১৩

বিপিনচন্দ্রের কলিকাতা যাত্রা প্রস্তুতি প্রায় শেষ। শুনেছেন ইতিপূর্বে তাঁর পিতামহ ভবানীপ্রসাদও মহারানি ইন্দুপ্রভা মামলায় কলিকাতায় কোম্পানি সকাশে হাজিরা দিয়েছিলেন। সদর মুন্সেফ আদালতের চৌহদ্দি পেরিয়ে এবার উচ্চতর আদালতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যে কী হবে এসব ভেবে ভেবে গোছগাছ শুরু করলেন। অবশ্য এবার তিনি মোটামুটি নিঃসংশয়। প্রথমবারের যাত্রার মতো এবার তেমন অনিশ্চয়তা বা অজানা আশঙ্কা আর নেই।

 তারাকিশোর চৌধুরী মহাশয় একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। তদনুযায়ী নথিপত্র সব কাপড় দিয়ে বেঁধে যথাস্থানে রাখা হল। সঙ্গে যাচ্ছে বিশ্বস্ত অনুচর অঘোর রাম। নায়েব রইলেন বাড়ির দায়িত্বে। তিনটি প্রমাণ সাইজের কাপড়ের খুতিতে কাঁচা টাকা বোঝাই হল। প্রাণ থাকতে অঘোরের হাত থেকে এগুলো কেউ নিতে পারবে না। কাগজের নোটগুলো অবশ্য বিপিনবাবুর ব্যক্তিগত চর্ম পেটিকায়। প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় ছাড়াও দুই প্রস্ত সৌখিন পোশাক গেল সঙ্গে।

 শুভক্ষণ দেখে পুবের বাড়ির খুড়ো মহাশয়কে প্রণাম দিয়ে দুর্গা স্মরণ করে যাত্রা করলেন বিপিনবাবু। নৌকায় উঠার আগে দেবী নিমাতার মন্দিরে প্রণাম করে যেন অভিমান ভরেই কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মন্দিরের বন্ধ দরজা খুলে দিতে কেউ এগিয়ে এল না। বোধহয় সঙ্কোচ বশতই পুরোহিতবাড়ির ওঁরা এল না। তাঁর কলিকাতা যাওয়ার কথা ওঁদের না জানার কথা নয়। তবে আত্মভোলা বিশ্বেশ্বর পণ্ডিত এসব মামলা মোকদ্দমার কিছুই জানেন না। জগমোহনবাবুর অতি ঘনিষ্টজন এ বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর পুত্রের কাণ্ডকারখানা দেখে নিতান্তই লজ্জিত। কিছুদিন যাবৎ দেবীর অধিকার নিয়ে গ্রাম জুড়ে কী সব কানাঘুষা শুনতে শুনতে বাড়ির এক বধূ কদিন থেকে কেমন যেন বিমনা হয়ে আছেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর মধ্যে উন্মাদনার লক্ষণও স্পষ্ট হচ্ছে। তবে কি পরিবারের উপর কোনও বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে?

 কলিকাতায় পৌঁছে গায়ে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া লাগতেই রায়বাহাদুরের অবসন্ন দেহটা কেমন সতেজ হয়ে উঠল। ভাড়া করা বাড়িতে সব সুবিধাই হয়ে গেল। বাড়ি থেকেই স্থির করে এসেছেন দেবী কালীমাতাকে দর্শন না করে কোনও কাজ শুরু করবেন না। বাড়ির ছোট বড় সবাই’ই এ কথাটি বার বার মনে রাখতে বলেছেন। স্নান সেরে অনুচর সহ চললেন কালীঘাটের উদ্দেশ্যে।

