১৪

দীর্ঘদিন মামলা মোকদ্দমা, আর আনুষঙ্গিক পুরাতত্ত্ব, প্রত্নলিপি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ফলে জমিদারির দিকে এবং মৌজার দিকে নজর দেওয়া হয়ে ওঠেনি বিপিনচন্দ্রের। এ সুযোগে অতি বিশ্বাসী আর সুযোগসন্ধানী সেরেস্তার কর্মীদের আতিশয্য এবং অপকর্ম যে তাঁর নজরে আসেনি তা নয়, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে এ সব উপেক্ষা করে গেছিলেন। ক্ষেত কৃষির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন কমার ফলে খাজনা আদায় প্রায় হয়ইনি। প্রজাদের হাতে উদ্বৃত্ত ফসল না থাকলে খাজনা দেবেই বা কী করে? ফসলের গুণগত মানও কমে গেছে। আর আউশ ধান করলে শাইল উরা তৈরি করতে করতে বছর চলে যায়। কৃষকেরা গোবর সার ছাড়া আর কোনও সার প্রয়োগের কথা ভাবতে পারে না। পচন এবং খৈলের প্রয়োগে উৎসাহিত করার কথা বলে গেলেও কেউ বিশেষ গা করেনি। পূর্বপুরুষের আমলের কালিজিরা, কালি মেউকরি, কাছালো, ধলা আছরা, ঠাকুর ভোগ, সোনা আছরা, সোনামুখি, হরিনারায়ণ, ভেড়া পাওয়া, নানা জাতের বিরইন এগুলো আলাদা আলাদা করে সংরক্ষণ না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি হাতে গুণে দেখলেন পঞ্চাশ ষাটটি নাম তো এখনই বলতে পারবেন। কতদিন ভেবেছেন অ্যাগ্রিকালচার ইন্সপেক্টেরের সঙ্গে কথা বলে নতুন কিছু একটা করবেন। সাহেবের উৎসাহও খুব। লক্ষীপুরের মণিপুরি কৃষকদেরও উৎসাহ আছে এদিকে খুব। তবে এবার যে একটু প্রজা, ক্ষেত জমিজমার দিকে নজর দেবেন তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় বিপিনচন্দ্রকে নিতে হল লোক্যাল বোর্ডের সদস্য পদ। সাহেবসুবার প্রতি খুব একটা মুগ্ধবোধ না থাকলেও এদের সঙ্গে চলাফেরা বেড়ে গেছে। ভূমি রাজস্ব আধিকারিক, দেশীয় সেলম্যাণ্ট অফিসার, ফৌজদারি দেওয়ানি কোর্টের হাকিম, মুনসেফ এমনকি ডেপুটি কমিশনারের দপ্তরে তাঁর পরামর্শ অপরিহার্য হয়ে উঠল। তিনি চোখের সামনে একটা পরিবর্তন লক্ষ করতে থাকলেন। প্রাচীন দিনের খোলস ছেড়ে একটা নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, এবং সংস্কারমূলক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নিজের জড়িত হয়ে যাওয়াটা প্রত্যক্ষ করে এক ধরনের পুলক অনুভব করলেন।

 এরই মধ্যে কমিশনারের পরামর্শে যেতে হল ভুবন পাহাড়ে গুহামন্দির পরিদর্শনে। তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে কিছু সংস্কারমূলক কাজের জন্য বরাদ্দ অর্থের কী সদ্‌ব্যবহার করা যায় এ জন্যেই এ অভিযান। মতিনগর গঙ্গানগর গাছের শিকড় বাকড় আঁকড়ে ধরে ঝোপ ঝাড় কাঁটা বন পেরিয়ে পেরিয়ে পাথুরে রাস্তায় প্রাণ হাতে করে গুহামন্দিরের সামনে পৌঁছোলে যাত্রীদের একমাত্র ভরসা যে একটা অগভীর জলাশয়, এর জলও অপেয়। ভক্তরা তা’ই আজলা ভরে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন এবং দেবাদিদেব মহেশ্বরের মাথায় বেলপাতা সহ ঢেলে দিয়ে নেমে আসেন। পুকুরটাকে সারানোর কাজে শ্রমিক লাগিয়ে শিবচতুর্দশীতে তীর্থযাত্রীরা যাতে একটা নির্দিষ্ট পথের দিশা পান এ কাজ শুরু করলেন। ভেঙে যাওয়া মেলমণ্ডপটির মেরামতের কাজও নিজের হাতে নিলেন। ভুবনের বিস্তারিত কথা নাকি বর্ণিত হয়েছে সাব ইন্সপেক্টর সাহেবের ইতিহাস গ্রন্থে। সদরে এসে দেখা করতে হবে লেখক উপেন গুহ মহোদয়ের সঙ্গে, যদি এ তীর্থ সম্বন্ধে কোনও বিশেষ তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

