতে বলে’ রাখ্লেও রাগ ক’রবো।—শোনো, লোহার সিন্দুকের চাবিটা—
বিধু। তুমি একলা বসে’ বসে’ রাগ করো আমি চ’ললুম, আমি আর সইতে পারচি নে।
মন্মথ। শশধর, সে ঘড়িটা তোমায় ফিরে নিয়ে যেতে হবে।
শশধর। তুমি যে লোহার সিন্দুক খুলতে যাচ্ছিলে, যাও না।
মন্মথ। সে পরে হবে, কিন্তু ঘড়িটা এখনি তুমি নিয়ে যাও!
শশধর। তুমি তো আচ্ছা লোক। ঘড়ি তো নিয়ে গেলুম; তার পর থেকে আমার সময়টা কাট্বে কি রকম? ঘরের লোকের কাছে জবাবদিহী ক’র্তে গিয়ে আমাকে যে ঘরছাড়া হ’তে হবে।
মন্মথ। না শশধর, ঠাট্টা নয়, আমি এ সব ভালবাসি নে!
শশধর। ভালবাস না, কিন্তু সহ্যও ক’র্তে হয়। সংসারের এই নিয়ম।
মন্মথ। নিজের সম্বন্ধে হলে নিঃশব্দে সহ্য ক’র্তেম। ছেলেকে মাটি ক’র্তে পারি না।
শশধর। সে তো ভালো কথা। কিন্তু স্ত্রীলোকের ইচ্ছার একেবারে খাড়া উল্টোমুখে চ’ল্তে গেলে বিপদে প’ড়্বে।—তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে ঘুরে গেলে ফল পাওয়া যায়! বাতাস যখন উল্টো বয়, জাহাজের পাল তখন আড় করে’ রাখ্তে হয়, নইলে চলা অসম্ভব।
মন্মথ। তাই বুঝি তুমি গৃহিণীর সকল কথাতেই সায় দিয়ে যাও! ভীরু!
শশধর। তোমাব মতো অসমসাহস আমার নেই। যাঁর ঘরকন্নার অধীনে চব্বিশ ঘণ্টা বাস ক’র্তে হয়, তাঁকে ভয় না ক’র্বো তো কা’কে করবো? নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে’ লাভ কি? আঘাত ক’রলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট। তার চেয়ে তর্কের বেলা গৃহিণী যুক্তিকে অকাট্য বলে’ কাজের বেলায় নিজের যুক্তিতে চলাই সৎপরামর্শ— গোয়ার্ত্তামি ক’রতে গেলেই মুস্কিল বাধে। আমি চ’ললেম, যা ভালো বোঝো কর।
বিধুর প্রবেশ
মন্মথ। তোমার ছেলেটিকে যে বিলাতি পোষাক পরাতে আরম্ভ ক’রেছো, সে আমার পছন্দ নয়।
বিধু। পছন্দ বুঝি একা তোমাবই আছে। আজকাল তো সকলেই ছেলেদের ইংরেজি কাপড় ধরিয়েছে।
মন্মথ। (হাসিয়া) সকলের মতেই যদি চ’ল্বে, তবে সকলকে ছেড়ে একটিমাত্র আমাকেই বিয়ে ক’র্লে কেন?
বিধু। তুমি যদি একমাত্র নিজের মতেই চ’ল্বে, তবে একা না থেকে আমাকেই বা তোমাব বিয়ে ক’র্বার কি দরকার ছিলো?
মন্মথ। নিজেব মত চালাবার জন্যও যে অন্য লোকের দরকার হয়।
বিধু। নিজের বোঝা বহাবার জন্য ধোবার দরকার হয় গাধাকে— কিন্তু আমি তো আর—
মন্মথ। (জিব কাটিয়া) আরে রাম রাম, তুমি আমার সংসারমরু-ভূমিব আরব ঘোড়া। কিন্তু সে প্রাণিবৃত্তান্তের তর্ক এখন থাক। তোমার ছেলেটিকে সাহেব করে’ তুলো না!
বিধু। কেন ক’রবো না? তাকে কি চাষা ক’রবো?
