শোধ-বোধ/প্রথম অঙ্ক/প্রথম দৃশ্য
শোধ-বোধ
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
মিষ্টার লাহিড়ির ড্রয়িংরুম
তাঁর কন্যা নলিনী ও নলিনীর বন্ধু চারুবালা।
চারু। ভাই নেলি, তোর হ’য়েছে কি বল্ তো?
নলিনী। মরণ-দশা।
চারু। না, ঠাট্ট নয়। তোকে কেমন এক রকম দেখ্চি।
নলিনী। কি রকম বল্ তো?
চারু। তা ব’ল্তে পারবোনা। রাগ না অনুরাগ, না বিরাগ, তোর ভাব দেখে কিছুই বোঝ্বার জো নেই; কেবল এইটুকু বুঝি, তোর ঈশেন কোণে যেন মেঘ উঠেছে।
নলিনী। শিলাবৃষ্টি, না জলবৃষ্টি, না ফাঁকা ঝড়, কী আন্দাজ ক’র্চিস্ বল্ তো।
চারু। তোমার আলিপুরের weather report ভাই আমার হাতে নেই। আজ পর্য্যন্ত তোমাকে বুঝ্তেই পার্লুম না।
নলিনী। তবে বুঝিয়ে দিই কেন যে মন চঞ্চল হ’য়েছে। ধৈর্য্য আর রাখ্তে পার্চিনে। ওরে পত্তুলাল, ডেকে দে তো লালবাজার থেকে চিঠি নিয়ে এসেচে।
চারু। মিষ্টার নন্দীর চিঠি? কী লিখেচে?
সে আমার গোপন কথা, শুনে যাও ও সখি!
ভেবে না পাই ব’ল্বো কী?
চারু। হাঁ ভাই, বল্ ভাই বল্, কিন্তু সাদা কথায়।
নলিনী। অবস্থাগতিকে সাদা কথা যে রাঙা হয়ে ওঠে।
গান
প্রাণ যে আমার বাঁশি শোনে
নীল গগনে,
গান হয়ে যায়,মনে মনে যাহাই বকি।
চারু। তুই ভাই এই সব সখীকে-ডাকপাড়া সেকেলে ধরণের গান কোথা থেকে জোগাড় করিস্ বল্ তো?
নলিনী। খুব একেলে ধরণের কবির কাছ থেকেই।
চারু। মিষ্টার লাহিড়ি রাগ করেন না?
নলিনী। বাংলা সাহিত্যে কোন্টা একেলে কোন্টা সেকেলে, সে তাঁর খেয়ালই নেই। একটি গান সব চেয়ে তাঁর পছন্দ, সেইটে তাঁকে শুনিয়ে দিলেই তিনি নিশ্চিন্ত হ’য়ে বোঝেন যে, ইহকাল পরকাল কোনো কালই যদি আমার না থাকে, অন্তত modern কালটা আছে—
Love's golden dream is done
Hidden in mist of pain.
