ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/১১
১১
মা নির্মাতাকে স্মরণ করে আজ সকাল থেকে অফিস ঘরে দপ্তর মেলে বসেছেন রায়বাহাদুর মশাই। এ কাজও করতে হচ্ছে—ইতিহাস প্রণয়ন। প্রয়োজনে সবাইকেই সব কাজ করতে হয়, এটা বুঝেছেন তিনি। বিদ্যাবিনোদের সাহচর্য তাঁকে একটা জিনিস শিখিয়েছে, সত্যের অনুসন্ধানে পেশা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনও প্রতিবন্ধক হতে পারে না। মূলত সংস্কৃত আর ইংরেজি বিদ্যা নিয়ে বিদ্যাবিনোদ মশাই এসেছেন সিলেট-কাছাড় আর কামরূপ অনুসন্ধানে। প্রয়োজনে তাঁকে লিখতে হচ্ছে অসমিয়া, বাংলা এবং ইংরেজি, বুঝতে হচ্ছে ফার্সি দলিলের ভাষা, রপ্ত করতে হচ্ছে আরবি হরফ। মাইবঙে গিয়ে মনে হল কাছারি অর্থাৎ হেড়ম্ব বা ডিমাসা ভাষাটা যদি রপ্ত করতে পারতেন ভালো হত। যেখানে যান সঙ্গে রাখেন ভূগোলের বই, মানচিত্র, অভিধান এবং কাব্য ব্যাকরণ গ্রন্থও। দেখা যাক্ রায়বাহাদুর ইউরোপীয় পাদ্রির কাছে ইংরেজি পাঠ, সিলেটের মধ্যবঙ্গ স্কুলের বাংলা বিদ্যা নিয়ে কতদূর এগোতে পারেন। তবে এখানে ভাষা আর অলংকার নয়, তারাকিশোরবাবুকে জ্ঞাতব্য তথ্যগুলো সাদামাটা ভাষায় জানিয়ে দেওয়া—এটাই প্রধান কাজ।
এত দিন মা কাকি জ্যেঠি পিসি এবং খুড়া জেঠা আর পুবের বাড়ির গুরু পরিবার কালাইনের দেশমুখ্যবাড়ির প্রাচীনদের মুখে যা শুনে এসেছেন সব মিলিয়ে কিছু ইংরেজি কিছু বাংলায় একটা খসড়া খাড়া করলেন। দেড়শো বছর পূর্বেকার স্বপ্নদর্শন উপাখ্যান, দেবীর আবির্ভাব, হেড়ম্ব রাজসভার খাসপুরে স্থানান্তর, বংশের আদিপুরুষ চান্দ লস্করের পুত্রের মন্ত্রিত্ব লাভ, এসব তো এক মহাভারত। সদর থেকে চড়ামূল্যে কিনে আনা এক দিস্তে বালি কাগজ বুঝি শেষই হয়ে যাবে।
মন্ত্রিত্ব লাভের পর মণিরামের দুশ্চিন্তা—খাসপুর রাজসভা কি শেষ পর্যন্ত মাইবঙের সঙ্গে সংযুক্তি মেনে নেবে? চারিদিকে তো উস্কানিদাতার অভাব নেই। মণিপুর, ত্রিপুরার সেনাদের বিচরণ তো রয়েছে। রাজ্যে কুকি, লুশাই, পেইতা নাগার আক্রমণ জনজীবনে ত্রাস সৃষ্টি করেই চলেছে। ওদিকে কোচ দেহান রাজবংশীরা পাহাড় ডিঙিয়ে কোচ রাজ্যে ফিরে যাবার আশা ত্যাগ করেছে। এখন কাছাড়ই তাঁদের নিজভূমি। এরা অবশ্য শান্তশিষ্ট, ক্ষেত-কৃষি, বনের মধুসংগ্রহ, শিকার নিয়ে আছে। কিন্তু অস্ত্র হাতে নিতে কতক্ষণ? বীর চিলারায়ের বীরত্বগাথা, সেনাপতি কমলনারায়ণ ওদের স্মৃতিতে জাগ্রত আছেন। এরা মনে রেখেছে কোচরাজা উদিতনারায়ণ, বিজয়নারায়ণ, ধীরনারায়ণ, মহেন্দ্র, রজত আর নরসিংহকে। কাছাড়ের মানুষ দেহান বিদ্রোহে নিহত এক কোচরাজার কথাও স্মরণে রেখেছেন, যাঁর পরই সিংহাসনে আসেন উদিতনারায়ণ। মণিরাম উজির চিন্তিত-অপুত্রক রাজা ভীমসিংহের কন্যা কাঞ্চনীর সঙ্গে যুবরাজ লক্ষ্মীচন্দ্রের বিবাহকে কি রাজবংশীরা মেনে নেবে? কাছাড়ের ব্রাহ্মণ কায়স্থ এবং মুসলমান জমিদার, মিরাশদাররাই বা দুই রাজ্যের সংযুক্তিতে মনেপ্রাণে সায় দেবেন?