মন্মথ। লোহার সিন্দুকের চাবিটা—
বিধবা জায়ের প্রবেশ
জা। ভাই, তোমরা এখানে ভালো হ’য়ে ব’সেই কথা কওনা! দাঁডিয়ে কেন? আমি পাশের ঘরে আছি ব’লে বুঝি আলাপ জম্ছে না? ভয় নেই ভাই, আমি নীচের ঘরে যাচ্চি।
সতীশের প্রবেশ ও বাপকে দেখিয়াই পলায়ন
মন্মথ। ও কি ও, তোমার ছেলেটাকে কি মাখিয়েছো?
বিধু। মূচ্ছা যেয়ো না, ভয়ানক কিছু নয়, একটুখানি এসেন্স মাত্র। তাও বিলাতি নয়—তোমাদের সাধের দিশি।
মন্মথ। আমি তোমাকে বারবার ব’লেছি, ছেলেদের তুমি এ সমস্ত সৌখীন জিনিস অভ্যাস করাতে পারবে না।
বিধু। আচ্ছা, যদি তোমার আরাম বোধ হয তো কাল থেকে মাথায় কেরোসিন মাখাবো, আর গায়ে কাষ্টর অয়েল্।
মন্মথ। সে ও বাজে খরচ হবে। কেরোসিন কাষ্টর অয়েল্ গায় মাথায় মাখা আমার মতে অনাবশ্যক।
বিধু। তোমাব মতে আবশ্যক জিনিষ কটা আছে, তা তো জানি না, গোড়াতেই আমাকে বোধ হয় বাদ দিয়ে ব’স্তে হয়।
মন্মথ। তোমাকে বাদ দিলে যে বাদ-প্রতিবাদ একেবারেই বন্ধ হবে। এত কালের দৈনিক অভ্যাস হঠাৎ ছাড়লে এ বয়সে হয় তো সহ্য হবে না! যাই হোক্, এ-কথা আমি তোমাকে আগে থাক্তে ব’লে রাখ্ছি, ছেলেটিকে তুমি সাহেব করো বা নবাব করো, তার খরচ আমি জোগাবো না। আমার মৃত্যুর পরে সে যা পাবে, তাতে তার সখের খরচ চ’ল্বে না।
বিধু। সে আমি জানি। তোমার টাকার উপরে ভরসা রাখলে ছেলেকে কপ্নি পরানো অভ্যাস করাতেম।
মন্মথ। আমিও তা জানি! তোমাবি ভগিনীপতি শশধরের পরেই তোমার ভরসা। তার সন্তান নেই বলে’ ঠিক করে’ বসে’ আছ, তোমার ছেলেকেই সে উইলে সমস্ত লিখে পড়ে, দিয়ে যাবে। সেই জন্যই যখন তখন ছেলেটাকে ফিরিঙ্গি সাজিয়ে এক গা গন্ধ মাখিয়ে তার মেসোর আদর কাড়্বার জন্য পাঠিয়ে দাও। আমি দারিদ্র্যের লজ্জা অনায়াসেই সহ্য ক’র্তে পারি, কিন্তু ধনী কুটুম্বের সোহাগ যাচনার লজ্জা আমার সহ্য হয় না।
বিধু। ছেলেকে মাসির কাছে পাঠালেও গায়ে সয় না, এত বড়ো মানী লোকের ঘরে আছি, সে তো পূর্ব্বে বুঝতে পারি নি।
বিধবা জার ঘরে প্রবেশ
জা। ভাব্লুম, এতক্ষণে কথা ফুরিয়ে গেছে, এইবাব ঘরে এসে পানগুলো সেজে রাখি। কিন্তু এখনো ফুরোলো না। মেজবৌ, তোদের ধন্য! আজ সে তোর ন’ বছর বয়স থেকে শুরু হ’য়েচে, তবু তোদের কথা যে আর ফুরোলো না! রাত্রে কুলোয় না, শেষকালে দিনেও দুইজনে মিলে ফিস্ ফিস্। তোদের জিবের আগায় বিধাতা এত মধু দিন-রাত্রি জোগান্ কোথা থেকে, আমি তাই ভাবি। রাগ কোরো না ঠাকুরপো, তোমাদের মধুরালাপে ব্যাঘাত ক’র্বো না।
বিধু। না দিদি, আমাদের মধুরালাপ লোকালয় থেকে অনেক দূরে গিয়েই ক’র্তে হবে, নইলে সবাই দেবে। ওগো, এসো—ছাতে এসো, গোটাকতক কথা বলে’ বাখি। তুমি আবার নাকি হঠাৎ কাল লঙ্কাদ্বীপে যাচ্চ—এখানকার হাওয়া তোমাব সহ্য হচ্ছে না।
সতীশের প্রবেশ
সতীশ। জেঠাইমা!
