ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/১
ত্রিশ বছর হল ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক বাংলার প্রান্তিক দুইটি জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে মূল বাংলার সীমারেখা থেকে এনে উপঢৌকন দিলেন নব প্রতিষ্ঠিত আসাম রাজ্যকে। প্রাদেশিক মানচিত্রে পড়ল এক গাঢ় তুলির টান। নদী নালা পর্বত বেষ্টিত এই সবুজ শ্যামল ভূখণ্ড রইল আগের জায়গায়ই, কিন্তু মানুষ পেল ভিন্ন পরিচিতি। সুরমা কুশিয়ারা বরাকের তীরে নির্বাসিতা ভূমির বাঙালির ঠিকানা গেল বদলে।
এবার সাম্রাজ্যবাদী পাশা খেলায় দ্বিতীয় চাল হিসেবে এল বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব। রঙ্গমঞ্চে এলেন লর্ড কার্জন। প্রবল প্রতিরোধের মধ্যেই পরিকল্পনা হল বাস্তবায়ন। বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষার সামনে এল নতুন প্রত্যাহ্বান। ঔপনিবেশিক কলমের এক আঁচড়ে এদের ঠিকানা বদল হল আরও একবার। এ ঠিকানা বঙ্গ হয়েও বঙ্গ নয়, আসাম হয়েও আসাম নয়। এক অসম্ভব প্রকল্পের বাস্তবায়ন এই অবাস্তব রাজ্য, ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’। এও এক বিপন্ন বিস্ময়। ভূ-ভারতে এমনটি আর কোথাও নেই। অবাস্তব এ প্রদেশের বাসিন্দার আত্মপরিচয় কী? ঔপনিবেশিক প্রভুদের ইচ্ছায় এ ভূমির প্রাপ্তি হল এক অবাস্তব নাম ‘নামে কি এসে যায়’, বলেছেন তাঁদের দেশের মহাকবি। তবে নামে অনেক কিছুই এসে যায়, সেটা উপলব্ধি করে আমাদের বিশ্বকবি গেঁথেছেন কয়েকটি ছন্দবদ্ধ পঙক্তি—
মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।
যারা আশায় ছিলেন দুই বাংলা আবার জোড়া লাগবে, আর যারা আশা করেছিলেন আসামকেও তার স্বভূমিতে স্বনামে ফিরিয়ে আনা হবে, এদের উভয়েরই স্বপ্ন অধরা থেকে গেল।
এই হতাশা, বেদনা আর গ্লানির পীড়ন অস্বীকার করে এরই মধ্যে কতিপয় জ্ঞানতাপস নতুন উদ্যমে জেগে উঠতে চাইলেন, সন্ধানে ব্রতী হলেন খণ্ডিত ভূখণ্ডের প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, যেতে চাইলেন ঐতিহ্যের উৎসে। মহানগরীর নিরাপত্তা ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে নির্বাসিতা বাংলার প্রান্তিক ভূমিতে এলেন মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ।
বঙ্গভঙ্গের চারটি বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এক দ্বিপ্রহরে পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ আলোচনায় বসেছেন জাটিঙ্গা নদীর তীরে প্রাচীন গ্রামটির জমিদার রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্রের সঙ্গে। যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন অবশ্য প্রথমোক্ত জনের নামের সঙ্গে ‘মহামহোপাধ্যায়’ আর দ্বিতীয়জনের নামের সঙ্গে ‘রায়বাহাদুর' অভিধা লাগেনি। সম্মানিত অতিথি পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ শ্রীহট্ট-কাছাড়, কামরূপ-শোনিতপুর এবং ত্রিপুরা-মাইবঙের অন্দরে কন্দরে অবিরাম পরিভ্রমণ করে চলেছেন। ছিলেন শিক্ষা আধিকারিক, সরকারি আমলা। সম্প্রতি আসামের ভূতপূর্ব চিফ কমিশনার স্যার হেনরি কটন সাহেবের ইচ্ছানুসারে তাঁরই নামাঙ্কিত ‘কটন কলেজে’ গিয়ে স্থিত হয়েছেন। এ হেন ব্যক্তিকে কাছে পেয়ে মাতৃভূমির গৌরবে গৌরবান্বিত বিপিনচন্দ্র মনের ভিতর চাপা ক্ষোভ ব্যক্ত করতে দ্বিধা করলেন না,
—লোকে বলে আমাদের স্থানটি পাণ্ডব বর্জিত এলাকা। কথাটা কি সত্যিই তাই? দ্বাদশবর্ষ বনবাস কালে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেনের সঙ্গে হিড়িম্বার প্রণয় থেকে এই ভুবনের প্রবেশ ‘মহাভারতে’র মানচিত্রে। এটাই তো শুনে আসছি। তবুও পাণ্ডব বর্জিত?
