সচিত্র রেল অবতার/তারে জামাইষষ্ঠী
তারে জামাইষষ্ঠী।
পদ্মার ওপারে সবে সেই রেল খুলেছে। প্যাসেঞ্জার গাড়ীর যাতায়াত তখনও আরম্ভ হয় নাই। দিনের মধ্যে একখানা মালগাড়ী যায় ও একখানা মালগাড়ী আসে। কিন্তু ষ্টেশনে লোকের ভিড় দেখে কে! দেশের যত নিম্নশ্রেণীর অশিক্ষিত লোক, কেমন করে ‘দ্যাওতায়’ (দেবতায়) গাড়ী টান্ছে, তাই দেখ্তে আসে। এঞ্জিনখানাই জীবন্ত—কাজেই সেটাকে দেবতা ভেবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। ড্রাইভার গুলোও তেমনি—লোক দেখ্লে, এঞ্জিনখানাকে ফ্যাঁস্ ফোঁস্ করিয়ে তাদের বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দেয়। ‘দ্যাওতা’ দেখছে বলে, তাদের কাছ থেকে পয়সা আদায় করে, না দিলে তাড়িয়ে দেয়। আবার যাদের কৌতুহল বড় বেশী—তারা ড্রাইভারকে বেশী পয়সা দিয়ে, এঞ্জিনটার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে নেয়। মোট কথা, ড্রাইভারদের তখন পোহাবারো—এক দিনের ‘উপরি আয়’ তাদের মাহিনার চেয়ে কম নয়।
ষ্টেশনে তখন দুটি বাবু; একজন ষ্টেশন-মাষ্টার ও এক জন তারবাবু। ষ্টেশন-মাষ্টার কায়স্থ; বয়স ৩৫৷৩৬ এর মধ্যে। আর তারবাবুটি—তাঁর বয়স ২০৷২২ এর ভিতর; জাতিতে ব্রাহ্মণ—লম্বা টিকি—আর এই পইতার গোছা! তারবাবু ছিটে ফোঁটা কাটেন—পূজা আহ্ণিক করেন—দেখতে যেন পরম সাত্ত্বিক পুরুষ।
একদিন তারবাবু ষ্টেশন—মাষ্টারকে বল্লেন—“দেখুন মাষ্টার ম’শায়, এ সময়ে ড্রাইভার বেটারা বেশ দুপয়সা রোজগার কচ্ছে, আমাদের জমাদার, পয়েণ্টম্যান পর্যন্তও বাদ যাচ্ছে না। এমন একটা দাঁও থাকতে আমরাই খালি ফাঁকে পড়চি। এখন ত আর মাল টাল হচ্ছে না, যে দু পয়সা রোজগার হবে? আসুন না কেন, একটা ফন্দি খাটিয়ে কিছু মেরে নেওয়া যাক্—সমস্ত দিনটা শুধু বেকার বসে থাকা হয় বইত নয়।”
ষ্টেশন-মাষ্টার হেসে বল্লেন—“মন্দকি? একটা ভাল রকমের ফন্দী ঠাউরে ফেলুন্ দেখি—আমার ত মাথায় তেমন কিছু খেলছে না।”
তারবাবু বল্লেন—“আমার ফন্দি টন্দি সব ঠিক করা আছে, তবে কাল থেকেই কাজটা শুরু করা যাক্।”
তার পরদিন বেলা আটটা ন’টার সময়, তারঘরের বেঞ্চি চেয়ার সরিয়ে বেশ পরিষ্কার করা হলো। কোশাকুশী ও নৈবেদ্য সাজিয়ে, একটা হরিণের চামড়া পেতে, তারবাবু সেই ঘরটায় বস্লেন—ধূপ ধূনা জ্বল্তে লাগলো। তারের কলটার উপর খানিকটা সিন্দুর লেপে রাখা হলো।
সকাল থেকেই লোকজন আস্তেে আরম্ভ করেছিল। বেলা দশটার মধ্যে, স্টেশনটি লোকে ভরে গেল। জমাদার, পয়েণ্টস্ম্যান গুলোকে শিখান ছিল;—তারা বল্লে “ঘরের মধ্যে ‘দ্যওতার’ পূজো হচ্ছে, তোমরা দেখবে তো যাও। ভাল করে পূজোর পয়সা কড়ি দিলে ‘দ্যাওতা’ ভারী সন্তুষ্ট হবেন। এমন জাগ্রত ‘দ্যাওতা’ যে আর নাই, তা তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছ।”