প্রশ্নগুলো যে ভাবে মনে আসছে তিনি লিখে যাচ্ছেন। বেলা দ্বিপ্রহর গড়িয়ে যায়, ভিতর বাড়ি থেকে বার বার ডাক আসছে। এবার উঠতেই হবে। তবে সন্ধ্যা হওয়ার আগে আরও এগিয়ে না গেলে যে রাতের ঘুম নষ্ট হবে। গ্রামে কেরোসিনের বাতি এলেও বার্মা ওয়েল কোম্পানির লাল কেরোসিনে যতটা ধুঁয়া হয় আলো ততটা হয় না। আর কুপিলম্পের শিস সারা ঘরকে করে তোলে বিষাক্ত। বিপিনবাবু গিন্নিকে সন্ধ্যার জন্য রেড়ির তেলের প্রদীপ তৈরি করে রাখতে বলে স্নানে গেলেন।
একবার উঠে গেলে খেই হারিয়ে যায়। ইতিমধ্যে মাথার মধ্যে আরও অনেক প্রসঙ্গ এসেছে ভিড় করে। মনে হচ্ছে আরও একটু পিছনে যাওয়া প্রয়োজন। তারাকিশোরবাবু কতটা গ্রহণ আর কতটা বর্জন করবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। একবার কামিনীবাবুর সঙ্গে দেখা করলে হয়, কিন্তু তিনি নাকি ‘কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে’ যাচ্ছেন। ওদিকে রেলের কৌসুলি হয়েও তাঁকে এদিক ওদিক বিচরণ করতে হচ্ছে। আর কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্বও তাঁর উপর। কোন আক্কেলে আবার তাঁর ওখানে যাই ব্যক্তিগত কাজে? এসব ভেবেচিন্তে নিজেই আবার শুরু করলেন একটু পিছন থেকেই। সেই আহোম আক্রমণের সময় থেকেই। শুনেছিলেন ষোলশো আটাশ শকাব্দে আহোম সেনা মাইবঙ রাজধানী অধিগ্রহণ করলে মহারাজ তাম্রধ্বজ নারায়ণ আশ্রয় গ্রহণ করেন সমতল কাছাড়ে। সঙ্গে মহারানি চন্দ্রপ্রভা। কী ক’রে গড়ের ভিতর গ্রামে খড়ের ছাউনির নীচে তৃণশয্যায় অস্থায়ী রাজপাটে শুরু করলেন অনিশ্চিত যাত্রা এ প্রসঙ্গেরও অবতারণা করলেন। চান্দ লস্কর মাঝে মাঝে যেতেন মহারাজ সান্নিধ্যে। রাজ্যহারা মহারাজের খুব পছন্দের মানুষ এ ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তিটি। মহারানির আবার ছিল সংগীত কাব্য সাহিত্যে রুচি, ঈশ্বরে গভীর আস্থা। এই দুর্দিনেও ঘাস মাটি খড়কুটোর রাজসভায় এসে জুটলেন এক কবি। হৈড়ম্ব বংশীয় এ কবি শ্রীহট্টে ন্যায়শাস্ত্র, বৈষ্ণব-দর্শন পাঠ করে সে সঙ্গে বাংলায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করে কী করে এই কাছাড় ভূমিতে