বিশ শতকের প্রথম দশকে হঠাৎ যেন মধ্যযুগের খোলস ছেড়ে নতুন যুগের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকল চোখের সামনেই। ব্রিটিশ প্রশাসনের অন্তর্গত এই জেলাটি জেগে উঠল নতুন উদ্যমে। কর্ম উপলক্ষে এলেন ঢাকা জেলার উপেন গুহ মশাই। সাব ইন্সপেক্টর অব স্কুলস। সমতল আর পার্বত্য কাছাড়ের অন্দরে কন্দরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বহুভাষায় পারদর্শী এ বিদ্বান ব্যক্তিটি। কাছাড়ি মণিপুরি নাগা হাজো জনজাতির জীবনযাত্রা, ইতিহাস ও সমাজের কত কিছুই না তিনি জানেন। গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে লিখেছেন গ্রন্থ, ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’। নিজ জেলা, ঢাকার সরস্বতী প্রেস থেকে প্রকাশিত এ বইটির মূল্য মাত্র পাঁচ সিকে। প্রকাশ হতে না হতেই বইটি কাছাড়, মাইবং, হাফলং পেরিয়ে পৌঁছে গেল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি অবধি। এদিকে মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্যও কলিকাতা থেকে ছাপিয়ে আনলেন সচিত্র গ্রন্থ ‘হেড়ম্ব রাজ্যের দণ্ডবিধি’। জাতীয় জীবনে যেন সঞ্চার হল নবচেতনার। বিপিনচন্দ্রও তাঁর কথা রেখেছেন। গ্রন্থটির মুদ্রণের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনিই বহন করলেন। হেড়ম্বভূমি জীবন্ত হয়ে উঠল ইতিহাসের পাতায়।

 ওদিকে করিমগঞ্জের মইনাগ্রামের আরেক পণ্ডিত চৌধুরী অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি দুই খণ্ডে বের করলেন এক মহাকাব্যোপম ইতিহাস গ্রন্থ, ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’। বিপিনচন্দ্রের দপ্তরে এখন পুথি আর পুথি। ছাপা গ্রন্থ এসে হস্তলিখিত পুথির জায়গা দখল করে নিল। ভেসে গেল জমিদারির তৌজি, বাকিজায়, জমাবন্দির কাগজ। বিদ্যাবিনোদের সাহচর্য তাঁকে আগ্রহী করে তুলছে প্রপিতামহদের সম্পর্কে। এটা তো একটা পরিবারের নয়, একটা প্রান্তিক ভূমির ইতিহাস। কী ক’রে এরা এদিকে এসে বসতি করলেন, এবং কবে? এখানকার রাজসভার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে তাঁর কৌতূহল বেড়ে চলল। বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলে খাসপুর সিংহাসনে নৃপতিদের একটি তালিকা তৈরি করতে বসে দেখলেন কাজটি মোটেই সহজ নয়। গোবিন্দচন্দ্রের আগে কৃষ্ণচন্দ্র, এর আগে লক্ষ্মীচন্দ্র পর্যন্ত যাওয়া গেল। কিন্তু এর আগে? তিনি কিন্তু থেমে গেলেন না। দিন কতক অনুসন্ধান করে সংগ্রহ করতে পারলেন অনেক নাম—হরিশ্চন্দ্র, রামচন্দ্র, সন্দিকারি, সুরদর্প, তাম্রধ্বজ নারায়ণ। আর কোথায় যায়? বিপিনচন্দ্র পিছন দিকে যেতে যেতে পৌঁছে গেলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব পর্যন্ত। হাতে এল ১০৩টি নামের তালিকা। পাঠিয়ে দিলেন বিদ্যাবিনোদের কাছে। এর সত্যাসত্য নির্ণয়ের কাজ তো ঐতিহাসিকের।

