রাজার মৃত্যুর পর সাহেবরা মধুরা নদীর তীরে বার্মাযুদ্ধের সেনানায়ক কর্নেল ঈনিশের ঘাঁটি দুধপাতিল গ্রামে কুঠি বানিয়ে এদিকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এবার ফিশার সাহেব দুধপাতিল ছেড়ে বরাক নদী পেরিয়ে অম্বিকাপুর পরগনার জানিগঞ্জ বাজারসংলগ্ন এক টুকরো জমিতে কার্যালয় স্থানান্তরের আয়োজন করলেন। বরাকের তীরে বাজার, খেয়াঘাট সংলগ্ন ওই স্থানটি নাকি মহারাজ গোবিন্দচন্দ্রই মৃত্যুর কিছুদিন আগে অম্বিকাপুর মিরাশদারের হাত থেকে খাস করিয়ে নিয়েছিলেন। হরিটিকরে অস্থায়ী রাজপাট গুটিয়ে সরাসরি খাসপুরে ফিরে যেতে তিনি ভরসা পাচ্ছিলেন না। ক্যাপ্টেন ফিশার অবশ্য এত সহজে সদর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন করে উঠতে পারছেন না। রাজার মৃত্যুর পর এই মিরাশদার জানিগঞ্জ তালুকের উপর তাঁর অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে ফিশারকে বাধা দেন। বিষয়টি বহুদূর পর্যন্ত গড়ালেও প্রায় জবরদস্তি করে সাহেব এখানেই সদর কাছারি গড়ে তোলা সাব্যস্ত করেন। যাঁদের পেছনে রয়েছেন খোদ ইংল্যাণ্ডেশ্বরী, যাঁদের নির্দেশ আসছে লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্কের ভদ্রাসন ফোর্ট উইলিয়ম থেকে, এদের এই নেটিভ মিরাশদারকে তোয়াক্কা না করলেও চলে। সরকার বাহাদুরের কাছে নালিশ গেলেও কাজের কাজ কিছুই হল না। জবরদখল জমিতেই গড়ে উঠল সুপারিনটেণ্ডেণ্টের কার্যালয়। ছোট বড় মাঝারি জমিদার মিরাশদারেরা ছুটলেন নিজস্ব নথিপত্র দাখিল করতে। রাজতন্ত্রের অবসানে এল কোম্পানির শাসন।

 বিপিনচন্দ্রের পূর্বসূরি কমলচরণ ছিলেন হেড়ম্বরাজার সর্বশেষ মন্ত্রী। রাজসভার ভাণ্ডারি, বড়ভাণ্ডারি, মোক্তার, খেল মোক্তার এদের জমি বাড়ি সম্পত্তির স্বীকৃতিও মিলল ফিশার সাহেবের আদালতে। দেবোত্তর ব্রহ্মোত্তর ধর্মোত্তর সম্পত্তি এবং প্রাচীন খেলপ্রথাকে মান্যতা দিয়েই কোম্পানির রাজস্ব নির্ধারিত হল। হাল, কুলবা, কেদার, নল ইত্যাদি পরিমাণ বাচক শব্দগুলোকে মান্যতা দিয়ে পাট্টা, নকশা, চিঠা, জমাবন্দি তৈরির কাজ শুরু হল। হাইলাকান্দি থেকে কালাইন লক্ষীপুর জয়পুর রাজাবাজার সোনাপুর বনরাজ বড়যাত্রাপুর বামঅঞ্চল, আর ছোটযাত্রাপুর থেকে লুশাই পাহাড়ের প্রান্তবর্তী অঞ্চল, দামছড়া বড়খলা থেকে কাটিগড়া বুন্দাশিল বদরপুর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে, হাতি চড়ে ঘোড়া চড়ে নৌকা চড়ে সাহেবদের বিচরণ শুরু হল। এমন সবুজ প্রান্তর, বিশাল হাওর, টলটল জলভর্তি বিল, গভীর অরণ্য এদের উন্মনা করে দিল। ঢাকা-সিলেট থেকে এলেন ফিতা হাতে দেশি পাটোয়ারি, নেটিভ নকশানবিশ, ইংলিশ রাইটার আর ইংরেজ সার্ভেয়ার। হেড়ম্ব যুগের খেল প্রথাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই শুরু হল জমির পুনর্বিন্যাস। সে এক মহা ধুমধাম। রাজার মৃত্যুর পর পালিয়ে যাওয়া মানুষজন আবার ফিরে এল। এদের উপস্থিতিতে ম্রিয়মান ভুমিতে সঞ্চার হল নতুন প্রাণ।