বিদ্যাবিনোদকে নিরুত্তর দেখে তিনি আবার বললেন,
—আপনি বলছেন, পর্বতের প্রান্তবর্তী নিচু ভূমি বলেই এ নাম কাছাড়?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। শব্দটি সংস্কৃত, ‘কচ্ছ’। উত্তরে আসাম, দক্ষিণে ত্রিপুরা, পূর্বদিকে মণিপুর আর পশ্চিমে সিলেট-জৈন্তা। এরই মধ্যবর্তী কচ্ছ-ভূমি, তাই তো কাছাড়। আপনার কী অভিমত? অবশ্য এসব ক্ষেত্রে আপনাদের মতামতের গুরুত্ব আছে বই কি। আপনারা এখানকার বাসিন্দা, আপনাদের অভিজ্ঞতা হল প্রত্যক্ষ। বলুন তো আপনি কী মনে করেন।
রায়বাহাদুর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন,
—আমার শোনা মতে, এইখানে হেড়ম্ব রাজত্বের আগে কোচ রাজত্বের একটি পর্ব ছিল। ওই কোচ, ধেয়ান বা রাজবংশীরা আমার জমিদারি এলাকায় বসবাসও করছে প্রজা হিসেবে। আপনি কাচাকান্তি দেবীস্থান দর্শন করে এসেছেন—এ দেবীও কিন্তু কোচজাতির আরাধ্যা। ওই কোচ থেকে নামটি হয়েছে কাছাড়, এ আমাদের এখানে প্রচলিত একটা ধারণা। আপনারা কী বলবেন জানি না। আমার পূর্বপুরুষের জানা মতে তা’ই।
রায়বাহাদুরের কথার মধ্যে একটা জোর আছে। কে তাঁর বিরোধিতা করবে? তাঁর গ্রামে এসে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ।
ফাল্গুন মাসের দুরন্ত দুপুর। অতিথিকে সামান্য প্রাতরাশ করিয়ে জমিদার মশাই ঢুকেছেন বাড়ির মহাফেজখানায়। বহুদিনের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে আজ। দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। দোলযাত্রার আর বেশি দিন বাকি নেই। বসন্ত বাতাসে ভেসে আসছে ফুলের সুবাস। দিকে দিকে পলাশ, শিমুল আর রঙ্গনের মেলা। আলোর আভা রাঙিয়ে তুলেছে এ বন্ধ ঘরটিকেও। জমিদারমশাই লোহার সিন্দুকের ভেতর চাবি ঘোরালেন। বের করে এনে এগিয়ে দিলেন ভেতরের সম্পদ। পরম যত্নে বিদ্যাবিনোদ হাতে তুলে নিলেন জমিদার বিপিনচন্দ্রের পূর্বপুরুষের সযত্ন রক্ষিত সম্পদ, লালসালুতে মোড়া একটি পেটিকা। একশো সত্তর বছর ধরে রক্ষিত দুটি মহামূল্যবান রাজকীয় সনন্দ।
উন্মোচিত হতে চলেছে এক অন্ধকারের যবনিকা। তক্তপোশে বিছানো সাদা চাদরের উপর মেলে রাখা হল দু’খানা ভূর্জপত্রের টুকরো। দুটো প্রাচীন বঙ্গলিপির নথি।
মহামহোপাধ্যায়ের কাপড়ের ঝুলি থেকে বেরোল একটি ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস, গোল আতসকাচ। এটা তাঁর বিদেশি বন্ধু উইলিয়ম ক্রুকের উপহার। প্রত্নতত্ত্ব ঘাঁটাঘাটি করতে হলে কত কি সরঞ্জাম লাগে তিনি শিখে নিয়েছেন সাহেবদের সঙ্গে থেকে থেকে।
ঘরের ভিতর স্তব্ধ নীরবতা। পণ্ডিতমশাই কাচ নিয়ে ঝুঁকে পড়েছেন নথিগুলোর উপর। অক্ষরগুলো ঝাপসা, পত্রগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ে যাছে।
বুক কাঁপছে জমিদারমশাইর।
অনেকক্ষণ পর ওদিক থেকে আওয়াজ শোনা গেল,
—আমার সঙ্গে তো সব সরঞ্জাম নেই। আতি সন্তর্পণে নাড়াচাড়া না করলে পত্রগুলো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবে। পাঠোদ্ধার করা যাবে না।
বিপিনচন্দ্র বুঝতে পারছেন এ কাজ সহজ নয় মোটেই। এও বুঝতে তাঁর বাকি নেই বিদ্যাবিনোদ ছাড়া আর কেউ এর পাঠোদ্ধারও করতে পারবে না।