 হাইকোর্টের কৌসুলী তারাকিশোরবাবু তাঁর বিশেষ মক্কেল রায়বাহাদুরকে আসতে বললেন উত্তর কলিকাতার বাড়িতেই। দেশের মানুষের সঙ্গে কোর্ট নয় বাড়িতেই কথাবার্তা বলেন তিনি। তাছাড়া বন্ধুবর কামিনীকুমার গ্রাম কাছাড়ের এ বিশিষ্ট ব্যক্তির সবিশেষ পরিচয় দিয়ে একখানা নাতিদীর্ঘ পত্রও লিখেছেন ইতিমধ্যে । স্কুল ছাড়ার পর থেকেই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাওয়ায়, সম্প্রতি পিতৃদেবের ক্রোধ প্রশমিত হওয়া সত্ত্বেও দেশবাড়ির খবরাখবর নেওয়া আর হয়ে উঠছে না। ছাত্রজীবনের প্রথম পর্বে কলিকাতায় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করার খবর সিলেটে পৌঁছালে তাঁর পিতা প্রচণ্ড ক্রোধবশত পুত্রকে নাকি মা কালীর পায়ে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, এরকম একটি কথা তখন লোকমুখে প্রচারিত ছিল। বিপিনবাবু অবশ্য অতশত ব্যাপার জানতেন না। তবে দেশের মানুষ পেয়ে তারাকিশোরবাবু নিতান্তই উচ্ছ্বসিত। একটু আবেগতাড়িত হয়ে তিনি অনেক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও উত্থাপন করে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন।

 চা-পর্ব শেষ করেই তিনি দপ্তর মেললেন। ইতিপূর্বে প্রেরিত সমস্ত নথি, চিঠি, নিমাতাবাড়ি সংক্রান্ত কাহিনির বয়ান, যা রায়বাহাদুর ডাকযোগে পাঠিয়েছিলেন সবই নিখুঁতভাবে ফাইলবন্দি করে রাখা আছে। এখান থেকে একটা একটা করে টেনে বের করে চোখ বুলাতে বুলাতে তিনি দু’একটা সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করছেন এবং পাশে বসা মুহুরিকে নোট নিতে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন।

 —আচ্ছা, বলুন তো, যে প্রচলিত কাহিনির বয়ান আপনি লিখে পাঠিয়েছেন এটাকে অবিশ্বাস করার কোনও সঙ্গত কারণ আপনার নিজের মনে কি আসছে? স্বপ্নদর্শনের ব্যাপারটি অবশ্য স্বাভাবিকভাবে আদালতে গ্রাহ্য হতে পারে না যদি না এর মধ্যে বাস্তবতার কোনও সংকেতসূত্র থাকে। আমাদের এই সংকেতসূত্রটি খুঁজে বের করা চাই। দেখা যাক দেবীর কী ইচ্ছা।

 এবার রায়বাহাদুরের কপালে দেখা দিল চিন্তার রেখা।

 —আজ্ঞে, এখানে মণিরামের স্বপ্নদর্শনের সঙ্গে যে মহারাজ হরিশ্চন্দ্রের স্বপ্ন...।

 —ও হ্যাঁ, দুইটি স্বপ্নের সংঘাত। এরকম স্বপ্নের কাহিনি আরও বহুক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে। আর ওই শ্বেত হস্তী উদ্ধারের ব্যাপারটা হৃতরাজ্য ফিরে পাবার প্রতীকীও হতে পারে। আমি খতিয়ে দেখছি এই স্বপ্ন দেখাটা কার বেশি জরুরি ছিল—রাজা না উজির মণিরামের? বিশেষ করে ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এর পরই ঘটনার সত্যাসত্য নির্ধারণের প্রশ্ন।

 তারাকিশোরবাবু উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে বলছেন,

 —স্বপ্নলব্ধ মহৌষধ, স্বপ্নলব্ধ মহামন্ত্র, স্বপ্নলব্ধ তাবিজ। বলুন তো এ সব স্বপ্ন কারা দেখে? আমি আপনি, সাধারণ সংসারী মানুষ তো ওসব দেখে না। যাঁর প্রয়োজন, সে-ই দেখে।

 আবার চেয়ারে এসে বসে শুরু করলেন,

 —কোনও কবিরাজ, ওঝা ছাড়া কোনও রাজমিস্ত্রি কি স্বপ্ন দেখে কোনও মহৌষধের সন্ধান পেতে পারে বা পেয়েছে? দাঁড়ান, স্বপ্ন দেখার দলে যে বৈজ্ঞানিকও আছেন। তবে বলি জর্মান বিজ্ঞানী অগাস্ট কেকুলে ভিন্ন অন্য কেউ তো আর Chemical structure-এর ফর্মুলা স্বপ্নে পেতে পারেন না। বাস্তবিক কথাটি হল, তিনি নিজ অধ্যবসায়েই এ ফর্মুলাকে আয়ত্বে আনার কাজ শেষ করে এনে রেখেছেন। এখানে স্বপ্ন আসলে স্বপ্ন নয়, জাগরণেরই একটি স্তর মাত্র। তবে এ বিষয়টি আরেক জর্মান মনীষী সিগমণ্ড ফ্রয়েড সাহেবের এক্তিয়ারে। আমার নয়।