জেঠাইমা। কি বাপ।
সতীশ। বাবা কাল ভোরে জাহাজে করে’ কলম্বো যাবেন, তাই কালই লাহিড়ি সাহেবের ছেলেকে মা চা খাওয়াতে ডেকেছেন, তুমি যেন সেখানে হঠাৎ গিয়ে পোড়ো না।
জেঠাইমা। আমার যাবার দরকার কি, সতীশ!
সতীশ। যদি যাও তো তোমার এ কাপড়ে চ’ল্বে না, তোমাকে—
জেঠাইমা। সতীশ, তোর কোনো ভয় নেই, আমি এই ঘরেই থাক্বো, যতক্ষণ তোর বন্ধুর চা খাওয়া না হয়, আমি বা’র হবো না।
সতীশ। জেঠাইমা, আমি মনে ক’র্ছি, তোমার ওই সামনের ঘরটাতেই তাকে চা খাওয়াবার বন্দোবস্ত ক’র্বো। এ বাড়িতে আমাদের যে ঠাসাঠাসি লোক—চা খাবার, ডিনার খাবার মতো ঘর একটাও খালি পাবার জো নেই। মা’র শোবার ঘরে সিন্দুক্ ফিন্দুক্ কত কি র’য়েচে, সেখানে কাকেও নিয়ে যেতে লজ্জা করে।
জেঠাইমা। আমারও ঘরে তো জিনিষপত্র—
সতীশ। ওগুলো বা’র করে’ দিতে হবে। বিশেষত তোমাব ঐ বঁটি চুপ্ড়ি বারকোশগুলো কোথাও না লুকিয়ে রাখ লে চ’ল্বে না।
জেঠাইমা। কেন বাবা, ওগুলোতে এত লজ্জা কিসের? তাদের বাড়িতে কি কুট্নো কুট্বার নিয়ম নেই?
সতীশ। তা জানিনে জেঠাইমা, কিন্তু চা খাবার ঘরে ওগুলো রাখা দস্তুর নয়। এ দেখ্লে নরেন লাহিড়ি নিশ্চয় হাসবে, বাড়ি গিয়ে তার বোন্দের কাছে গল্প ক’র্বে।
জেঠাইমা। শোনো একবাব ছেলের কথা শোনো। বঁটি চুপড়ি তো চিরকাল ঘরেই থাকে। তা নিয়ে ভাই বোনে মিলে গল্প ক’রতে তো শুনি নি।
সতীশ। তোমাকে আর এক কাজ ক’রতে হবে, জেঠাইমা—আমাদের নন্দকে তুমি যেমন করে’ পার এখানে ঠেকিয়ে রেখো। আমার কথা শুন্বে না, খালি গায়ে ফস করে’ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে।
জেঠাইমা। তাকে যেন ঠেকালেম, কিন্তু তোমাব বাবা যখন খালি গায়ে—
সতীশ। তিনি তো কাল কলম্বোয় যাবেন।
জেঠাইমা। বাবা সতীশ, যা মন হয় করিস, কিন্তু আমার ঘরটাতে তোদের ওই খানাটানাগুলো—
সতীশ। সে ভালো করে’ সাফ করিয়ে দেবো এখন।
জেঠাইমার প্রস্থান ও বিধুর প্রবেশ
বিধু। পারলুম না, জানো তো সতীশ, তিনি যা ধরেন, তা কিছুতেই ছাড়েন না। কত টাকা হ’লে তোমার মনের মত পোষাক হয় শুনি।
সতীশ। একটা মর্ণিং সুট তো মাসি অর্ডার দিয়েছেন, আর একটা লাউঞ্জ সুটে একশো টাকার কাছাকাছি লাগবে। একটা চলনসই ইভনিং ড্রেস দেডশো টাকার কমে কিছুতেই হবে না।
বিধু। বলো কি সতীশ। এ তো আড়াইশো টাকার ধাক্কা, এত টাকা—
সতীশ। মা, ঐ তোমাদের দোষ। এক ফকিরি ক’র্তে চাও, সে ভালো, আর যদি ভদ্র সমাজে মিশতে হয় তো খবচ ক’র্তে হবে। সুন্দরবনে পাঠিয়ে দাও না কেন, সেখানে বনের বাঁদররা ড্রেস কোট পরে না।— কিন্তু মা, সেই গুড়গুড়ি। একটা প্ল্যান ভেবেছি, তুমি বাবাকে বলো যে, কাল রাত্রে তোমার লোহার সিন্দুকের চাবি চুরি গেছে।