 ভুবনতীর্থের অনেক রহস্যই অজানা থাকত যদি উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ মহোদয়ের সঙ্গে বিপিনচন্দ্রের সাক্ষাৎ না হত। তিনি জানালেন এ গুহামন্দির নাকি হাজার বছরেরও প্রাচীন। এখানকার দশ বারোটি সুড়ঙ্গ যে কোন দিকে গিয়ে মিলেছে কেউ বলতে পারে না। সাধু সন্ন্যাসীরা নাকি এখানে বছরের পর বছর সাধনা করে কাটান। শোনা যায় মহাবিদ্রোহের সময় সিপাহিরা নাকি এ গুহাগুলোতে আস্তানা গেড়েছিলেন। তিনি আরও জানালেন এখানে কিছু কিছু কুকি জনজাতীয়দের অঙ্কিত গুহাচিত্রও রয়েছে। কয়েকটি পাথরের ভগ্নমূর্তিও ওখানে রয়েছে যেগুলো সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণেরও প্রয়োজন, এ কথাটিও তিনি রায়বাহাদুরকে মনে করিয়ে দিলেন। তিনি আরও জানালেন কাছাড়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই নাকি এ লুপ্ততীর্থের সন্ধান মেলে।

 —এ কাহিনির কিছুটা আপনি মৎপ্রণীত ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’গ্রন্থখানিতে দেখতে পারেন।

 রায়বাহাদুরের হাতে ইতিপূর্বে গ্রন্থখানি পৌঁছে গেছে, কিন্তু খুলে দেখা আর হয়ে ওঠেনি। তবে স্বয়ং ঐতিহাসিকের মুখে এর বর্ণনা তাঁকে রীতিমতো রোমাঞ্চিত করে তুলল। কী করে মণিপুর রাজ মধুচন্দ্রের কন্যা ইন্দুপ্রভার অনুরোধে শৈবতীর্থ সন্ধানকল্পে যাত্রা করে সচিব জয়সিংহ বার্মা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে উপস্থিত হলেন সোনাপুরের চন্দ্রগিরিতে এবং মন্দির নির্মাণ প্রতিষ্ঠা করলেন ভুবনেশ্বর শিব মহাদেবকে।

 —মন্দিরটি এখন সংস্কারের অভাবে জীর্ণ, কিন্তু দু’খানা প্রস্তরলিপি আজও অক্ষত রয়েছে। আমি স্বয়ং পায়ে হেঁটে মন্দির দর্শন করতে গেছি এবং দু’খানা লিপির বয়ান নকল করেও এনেছি। আপনি ‘ইতিবৃত্তে’ পাবেন।

 রায়বাহাদুরের মনে পড়েছে এ ঐতিহাসিক তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে একবার গিয়েছিলেন। রাজা ইশকুলের কোনও একটা বিষয়ে সরকারি কাজেই ওই যাওয়া। তখনই তিনি মহারাজ কীর্তিচন্দ্রের সনন্দখানা দেখতে চেয়েছিলেন। তবে দেখা হয়ে ওঠেনি এ কথাও তিনি তাঁর বইতে উল্লেখও করেছেন। একটা বিষয়ে তাঁর মনে খটকা লাগছে। পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ এবং অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি দুজনে একই বিষয়ে একই সময়ে কাজ করে গেছেন, বইও লিখেছেন, কিন্তু মনে হল এরা উপেনবাবুকে চেনেনই না।

 —আমার তো ঢাকা জেলার লোকটিকে চমৎকার লাগছে। একটু টানা সুরে কথা বলেন ধীরে ধীরে। আমাদের কাছাড়বাসীর কাছে সবই সমান।