এসে পৌঁছালেন কে জানে। চান্দলস্করের সঙ্গে তার সখ্য হতেও সময় লাগল না। দুজনের নামের মধ্যেও রয়েছে মিল। একজন চান্দলস্কর, অপরজন চন্দ্রমোহন। প্রাচীন দিনের কথা তিনি ছন্দবদ্ধ বাক্যে গেঁথে শোনান। রাজ্যহারা দুটি প্রাণী তাই শুনে যান। দুর্বল মুহূর্তে নিজেদের প্রাণের কথাও বলেন মহারাজ তাম্রধ্বজ নারায়ণ।
বিপিনচন্দ্রের বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন এই মহারাজের পৌত্র কীর্তিচন্দ্র তাঁর পুত্র মণিরামকে নিজ পারিষদ হিসেবে গ্রহণ করেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত মণিরাম পৈত্রিক সূত্রে একই সঙ্গে শাক্ত এবং বৈষ্ণব মতের অনুগামী। কিন্তু আশেপাশে এমন কোনও দেবস্থান নেই, নেই কোনও প্রতিষ্ঠিত দেবতাও, সম্পদে বিপদে যার পদতলে দু’দণ্ড শান্তি লাভ করতে পারেন, ফিরে পেতে পারেন মনোবল। শুনেছিলেন কোন অতীতে, সহস্রাব্দ কাল পূর্বে এখানকার সুবঙ্গ বিষয়ায় এক অনন্ত নারায়ণের মন্দিরের কথা। কিন্তু উজিরের কোনও অনুচর অরণ্যসঙ্কুল পূর্ব তীরে কোনও মন্দির বা দেবস্থানের চিহ্নও খুঁজে পেল না। এমন সময়েই এ অভাবনীয় স্বপ্নদর্শন। ‘সদা বাসন্তী জ্ঞানচক্ষু উন্মিলনী সর্বমঙ্গলকারিনী’ দেবীর আবির্ভাব।
কী ক’রে কোনও এক মাঘী পূর্ণিমার দিন মহারাজার অনুমতি নিয়ে পাত্র মিত্র কূলপুরোহিত সহ নিমাতা পাহাড় থেকে দেবীর প্রতীকী এক পবিত্র প্রস্তরখণ্ডকে সমতলে নামিয়ে এনে প্রতিষ্ঠা করা হল—এ ইতিহাস লোকমুখে আজও প্রচলিত রয়েছে। সর্বজন স্বীকৃত এ ইতিহাসকে কী ক’রে জেলা আদালতে অস্বীকার করা হল এটাই রহস্য।
কোনও নিজস্ব মতামত আরোপ না করেই রায়বাহাদুর ঠিক যেমনটি শুনেছেন তেমনটিই লিপিবদ্ধ করলেন, যেমন পরামর্শ দিয়েছিলেন কামিনীকুমার চন্দমশাই। কলিকাতা যাবার আগে যদি পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ মহাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মূল নথিগুলো সংগ্রহ করা যেত! অবশ্য মুদ্রিত গ্রন্থে তিনি যে ভাবে সব ক’টি নথি সন্নিবিষ্ট করেছেন এটাকে অস্বীকার করাও বেশ কঠিন কাজ হবে। তবুও মহারাজের সনন্দ দু’খানির প্রতিলিপি করিয়ে নেওয়া চাই।