১০

নদীর তীরে চুন সুরকি ইট দিয়ে তৈরি একেবারে হেড়ম্ব স্থাপত্য শৈলীর আদলে গড়া একটি একচালা বিশিষ্ট মন্দির। এখানে প্রতিষ্ঠিতা দেবী নিমাতা। ঠিক নদীর অপর পারে প্রায় সমান্তরাল ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে দেবী রণচণ্ডী মন্দির। রাজ পরিবারের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত এ মন্দির অবশ্য একেবারে সাদামাটা। কাঁচা ঘরে দেবী-প্রতীকী একটি স্বর্ণ অসী পূজিতা হয়ে আসছেন। এ অসী অবশ্য মন্দিরের পূজারি ছাড়া আর কারও দেখার অনুমতি নেই। কাহিনি আছে হেড়ম্ব রাজ্যের এক দুঃসময়ে দেবী মহারাজকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে আদেশ করেন। তাঁর নির্দেশে মহারাজ নদীতে এক ভীষণদর্শন সর্পের সম্মুখীন হন। কথা ছিল যে সর্পের মস্তক স্পর্শ করলে প্রাপ্ত হবেন একটি দেবী মূর্তি। কিন্তু ভয়চকিত সম্রাট কোন মতে সর্পের লাঙুলে হাত ঠেকাতেই সক্ষম হলেন। প্রাপ্তি হল এ স্বর্ণঅসী। আশ্বাস পেলেন মহারাজ, রাজ্যে দেবীকল্প হিসেবে এ অসীই তাঁদের দুর্দৈব, যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে রক্ষা করবেন।

 বিপিনচন্দ্র শৈশব থেকে শুনে আসছেন এসব কাহিনি। লোকের বিশ্বাস, হরিটিকরে যে-অভিশপ্ত শেষ চৈত্র দিন ১২৩৭ বঙ্গাব্দে গুপ্তঘাতকের হাতে মহারাজ গোবিন্দচন্দ্রের মৃত্যু হয় ওই দিন দেবীর আশীর্বাদসূচক স্বর্ণ অসীটি অস্থায়ী রাজধানীতে ছিল না। গুপ্তচরের মুখে বিপদের সংকেত পেয়ে এ ঘটনার পূর্বদিনই রানি ইন্দুপ্রভা সহ অসীটি মহারাজা প্রেরণ করেন যাত্রাপুর গ্রামে। এই যাত্রাপুর থেকে কী ক’রে রণচণ্ডী স্থান পেলেন জাটিঙ্গার পুব পাড়ে সে অবশ্য অন্য ইতিহাস।

 আপাতত বিপিনচন্দ্রের প্রয়োজন নিমাতার ইতিহাস। এবং এ জন্য প্রয়োজন বিদ্যাবিনোদের সঙ্গে সংযোগ করা। কিন্তু এত শীঘ্র তো তা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর কাছে যে রয়ে গেছে কয়েকটি নথি। তবে তিনি যে কথা রাখেননি, তাও বলা যাবে না। নথিগুলোর নিখুঁত তৈলচিত্র, সে সঙ্গে আধুনিক হরফে এর বয়ান, সঙ্গে নিজস্ব ভাষ্য নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন ‘গৌহাটি বঙ্গসাহিত্যানুশীলনী সভা’র পক্ষ থেকে।

 নিমাতা মামলায় এ গ্রন্থের নথিগুলো প্রদর্শন করা যাবে কি? বিদ্যাবিনোদ কথা দিয়েছিলেন যে কাজ শেষ হয়ে গেলে মূল নথিগুলো ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু এত ধকলের পর নথিগুলো কী অবস্থায় আছে তাও ভাবনার বিষয়। দেখি, একবার কামিনীকুমার চন্দ মহাশয়ের সঙ্গে কি পরামর্শ করা যেতে পারে?