 বিপিনচন্দ্রের মনে একটা খটকা লাগল।

 —তবে ওসব বিদ্বান, পণ্ডিতদের ব্যাপার, আমার এতে কিছু বলার নেই।

 খুব সুচতুর ভাবে পদ্মনাথ প্রসঙ্গ এড়িয়েই তিনি আলোচনা করে গেলেন। উপেনবাবু একেবারে গুরুমশাইয়ের মতো মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ সংস্কৃত লিপির বয়ানটি উচ্চারণ করে জানালেন এরই মধ্যে একটা astrological puzzle আছে যার সমাধান করেই তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ তিথি নক্ষত্র বের করতে পেরেছেন।

 গুহমশাইয়ের আজ আর কোনও তাড়া নেই। ইতিপূর্বে যে মানুষটির কাছে পেয়েছিলেন উপেক্ষা, আজ এ ব্যক্তির বিনম্র আচরণ দেখে তাঁর মনের ভিতর জমানো পুরনো অভিমান ফুৎকারে উড়ে গেল। শিক্ষকের মতোই তিনি একটুকরো কাগজ টেনে নিয়ে দুর্বোধ্য কথা ক’টি লিখে রায়বাহাদুরের সামনে তুলে ধরে বললেন,

 —প্রস্তরলিপিতে উৎকীর্ণ এ কথাটির আপাতদৃষ্টিতে কোনও অর্থ হয় না-‘খেটাম্বর নগেন্দু শাকে ভানু স্থিতে মন্মথ রাশৌ পূর্ণমিতি’।

 পদ্মনাথ সান্নিধ্য বিপিনবাবুকে পণ্ডিতদের ধরন ধারণ সম্বন্ধে সচেতন করে রেখেছে ইতিপূর্বেই। তিনি নিবিষ্ট মনে বোঝার চেষ্টা করছেন।

 —এ শব্দগুলোকে এ ভাবে সাজানো যাক—প্রতি শব্দের corresponding একটা করে গাণিতিক সংখ্যা রয়েছে—

 খেট: = ৭, এতে আছে সপ্তরথির অনুষঙ্গ

 অম্বর = ০ মহাশূন্য আকাশ

 নগ = ৭ সপ্ত পর্বতের অনুষঙ্গ

 ইন্দু = ১ চন্দ্র তো একমোবদ্বিতীয়ম।

 রায়বাহাদুরের মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছে। তবে গুহমশাই পরিবেশ হাল্কা করে দিলেন,

 —দেখুন তো কত হল? ৭০৭১। আপনাদের জমিদারির হিসাবে কী হয় জানি না, তবে এখানে আর্য্যাটি হল ‘অঙ্কস্য বামা গতি’। অবশ্য বাকিজায়ের খাতায় করলে সমূহ ক্ষতি। তবে এখানে করলে পাবেন ১৭০৭ শকাব্দ (শাকে)।

 রায়বাহাদুরের তো চক্ষু চড়ক গাছ। তবে তিনিও চমক দেখালেন। কলমটি কেড়ে নিয়ে সংখ্যাটির সঙ্গে ৭৮ যোগ করে বলে উঠলেন ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ। জমিদারির দলিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে গিয়ে এটা তাঁকে করতে হয়। সাহেবদের আদালতে সন তারিখগুলোকে অহরহ খ্রিস্টাব্দে রূপান্তরিত করে দিতে হয়। গুহমশাই বাকি কথাটিও শেষ করে দিলেন,

 —এটাও আপনার জানা থাকতে পারে যে সূর্য আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে মন্মথ রাশিতে স্থিত হয়। এখানে বলা হয়েছে ‘ভানুস্থিতে মন্মথ রাশৌ’। ওই নির্দিষ্ট দিনটিতেই মন্দির নির্মাণকার্য ‘পূর্ণমিতি’ অর্থাৎ সম্পূর্ণ হয়েছে।