 সন্ধ্যার পর জমিদারের ফরশো ঘরে-এ নিয়ে জমে উঠল পুরনো দিনের গল্প। সম্মানিত অতিথি সিলেটের ইতিহাস নিয়ে যেসব তথ্য নাড়াচাড়া করেছেন এসব কথাও বললেন। এ অঞ্চলে শত শত ব্রাহ্মণের অস্তিত্বের উৎস নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেও তিনি কোন কূল কিনারা পাচ্ছেন না। কী সূত্রে এরা উত্তর ভারত, এমনকী দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত থেকে এই ভূমিতে এসে বসতি করেন?

 রায়বাহাদুর মশাইয়ের মুখে এ অঞ্চলে কোম্পানি অধিগ্রহণ, ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার কথা শুনে বুঝলেন ইনি নিতান্ত এক জমিদার নন, বিদ্যোৎসাহী বনেদি ভূস্বামীও বটে। বিদ্যাবিনোদ শুনেছেন ইতিপূর্বে আরও দুইজন ব্যক্তি নাকি কাছাড় নিয়ে অনুসন্ধান করতে এদিকে এসেছিলেন। একজন মৈনা গ্রাম নিবাসী অচ্যুতচরণ চৌধুরী, অপরজন কাছাড় জেলার শিক্ষা আধিকারিক, এস আই, উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ।

 নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ মহামহোপাধ্যায় গভীর শ্রদ্ধা সহকারে বলে চলছেন সিলেটের পির শাহজালালের কথা। কী করে ছয় শতাব্দী পূর্বে ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে সুদূর ইয়েমেন থেকে এ অলৌকিক পুরুষ এই ভূমিতে পদার্পণ করলেন, রাজা গৌড়গোবিন্দকে যুদ্ধে পরাজিত করে অধিকার করলেন শ্রীভূমি-সিলেট রাজ্য। নিজ দেশ থেকে নাকি এনেছিলেন একজোড়া কবুতর আর এক পুঁটুলি মাটি। কবুতর জোড়া সিলেটের আকাশে স্বচ্ছন্দে উড়তে শুরু করল, পুঁটুলির মাটি মিশে গেল সিলেটের মাটিতে। পির এ মাটিকেই আপন করে নিলেন। তাঁর অলৌকিক শক্তির কাছে বনের পশু, নদীর খরস্রোত, দুর্গম পাহাড় হার মানল। তাঁর স্পর্শে সুরমা নদীর জল হল সুপেয়। এক আশ্চর্য মৃগচর্মে বসে তিনি সুরমা নদী এপার ওপার করতে লাগলেন। অরণ্যের ব্যাঘ্রসমূহ তাঁর কাছে মাথা নত করল। তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করলেন ব্রাহ্মণ শূদ্র বৌদ্ধ নির্বিশেষে। কী করে সহজিয়া সাধনতত্ত্বের এ প্রান্তিক ভূমিতে সুফি ইসলামতত্ত্ব এসে মানুষের মনকে জয় করে নিল এ সবই মহামহোপাধ্যায়ের চর্চার বিষয়। তিনি ৩৬০ জন আউলিয়ার নামের একটি তালিকা তৈরির কাজও শেষ করে আনছেন জানালেন। তাঁর বিশ্বাস কাছাড়ের কাটিগড়া, কালাইন কিংবা বদরপুর অঞ্চলের দিকেও এদের কয়েকজনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বায়বাহাদুর জানালেন তাঁর অনুমান সঠিক। নইলে সুরমা পেরিয়ে এতদূরে এদিকে একটি গ্রামের নামই বা কী করে হয় ‘জালালপুর’। আঁতকে উঠলেন বিদ্যাবিনোদ,

 —কী বললেন? জালালপুর? বেশ নাম তো। ইসলামীয় নামবাচক শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত ‘পুর’। বাঃ বাঃ, বেশ তথ্য দিলেন মশাই।

