ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/৩০
৩০
তৃতীয় আইন পরিষদের নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হতে না হতেই রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র স্থির করে ফেলেছেন, আর নয়। রাজনীতি যেমন দিনে দিনে জটিল হতে চলেছে তেমনি নিজের শরীর মনও এ থেকে বিরাম চাইছে। ওদিকে বনরাজ পরগনার মৌজাদারিও তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়ে গেছে। প্রজাদের থেকে খাজনা আদায়েও খুব একটা অগ্রগতি দেখাতে পারছেন না। কৃষিক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নেও সরকার বাহাদুর উৎসাহ দেখালেন না। এ দিকে অরণ্যের মূল্যবান সব বৃক্ষ ধ্বংস করে দেশবাড়িতে কাঠ চালানে কোনও বাধা নিষেধ আরোপ করাও যাচ্ছে না। চা বাগানের মালিক, ম্যানেজারদের সঙ্গে কমিশনার স্তরের অফিসারদের যোগসাজসেই এটা হচ্ছে। ভুবন পাহাড়ের উপর যে হারে লোভের কুড়াল পড়ছে, বিপিনচন্দ্রের আশঙ্কা, আগামী দশ বছরেই সব মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাবে। একই সঙ্গে সোনাপুর-বনরাজ আর ভুবন পাহাড়ে বন্দুকবাজ সাহেবদের হাতে সপ্তাহান্তে কাতারে কাতারে প্রাণ দিচ্ছে হরিণ, গণ্ডার, বুনো শূকর আর বুনো হাঁসের দল। সরকার বাহাদুর আর বোধহয় দেশীয় জমিদার, মৌজাদার বা জনপ্রতিনিধিদের প্রতি বিশেষ আস্থা রাখতে পারছেন না। ওদিকে খিলাফতি আর নন-কোঅপারেটরদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসাটা নতুন গভর্নর বাহাদুর শ্রীল শ্রীযুক্ত উইলিয়ম হেনরি রেইড এবং জন হেনরি কার দুজনেই ভিন্ন চোখে দেখছেন। আর্ল কিংবা নিকোলাস বিটসন বেল সাহেবের মতো উদার মনের গভর্নর আর ক’জনই হতে পারেন?
—এদের খুশি করতে গিয়ে আমি তো আর প্রজাপীড়ন শুরু করতে পারি না।
রেভিনিউ দপ্তর থেকে ইতিপূর্বে রায়বাহাদুরকে এ মর্মে একটা সবধানবাণীও শোনানো হয়েছে, তিনি নাকি রাইয়তদের প্রতি প্রয়োজনের চাইতেও অধিক নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছেন।
এদিকে আইন পরিষদে সিলেট রি-ইউনিয়ন প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ায় রায়বাহাদুর রমণীমোহন দাস, ক্ষীরোদচন্দ্র দেব, ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, আব্দুল মজিদ সাহেব, এমনকি খান সাহেব রাশিদ আলি লস্করও তাঁকে এড়িয়ে চলতে চান, যদিও তাঁরা সবাই জানেন তিনি মুখে যাই বলেন না কেন, ভোটটা ওঁদের পক্ষেই দিয়েছেন। সেদিন থেকেই তিনি স্থির করে ফেলেছেন, এ পথে আর চলার প্রয়োজন নেই।রায়বাহাদুর ভেবেছিলেন কলিকাতা গিয়ে ডাক্তার বৈদ্য করিয়ে তারপর বাড়ি যাবেন। কিন্তু আজকাল অল্পেতেই ক্লান্তি আসে। দূরদেশে যাত্রার ধকল সইতে পারবেন কি না বুঝতে পারছেন না।
এদিকে উপযাচক হয়ে সিলেট-কাছাড়ের কংগ্রেসিরা তৃতীয় আইন পরিষদে কারা আসবেন, কারা মনোনীত হবেন এসব কথা তাঁর কানে দিচ্ছেন। এদেরই মুখে শুনলেন তাঁর অনুজ যতীন্দ্রমোহনের কথা। স্বরাজ্য দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের খুবই পছন্দের পাত্র সে। যদি এদের কথা সত্য হয়, যদি সত্য সত্যই যতি তাঁর পরবর্তীতে আইন পরিষদে সদস্য হয়ে আসে তবে তিনি শান্তিতে চোখ বুজতে পারেন। আর তাঁর ইংরেজ তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নের ব্যাপারে রায়বাহাদুরের কিছুই বলার নেই। এই একটি ব্যাপারে যতির সঙ্গে কোন তর্ক করার জো নেই। বয়স কুড়ি থেকেই তাঁর মাথায় এ ভাবনা। যদি আমার কথা শুনে কলিকাতায় গিয়ে সে আইনটা পড়ে আসত? বিপিনচন্দ্র এখনও ওই কথা ভাবেন, যদিও জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে।
ওদিকে কামিনী চন্দ মশাই কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য হয়ে বহুদূরে। সামনাসামনি হলে যে কথাটা সহজে বলা যায়, পত্র মারফত তা বলা যায় না। কা’র সঙ্গে কথা বলে যতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়? কংগ্রেসি বলুন, স্বরাজ্যিই বলুন আর খিলাফতিই বলুন এদের কারো কাছেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা যায় না।