অনুশোচনা।

কে বলে মানব উন্নতির সীমা
প্রকাশে বিধির সৃজনমহিমা?
কে বলে তাহার অপূর্ব্বকৌশল
মেধা চিন্তা শক্তি মতি বুদ্ধি বল?
—নাহি জানে তারা কি আছে কপালে
নাহি জানে তার কি হইবে কালে,
থাকে যত দিন চিনিতে না পারে
বুঝিলে অভাব ভিজে অশ্রুধারে,
গলায় আমার ছিল সে যখন
বুঝি নাহি সে যে কি অমূল্যধন।

নাহি তাই তার বুঝেছি মরম
মানব-প্রকৃতি কি এক রকম।
বুঝে ও বুঝে না করে ভাবনা
মানবের রীত গতানুশোচনা।
হৃদয় আকাশ পৃথিবী যখন
প্রণয়ের পূর্ণ প্রবাহে মগন;
ভেবেছি তখন প্রণয় অমর
না পরশে তায় বিচ্ছেদের কর,
এরূপে প্রবাহ হেলিয়া দুলিয়া
সমস্ত জীবন যাইবে বহিয়া।
কে জানিত হেথা হিতে বিপরীত
সুসংযোগ নহে বিধাতার নীত,
বিচ্ছেদ প্রণয়ে, মৃণালে কণ্টক,
কীট ফুলদলে, নিগন্ধ কনক,
মণি ফণিশিরে সুধা রাহুকরে,
চন্দনপাদপ ধৃত বিষধরে,
স্বরগের পথে কণ্টক কঙ্কর,
পাপ-পথ স্নিগ্ধ শীতল সুন্দর,
আছে বিভীষিকা বিরাম নিদ্রায়
চিন্তা জাগরণে ভ্রান্তি কল্পনায়,
বিজলিতে হাসি অশনি নিঃস্বন
প্রমোদ বিলাপ, জনমে মরণ।

ছিল সে যখন ছিল এ যামিনী
ফুটিত সরসে এই কুমুদিনী,
হেলিত দুলিত লহরে লহরে
ছুটিত সোহাগ অন্তরে অন্তরে,
হাসিত এ শশী আকাশের গায়
নাচিত কিরণ তরঙ্গের ঘায়,
গগন-গবাক্ষে তারকা-নয়ন
এরূপে হেরিত দুইটী জীবন।
এই সমীরণ তুলি গন্ধচয়
তুষিত সাদরে দুইটী হৃদয়
এ কিরণে ঢালি দুইটী পরাণ
শুনিত কেবল প্রকৃতির গান।
নব-কুসুমিত লতার মতন
আপন লাবণ্যে আপনি মগন
আপন সৌন্দর্য্যে আপনি বিব্রত
নব-বিকসিত যুথিকার মত,
ঐ যে তপন খেলিছে গগনে
হাসিছে কমল সরসী-জীবনে,
দুলিছে লতিকা সমীরণভরে
নাচিছে সলিল লহরে লহরে,
এরূপে খেলিত হাসিত দুলিত
নাচিত জীবন সঙ্গীত শুনিত,

ছিল মুগ্ধকরী কি এক জিনিস
সাথে সহচরে সঙ্গে অহর্নিশ,
পরশ-মাণিক পরশিতো যায়
সেইত ধরিত কনকের কায়,
নাহি সে পরশ-মাণিক আমার
এখন উজল হৃদয় আঁধার
এখন জীবন সমাধি শ্মশান
এক বিন্দু স্নেহ শোণিত সমান
এক ফোঁটা জল প্রবাহ প্রবল
এক কণা বহ্ণি শত দাবানল
সুখ-প্রস্রবণ দুঃখের লহরী
আশার আলোক বিষাদ শর্ব্বরী।
চারু মনোহর যা’ কিছু সুন্দর
যা’ কিছু মধুর সব দুঃখকর।
নাহি প্রফুল্লতা উচ্চ অভিলাষ
আশার উৎসাহ প্রণয়ে পিয়াস
নাহি ভালবাসা বিভ্রম বিলাস
হৃদয় পরাণ জীবন উদাস,
পূরিত অতুল সৌন্দর্য্য নির্যাস
সেই মুখ খানি চিন্তা বারমাস।
এক এক শশী বারেক হাসিতে
সমস্ত জগৎ একটী আঁখিতে

একবার কথা দেহ প্রাণপণ,
এক ফোঁটা জলে আত্ম-বিসর্জ্জন।
সেই মুখটিতে বিশ্ব-বিনিময়
করিলেও কিরে পূরিত হৃদয়?
বিসর্জ্জে প্রতিমা লোকে গঙ্গাজলে
স্বর্ণপ্রতিমারে দিলাম অনলে।
রাখি নাহি তারে আদরে যতনে
ধরি নাহি তারে হৃদয়ে জীবনে।
আদরেও যেন মরমপীড়িতা
সোহাগ পরশে সদা সঙ্কুচিতা,
কাননের লতা কানন খুঁজিয়া
বিশ্রাম লতিত আমারে বেড়িয়া,
সেই তার ছিল সোহাগ আদর
তাহাতেই সুখী প্রফুল্ল অন্তর,
এক দিন এক প্রবল ঝটিকা
ফেলিল ছিঁড়িয়া সোহাগ-লতিকা,
যদি জানিতাম ঝটিকার ভর
সহিবেনা তোর কোমল অন্তর
তাহলে সঞ্চিত সোহাগ আদরে
সাজাতেম তোর বপু থরে থরে,
প্রাণে প্রাণে খালি দিত আলিঙ্গন
হৃদয়ে হৃদয় জীবনে জীবন।