 এতগুলো কথা এক নাগাড়ে বলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন তারাকিশোরবাবু।

 —আমরা আগামী শনিবার কি এ নিয়ে আরেকবার বসতে পারি? আপনি তো যা বলার বলেছেন, যা জানাবার জানিয়েছেন, যা দেবার জমা দিয়েছেন । এখন ভাবনা বলুন, দুর্ভাবনা বলুন সব আমার। দুটো দিন আপনি বিশ্রাম নিন, একটু ঘুরে ফিরে কলিকাতা মহানগরীকে দেখে যান।

 তিনদিন পর আইনজীবীর বৈঠকখানায় দু'জনের সাক্ষাৎকার। আজ তারাকিশোরবাবু পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

 —দণ্ডবিধি বইখানাই তো আপনাকে এগিয়ে দিল মশাই। যে দু’খানা সনন্দ আছে এতে—।

 —কিন্তু মূল নথি যে আনতে পারছি না, আপাতত হাতের নাগালের বাইরে। পদ্মনাথবাবুর কাছে রয়ে গেছে।

 —আরে রাখুন তো মশাই, সর্বজনমান্য ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ববিদের Introduction, সঙ্গে একাধিক সুস্পষ্ট দৃষ্টিগ্রাহ্য ফটোগ্রাফ, মূল টেক্সট এবং পরিশিষ্ট নিয়ে সুসম্পাদিত এ গ্রন্থের প্রকাশক, মুদ্রক, পরিবেশক— সবারই গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।

 বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে তারাকিশোরবাবু বলেন,

 —আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। অনেকদিন পর একটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষর সঙ্গে লড়াইতে নামছি। অবশ্য প্রতিপক্ষ প্রথম চালেই কুপোকাত হবে।

 তিনি বিপিনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন,  —আপনি রাজকীয় সনন্দটি কি খতিয়ে দেখেছেন? দেখুন ‘চান্দ লস্করের বেটা মণিরাম’।— বাদী পক্ষ একটা কাল্পনিক সত্তাকেই যখন খাড়া করেছে মণিরামের প্রতিপক্ষ হিসেবে, তখন চান্দ খাঁ ই বা কেন? বুদ্ধিমান মানুষও মোক্ষম সময়ে একটা ফাঁক রেখে দেয়। আমরা জানি সিলেটে খাঁ উপাধি থাকলেও গ্রাম কাছাড়ে, তাও আবার পাটনি, নমশূদ্র সমাজে এ উপাধি নৈবঃ নৈবঃচঃ। আর এ সনন্দে স্পষ্টভাবে বড়ভুইঞা, মজুমদার উপাধিধারী মিরাশদারের উল্লেখ রয়েছে। এ এলাকায় এর বাইরে আর কোনও মিরাশদার জমিদারের অস্তিত্ব থাকার কথাই নেই। চান্দ খাঁর পিতৃপরিচয়ও অস্পষ্ট, লেখা হয়েছে ‘সাকিন কাছাড়’, এটা তো আরও অস্পষ্ট।

 একেবারে শিশুর সারল্যে তারাকিশোরবাবু বলে উঠলেন,

 —বিপিনবাবু, আপনি বাড়ি যেতে পারেন। যথা সময়ে মামলার রায় আপনার হাতে পৌঁছে যাবে।

 এ মামলাকে কেন্দ্র করে রায়বাহাদুর বিপিনবাবুর অভিজ্ঞতার দিগন্ত নানা দিকে বিস্তার লাভ করল। তিনি ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, লিপি, ভাষা ইত্যাদি বিষয়েও অনেক ব্যুৎপত্তি লাভও করলেন, অন্য অবস্থায় যা হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। এখানেই মা নিমাতার আশীর্বাদ। জ্ঞানচক্ষু উন্মিলনী সর্বমঙ্গলকারিনী এ দেবীকে শত কোটি প্রণাম। নিজ নিজ স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী ভক্তেরা তাঁকে নিমাতা, নির্মাতা বা নৃমাতা যে নামেই ডাকেন না কেন তিনি কাউকেই বিমুখ করেন না।