ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/১৯
১৯
মহাযুদ্ধ শেষ হতে না হতে দেশে একজন ব্যক্তির নাম শোনা যেতে লাগল। দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত এক তরুণ ব্যারিস্টার, নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। ইতিমধ্যে ব্যারিস্টারের পোশাক ছেড়ে, সমস্ত সাহেবিয়ানা পরিত্যাগ করে এক টুকরো মাত্র কটিবস্ত্র পরে সারা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে পরিভ্রমণ সেরে এখন দেশে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকারি খেতাব প্রাপ্ত, বনরাজ-সোনাপুর আর লক্ষীপুরের মৌজাদার, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র এখন ধর্মসংকটে। সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে যাঁর সঙ্গে সম্প্রতি এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল সেই কামিনীকুমার চন্দমশাই এখন কংগ্রেসের জেলা সভাপতি হিসেবে কাছাড়, সিলেট, শিলং, গৌহাটি, কলিকাতার এখানে ওখানে ব্রিটিশ বিরোধী সভা সমিতি করে বেড়াচ্ছেন। সাহিত্য সম্মেলনে এসে কমিশনার সাহেব মহাযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ এবং রাজপরিবার সদস্যের প্রয়াণে শোক প্রস্তাবের পর্বটি প্রত্যক্ষ করায় প্রশাসকরা তাঁদের উপর যারপরনাই তৃপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন এদের মনোভাব তো আগের জায়গায় থাকার কথা নয়। আর কামিনীবাবু? এ ব্যক্তিটিকে নিয়ে সাহেবদেরও সমস্যা। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে সরাসরি সরানো গেল না, এখন চেয়ারম্যানের পদটিও তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু তবুও রায়বাহাদুরের মনে হচ্ছে এ তো জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ। অবশ্য কামিনীবাবু আজ নয়, সেই বঙ্গভঙ্গের আগ থেকেই কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে আসছেন। বছর দশেক আগেই তিনি চিফ কমিশনার ফুলার সাহেবকে সিলেট-কাছাড় আর ঢাকা-চট্টগ্রাম-ময়মনসিং-আসাম নিয়ে প্রস্তাবিত নতুন প্রদেশের বিরোধিতা করে একখানা পত্র দিয়েছেন, এর একটি নকল তাঁর হাতেও এসে পৌঁছেছে। সাহসও আছে লোকটির। ১৮৭৪ সালে সিলেট-কাছাড়ের আসাম ভুক্তির সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে তিনি বলছেন, এ দুটো জেলার মানুষ এর ঘোরতর বিরোধী। ১৯০৪ সালের ৩১ মার্চে লেখা ওই পত্র নিয়ে সারা আসামে নতুন করে চর্চা হচ্ছে, বিশেষ করে একটি কথা নিয়ে জোর আলোচনা, “Assam - as it is at present constituted contains communities of very conflicting interests"। বঙ্গভঙ্গ রদ হবার পরও কামিনীবাবুর কথার খেই ধরে আলোচনার বিরাম নেই। নবপ্রতিষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রশাসনিক-প্রধান প্রসঙ্গে তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন, “I am of opinion that the proposed