 উৎসাহ পেয়ে রায়বাহাদুর বললেন আমাদের অঞ্চলে পুর দিয়ে কত স্থাননাম আছে গুণে শেষ করা যাবে না, যেমন রামপুর, বিজয়পুর, লক্ষীপুর, কনকপুর, রতনপুর, নাতানপুর, যাত্রাপুর, সোনাপুর, বিক্রমপুর, বাহাদুরপুর, আকবরপুর, বদরপুর। বিদ্যাবিনোদ জানালেন দ্রাবিড় উৎসজাত এ ‘পুর’ শব্দটির উল্লেখ আছে ঋক্ বেদে। রায়বাহাদুর বলে ওঠেন,

 —আচ্ছা, এর সঙ্গে যখন ইংরেজি শব্দ জুড়ে বসে তখন আপনি কী বলবেন, যেমন স্কটপুর, জেকবপুর, আলেকজাণ্ডারপুর?

 —কোথায়? কাছাড়ে? এরকম স্থাননামও আছে নাকি এ দিকে? সত্যিই আমাদের এই দেশের এই রকম প্রান্তভূমিতে এসে কত কি শিখছি!

 তিনি আবার ফিরে গেলেন জালালপুর প্রসঙ্গে। রায়বাহাদুর জানালেন এ গ্রামে তাঁর আত্মীয়তাও আছে।

 বিপিনচন্দ্র আশ্চর্য হয়ে গেলেন এ কঠোর ব্রাহ্মণের মুখে সুফিতত্ত্বের কথা শুনে। এই সেই ব্যক্তি যে কিনা উদারনৈতিক বিশ্ববিজয়ী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের বিরুদ্ধাচরণ করতেও দ্বিধা করেননি। কামাখ্যা দর্শন করতে আসা স্বামীজির সঙ্গে তিনি যে বিরাট তর্কযুদ্ধে নেমে গিয়েছিলেন এ কথা রায়বাহাদুরের কানেও এসেছে। তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা মাত্রই বিদ্যাবিনোদ কথঞ্চিৎ উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,

 —আপনারা আসমুদ্র হিমাচলবাসী যাঁকে মাথায় তুলে উদ্বাহু নৃত্য করছেন, আমি তাঁকে একজন রাজনৈতিক বক্তা, কিংবা বহুভাষিক এক পণ্ডিত ছাড়া আর কিছুই মনে করি না। তিনি এখন স্বর্গত, তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা অসঙ্গত।

 —আপনার সঙ্গে কবে তাঁর সাক্ষাৎ হয়?

 —মৃত্যুর এক বছর পূর্বে, ১৩০৮ বঙ্গাব্দেই হবে।

 পদ্মনাথবাবু তখনও কটন কলেজে যোগদান করেন নি, তবে অধ্যাপক মহলে তাঁর যাতায়াত ছিল। স্যার হেনরি কটনের নামাঙ্কিত কলেজটির উদ্বোধনীতে শিলং গৌহাটির বিশিষ্ট বিদ্বান এবং বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের সঙ্গে পদ্মনাথেরও নিমন্ত্রণ ছিল। ইতিমধ্যে স্বয়ং স্যার হেনরি কটন অধ্যক্ষ ফ্রেডরিক উইলিয়ম স্যণ্ডার্সনকে উদীয়মান পণ্ডিত পদ্মনাথের কথা বলে রেখেছেন। স্বামীজি এরই মধ্যে কটন সাহেবের আমন্ত্রণে শিলং কুইণ্টন হলে একটি বক্তৃতাও করে এসেছেন। গৌহাটিতে এক ভাড়া বাড়িতে অসুস্থ বিবেকানন্দের সঙ্গে বিদ্যাবিনোদের প্রথম সাক্ষাৎকার খুব সুখপ্রদ হয়নি বলাই বাহুল্য। আসলে ইতিপূর্বেই পণ্ডিত মহোদয়ের তীব্র আক্রমণাত্মক লেখাগুলো স্বামীজির কাছে কেউ পৌঁছে দিয়েছে।

 —বারান্দায় একখানা টুলের উপর গৌরবর্ণ গেরুয়া ধুতি ও গেঞ্জি পরা একজন লোক বসে আছেন। চুলগুলি এলোমেলো, পান চিবিয়ে ঠোঁটগুলো লাল—এই হল পদ্মনাথবাবুর বিবেকানন্দ বর্ণনা।