চারু। তোর মতো অদ্ভুত মেযে আমি দেখিনি—সবই উল্টো-পাল্টা। তুই যদি ভাটপাড়ার পণ্ডিতের ঘরে জন্মাতিস্, তা’হ’লে চটেমটে মেমসাহেব হ’য়ে উঠতিস্। মিষ্টার লাহিড়ির ঘরে জন্মেছিস্ বলেই বুড়ি ঠাকুরমার চাল প্র্যাকটিস্ চ’লচে। কোন্ দিন এসে দেখ্বো, জ্যাকেট ছেড়ে নামাবলী ধ’রেছিস্।
নলিনী। আগাগোড়া ছুবিয়ে রাখ্বো—মিষ্টার নন্দী বার-এট-ল।
চাপরাশির প্রবেশ
তোমারা সাবকো বোলো, জবাব পিছে ভেজ দেউজী।
দেখ্লি, একবার চাপরাশের ঘটা দেখ্লি—গিল্টি তক্মার ঝলমলানিতে চোখ ঝ’ল্সে গেল।
চারু। ভয় করিস্নে নেলি, গিল্টি সোনার চাপরাশ জোটে চাপরাশির ভাগ্যে কিন্তু—
নলিনী। হা গো, আর খাঁটি সোনা চাপরাশ প’র্বেন মিসেস নন্দী। তাঁর কি সৌভাগ্য।
চারু। দেখ্ নেলি, ন্যাকামি করিস্নে। মিষ্টার নন্দীব মত পাত্র যেন অম্নি—
মিসেস্ লাহিড়ির প্রবেশ
মিসেস্ লাহিড়ি। নেলি, ছি ছি, তুই এই কাপড় পরে মিষ্টার নন্দীর বেয়ারার— নলিনী। কেন, এ তো মন্দ কাপড় নয়।
মিসেস্ লাহিড়ি। কী মনে ক’রবে বল্ তো? ওদের বাড়ীতে সব—
নলিনী। বেহারা হ’য়ে জন্মেচে বলেই কী এত শাস্তি দিতে হবে? বেচাবা মনিব বাড়ীতে চব্বিশ ঘণ্টা যা দেখে, আজ তার থেকে নতুন কিছু দেখে বেঁচে গেল। এত খুসি হ’লো যে বকশিষ চাইতে ভুলে গেলো।
মিসেস লাহিড়ি। চিঠি দিতে এসে আবার বকশিষ চাইবে কী? তোর সব অদ্ভুত কথা।
নলিনী। এমন আশ্চর্য্য চিঠি, মা, তাতে এত—
মিসেস্ লাহিড়ি। এত কী?
নলিনী। সোনালি ক্রেষ্ট আঁকা,—আর তাতে লেখা আছে তিনি স্বয়ং এখানে আসবেন—আমাকে—
মিসেস্ লাহিড়ি। কী ক’রতে?
নলিনী। বেশি আশা ক’রে বোসো না মা। Propose ক’রতে না, আমার জন্মদিনের জন্যে congratulate ক’রতে। সেই বা ক’জনের ভাগ্যে—
মিসেস্ লাহিড়ি। যা আর বকিসনে, শীঘ্র যা, dress ক’রে নে, এখনি লোক আস্তে আরম্ভ হবে। মিষ্টার নন্দী তোর সেই ধুপছায়া রঙের সাড়িটা খুব admire করেন, সেটা—
নলিনী। সে হবে, মা, আমি এখনি যাচ্চি।
মিসেস লাহিড়ি। যাই, হোটেল থেকে খানসামাগুলো এলো কি না দেখিগে।
নলিনী। দেখ্বি? এই দেখ্ চিঠি। সশরীরে আস্বেন্ তার announcement সেকালে বিশু ডাকাত এই বকম খবর পাঠিয়ে ডাকাতি ক’র্তো।
চারু। ডাকাতি?
নলিনী। নয় তো কি? একজন সবলা অবলার হৃদয়ভাণ্ডার লুঠ। তার সিঁধকাঠিটা দেখ্বি? এই দেখ্।
চারু। ইস্। এ যে হীরে দেওয়া ব্রেসলেট্। যা বলিস্ তোর কপাল ভালো। এ বুঝি তোর জন্মদিনের—
নলিনী। হাঁ, হাঁ, জন্মদিনের উপহার—আমার জন্ম মৃত্যু বিবাহ এই তিনকেই ঘিরে ফেল্বার সুদর্শন চক্র।
চারু। সুদর্শন চক্র বটে। যা বলিস্, মিষ্টাব নন্দীব taste আছে।
নলিনী। ব্রেস্লেটও তার প্রমাণ, আর ব্রেস্লেট পরাবার জন্য যে মৃণালবাহু বেছে নিয়েছেন তাতেও প্রমাণ।
চারু। আজ যে বড় ঠাট্টার সুর ধ’রেছিস্।
নলিনী। তাহলে গম্ভীর সুর ধরি।
গান
সে যেন আসবে আমার মন ব’লেছে।
হাসির পরে তাই তো চোখের জল গ’লেছে।
দেখ্লো তাই দেয় ইসারা
তারায় তারা;
চাঁদ হেসে ঐ হ’লো সারা তাহাই লখি’।
শুনে যা ও সখি।
চারু। আমি যদি পুরুষ হতুম, নেলি, তা’হ’লে তোর ঐ পায়ের কাছে পড়ে’—
নলিনী। জুতোর লেস্ লাগাতিস্ বুঝি? আব ব্রেসলেট্ পরাতো কে?