 ওদিকে কলিকাতা হাইকোর্টের কৌসুলি মান্যবর শ্রী তারাকিশোর চৌধুরী মশাই নিমাতা মামলার জন্য কিছু পারিবারিক নথি দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছু পারিবারিক শ্রুতি, গ্রামের প্রাচীনদের মুখে কিছু কাহিনি ছাড়া আর কোনও লিখিত প্রামাণিক তথ্য যা আদালতে গ্রাহ্য হবে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাদীপক্ষ মামলাটি সাজিয়েছে একেবারে ভিন্নতর ইতিহাসের উপর। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বংশের আদিপুরুষ মণিরামের বিপরীতে চান্দ খাঁ বলে পাটনি সম্প্রদায়ের এক কল্পিত পুরুষকে উপস্থাপন করেছে। এতদিন উর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ মণিরামকে এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হত। কিন্তু মামলায় দেখা গেল এ তথ্যকে একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রয়াস। এ অঞ্চলে পাটনি সম্প্রদায়ে কারও উপাধি খাঁ, এরকম কথা কেউ তো শুনেনি। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বিপিনচন্দ্র অসহায়ের মতো পারিবারিক নথিপত্র খুঁজে খুঁজে হায়রান। নায়েবমশাই বাঁশের চুঙির ভিতর গোল করে পাকানো একটার পর একটা দলিল বের করেই চলেছেন। মহামহিম সপ্তম জর্জ, মহারানি ভিক্টোরিয়ার ‘জিলে কাছাড়’ সিলমোহর দেওয়া ‘লিখিতমিদং কার্জঞ্চ’ ইত্যাদি পাঠসম্বলিত জমিবন্দোবস্ত, চিঠা, নকশা, পাট্টা, খাজনার নোটিশ, তুলোট কাগজের উপর হাতে লেখা বন্দোবস্তনামা দেখেই যাচ্ছেন। কিন্তু নিমাতা সংক্রান্ত কোনও নথি নেই। যে-উজির কমলচরণের বসতবাটিতেই দেবী মন্দিরের অবস্থিতি, এরও কোনও বস্তুগত প্রমাণ নেই। নিঃসন্তান কমলচরণ উজির যে তাঁর তালুক মা নির্মাতার নামে উৎসর্গ করে গেছেন, এরই বা গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রমাণ কোথায়? ওই তালুকটির অবস্থিতিই বা কোথায়? সত্তর আশি বছরের ব্যবধানে সব কিছু যে উলটপালট হয়ে গেছে।

 কামিনীবাবু ধীর মস্তিষ্কের মানুষ। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে বিপিনচন্দ্রের কথাগুলো শুনলেন।

 —দেখুন বিপিনবাবু, সত্য নিজে থেকে ধরা দেয় না। সত্যকে খুঁজে পেতে ধরে এনে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

 বলতে পারেন সত্যই ঈশ্বর, অনেক সাধনায় তাঁকে ধরা যায়, আবার যায়ও না।

 বালাধন মামলা বিজয়ী বিখ্যাত এ ব্যক্তির কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছেন না বিপিনচন্দ্র। ঈশ্বরতত্ত্ব শুনবার ধৈর্য আর মানসিকতা কিছুই তাঁর নেই।

 বিপিনবাবুর বিমূঢ় দশা দেখে কামিনীবাবু হেসে উঠলেন,

 —শুনুন জমিদারবাবু, আপনি যেমন তথ্যের অভাবে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন, আপনার প্রতিপক্ষ তেমনি ইতিমধ্যে অন্ধকারেই একটি ঢিল মেরেছেন। এবার আপনার মারার পালা। কতটুকু তথ্য আপনি সংগ্রহ করতে পেরেছেন, মানে কিছু তো পেয়েছেন, তাই না...?’

 —সে তো পারিবারিক কথা, মুখে মুখে প্রচারিত, কিছু কল্পকাহিনি।

 —আরে মশাই, যখন কোনও বস্তুগত ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, তখন লোকশ্রুতিই প্রামাণ্য সূত্র, অবশ্য যদি যুক্তির ধোপে টিকে। আর, আপনি যে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছেন, এ ঘাট থেকে খালি হাতে কেউ আসে না।

 বিপিনবাবু সিধা কথার মানুষ। এত উপমা দিয়ে বলা কথা বোঝার মানসিক অবস্থায়ও এই মুহূর্তে তিনি নেই। সুচতুর কামিনীকুমার চন্দ এবার স্পষ্ট করেই বললেন,

 —আমার বন্ধুবর তারাকিশোরের কথাই বলছি। কলিকাতায় আমরা একই মেসবাড়িতে থাকতাম। তাঁর সততা এবং মেধার পরিমাপ করাও দুঃসাধ্য। তিনি যখন মামলাটা হাতে নিয়েছেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপাতত আপনাকে বলে রাখি, আপনার প্রতিপক্ষের ঘটে এত বুদ্ধি নেই যে উচ্চ আদালতে তৈরি-করা একটি কাহিনিকে ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এ যাবৎ যে কাহিনিটি আপনি আমাকে শোনালেন এটাই সাদামাটা ভাষায় লিখে পাঠিয়ে দিন। যতটুকু পেয়েছেন, ঠিক ততটুকুই। যা পাননি, তা নিয়ে চিন্তা করলে যা পেয়েছেন তাও হারাবেন। সন্ধানকারীকে কেউই সিন্দুক খুলে তথ্যপাতির যোগান দেয় না। আর বলে রাখি, সত্যের সূত্র সিন্দুক বা ফাইলপত্রে লুকিয়ে থাকতে পারে না, তার থাকে অজস্র ফাঁক-ফোকর। আর হ্যাঁ, বিদ্যাবিনোদের এই যে বই ‘হেড়ম্ব রাজ্যের...’ কী যেন নাম, এর দুই কপি জমা দেবেন। পারবেন তো?

 — আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি এ বইয়ের প্রকাশকও বটে।

 —তা হলে পারিশ্রমিক হিসেবে একটি বই আমি পেতেই পারি? শুনেছি বানিয়াচঙের মহামহোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব।

 —না, না, ঠিক তা নয়। ইনি অনেক উঁচু স্তরের মানুষ। আমি তাঁর বন্ধুত্বের দাবিদার হতে পারি না, তাঁর গুণমুগ্ধ সহযোগী মাত্র।

 —এ আপনার বিনয়। কাছাড়ের জমিদারদের এটা একটা মহৎ গুণ। এদের লাঠিয়ালবাহিনী নেই, আছে বিনয়।

 বিপিনবাবুর মুখে মুচকি হাসি। তার সদ্যোজাত পুত্রের নাম যে বিনয় এ কথাটা মুখে এলেও বলতে পারলেন না ।

 এত ব্যস্ত আইনজীবীর আজ যেন কোনও তাড়া নেই। ভিতর বাড়িতে চা মিষ্টির আয়োজন হয়েছে। বিপিনবাবুর মনটাকে হালকা করার জন্য তিনি পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদের খ্যাপামো নিয়ে কিছু প্রসঙ্গের অবতরণা করে বসলেন। ইনি নাকি স্বামী বিবেকানন্দকে দু’চোখে দেখতে পারেন না? নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গৌহাটিতে সংবর্ধনা জানাতেও তাঁর প্রবল অনীহা। গৌহাটির অসমিয়া আইনজীবীরাও নাকি এ নিয়ে বিদ্যাবিনোদের উপর ক্ষুব্ধ। ইনি নাকি শেখ ব্রাদার্সের রুটি খাওয়ার অপরাধে নিজ পুত্রকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। বিপিনবাবুর কথা নয়। দু’একটি সৌজন্যমূলক কথা বলে তিনি বিদায় নিলেন প্রসন্ন চিত্তে। কাল সকালেই দপ্তর মেলে বসতে হবে।