—আপনি দয়া করে এতদূর এসেছেন, এত ক্লেশ স্বীকার করেছেন। যদি এই নথিগুলো আপনি নিয়ে যান, পাঠোদ্ধার করেন তবে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। এ বুঝি এতদিন আপনার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। নিয়ে যান পণ্ডিতমশাই মহারাজ কীর্তিচন্দ্রের সনন্দ আর এই অভয়পত্র। সে সঙ্গে আপনাকে দেব আরও একটি নথি, ‘দণ্ডবিধি পুথি’, আমাদের পূর্বপুরুষের সঞ্চিত আরেক ধন। অনুমান এরও বয়স দু’শো বৎসর। তবে এর আরেকটি অংশ সম্ভবত বন্ধুবর নন্দলাল বর্মন মহাশয়ের কাছে রক্ষিত আছে। আমি তাঁকে আপনার কথা বলেছি। আশাকরি তাঁর সাহায্যও আমরা পাব।
ভেতর বাড়ি থেকে কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠল। আজ মঙ্গলবার। হরিনারায়ণের ভোগ লেগে গেছে। এখন অতিথি নারায়ণের সেবা।
—ওরে কে আছিস! পণ্ডিতমশায়ের খড়ম গামছা এগিয়ে দে। জলের পাত্র নিয়ে আয়।
বিদ্যাবিনোদ অনেকটা সময় নিয়ে বহু যত্ন করে ঠিক আগের মতো নথিগুলো গুটিয়ে দুটো কাঠের টুকরো বসিয়ে লালসালুতে মুড়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখলেন।
আজ পুরোহিত বাড়ির মেয়েরা এসে রান্না করেছে এই সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের জন্য। এরপর তাঁকে যেতে হবে সোনাপুর, হরগোবিন্দ সেন মহাশয়ের বাড়ি। ওখানে তাঁর জন্য রক্ষিত আছে আরও একখানি অমুল্য পুথি ‘ঋণাদান বিধি’।
জমিদারবাড়ির চর্বচোষ্য লেহ্য পেয় দিয়ে ভূরিভোজনের পর বিছানায় শরীর লাগাতে না লাগাতেই বিদ্যাবিনোদ উঠে পড়েছেন। পরিকল্পনা, পায়ে হেঁটে মেরে দেবেন সাত মাইল পথ। খবর গেল ভিতর বাড়িতে। ছুটে এলেন গৃহকর্তা। পণ্ডিত ব্যক্তিটিকে কি তিনি এমনি ছেড়ে দিতে পারেন? জেদি মানুষটি আবার পালকিতে উঠবেন না, ঘোড়ায় চড়ারও অভ্যাস নেই। অতদূর গেলে আজ ফিরে আসার সম্ভাবনাও নেই। আর পেলে সেনমশাইই বা তাঁকে ছাড়বেন কেন?
—আমি বলি, পণ্ডিতমশাই, পুথিটি আমি যদি আনিয়ে নিই?
—না না, তা হয় না। আমি পত্র দিয়ে জানিয়েছি। তাছাড়া মালিকের সঙ্গে কিছু আলোচনাও তো জরুরি।
অনেক সাধ্যসাধনায় পণ্ডিতপ্রবরকে সেইদিনের জন্য বিরত করা গেল। বিপিনবাবু আসলে আজ রাত বিদ্যাবিনোদের সান্নিধ্য চাইছিলেন। পণ্ডিতমশাই অবশ্য তাঁর ‘সুবঙ্গ বিষয়া’ অভিযানের কথা মনে করিয়ে দিলেন। ঢাকার তরুণ ছাত্র নলিনীকান্ত ভট্টশালি ঠিক এই স্থানে বঙ্গ-সমতটের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাচীন এক ইতিহাসের সূত্রের কথা শুনিয়েছেন।
—এসেছি যখন দেখে যাব ওই দিকটা।
সন্ধ্যার অবকাশে অন্তরঙ্গ আলাপে বসে বিপিনবাবু বললেন,
—আজ্ঞে একটা প্রস্তাব রাখতে চাই, যদি অনুমতি দিন।
বিদ্যাবিনোদের সহাস্য উত্তর,
—আপনি দেশের জমিদার, হেড়ম্বরাজমন্ত্রী বংশ-সম্ভূত সর্বজনমান্য ব্যক্তি। আপনাদের কথা বলতে অনুমতি লাগে, এমন তো ভাবি নাই।
বিপিনবাবুর প্রস্তাব হল, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ মহোদয়ের কাছাড় ভ্রমণের যাবতীয় খরচা তিনি বহন করবেন। যদি কোনও গ্রন্থ প্রকাশ করতে মনস্থ করেন বিদ্যাবিনোদ মহাশয়, তবে এর ব্যয়ভারও তিনি বহন করতে চান। খাসপুরে পরিত্যক্ত রাজবাড়ি, রাজন্যবর্গের অভিজ্ঞানসমূহ, বাসনপত্র, পূজার সামগ্রী, পুথিপত্র ইত্যাদির তৈলচিত্র, লিপিকর, নকলনবিশের দক্ষিণা বাবত সমস্ত খরচাপাতি সহ গ্রন্থপ্রকাশের যাবতীয় ব্যয়ভারও তিনি বহন করবেন। অতি বিনীত ভাবেই বিপিনবাবুর নিবেদন,
—দয়া করে এটুকু পুণ্য সঞ্চয় করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না আমাকে।