Lietenant Governorship is also objectionable.” বিপিনচন্দ্র বুঝতে পারছেন, কাদের সঙ্গে তিনি চলাফেরা করছেন। ওদিকে বিদ্যাবিনোদও এডোয়ার্ড গেইট সাহেবের ইতিহাসকে সমালোচনা করে একখানি বই প্রকাশ করেছেন, এ নিয়েও তীব্র কানাকানি। আর এদিকে অনুজভ্রাতা যতীন্দ্রকে নিয়ে তো দুশ্চিন্তার অবধি নেই। বাপের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে মাধ্যমিক পড়াকালীন অবস্থায়ই তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু স্বদেশিদের সঙ্গে চলাফেরায় কোন বিরাম নেই। এই তো কিছুদিন আগে বরিশাল থেকে আসা এক চারণকবি তাঁর মাথা খারাপ করে দিয়ে গেছেন। যতি নাকি বাড়িঘর ছেড়ে তাঁর পিছনে পিছনে ঘুরেছে। ভ্রাতা এখন বয়ঃপ্রাপ্ত। আমি কী করতে পারি? সেদিন বিদেশি বর্জন আর বহ্নিউৎসবে সে নাকি নেতৃত্ব দিয়েছে। উচ্চকণ্ঠে গান গেয়ে মায়েদের, মেয়েদের আহ্বান করেছে রেশমি চুড়ি আর বিলেতি কাপড় পরিত্যাগ করতে। বিপিনচন্দ্র এসব দেখেও না-দেখার ভান করেছেন, তাঁর বাড়ির মেয়েরাও চাকরের হাত দিয়ে জাপানি টেবিল ক্লথ, চিনা পর্দা, রেশমি বস্ত্র আর বিলেতি মিলের শাড়ি পাঠিয়েছে আগুনে দিতে। সঙ্গে জুটেছে তারাচরণ, ওয়াজেদ আলি, দেশমুখ্য আর চক্রবর্তী বাড়ির ছেলেরা, খবর পেয়ে এসেছে বড়যাত্রাপুর, অরুণাচল-মাসিমপুর, সোনাপুর, বিহাড়া, বিক্রমপুরের স্বেচ্ছাসেবকের দল। ভেতর থেকে উস্কানি দিচ্ছে ভগ্নী ব্রহ্মময়ী। বিয়ের পর স্বামীর ঘর করতে পারেনি, এখন কাশীবাস শেষ করে বাড়িতে ফিরে এসে হয়েছে স্বদেশি ডাকাতনি। ভাইকে শেখাচ্ছে নানা ধরনের গান, স্বদেশি মন্ত্রও। আর কি বলব, আমাদের বৌমাও এক কাঠি সরেস। লেখাপড়ায় বিশারদ এ বউ যতিকে আটকে রাখা তো দূরে থাক, সমান তালে উৎসাহও দিয়ে যাচ্ছেন। বিপিনবাবু কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আমাদের সমস্যা হচ্ছে সিলেট ছাড়া এদিকে তো পালটা ঘরও নেই সম্বন্ধ করার। আর সিলেট তো স্বদেশিয়ানার আঁতুড় ঘর। সেখানকার মেয়েরাই বা আর পিছিয়েই থাকবে কেন? দুশ্চিন্তায় পীড়িত বিপিনচন্দ্র মাঝে মাঝে খুড়ামহাশয়ের কাছে গিয়ে বসেন। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এলেও সাংসারিক জ্ঞান তাঁর টনটনে। তিনিও এ ভ্রাতুষ্পুত্রের পরামর্শ ছাড়া কোন পদক্ষেপ নিতে পারেন না। আর অপরাপর খুড়াজেঠা যাঁরা আছেন, এরা সবই কেমন যেন খাপছাড়া। এর মধ্যে আবার জগবন্ধুকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। সাহেবদের সঙ্গে চলাফেরা করে ওদের বিষয়বুদ্ধি কিছুই নিতে পারেন নি, কিন্তু মদ্যপানটা রপ্ত করে নিয়েছেন। এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি। জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাঁকে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করে দিলেও গোপনে আসা যাওয়া কে আটকায়? এমনিতে তো মানুষটা খারাপ নয়, ছেলেমেয়েদের ছেড়ে কতদিন আর বাইরে ঘুরে কাটাবেন?