লোকগুলা নূতন কিছু দেখতে পাবে বলে, ছুটে তারঘরের দিকে গেল। দরজার কাছে, পূজো দেখবার জন্য, ভারী ঠেলা ঠেলি, হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দিলে। পয়েণ্টস্ম্যান, জমাদারেরা অনেক করে তাদের থামিয়ে রাখ্লে।
তারবাবু স্তিমিতনেত্রে কতকক্ষণ ধ্যান কর্লেন। তার পর কোশাকুশী আর নৈবেদ্য নেড়ে পূজো আরম্ভ হলো। সে পূজো কি শিগ্গির ফুরোয়? প্রায় দুঘণ্টা চল্লো। পূজো শেষ হ’লে তিনি সবাইকে বল্লেন—“তোমরা সব খোঁটাখুটী ছেড়ে দাঁড়াও, শিগ্গির ‘দ্যাওতা’ আস্ছেন।”
লোকগুলো হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তারবাবু ঘণ্টার কলে চাবিটা এঁটে দিয়ে, একখানা লাল চেলির কাপড় দিয়ে কলটা ঢেকে দিলেন। একটু পরেই ঠং ঠং করে ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ হলো।
তারবাবু চেঁচিয়ে বল্লেন—“এই ‘দ্যাওতা’ এসেছেন—এই ‘দ্যাওতা’ এসেছেন। তোমরা প্রণামী দাও আর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর—‘দ্যাওতা’ তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর্বেন।”
লোকগুলো প্রণাম করে, একটা সিঁদুর দেওয়া থালার উপর টপাটপ্ পয়সা ফেল্তে লাগলো। দেখ্তে দেখ্তে থালাখানা প্রায় ভরে গেল। যাবার সময় তারবাবু সবাইকে বলে দিলেন, ‘এই জাগ্রত ঠাকুরকে পূজো দিলে, রোগ, শোক, ব্যাধি কিছুই থাকে না। ঠাকুর জীয়ন্ত দেবতা—আপনার আসার কথা আপনি জানিয়ে দেয়।
লোকগুলো বিস্ময়ে অভিভূত হ’য়ে গেল।
এই কথা গ্রামে গ্রামে রটে গেল, ললাকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো। আতপ চাল, কলা, নানা রকম ফল—এমন কি, দু চার্টে পাঁটা পর্যন্ত পূজোর জন্য আসতে লাগল। এক খানা থালাতে পয়সা ধরেনা বলে, তিন চারটে থালা সাজিয়ে রাখতে হলো।
তারবাবুও নানারকম করে, তাদের বিশ্বাস ক্রমেই বাড়িয়ে তুল্তে লাগলেন। স্টেশন-মাষ্টার ত হেসেই কুট্পাট্; বল্লেন—“ভারী ফন্দী ঠাউরেছেন বটে! এমনটি দিনকতক চল্লে, বস্তা করে আমাদের পয়সা রাখতে হবে।”
* * *
একদিন একজন বুড়ো লোক দুহাঁড়ি নাটোরের কাঁচাগোল্লা, একখানি ভাল কাপড় ও একখানি ভাল চাদর, দুটো লোকের মাথায় দিয়ে নিয়ে এল। তারবাবুকে বল্লে—“বাবু, আমি বড়ই বিপদে পড়েছি। আজ জামাইষষ্ঠী—অথচ জামাইকে তত্ত্ব করা হয় নাই। মেয়ের আমার এই বছরই বিয়ে হয়েছে, —একটু ভাল ঘরেই দেওয়া গেছে। এই প্রথমবারেই যদি তত্ত্ব-তল্লাসী না করা হয়, তা’হলে আমার জাত মান কিছুই থাক্বে না। এখান থেকে আমার জামাই বাড়ী একদিনেরও বেশী রাস্তা;—লোক পাঠা’লেও তারা গিয়ে পৌঁছুতে পারবে না। তারে ত আপনারা খবর পাঠিয়ে দেন—খবর নিয়ে আসেন, আমার এটা পাঠিয়ে দেবার কিছু বিহিত করতে পারেন না?”