 একই সঙ্গে আরেকটি কাজও করে নিলেন। পারিবারিক তর্পণের তালিকা দেখে দেখে নিজ পূর্বপুরুষের তালিকা। পিতার নাম ভৈরবচন্দ্র, পিতামহ ভবানীপ্রসাদ, প্র-পিতামহ হৃদয়রায়, বৃদ্ধ পিতামহ যাদবরায় আর অতিবৃদ্ধ প্র-পিতামহ রতিরায় যিনি হেড়ম্ব রাজ-মন্ত্রী মণিরামের ষষ্টিতম ভ্রাতা। উজান বেয়ে পাঁচ সিঁড়ি গিয়ে দেখলেন নিজেকে গণনায় নিলে এ নথি হয়ে গেল ষষ্ঠীপুরুষ নামা। নিয়ে গেলেন পুবের বাড়ির খুড়ামহাশয়ের কাছে। নায়েব গগন মজুমদার বের করে দিলেন আরেকটি তর্পণের তালিকা। তিনি বুঝতে পারছেন না, পিতৃপক্ষের তো এখনও দুই মাস বাকি, এখন এসবের কী প্রয়োজন? খুড়া মহাশয় অবশ্য খবর পেয়েছেন তাঁর বিচিত্র খেয়ালি এ ভ্রাতুষ্পুত্র এখন পণ্ডিতসংসর্গ করছে। নিজের তো দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তবে স্মৃতিশক্তি এখনও প্রখর। মুখে মুখেই বলে দিলেন আমার পিতা জয়কৃষ্ণ, পিতামহ শান্ত রাম, তস্য পিতা অর্থাৎ প্র-পিতামহ রামকৃষ্ণ, বৃদ্ধ প্র-পিতামহ জোড়ারায়। ইনি হলেন মণিরামের চতুর্থ ভ্রাতা।

 —তবে লিখে রাখ এর উপরের আরও পাঁচ সিঁড়ির নাম। নীচ থেকে উপর দিকে গেলে মণিরাম, জোড়ারায়, রতিরায়ের পিতা চান্দলস্কর, তস্যপিতা লক্ষ্মীচন্দ্র, তস্য পিতা ত্রৈলোক্য রায়, তস্য পিতা কালারায়, এবং এর উপর হলেন জোড়ারায়। এই নামটি পাঁচ পুরুষ পরে দ্বিতীয় বার ফিরে এসেছে।

 খুড়া মহাশয় জগমোহনবাবু বললেন,

 —আমার পিতা অবশ্য এর উপরের কয়েকটি নামও বলতে পারতেন। কিন্তু তর্পণ বিধিতে এর আর প্রয়োজন হয় না, তাই রাখা হয় নাই। এবার বিপিনচন্দ্রের প্রকৃতই মাথা ঘুরে যাবার কথা।

 —এমনি পিতৃপুরুষের নামের উপর ভর করে পিছনে দিকে হাঁটলে তো এক অনন্ত অতীতের মুখোমুখি হব। আমরা কোথা থেকে, কোন প্রাচীন, সুদূর অতীত কাল থেকে এলাম?

 একা ঘরে বসে ইচ্ছে করছে এখনই ওই পণ্ডিত লোকটির সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলি। জিজ্ঞেস করি,

 —মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ মহাশয়! বলুন তো, আপনি আমাকে কোন্ দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান? আমি অতি সাধারণ এক সংসারী, বিষয়ী মানুষ। বিষয়সম্পত্তির মোহজালে আটকে আছি। এই তো ভালো ছিল। আপনি আমাকে কোন্ পথে টানছেন?

 ইদানীং বিদ্যাবিনোদের নাকি ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। নিয়মিত ভাবে পত্রের উত্তর দিতেও পারেন না। বিপিনচন্দ্রের কয়েকটি নথি রয়েছে তাঁর হেফাজতে। কথা ছিল পাঠোদ্ধার করে, লিপিকর দিয়ে নকল করিয়ে, ফটোগ্রাফ উঠিয়ে ফেরত দেবেন। প্রকাশিত ‘হেড়ম্ব দণ্ডবিধি’ গ্রন্থে অবশ্য সব কিছুর প্রতিলিপি স্পষ্ট ভাবেই এসেছে। কিন্তু সম্প্রতি একটি মামলার সূত্রে যে মূল নথিগুলোর প্রয়োজন।

 পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠাতা দেবী নিমাতার সম্পত্তি, মন্দিরের মালিকানা, প্রতিষ্ঠার দাবিদার এসব নিয়ে পুরোহিত বংশের উকিল জেলা আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। বিপিনচন্দ্র বিশেষ গা করেন নি প্রথম দিকে। নইলে বন্ধুবর কামিনীকুমার চন্দ, মহেশচন্দ্র দত্তদের পরামর্শ নিতেন। এবার মামলাটি গেল কলিকাতা হাইকোর্টে।

 জমিদারবাবুকে গ্রামের ভদ্রাসন ছেড়ে ছুটে যেতে হল তৎকালীন রাজধানী শহর কলিকাতায়। যদিও তিন বছর আগেই রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে গেছে দিল্লিতে, তবুও এদিকে সবার কাছে কলিকাতাই রাজধানী নগরী। ভাঙ্গা স্টেশনে উঠে করিমগঞ্জ হয়ে সিলেট এবং অতঃপর গোয়ালন্দ থেকে রেলগাড়িতে কলিকাতা

 মহানগরীতে এক মেসবাড়ির ঠিকানা নিয়ে গেছেন। এখানে সুরমা উপত্যকার ছাত্র যুবদল সব একসঙ্গে থাকেন। এ বাড়িতে উঠে বিপিনচন্দ্র মামলায় লড়বার জন্য একজন বিচক্ষণ উকিলের সন্ধান করলেন। এ সূত্রেই পরিচিত হলেন দুই ব্যক্তির সঙ্গে। কলিকাতা মহানগরীতে এক ডাকে সবাই তাঁদের চেনে। একজন বিপিনচন্দ্র পাল, অপরজন ড. সুন্দরীমোহন দাস। দুজনেই সিলেটের সন্তান। এদের কাছে কাছাড় বেশ একটা রহস্যময় স্থানও বটে। ওরা জানেন এই তো সেদিন পর্যন্ত এখানে রাজদরবার বহাল ছিল। বার্মা সেনার আগ্রাসন, লুসাই অন্তর্ঘাত, বিদ্রোহী সিপাহিদের অভিযান এসব নিয়ে সচেতন বাঙালির কাছে কাছাড় একটি বিশেষ কৌতূহল উদ্দীপক অঞ্চল। চারণ কবি মুকুন্দদাস তাঁর গানের এক কলিতে আবার কাছাড়কে মহীয়ান করে তুলেছেন—‘রামা আজ দিল্লি যাবেন শ্যামা যাবেন কাছাড়—স্টারে নাচবে কুসুমকুমারী, আ মরি খবরের বাহার।’ সিলেটের সন্তান গৃহত্যাগী, নির্বাসিত বিপিনচন্দ্র পালের পক্ষে কাছাড়ের বিপিনচন্দ্রকে আপন করতে বিলম্ব হল না। দুই বিপিনচন্দ্র একান্তে বসলে কাছাড়ি জমিদার-বিপিনচন্দ্র বাগ্মী-বিপিনচন্দ্রের কাছে ক্ষুদিরামের ফাঁসি বিষয়ক গানটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। জানালেন তাঁর অনুজের কণ্ঠে শোনা গীতটির স্বয়ং পদকর্তার সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি বিশেষ পুলকিত। গীতটির ভণিতা অংশটি উদ্ধার করলে বিপিন পাল কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন। সত্যিই কি গানটি তিনি লিখেছেন? মনে করতে পারছেন না—

‘কেঁদে বিপিন পালে বলে
বুক ভেসে যায় নয়ন জলে।’

 কয়েক বছর আগেকার কাছাড় পরিক্রমণের কথা তাঁর মনে আছে। বন্ধুবর কামিনীকুমার চন্দের কুশল মঙ্গলাদিও জিজ্ঞাসা কলেন। এমনি করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক যে গানের সুরে গ্রামকাছাড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে এটা অনুভব করে তাঁরও চোখে জল এসে গেল।

 যে উদ্দেশ্যে কলিকাতা আগমন তা শুনে উচ্চারণ করলেন একটি নাম। বললেন,

 —আপনি নিশ্চিত থাকুন, এক রাসবিহারী ঘোষ ছাড়া কলিকাতা হাইকোর্টে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। এ আইনজীবীর নাম তারাকিশোর চৌধুরী। ইনিও শ্রীহট্টের সন্তান,

 —আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, আপনি আজই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন।