ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/২৩
২৩
রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র বাড়ি থেকে অনেক দূর। গভর্নমেণ্ট অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৯ অনুযায়ী ইতিমধ্যে আসামকে গভর্নর শাসিত প্রদেশ হিসেবে পুনর্গঠিত করা হয়েছে। সম্প্রসারিত বিধান পরিষদে সুরমা উপত্যকার ষোলোজন সদস্যের মধ্যে সরকার মনোনীত সদস্য হিসেবে বিপিনচন্দ্র উপস্থিত রাজধানী শহর শিলঙে। তিনি কিছুই জানেন না গ্রামে কী ঘটছে। এদিকে প্রভুভক্ত হাতিয়ার বিহীন ভীষণ দর্শন দেহরক্ষী মোবেশ্বর আলি কেবলই হাস্ফাঁস্ করছে। পারলে এক্ষুণি জৈন্তা পাহাড় কিংবা রাতাছড়া পেরিয়ে সোজা দুর্গম পথে পৌঁছে যায় খাসিয়া মুলুকে। পূর্বজীবনে ডাকাতি করতে গিয়ে এসব পথে বেজায় চলাফেরা করতে হয়েছে তাঁকে।
যতির জন্য যে জেলের দরজা খোলাই ছিল এটা রায়বাহাদুর অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। যে-ছেলে মুখের উপর এক কথায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ প্রত্যাখ্যান করে ‘বন্দে মাতরম' বলে পথে বেরোতে পারে সে একদিন না একদিন কারাগারের ভেতর যাবেই জানতেন। তবে এটা বড় অসময়। বাড়ির সব ক’টি ছেলে বাইরে।
যতিকে তো আর সেরেস্তার দায়িত্ব নিতে বলা যাবে না। যামিনীকে তাই বিষয় বৃত্তান্ত বুঝিয়ে দেবার জন্য বাড়িতে আনিয়েছিলেন। দূর থেকে বসে বসে এসব সংসারী কথাই ভাবছিলেন। এরই মাঝে যদি যামিনীর বিয়ের সম্বন্ধটা পাকা হয়ে যায়। তবে রায়বাহাদুরের ইচ্ছে, সে ফিরে গিয়ে পড়াশুনাটা শেষ করে আসুক। ক’টা দিন আর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আপাতত বাড়িতে দাতব্য চিকিৎসালয়ের সাজ সরঞ্জাম ঠিকঠাক করে নিক। পাশ করে তো গ্রামেই রোগীদের সেবা করবে। চা বাগানের মিস্ত্রির কাছে দুটো কাঠের আলমারির অর্ডারও দেওয়া হয়ে গেছে।
বাড়িতে এসেই রায়বাহাদুর দেখা করলেন খুড়ামহাশয়ের সঙ্গে। এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও মানুষটি স্থির, অচঞ্চল।
—আমি এসে গেছি, এখন আপনার যতির কেউই ক্ষতি করতে পারবে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন খুড়ামহাশয়।
ভ্রাতুষ্পুত্রের এ আশ্বাস শুনেও তিনি সন্দিহান। যতি কি তাঁর পরামর্শ নেবে? ইতিমধ্যে পুত্র কর্তৃক সরকার বিরোধিতা, জনমত গঠন, মিটিং, মিছিলে ইংরেজ বিদ্বেষ প্রচার ইত্যাদি কাজে নীরব সমর্থনের জন্য সরকারি তহবিলে একশত টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। গ্রামের আরও দশ বারো জনকেও নিজ সামর্থ অনুযায়ী এই পিটুনি কর দিতে হয়েছে। রবিদাস সম্প্রদায়ের ষণ্ডামার্কা সর্দার সেদিন চিৎকার করতে করতে যতিবাবুর অনুগামী হয়েছে, তাঁর উপরও আষ্টআনা জরিমানা ধার্য হয়েছে। উঁকিঝুকি মারতে দেখা গেছে পঞ্চায়েত মৌলবিকে, ভোরবেলা তাঁর প্রিয় বাবুকে ক্ষৌরী করতে এসেছিল চন্দ্রবৈদ্য বুড়া, ভাটি থেকে সুদৃশ্য ধপ্ধপে পোশাক নিয়ে এসেছিল শুক্লবৈদ্য। থানার পেয়াদা এসে তালিকা ধরে সবার উপর আষ্টআনা করে জরিমানা আদায় করে নিয়ে গেছে। দেখি ‘বন্দে মাতরম’ বলে আর কে চেঁচায়? রেহাই পান নি বিশ্বেশ্বর পণ্ডিত, রোহিনী চক্রবর্তী এবং বাজারের মহাজনগোষ্ঠীও। ইদানীং এদের প্ররোচনায় গ্রামে বিবাহের কুঞ্জে সপ্ত প্রদক্ষিণের সময় প্রেমধ্বনির পরিবর্তে সবাই ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি তোলে, এটা কি গভর্নমেণ্টের কানে যায় না ওরা ভেবেছে?