ইতিমধ্যে জীবনকৃষ্ণের দুই কন্যা ময়না আর সোনাইকে কাছাকাছি মজুমদার বাজার আর সোনাপুরে সেনবাড়িতে পাত্রস্থ করা হয়েছে। এই সোনাপুরের সেনবাড়িতে রায়বাহাদুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা বিরজাসুন্দরীরও বিয়ে হল। বেতুকান্দির স্বামী পুরকায়স্থ এবং হাইলাকান্দি-বোয়ালিপারের দেবচৌধুরী বাড়িতে দুই কন্যা সম্প্রদান করে খুড়ামশাই নিশ্চিন্ত। বিপিনচন্দ্রের দ্বিতীয়া কন্যা পড়াশুনায় মেধাবী কিন্তু তাঁকে তো আর দূর বিদেশে পাঠানো যায় না। পুত্র বিনয় এখন কলিকাতায় পড়াশুনা করতে গেছে। পুবের বাড়ির তিন সন্তান, জগৎ-শশী-সত্যেন্দ্র মাতা স্বর্ণময়ী দেবীর প্রভাবে সবারই প্রিয়জন হয়ে উঠেছে। ভগ্নী শারদার জন্য খুব দূর যেতে হয় নি। জমিদারি সেরেস্তায় কর্মোপলক্ষে আসা সদ্বংশজাত সুপুরুষ যোগেন্দ্র করকে পাত্র হিসেবে সবারই পছন্দ। অপর কন্যা চারুবালার স্বামী রমেশ চৌধুরীর অকাল প্রয়াণে দুই নাতনি আশালতা আর স্মৃতিকণা মাতুলালয়ে পরম আদরে বড় হতে থাকে।
যতি মাধ্যমিক পাশ করেছে। কিন্তু তাঁর চোখে এখন অন্য স্বপ্ন। তাঁকে সিলেট, কলিকাতা, ঢাকা কোথাও উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো গেল না। সে মনেপ্রাণে স্বদেশি। এখন তাঁর মন্ত্রণাদাতা শ্যামাচরণ দেব, কামিনী চন্দ, সম্প্রতি এসে জুটেছেন রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সাহিত্যসরস্বতী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রীতিধন্য এই ব্যক্তি স্বদেশি প্রচার, চরকা এবং জাতীয় বিদ্যালয়ের বার্তা নিয়ে এসেছেন গ্রামে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে দৌড়াদৌড়ি করে সরকারি রোষানলে পড়ে সিলেট থেকে সপরিবারে চলে এসেছেন এদিকে। গড়ে তুলেছেন জাতীয় বিদ্যালয়, গান্ধি পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের বার্তা ছড়াচ্ছেন গ্রামের ঘরে ঘরে। শুধু কি তাই? যতির আর্থিক সহযোগিতায় ইতিমধ্যে রমেশবাবুর পত্নী সুরবালা দেবী জেলা সদরে নারী সমাজে সূতা কাটা ও বস্ত্রবয়ন প্রবর্তনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘নারী শিল্পাশ্রম’। ওটাও গোর্খা সেনার নজরাধীনে আছে সম্প্রতি। খুড়ামহাশয় এটা একেবারে জানেন না বললে চলবে না। যতির মন্ত্রণাদাতা শ্যামাচরণ দেবের স্ত্রী সৌদামিনী দেবীও তো এর সঙ্গে জড়িত। শ্যামাচরণবাবু ইদানীং এ বাড়িতে ঘন ঘনই আসা যাওয়া করছেন। একদিন তো রায়বাহাদুর পুবের বাড়ি গিয়ে অপ্রস্তুত। বারান্দায় বসে দুই দাড়ি গোঁফওয়ালা স্বদেশি, রমেশবাবু আর শ্যামাচরণবাবু বিরাট আসর জমিয়েছেন। রমেশ ভট নাকি বাংলায় ‘ঋকবেদ সংহিতা’ রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বুঝি তাঁর যোগাযোগ আছে। ভেতরে আড়ালে বসে পাঠ শুনছেন জেঠিমা আর খুড়িমারা।
সবই কপাল। সেদিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যতি সম্বন্ধে নিজেই বলেছেন,
—He appears to me a bright chap। আরেক দিন নিয়ে আসুন আমার বাংলোয়। We need this type of young man as our Mauzadar। তরুণ যতীন্দ্রের কাজের আর শেষ নেই। রায়বাহাদুর অবশেষে ভাবলেন, ঠিক আছে বাড়িতে থাকুক, স্বদেশিই করুক, সে সঙ্গে জমিদারিটাও যদি দেখে তবে কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কনিষ্ঠ যামিনীকে পাঠানো হয়েছে কলিকাতায় হোমিওপ্যাথ কলেজে, সিলেট এমসি কলেজে গেল সত্যেন্দ্র, আর সৌখিন, মেজাজি সন্তান শশীকুমারকে পাঠানো হল ডিব্রুগড় ব্যারিহোয়াইট স্কুলে ডাক্তারি পড়তে।