 বিপিনচন্দ্রের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করছে। সেই পণ্ডিত পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ আসার পর থেকে তিনি যে দিকে যান, যেদিকে তাকান ইতিহাসের সূত্রগুলো এসে ভিড় করে। এরকম চলতে থাকলে জমিদারি চালাবেন কী করে? ওদিকে সরকার থেকে তাঁর কাছে একের পর প্রস্তাব আসছে। লোক্যাল বোর্ডের কিছু দায়িত্ব তো নিজেই আগ বাড়িয়ে নিয়ে বসে আছেন। কমিশন-ভিত্তিক মৌজাদারির দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাবও এসেছে। বনরাজ সোনাপুর এবং লক্ষীপুর পরগনার রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা প্রশাসনিক দায়িত্বও এসেছে।

 আবার এদিকে পারিবারিক দায়িত্বও বাড়ছে। বৃহৎ পরিবারটির যে দুইটি শরিক রয়েছে গ্রামে, এর মধ্যে অনেক বিভাজন। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা, তালুক বিভাজন ছাড়াও সরকারি খাতায় নামভুক্তি, দ্বিতীয় রি-জরিফা এসব নিয়ে জটিলতা ক্রমেই বাড়ছে। মণিরাম থেকে নীচে পাঁচ পুরুষ অতিক্রান্ত বর্তমান অর্থাৎ ষষ্ঠস্তরে আসতে আসতে “পূর্বে বৈল্যা হাওর ও আভঙ্গ, পশ্চিমে তাহিরর পশ্চিম সীমানা, উত্তরে পানিঘাট আর দক্ষিণে বড় বরাক” —রাজসভা নির্ধারিত জমিদারির এই চৌহদ্দিতে বিগত দুইটি শতাব্দীতে প্রকৃতির খেয়ালে এবং মানব সৃষ্ট কারণেও বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। বৈল্যা হাওরের সীমানাও একদিকে সংকুচিত হয়ে অপর দিকে বিস্তার লাভ করেছে। বড়-বরাকও বিশাল অজগর সাপের মতো তার গতিপথ এদিক ওদিক পালটে তীরবর্তী জমি, গ্রাম গ্রাস করেছে, কোথাও আবার সৃষ্টি করেছে বিস্তীর্ণ চরাভূমি। গত পঞ্চাশ বছর আগেও মণিরামের মোট আট ভ্রাতার মধ্যে চার জনের স্বতন্ত্র বসতবাটির অস্তিত্ব সনাক্ত করা সম্ভব হত। কিন্তু এখন সব বিলুপ্ত হয়ে সাকুল্যে দুইটি বাড়িই বহাল রয়েছে, পবের বাড়ি আর পশ্চিমের বাড়ি, অনেকে বলে ‘ওবাড়ি’ আর ‘হবাড়ি’। নদীর ওপারে মজুমদার বাজার, বড়যাত্রাপুর, বিক্রমপুর কিংবা বিহাড়া কালাইনে যারা বসতি করেছেন পাঁচ পুরুষের দূরত্বে এদের সঙ্গে পারিবারিক সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। একটি পরিবার নাকি ধর্মান্তরিতও হয়েছে, দুইপুরুষ পর সামাজিক প্রথায় এদের সঙ্গে জন্মমৃত্যু বিবাহের সংবাদ আদান প্রদানও আর নেই। বিস্তৃত জমিদারি নানা ভাগে বিভক্তও হয়েছে। জেলা সদরে ভকিল, মুহুরিদের কারসাজিতে কোন্ জমি কোন্ দিকে হস্তান্তরিত হয়েছে, কোন্ পাট্টা কার যোগসাজসে কোন্ দাগ নম্বরে সামিল হয়েছে, উকিল মোক্তার আর পেয়াদার চক্রান্তে কোন্ বে-আইনি কাগজে সরকারি মোহর পড়েছে এর হিসাব রাখা একজনের কর্ম নয়।