মিষ্টার লাহিড়ির প্রবেশ
মিষ্টার লাহিড়ি। আজ বরুণ নন্দীব আস্বার কথা আছে না?
নলিনী। হাঁ, তাঁর চিঠি পেয়েছি।
মিষ্টার লাহিড়ি। তা’হ’লে এখনো যে ড্রেস্ করো নি?
নলিনী। কি ড্রেস প’র্বো, তাই তো এতক্ষণ চারুর সঙ্গে পরামর্শ ক’র্ছিলুম।
মিষ্টার লাহিড়ি। দেখ, ভুলো না, সার হাবকোর্ট তোমাকে কী চিঠি লিখেছেন, সেইটে বরুণ নন্দী দেখ্তে চেয়েছিলো—সেটা—
নলিনী। হাঁ, সেটা আমি বেব করে’ রাখ্বো, আর জেনেরাল্ পর্কিন্সের ভাইঝি তার অটোগ্রাফওয়ালা যে ফোটো আমাকে দিয়েছিলো, সেটাও—
মিষ্টার লাহিড়ি। হাঁ হাঁ সেটা, আর সেই যে—
নলিনী। বুঝেছি, গবর্মেণ্ট হাউসে নেমন্তন্নে গিয়েছিলুম, তার নাচের প্রোগ্রামটা।
মিষ্টার লাহিড়ি। আজ কোন্ গানটা গাবে বলো তো?
নলিনী। সেই যে ঐটে,
Love's golden dream is done
Hidden in mist of pain.
মিষ্টার লাহিড়ি। হাঁ, হাঁ, first class। ওটা তোমার গলায় খুব মানায়, আর সেইটে—মনে আছে তো? In the gloaming, oh my darling.
নলিনী। আছে।
মিষ্টার লাহিড়ি। আর সব শেষে গেয়ো Good bye, sweet heart।
নলিনী। কিন্তু ওগুলো যে পুরুষের গান।
মিষ্টার লাহিড়ি। (হাসিয়া) তাতে ক্ষতি কী নেলি—আজকাল মেয়েরাও—
নলিনী। ভুল্তে আরম্ভ ক’রেছে যে, তারা মেয়ে। কিন্তু মুস্কিল এই যে, তাতে পুরুষদের একটুও ভুল হচ্চে না।
মিষ্টার লাহিড়ি। Bravo, well said। যাও এবার ড্রেস ক’র্তে যাও। অমনি সেই তোমার অটোগ্রাফ বইটা, সেই যেটাতে—
নলিনী। বুঝিছি, যেটাতে লর্ড বেরেস্ফোর্ডের কার্ড আঁটা আছে। আচ্ছা বাবা, সে হবে এখন। তুমি তৈরি হওগে, আমি যাচ্চি।
লাহিড়ি। (ফিরিয়া আসিয়া) দেখ, একটা জিনিষ নোটিস্ ক’র্চি নেলি, সেটা তোমাকে বলা ভালো। তুমি অনেক সময়ে বরুণের সঙ্গে এমন টোনে কথা কও যে, সে মনে করে, তুমি তাকে একটুও সীরিয়াস্লি নিচ্চ না, তাই সে ভেবে পায় না যে, তুমি—
নলিনী। বুঝেছি, বাবা। সুবিধে পেলেই বুঝিয়ে দেব আমি খুব সীরিয়াস।
লাহিড়ি। আর একটা কথা। আমি ঠিক বুঝতে পারিনে তুমি সতীশকে কেমন যেন একটুখানি indulgence দাও।
চারু। না। মিষ্টার লাহিড়ি, নেলি তো তাকে কথায় কথায় নাকের জলে চোখের জলে করে। পৃথিবীতে ওব কুকুর টম্কে ছাড়া নেলি আর যে কাউকে একটু indulgence দেয়, এ তো আমি দেখিনি।