রায়বাহাদুর চিঠি লিখে মোবেশ্বর আলিকে পাঠালেন জেলের অফিসে। তাঁকে খুব বুঝিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। জেলের সেপাই সান্ত্রিরা সবাই তাঁকে এক ডাকে চেনে। এই তে। এই জেলখানা থেকেই রায়বাহাদুর তাঁকে সংগ্রহ করেছেন। এর পূর্বপুরুষ কোন এক কালে কাছারি ছিল। ধর্মান্তরিত হবার পর এদিকে এসে জ্ঞাতিগোষ্ঠী সহ সবাই কয়েক পুরুষ ধরে বাংলাভাষী। খুব নিবিড় ভাবে দেখলে চেহারায় জনজাতীয় চরিত্রলক্ষণ বোঝা যায়। আদিনিবাস নাকি নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুর, তাই স্থানীয় মুসলিমরা আড়ালে আবডালে এদের নাগা বলেও অভিহিত করে, এমনকি এদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ করার আগে বিস্তর চিন্তা ভাবনায় কালাতিপাতও করে। মসজিদের বড় মিঞাঁসাব মানুষকে বোঝান, —এইসব কর্মের ফলেই তোমরা নিজের বিরাদরি রক্ষা করতে পারবায় না।
এমনিতে এরা এসব গায়ে মাখে না। কিন্তু গ্রামবস্তির রসিকতা মাত্রা ছাড়ালে মোবেশ্বর আলিও বলতে ছাড়ে না,
—আকাশর দিকে থুতু মারিলে, নিজার মাথাত পড়ে। আমরা যেমত ধর্ম ছাড়িয়া নতুন বুলি ধরছি, তেমত আরও আছইন আমরার ধারে কাছে—খোদ চক্রবর্তী, চোধরী বাবন—কাছারি শাদি করিয়া নয়া বুলি, নয়া লেবাস ধরছইন। চেহারাছবির মাঝে নু অখনও বাবন বাপর ছাপ আছে, মুখো যতউ কেরেং বেরেং বুলি থাকউক না কেনে।
মোবেশ্বর আলির মুখ খুললে বিপদ,
—আমার চলাফিরা সর্বত্র, যাত্রাপুর, রানিঘাট, ধুমকর, উজানগ্রাম সর্বত্র। আমি যে হকলর নাড়ি নক্ষত্র জানি।
-এইটা ঠিক। এর লাগিয়াই তুমারে সবে ডাকইন মোবেশ্বর ঠাকুর।
—ঠিক কইছ, আমিও বাবনঅর তাকি কম যাই না। আমার দুই জমিদারবাড়ির দুর্গাপূজার হকলতা আমি জানি—কুন পাঁঠা বলিত লাগে আর কুনটা লাগে না, পইঞ্চ পল্লব মানে কী কী জাতর বটপাতা, দুর্গা পূজাত কত ঘাটর পানি আর কত ঘরর মাটি লাগে ইতা আমার জানা। সব বাবন ঠাকুরেও জানইন না।
একটু থেমে সে মোক্ষম কথাটি নিক্ষেপ করে,
—শুনি রাখে রাখো, হরিটিকরো কাছারি রাজার মৌত অইলে পরে কে যে কুন দিকে গেলা, কুন কাছারি বাড়িত আশ্রয় লইয়া কুন বাবনর বেটা পইতা-হারা হইলা, ইতার খবর আমার কাছে আছে। রাখো ইতা মাত। মানুষর সমাজ তো ইতা সব লইয়াউ। ভালাউ তো আছি আমরা মিল মিশ হইয়া। দুনিয়ার সারা মানুষর যদি এক চেহারা, এক বুলি আর এক ধর্ম অইত, কিজানি মন লয়, বিলকুল ভালা লাগত না।
এই কথা বলে আঙুল তুলে দেখায় উইলিয়াম গ্র্যাণ্ট সাহেবের জোড়াপুত্র নাপু মিঞা আর পঙ্কু মিঞার দিকে। সত্যিই, ইয়া তাগড়া দশাসই দুই ব্রিটিশ পুঙ্গব, গায়ের রঙ বাদামি।
—বাপ তাঁর পথো গেছে, নিজ মুলুকো। থাক ব্যাটা আমরার লগে, প্যাক কাদা ছানিয়া দেশি বাঙ্গালর গা ঘেঁসিয়া, আর বারিষার দিন রমানাথ কাছারির লগে আইল ঠেলাঠেলির মাইর করিয়া। লণ্ডনি ফুটানি যে কই গেল তোর!
জেল অফিস থেকে বেরিয়ে মোবেশ্বর আলি সরাসরি রায়বাহাদুরের কাছারি ঘরে।
—যতিবাবু খুব খুশ মিজাজে আছইন। তান অখন বেজান বিরাদর। আমরার বাঙ্গালী জাতি হিন্দু মুসলমান আছইন। সিফাইরা সব খবরই দিল। কিন্তু আপনার দেওয়া চিঠি তাইন লওয়ার আগেই সিফাইয়ে লইয়া গেল গিয়া। আমি কইলাম, রায়বাহাদুরর হুকুম, ‘চিঠি হাতে হাতে দিতাম।’ কিন্তু তারা মানে না। আগে বুলে অফিসো যাইব, তার বাদে তান কাছে।
মোবেশ্বর নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে যতিবাবুকে বলেছে,
—বাবু, আপনে মুখ খুললে রায়বাহাদুরে আপনারে ছুটাইয়া লইতা।
এসব শুনে যতীন্দ্রমোহন হাসেন। মোবেশ্বরকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘সাহেবরা কতদিন আর বন্দি করে রাখতে পারবে?’ তাঁদের সংখ্যা যে অনেক।
—বাবু, আসাম থাকি বউৎ বড়ো বড়ো লিডর আনিয়া ফাটকবন্দি করা অইছে এইখানে। এইটা সিফাইর নিজর মুখর কথা, মিছা নায়। আমারে তারা কইছে বাবু। আর আমরার বাবু এই কয়েক দিনেউ তারার লগে মিলি গেছইন।