 জনা কয়েক গোষ্ঠী সম্পর্কিত বৃদ্ধ জেঠা জেঠি খুড়া খুড়ি আর তিন কনিষ্ঠ ভ্রাতা, সঙ্গে একদল ভগ্নি নিয়ে বৃহৎ পরিবারে সচল সক্ষম উদ্যোগী পুরুষ বলতে তো মাত্র একজনই। রাতে বালিশে মাথা দিলে আজকাল বিপিনচন্দ্রকে হাজারটা চিন্তা একসঙ্গে এসে চেপে ধরে। গ্রামের পশ্চিমে বন কেটে বসতি গড়ে উঠেছে, শাইল উরার বিস্তারও ঘটেছে বিগত শতাব্দীগুলোতে। হাতির পালের আনাগোনা নেই, তাই খেদার কর্মীরা লাঙল নিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে, কালো কুচকুচে লম্বা শিং-ওয়ালা স্থানীয় বাঙ্গড় প্রজাতির মহিষ ছাড়াও এরা পেয়েছে গলায় লাল দাগ টানা পাহাড়ি আর আবছা বাদামি রঙের মণিপুরি মহিষ, পেক কাদায় খুব স্বচ্ছন্দ না হলেও বাউশ উরা আর ধান মাড়াইয়ের কাজে এরা দক্ষ। সিলেট-বদরপুর হয়ে কাটিগড়া পেরিয়ে এল মাহিষ্য সম্প্রদায়, জৈন্তাপুর থেকে এল বাশঁবেতের কর্মী, ঘরামি, হাতুড়ি বাটালির কাজে দক্ষ সূত্রধর সম্প্রদায়, লোহা, রাঙ গলিয়ে ঘটি-বাটি লেম লণ্ঠন ঝালা দেওয়ার মিস্ত্রি, ঠাটারুরা খুলে বসল কারখানা। ডিমারাজ্য থেকে এল আরেক শ্রেণি, চেহারায় জনজাতীয়ের ছাপ, মুখে বাঙ্গালী বুলি, ধর্মে মুসলমান। গ্রামের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে এরা ঘর বেঁধে বসতি করল। যাঁরা মাঠে গেল না এদের একদল নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিল, আরেক দল পাতাখাউরি দেবী আর মা নিমাতাকে প্রণাম জানিয়ে বাঁশ কাঠ আর আগর গাছের সন্ধানে ঢুকে গেল গভীর অরণ্যে। হেড়ম্ব রাজসভার কৃপাধন্য বড়ভুইয়াঁর বেটা, মজুমদারের বেটা আর চৌধুরীর বেটাদের উত্তরসূরিরাও নিজ সাধ্যানুযায়ী মিরাশের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

 নানা ব্যস্ততার মধ্যেও বিপিনচন্দ্র সঙ্গী নিয়ে পায়ে হেঁটে নিজ জমিদারির এলাকাসহ উত্তর পূর্বে চা-করদের এলাকার সীমা ঘুরে দেখতে বেরোলেন। কাছারি আর মণিপুরিদের ঘরবাড়ি দেখে তিনি খুব তৃপ্ত। এত পরিপাটি করে বাঁশ বেত আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর, প্রতিটি বাড়িতে মেয়েরা বসিয়েছে তাঁত, পুরুষেরা আম জাম কাঁঠাল আর কলাবাগান দিয়ে বাড়ি সাজিয়েছে। দুটো নাটমন্দিরের ভিত্তি দেওয়া হয়েছে দেখে তিনি সেরেস্তা থেকে পাঁচ টাকা করে অনুদানও দিয়ে এলেন। আরও খুশি হলেন পশ্চিমাঞ্চলে নাথযোগীদের গ্রামে গিয়ে। হাতে চাটাই পাঠশালায় যাওয়া বাচ্চা দেখে তিনি যারপরনাই খুশি হলেন। সাবাসি দিলেন মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় পাঠদানরত মোল্লা সাহেবকে। মাহিষ্য দাস, নমশূদ্র আর পাটনিদের আবার এদিকে বিশেষ রুচি নেই, এটা উপলব্ধি করে তিনি যারপরনাই দুঃখিত হলেন। এ থেকেই তাঁর মাথায় এল ‘গোবিন্দচন্দ্র শিক্ষা ভাণ্ডারের’ পরিকল্পনা। গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রাজা ইশকুলে এই দরিদ্র শ্রেনির পড়ুয়াদের সহায়তা না করলে চাষের মরশুম আর ফসল তোলার মরশুমে এদের উপস্থিতি শূন্যই থাকবে। শুধু ব্রাহ্মণ কায়স্থ আর বণিক সন্তান দিয়ে তো আর স্কুল চলে না। বন্ধুবর নন্দলাল বর্মন, গ্রামের হিন্দু মুসলমান মাতব্বর আর খুড়ামহাশয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করতে হবে অদ্য অদ্যই।