লাহিডি। কিন্তু সে আসতেও ছাড়ে না। সে দিন চা পার্টিতে এমন একটা জুতো পরে’ এসেছিলো, যে তার মচ্ মচ্ শব্দে দেয়ালের ইঁটগুলোকে পর্য্যন্ত চম্কিয়ে দিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে এক এক সময় ভারি awkward হয়। তা ছাড়া ওর ট্রাউজারগুলো—থাকগে, লোরেটোতে ছোটোবেলায় তোমার সঙ্গে ও এক সঙ্গে প’ড়েছিলো, ওকে আমি কিছু ব’ল্তে চাইনে, কিন্তু যে দিন বরুণরা আসবে, সে দিন ববঞ্চ ওকে—
নলিনী। ভয় কী, বাবা, সে দিন ববঞ্চ সতীশকে ট্রাউজার না পরে’ ধুতি পরে’ আস্তে ব’লবো, আর দিল্লির জুতো, সে মচ্ মচ ক’রবে না।
লাহিড়ি। ধুতি? পার্টিতে? আবার দিল্লির নাগরা?
নলিনী। পৃথিবীতে যে সব বালাই অসহ্য, সেগুলো ক্রমে ক্রমে সইয়ে নেওয়া ভালো।
চারু। ওর সঙ্গে কথায় পার্বেন না। এদিকে লোক আস্বাব সময় হ’য়ে আস্চে। নেলি, তুই যা ভাই, কাপড় পরে’ আয়, যদি কেউ লোক আসে, আমি তাদের সাম্লাব।
লাহিড়ি। এই বুঝি ওর সব জন্মদিনের প্রেজেণ্ট? বরুণের ব্রেস্লেট্টা কী এমনি টেবিলের উপরেই থাকবে?
চারু। থাক্ না, আমি ওর উপর চোখ রাখ্বো।
লাহিড়ি। এটা কার? একটা মকমলের মলাটের এলবম্। এ দেখ্চি সতীশের। দাম লেখা আছে, মুছে ফেল্তেও হুঁস্ ছিলো না। এক টাকা বারো আনা। ইন্সলভেন্সির মামলা আন্তে হবে না। সেকেণ্ডহ্যাণ্ড সেলে কেনা। এটাও কী এখানে থাক্বে নাকি?
চারু। সরাতে গেলে নেলি রক্ষা রাখবে না।
লাহিড়ি। থাক্ তবে, তুমি এখানে একটু বোসো, আমি ড্রেস করে’ আসি।
সতীশের প্রবেশ
চারু। এত সকাল সকাল যে?
সতীশ। (লজ্জিত হয়ে) দেখছি আমার ঘড়িটা ঠিক চ’ল্ছিলো না। যাই, ববঞ্চ আমি একটু ঘুরে আসিগে।
চারু। না, আপনি বসুন। সময় হ’য়ে এসেচে। নেলির প্রেজেণ্টগুলো দেখুন না। এই দেখ্বেন?
সতীশ। এ যে হীরের ব্রেসলেট্। এ কে দিয়েচে?
চারু। মিষ্টার নন্দী। চমৎকার না?
সতীশ। বেশ।
চারু। এই মুক্তো দেওয়া হেয়ার পিন্টা আমার ভাই অমূল্যর দেওয়া। আর এই রূপোর দোয়াতদান—ও কি সতীশবাবু, যাচ্চেন না কী?
সতীশ। ভাব্চি, এই বেলা আমার কাজ সেরে আসি।
চারু। আপনার এলবম্টি নেলির কাজে লাগ্বে। এই দেখুন না, মিষ্টার নন্দী ওকে তাঁর সই করা ফোটো পাঠিয়ে দিয়েচেন।
সতীশ। হাঁ, তাই তো দেখ্চি। আমার কিন্তু বিশেষ কাজ আছে, আমি যাই। আর দেখুন্, এখনকার মতো এই এল্বম্টা আমি নিয়ে যাচ্চি—তার পরে—
চারু। কী ক’র্বেন?
সতীশ। না, ওটা—একবার—একটুখানি ঐ—আপনি দয়া করে নেলিকে ব’ল্বেন যে, বিশেষ একটু কারণে এখনকার মতো—তার পরে আবার—এখন যাই—কাজ আছে। (প্রস্থান)
চারু। যাক, বিদায় করে’ দেওয়া গেলো। মা গো, কী টাই পরেই এসেচে! এল্বম্টাও গেলো। এই যে মিষ্টার লাহিড়ি, শুনে যান, সুখবর আছে, বক্শিস্ চাই।
নেপথ্যে। একটু পরেই যাচ্চি, আমার বাট্ন হুকটা খুঁজে পাচ্চিনে।
সতীশকে লইয়া নলিনীর প্রবেশ
চারু। ও কি, নেলি, তোর ভালো করে’ তো সাজা হ’লো না।
নলিনী। হঠাৎ কোতোয়ালি ক’র্তে হ’লো। ড্রেসিংরুমের জানলা দিয়ে দেখি চোর পালাচ্চে একটা মাল বগলে নিয়ে, তখনি নেমে গিয়ে বমাল সুদ্ধ গ্রেফতাব করে’ নিয়ে এসেছি।
চারু। বাস রে, কী কড়া পাহারা? মালটা কি খুবই দামী, আব চোরটাও কী খুবই দাগী?
নলিনী। (সতীশকে) তুমি এসেই তখনি পালাচ্চিলে যে, আর আমার একখানা এল্বম্ নিয়ে? (সতীশ নিরুত্তর)
চারু। ওঃ বুঝেছি, প্রাইভেট্ কামরায় বিচার হবে। নেলি, আমি তা’হ’লে তৈরি হ’য়ে আসিগে। তোর নাবার ঘরে টয়লেট ভিনিগাব আছে তো?
নলিনী। আছে। (চারুর প্রস্থান) তোমার এ কী রকম দুর্ব্বুদ্ধি? আমার এলবাম নিয়ে—
সতীশ। লক্ষ্মীছাড়ার দান লক্ষ্মীকে পৌছব না। যেটা যার যোগ্য নয়, সে জিনিষটা তার নয়, আমি এই বুঝি।
নলিনী। আর বগলে করে’ যে নিয়ে যায়, সেটা যে তারই এই বা কোন্ শাস্ত্রে লেখে?
সতীশ। তবে সত্যি কথাটা বলি। আমি যে ভীরু, বেশ জোরের সঙ্গে কিছুই দিতে পারিনে। সেই জন্যে দিয়ে লজ্জা পাই।
নলিনী। তোমার এই এলবমের মধ্যে কম জোরের লক্ষণটা কী দেখ্লে? এ তো টকটকে লাল।
সতীশ। লজ্জায় লাল। কতবাব মনে হ’য়েছিলো, এই এলবমের মধ্যে নিজের একখানা ছবি পূরে দিই, “আমাকে মনে বেখো” এই করুণ দাবীটুকু বোঝাবার জন্যে। কিন্তু ভয় হ’লো, তুমি মনে ক’র্বে ওটা আমার স্পর্ধা, খালি রেখে দিলুম, তুমি নিজে ইচ্ছে করে’ যার ছবি রাখ্বে, ওর মধ্যে তারি স্থান থাক্।
নলিনী। খুব ভালো ব’লচো, সতীশ, ইচ্ছে ক’র্চে বইয়ে লিখে রাখি।
সতীশ। ঠাট্টা কোরো না।
নলিনী। আমার আর-এক জনের কথা মনে প’ড়্চে। সে দিয়েছিলো একখানা খাতা—তোমার এল্বমের মধ্যে যে-কথাটা না-লেখা অক্ষরে আছে, সেইটে সে গানে লিখে দিয়েছিলো—শুধু তাই নয়, পাছে চোখে না পড়ে, তাই নিজে এসে গেয়ে শুনিয়েছিলো—
পাতা খানি শূন্য রাখিলাম,
নিজের হাতে লিখে রেখো শুধু আমার নাম।
সতীশ। কে লোকটা কে?
নলিনী। তার সঙ্গে ডুয়েল লড়্তে যাবে না কী? আমাদের কবি গো—কিন্তু কবিত্বে তুমি তাকেও ছাডিয়ে গেছো—তোমার এ যে unheard melody। আমি শুনতে পাচ্চি—
এই এলবম্ শূন্য রইলো সবি,
নিজের হাতে ভ’রে রেখো শুধু আমার ছবি।
কিন্তু তোমার সব কথা বলা হয় নি।
সতীশ। না, হয়নি। বলি তা’হ’লে। এসে দেখ্লুম—সবাই আমার মতো ভীরু নয়। যার জোর আছে, সে নিজেব ছবিতে নিজের নাম লিখে পাঠাতে সঙ্কোচ করে না। মনে বুঝ্লুম, আমি দিয়েছি শূন্য পাতা, আব তারাই দিলে পূর্ণ কর্বার জিনিষ।
নলিনী। তোমাকে এখনি বুঝিয়ে দিচ্চি ভুল ক’রেছে সে। ছবি দিতে সবাই পারে, ছবি রাখ্বার জায়গা দিতে ক’জন পারে। ভীরু, তোমার অদৃশ্য ছবিরই জিৎ থাক। (নন্দীর ছবি ছিঁড়িয়া ফেলিল) ও কি, অমন করে’ লাফিয়ে উঠ্লে কেন? মৃগী-রোগে ধ’র্লো নাকি?
সতীশ। কোন্ রোগে ধ’রেছে, তা অন্তর্য্যামী জানেন। নেলি, একবার তুমি আমাকে স্পষ্ট করে’—
নলিনী। এই বুঝি নাটক সুরু হ’লো? চোখের সাম্নে দেখ্লে তো যে-ছবি চেঁচিয়ে কথা কয়, তার কী দশা। যে মানুষ চুপ করে’ থাকতে জানে না, তারো—
সতীশ। আর কাজ নেই, নেলি, থাক্। তোমাকে কত ভয় করি, তুমি জানো না।
নলিনী। ভয় যদি করো’ তা’হ’লে এল্বম্ চুরি কোরো না। আমি কাপড় ছেড়ে আসিগে।
সতীশ। একটি অনুরোধ। Unheard melody আমার মুখে খুবই মিষ্টি, কিন্তু তোমার মুখে নয়। তোমার জন্মদিনে তোমার মুখে একটি গান শুনে যাব।
নলিনী। আচ্ছা।
গান
বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা,
নিয়ো হে নিয়ো।
হৃদয় বিদারি হয়ে গেলো ঢালা
পিয়ো হে পিয়ো।
ভরা সে পাত্র তারে বুকে করে’
বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে’
লও তুলে লও আজি নিশি ভোরে
প্রিয় হে প্রিয়।
বাসনার রঙে লহরে লহরে
রঙীন হোলো।
করুণ তোমার অরুণ অধরে
তোলো হে তোলো।
এ রসে মিশাক্ তব নিশ্বাস
নবীন ঊষার পুষ্প সুবাস,
এরি পরে তব আঁখির আভাস
দিয়ো হে দিয়ো।
চারুর প্রবেশ
চারু। এ কি করছিস্, নেলি? মিষ্টার নন্দীর ফোটো—
নলিনী। যে মাটিব গর্ভে হীরে থাকে, যে মাটির বুকে ভুইচাঁপা ফুল ফোটে, সেই মাটীর হাতে ওকে সমর্পণ করে’ দিয়েছি। এর চেয়ে আর কত সম্মান হবে?
চারু। ছি ছি, নেলি, মিষ্টার নন্দী জান্তে পারলে কী মনে ক’রবেন? এ যে একবারে ছিঁড়ে ফেলেছিস।
নলিনী। ইচ্ছে করিস্ তো তোর ঘরের আটা দিয়ে তুই জোড়া দিয়ে নিতে পারিস্।