 ভট্টাচার্য মহোদয় স্বামীজির মাংসভক্ষণ আর ফরাসি সংগীতের প্রতি অনুরাগ নিয়ে ইতিপূর্বে কটাক্ষ করেছিলেন,

 —ফরাসি সংগীতে বৈরাগ্যের উপাদান আছে কি না জানি না।

 দুই কৃতীপুরুষের সম্মুখ সমরের রণাঙ্গন যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। ফরাসি সংগীত মুগ্ধতা নিয়ে কটাক্ষের উত্তরে স্বামীজি বলে ওঠেন,

 —এই যে আপনার গলায় পৈতা, জানেন এটা যে পারশিকদের কাছ থেকে পাওয়া?

 আর যায় কোথা? কথাটি বিদ্যাবিনোদকে রীতিমতো উত্তেজিত করে তুলল। তিনি রাগত স্বরে উচ্চারণ করে উঠলেন ‘যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্র’ মন্ত্র। স্বামীজি সরাসরি তীর নিক্ষেপ করলেন,  —দেখুন এ মন্ত্র প্রক্ষিপ্ত, মন্ত্রটির শব্দ ও ছন্দ অর্বাচীন।

 এমতাবস্থায় আর কোনও তাত্ত্বিক আলোচনা চলতে পারে না, বলাই বাহুল্য।

 রায়বাহাদুর প্রসঙ্গান্তরে আর যেতেই চাইছিলেন না। এ হেন পণ্ডিতের সান্নিধ্য এবং তদুপরি তাঁর মুখে স্বামীজিপ্রসঙ্গ যে তাঁর কাছে পরম প্রাপ্তি, হোক না প্রসঙ্গটি একটু তিক্তই। বাকি কথাগুলোও বলে নিয়ে বিদ্যাবিনোদ মনের খেদ মেটালেন। তিনি বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের কথাও বললেন। কয়েক দিন পর স্বামীজি কটন কলেজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন বক্তৃতা করতে। পদ্মনাথও গিয়ে শ্রোতার ভিড়ে একটা জায়গা করে বসলেন। স্বামীজি সেদিন যথেষ্ট অসুস্থ। পদ্মনাথের উপস্থিতি অবশ্য তাঁর চোখ এড়ায়নি। শ্রোতাদের কাছে নিবেদন রাখলেন কী বিষয় নিয়ে বলবেন? সবাই নিরুত্তর। এত বড়ো বাগ্মী সন্ন্যাসীর সামনে কেই বা মুখ খুলবে? তিনি বললেন,

 —সেই ভট্টচার্জি কোথায়?

 ওদিক থেকে কোনও উত্তর না আসায় অগত্যা তিনি সেই হাঁড়ি ধর্ম, জাতি বিচার, ছুৎমার্গ এসব নিয়েই শুরু করলেন। আসলে এ নিয়েই তো বিদ্যাবিনোদের গোঁসা। স্বামীজির কথাগুলো বড়ো তীর্যক। আর কী সব পরামর্শ? না, জড়তায় দেশ উৎসন্নে যাচ্ছে, ‘বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু একটা করো’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

 —আমি নীরবে সব সহ্য করলাম। একেবারে সন্ন্যাসীপ্রবরের শেষ কথাগুলো পর্যন্ত...। ইনি উপদেশ দিচ্ছেন, ‘নাহয় বড়োদরের একটা চুরি ডাকাতি করেই বুদ্ধি খোলো’।

 বিপিনবাবু চুপ করে শুনেই যাচ্ছেন,

 —সে দিন আমার কী মনে হয়েছিল জানেন? মনে হয়েছিল ইনি ইনি ধর্ম নয়, রাজনীতি প্রচারের যোগ্য ব্যক্তি। এত অসাধারণ বাগ্মিতা, পাণ্ডিত্য, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি সত্বেও সন্ন্যাসীর সাজ পরা লোকটি আমার মনে হয়েছে যেন মেষচর্মাচ্ছাদিত একটি কেশরী।

 এ কথাগুলো আমি লিখিত ভাবেই প্রচার করেছিলাম।