বিধু। দেখ সতীশ, এ দিকে তোর বাবার বিষয়বুদ্ধি একটুও নেই— কিন্তু ওঁকে ফাঁকি দেওয়া শক্ত। ধরা পড়ে’ যাবি।
সতীশ। ধরা তো এক সময়ে প’ড়্বোই। আপাতত কোনো রকম করে’—তা ছাড়া কাল তো উনি কলম্বোয় যাচ্চেন, ইতিমধ্যে যা হয় একটা উপায় করা যাবে। যথেষ্ট সময় পেলে নেকলেসটা চাই কি ফিরিয়েও নিতে পারি। অনেক ভেবে দেখলুম শেষকালে—ঐ যে বাবা আস্চেন। মা, এখনি, আর দেরি কোরো না।
শশধর ও মন্মথের প্রবেশ
বিধু। ওগো শুন্চো, সর্ব্বনাশ হ’য়েচে। কাল রাত্রে লোহার সিন্দুকের চাবি চুরি গেছে।
শশধর। সে কি কথা বউ। কোথায় চাবি রেখেছিলে, কে ক’র্লে এমন কাজ?
বিধু। তাই তো ভাব্ছি, হয় তো নতুন বেহারাটা—
শশধর। মন্মথ, তুমি যে একেবাবে অবিচলিত? একবার খোঁজ করে’ দেখো।
মন্মথ। কোনো লাভ নেই।
শশধর। কি গেল না গেল, সেটা তো একবার দেখাও চাই।
মন্মথ। কিছু নিশ্চ্য গেছে, শুধু চাবি নিয়ে ঝম্ঝমিয়ে বেড়াবে, চোরের এমন সখ প্রায় থাকে না।
শশধর। কিন্তু কে চোর, সেটা তো বের করা চাই।
মন্মথ। সাধুব চেয়ে যার দরকার অনেক বেশি, সেই হয় চোর।
শশধর। আমি কি তোমার কাছে চোরের definition চাচ্চি? ব’ল্চি সন্ধান করা চাই তো?
মন্মথ। (উত্তেজনার সহিত) না, চাইনে, না, চাইনে। ভিতরে যে আছে, তাকে বাইরে সন্ধান ক’র্তে যাওয়া বিড়ম্বনা।
শশধব। কি ব’লচো মন্মথ। চলো না একবার দেখেই আসা যাক।
মন্মথ। নিষ্ফল, নিষ্ফল, আমার দেখা শেষ হ’য়ে গেছে।
শশধর। অন্তত কালকে কলম্বো যাওয়াটা স্থগিত বাখো, একটা পুলিস তদন্ত করাও।
মন্মথ। কলম্বোর চেয়ে আরও অনেক দূরে যাওয়া দরকার— সাউথ পোলে, সেখানে থাকে পেঙ্গুয়িন পাখী, সেখানে থাকে সিন্ধুঘোটক, সেখানে চাবিও চুরি যায় না, আর পুলিশ তদন্তর ঠাট্ বসাতে হয় না।
শশধর। বউ যে একেবাবে চুপ, মুখ হ’য়ে গেছে সাদা। চলো বরঞ্চ তোমাতে আমাতে একবার—
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য। সাহেববাড়ি থেকে এই কাপড় এসেছে।
মন্মথ। নিয়ে যা, কাপড় নিয়ে যা, এখনি নিয়ে যা।
শশধর। আহা, আহা, ক’রচো কি মন্মথ। কাপড় ফিরিয়ে দিয়ে আমাকেই—
মন্মথ। ঐ কাপড়গুলোতেই আছে চাবিচুবিব ব্যাকটীরিয়া—টাকা চুরির বীজ—এই আমি তোমাকে বলে’ গেলুম। (প্রস্থান। বিধুমুখীর মেজের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া কান্না)
শশধর। বউ, ছি, ছি, এমন করে’ কাঁদতে নেই। ওঠো ওঠো।
বিধু। রায় মশায়, আমার বেঁচে সুখ নেই।
শশধর। কিছুই বুঝতে পারচি নে। মন্মথ কাকে সন্দেহ ক’রচে। সতীশকে না কি?