ছিলি হৃদয়েতে দেবীর মতন
দিত তোরে আরো উচ্চ সিংহাসন,
রাখিতাম তোরে নয়নে নয়নে
সাথে সহচরে বিরহ মিলনে
যদি তোর কিছু থাকিত প্রয়াস
ঢালিয়া শোণিত পূরাতেম আশ,
স্নেহ ভালবাসা প্রণয়-কুসুমে
সোহাগ আদর যতন-কুঙ্কুমে
প্রণয়ের হাসি অশ্রু-গঙ্গাজলে
প্রণয়ের ফুল ফল বিল্বদলে
পূজিতাম তোরে প্রাণের প্রতিমা
হেরিতাম তোর সৌন্দর্য্য মহিমা।
ছিলি জীবনেতে যেন প্রভাকর
তোর তেজে দীপ্ত আমি শশধর,
কনকের দীপ আমি সে দর্পণ
তুইসে প্রতিভা কল্পনা এ মন।
যদি জানিতাম ঝটিকার ভর
সহিবেনা তোর কোমল অন্তর
তাহ’লে প্রণয় হতো কি এমন
ক্ষণেকের রেখা তড়িত যেমন।
হতো শৈলে শৈলে বজর-বন্ধন
সাগরে সাগরে দৃঢ় আলিঙ্গন,

সাগর শুকাতো পর্ব্বত ভাঙ্গিত
তবুও তাদের গ্রন্থি না টুটিত।
ছিল এ সময় যখন জীবনে
হাসি কান্না হাসি হতো ক্ষণে ক্ষণে
সংঙ্কীর্ণ হৃদয় মন সঙ্কুচিত
হয় সুখে নয় দুঃখে প্রপূরিত
তখনো জীবনে বহিত ঝটিকা
ফুটিত তপনে কমল-কলিকা
তখনো জীবনে জ্বলিত অনল
ঝরিত নয়নে অশ্রু অনর্গল
এতটুকু স্নেহে আদরে যতনে
ভুলিত যা’ কিছু ছিল তার মনে,
পরশ মণির কি আশ্চর্য্য গুণ
নিভাতো ঝটিকা নিভাতে আগুন,
কেনরে মিলিয়া বালক বালিকা
গাঁথিয়া আপন ভবিষ্য মালিকা,
পরাইতে চায় যারে ভালবাসে,
এক সাথে বদ্ধ হয় তার পাশে।
অনলের তাপ ঝটিকার ভর
বুঝে নাই বুঝি প্রচণ্ড প্রখর,
তাহলে কি তারা যাইত সে স্থলে
সলিল ভাবিয়া পশিতে অনলে।

অপ্সরা অমরাবতী বিনিময়ে
হয়না তেমন আনন্দ হৃদয়ে;
দেখিলে সুন্দর আঁখি নাহি চায়
দু’নয়ন ধারা ধরণী ভিজায়।
শুনিলে সঙ্গীত সুস্বর লহরী
শোকমগ্ন হিয়া দিবা বিভাবরী।
পূরিয়াছি প্রাণে এ বিশ্ব সংসার
তবু যেন কিছু বাকি আছে তার।
দেখিয়াছি চাঁদ পূর্ণিমা গগনে
যেন কি জিনিষ নাহি তার সনে।
প্রশস্ত হিয়ায় মানব মণ্ডলী
পাইয়াছ স্থান তবু বনস্থলী।
এখনো নিসর্গ রূপের নিলয়
অতীতের যেন স্মৃতিচিহ্লময়
ঐ যৌবনের প্রমোদ উদ্যান
উথলিত যেথা হাসি অশ্রু গান।
ঐ দেখো ঐ শয়ন-আলয়
সুখের সমাধি শান্তির প্রলয়।
যেখানে সেকালে পলকে পলকে
উথলিত প্রেম ঝলকে ঝলকে
হায়! সে এখন প্রশস্ত শ্মশান
চিতা আগুণের দগ্ধ অবসান।

 শুকালে সলিল তড়াগ যেমন
যেমন বিদলিত-শোভা কুসুম মতন।
সে দিকে নয়ন চাহিবেনা আর
হয় লয় হোক সমস্ত সংসার।
যে ধারে তাকাই খালি সেই দিক্
চায় শূন্য পানে দৃষ্টি অনিমিক্‌।
শূন্য এ পৃথিবী শূন্য এ জীবন
বিহগাপহৃত পিঞ্জর যেমন
থাকে থাকে মন সদা সচকিত
যেন কি জিনিসে জীবন বঞ্চিত।
এখন জীবন সমাধি শ্মশান
এক বিন্দু স্নেহ শোণিত সমান
এক ফোঁটা জল প্রবাহ প্রবল
একটি ফুলিঙ্গ শত চিতানল,
এক কণা সুখে অশনি নিপাত
হাসি দিগ্‌দাহ তারা উল্কাপাত
পূরিত অতুল সৌন্দর্য্য-নির্যাস।
সেই মুখখানি চিন্তা বারমাস।

—:০:—