বিধু। নিজের ছেলেকে যদি সন্দেহ না ক’রবে, তবে বাপ কিসের? যদি মা হতো, ছেলেকে গর্ভে ধাবণ ক’রতো, তা’ হ’লে বুঝ্তো ছেলে ব’লতে কী বুঝায়। গেছে তো গেছে না হয় সোনার গুড়গুড়িটাই গেছে, আমার সতীশ কি ওঁর সোনার গুড়গুড়ির চেয়ে কম দামের?
শশধর। সোনার গুড় গুড়ির কথা কি ব’লচো? সিন্দুক থেকে কী গেছে, দেখেচো না কি?
বিধু। হাঁ, তা—না দেখিনি। আমি বলচি ওঁব সিন্দুকে সেই গুড়গুড়ি ছাড়া আর তো দামী জিনিষ নেই,—তা সেটা যদি চুরি হ’য়েই থাকে, তাই ব’লেই কি ছেলেকে সন্দেহ?
শশধর। তোমার সন্দেহটা কাকে বউ?
বিধু। কেন? ওঁর তো সেই বড় ভালবাসার উড়ে বেয়ারা আছে বনমালী। তার হাতেই তো ওঁর সব। সে হ’লো ভারী সাধু, ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির। একটু ইসারাতেও বলো দেখি পুলিস দিয়ে তার বাক্সো তল্লাস ক’র্তে, হাঁ হাঁ করে’ মার্তে আস্বেন—সে তো ওঁর ছেলে নয়। ও বেয়ারা, তাই তার পরে এত ভালবাসা।
শশধর। কিছু মনে কোরো না বউ, আমি যাচ্চি, ওকে বুঝিয়ে ব’ল্চি।
সতীশের দ্রুত প্রবেশ
সতীশ। মা, ভয়ানক বিপদ।
বিধু। আবার কি হ’লো? বুকের ধড়ধড়ানি এক মূহুর্ত্তও থাম্তে দিলো না।
সতীশ। সেই যে মতি পাল, যার কাছে টাকা ধার নিয়েছিলুম, সে বাবার কাছে চিঠি দিয়ে লোক পাঠিয়েছে দেখলুম—এতক্ষণে বোধ হয়—
বিধু। সর্ব্বনাশ। যা তুই রায় মশায়কে শীগ্গির আমার কাছে পাঠিয়ে দে, এখনো তিনি যান নি।
মন্মথর প্রবেশ
মন্মথ। এই দেখ চিঠি। পড়ে’ দেখ।
বিধু। না, আমি প’ড়্তে চাইনে।
মন্মথ। প’ড়্তেই হবে।
বিধু। (চিঠি পড়িয়া) তা কি হ’য়েছে?
মন্মথ। বেশি কিছু না, চুরি হ’য়েছে, আমার গুড়গুড়ি চুরি।
বিধু। নিজের ছেলে নিয়েছে, তাকে বলো চুবি? ব’ল্তে তোমাব জিব্ টাক্রায় আট্কে গেলো না?
মন্মথ। যে কথা ব’ল্তে জিব আট্কে যাওয়া উচিত ছিলো, সে কথা তুমিই ব’লেচো।
বিধু। কি ব’লেচি?
মন্মথ। সেই চাবি চুরির মিথ্যে গল্প।
বিধু। বেশ ক’রেচি। নিজের ছেলের জন্য ব’লেচি, তার বাপের হাত থেকে তার প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ব’লেচি।
মন্মথ। প্রাণ বাঁচালেই কি বাঁচানো হ’লো?
বিধু। অনেক হ’য়েচে; আর ধর্ম্ম উপদেশ শুন্তে চাইনে। এখন ছেলের উপর কোন জল্লাদী ক’রতে চাও, খোলসা করে’ বলো।
মন্মথ। পুলিসে খবর দেবো।
বিধু। দাও না। চাবি আমার হাতে ছিলো, আমিই তো চুবি করে’ ওকে দিয়েচি। যাক্ আমাকে নিয়ে জেলে, সেখানে আমি সুখে থাক্বো। অনেক সুখে, এর চেয়ে অনেক সুখে; মনে হবে স্বর্গে গেচি।
মন্মথ। দরকার নেই; তোমাদের কোথাও যেতে হবে না, অনেক সুখে, এর চেয়ে অনেক সুখে; মনে হবে স্বর্গে গেচি।
মন্মথ। দরকার নেই; তোমাদের কোথাও যেতে হবে না, অনেক দিন আগেই যার যাওয়া উচিত ছিলো, সেই একলা যাবে।
শশধরের প্রবেশ
শশধর। আমাকে এ বাড়িতে দেখলে মন্মথ ভয় পায়। ভাবে কালো কোর্ত্তা ফর্মাস দেবার জন্য ফিতা হাতে তার ছেলের গায়ের মাপ নিতে এসেছি। ওর আবার বুকের ব্যামো, ভয় হয়, পাছে আমাদেব কথায় উত্তেজিত হ’য়ে ওর বিপদ ঘটে। যা হোক, এ ব্যাপারটা কি হ’লো? তুমি ব’ললে চাবি চুরি, যে রকমটা দেখা যাচ্চে, তাতে কথাটা—
বিধু। সবই তো শুনেছো। ব’লতে গেলে সতীশেরই জিনিষ, ওরই আপন প্রপিতামহের। আজ বাদে কাল ওরই হাতে আসতো, সেইটে নিয়েচে ব’লেই—
শশধর। তা যা বলো বউ, কাজটা ভালো হয়নি, ওটা চুরিই বটে।
বিধু। তাই যদি হয়, তবে প্রপিতামহের দান সতীশকে নিতে না দিয়ে উনি সেটা তালাবন্ধ করে’ রেখেচেন, সে ও কি চুরি নয়? এ গুড়গুড়ি কি ওঁর আপন উপার্জ্জনের টাকায়?
সতীশের প্রবেশ
শশধর। কি সতীশ, খরচপত্র বিবেচনা করে’ করো না, এখন কি মুস্কিলে প’ড়েছো দেখ দেখি।
সতীশ। মুস্কিল তো কিছুই দেখি নে।
শশধর। তবে হাতে কিছু আছে বুঝি। ফাঁস করো নি।
সতীশ। কিছু তো আছেই।
শশধর। কত?
সতীশ। আফিম কেনবার মতো।
বিধু। (কাঁদিয়া উঠিয়া) সতীশ, ও কি কথা তুই বলিস্, আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি, আমাকে আর দগ্ধাস্নে।
শশধর। ছি ছি, সতীশ। এমন কথা যদি বা কখনো মনেও আসে, তবু কি মা’র সামনে উচ্চারণ করা যায়? বড়ো অন্যায় কথা।
সতীশ। (জনান্তিকে) মা, তোমাকেও বলে’ রাখি, আমি যেমন করে’ পারি, সেই নেকলেসটা ফিরিয়ে এনে বাবাব গুড়গুড়ি উদ্ধার করে’ তাঁর হাতে দিয়ে তবে এ বাড়ি থেকে ছুটি নেবো। বাবার সম্পত্তি যে আমার নয়, এ কথাটা খুব স্পষ্ট করে’ বুঝতে পেবেছি। আর যাই হোক, আমার প্রাণটা তো আমার, এটা তো বাবার লোহার সিন্দুকে বাঁধা পড়েনি, এটা তো রাখ্তেও পাবি, ফেল্তেও পারি।
সুকুমারীর প্রবেশ
বিধু। দিদি, সতীশকে রক্ষা করো। ও কোন্ দিন কি করে’ বসে। আমি তো ভয়ে বাঁচি নে। ও যা বলে, শুনে আমার গা কাঁপে।
সুকুমারী। কি সর্ব্বনাশ! সতীশ, আমার গা ছুঁয়ে বল্, এমন সব কথা মনেও আন্বি নে। চুপ করে’ রইলি যে। লক্ষ্মী বাপ আমার। তোর মা মাসির কথা মনে করিস।
সতীশ। জেলে বসে মনে করার চেয়ে এ সমস্ত হাস্যকব ব্যাপার জেলেব বাইরে চুকিয়ে ফেলাই ভালো।
সুকুমারী। আমরা থাকতে তোকে জেলে কে নিয়ে যাবে?
সতীশ। পেয়াদা।
সুকুমারী। আচ্ছা, সে দেখবো কত বড়ো পেয়াদা, ওগো, এই টাকাটা ফেলে দাও না, ছেলেমানুষকে কেন কষ্ট দেওয়া!
শশধর। টাকা ফেলে দিতে পারি, কিন্তু মন্মথ আমাব মাথায় ইঁট ফেলে না মারে!
সতীশ। মেসোমশায়, সে ইঁট তোমার মাথায় পৌঁছবে না, আমার ঘাড়ে প’ড়বে। একে একজামিনে ফেল ক’রেছি, তার উপর দেনা, এর উপরে জেলে যাবার এত বড়ো সুযোগটা যদি মাটি হ’য়ে যায়, তবে বাবা আমার সে অপরাধ মাপ ক’র্বেন না।
বিধু। সত্য দিদি। সতীশ মেসোর টাকা নিয়েচে শুন্লে তিনি বোধ হয় ওকে বাড়ি থেকে বা’র ক’রে দেবেন।
সুকুমারী। তা দিন না। আর কি কোথাও বাড়ি নেই না কি? ও বিধু, সতীশকে তুই আমাকেই দিয়ে দে না। আমার তো ছেলেপুলে নেই, আমিই না হয় ওকে মানুষ করি? কি বলো গো?
শশধর। সে তো ভালোই। কিন্তু সতীশ যে বাঘের বাচ্চা, ওকে টান্তে গেলে তার মুখ থেকে প্রাণ বাঁচান দায় হবে।
সুকুমারী। বাঘ মশায় তো বাচ্ছাটিকে জেলের পেয়াদার হাতেই সমর্পণ করে’ দিয়েছেন, আমরা যদি তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাই, এখন তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না।
শশধর। বাঘিনী কি বলেন, বাচ্ছাই বা কি বলে?
সুকুমারী। যা বলে, আমি জানি, সে-কথা আর জিজ্ঞাসা করতে হবে না। তুমি এখন দেনাটা শোধ করে’ দাও।
বিধু। দিদি।
সুকুমারী। আর দিদি দিদি করে’ কাঁদতে হবে না। চল তোর চুল বেঁধে দিই গে। এমন ছিরি করে’ তোর ভগ্নীপতির সাম্নে বা’র হতে লজ্জা করে না?
মন্মথের প্রবেশ
শশধর। মন্মথ, ভাই, তুমি একটু বিবেচনা করে’ দেখো—
মন্মথ। বিবেচনা না ক’রে তো আমি কিছুই করি না।
শশধর। তবে দোহাই তোমার, বিবেচনা একটু খাটো করো! ছেলেটাকে কি জেলে দেবে? তাতে কি ওর ভালো হবে?
মন্মথ। তা জানিনে, কিন্তু যার যেটা প্রাপ্য, সে তাকে পেতেই হবে।
শশধর। প্রাপ্যের চেয়েও বড়ো জিনিষ আছে, তার পরেও মানুষেব দাবী থাকা অন্যায় নয়।
মন্মথ। মিথ্যে আমাকে ব’ল্চো। হয় তো সব দোষ আমারই, একলা আমারই। তার শাস্তিও যথেষ্ট পেয়েচি। এখন তোমরাই যদি সংশোধনের ভার নাও তো নাও, আমি নিষ্কৃতি নিলুম।
সতীশের বেগে প্রবেশ
সতীশ। (উচ্চস্বরে) মা, মা!
বিধুর প্রবেশ
বিধু। কী সতীশ, কী হ’য়েছে?
সতীশ। ঠিক ক’রেছি, যেমন করে’ হোক্ নেকলেস্টা নেলির কাছ থেকে ফিরিয়ে আন্বোই।
বিধু। কী ছুতো ক’র্বি?
সতীশ। কোনো ছুতোই না। সত্যি কথা ব’ল্বো। নেলির কাছে আমি কিছু লুকোবো না।
বিধু। না, না, সে কি হয়?
সতীশ। ব’ল্বো গুড়গুড়ির কথা—ব’ল্বো আমার অবস্থা কত খারাপ। আমি নেলিকে ফাঁকি দিতে পার্বো না।
বিধু। সতীশ, আমার কথা শোন্, বিয়েটা আগে হোক, তার পরে সত্যি মিথ্যে যা ইচ্ছে তোর তাই বলিস।
সতীশ। সে আমি কিছুতে পারবো না। আমি জানি, নেলি একটুও মিথ্যে সইতে পারে না। আমি কিচ্ছু লুকোবো না। আগাগোড়া সব ব’ল্বো।
বিধু। তার পরে?
সতীশ। (ললাট আঘাত করিয়া) তার পরে কপাল।