ষ্টেশন-মাষ্টার ও তারবাবু দু’জনেই কথাটা শুনলেন। একটু মৌন থেকে, তারবাবু বল্লেন—“হাঁ, জিনিষগুলো পাঠান যেতে পারে বটে—তবে একটু বেশী চেষ্টা করতে হবে।”
বৃদ্ধ অকুল সাগরে ভাস্ছিল। কথাটা শুনে যেন কুল পেলে। বল্লে—“বাঁচলুম বাবু, আমার মান রক্ষা হবার পথ হলো। এই নিন্ পাঁচ টাকা মাশুল। আর আপনি যে এতটা কষ্ট করবেন, তার জন্য এক টাকা আমি আপনাকে পান খেতে দিচ্ছি। দেখবেন বাবু—যেন জিনিষগুলি সন্ধ্যার আগে পৌছায়। আমি মেয়েটাকে দেখবার জন্য একটা লোক সেখানে পাঠাচ্ছি—সে না হয় কাল গিয়ে পৌঁছুবে।”
তারবাবু তাকে আশ্বাস দিয়ে সন্দেশ আর কাপড় রাখলেন, লোকটি চলে গেল। ষ্টেশন-মাষ্টার বল্লেন—“তার বাবু, এই কাজটা ভাল হ’ল না। ঐ বুড়ো যখন লোক পাঠাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই খবর পাবে, যে সন্দেশ কাপড় সেখানে গিয়ে পৌঁছায় নাই। বুড়ো নিশ্চয়ই এসে, জিনিষগুলো না। পাবার কারণ জিজ্ঞাসা কর্বে—তখন আমরা কি বলবো?”
তারবাবু হেসে বল্লেন,—“আপনাকে ভাব্তে হবে না। তাকে বোঝাবার ভার আমার রইল। এখন কঁচাগোল্লা গুলো—তার মেয়ে-জামায়ের নাম করে খাওয়া যাক্ ত! ও বুড়ো বেটা আস্ত গরু—নাহলে কি টেলিগ্রাফে সন্দেশ কাপড় পাঠাতে চায়। সুবিধা যখন পাওয়া গেছে, তখন ছাড়া উচিত নয়।”
ষ্টেশন-মাষ্টার তারবাবুর বুদ্ধির পরিচয় আগেই পেয়ে ছিলেন, কাজেই তাঁর কথায় সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত রইলেন।
* * *
পাঁচ ছয় দিন পরে বুড়ো এসে হাজির। জিজ্ঞাসা কল্লে —“বাবু, আমার জিনিষগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কি? কাল আমার লোক ফিরে এসেছে, সে বল্লে,—জিনিষপত্তর কিছুই পাওয়া যায় নাই। আমার মান, ইজ্জত, সব গেছে! বেহাই, বেয়ান, আমার লোকটাকে বড় ভারী ভারী কথা শুনিয়ে দিয়েছে। মেয়েকেও অনেক কথা শুনিয়েছে বলে— মেয়ে ভারী কেঁদেছে। কেন বাবু, আমার জিনিষটা গিয়ে সেখানে পৌছুলো না?”—
তারবাবু দুঃখিতভাবে বল্লেন—“সে দুঃখের কথা আর বল্ব কি? তুমি আমাকে একটা টাকা পান খেতে দিয়ে গিয়েছিলে—আমি কি চেষ্টার ত্রুটি করেছিলুম? যেই সুবিধে পেলুম, অমনি জিনিষগুলোকে ভাল করে এক জায়গায় বেঁধে তারে ছেড়ে দিলুম, সেটা বোঁ বোঁ শব্দে ছুটতে লাগলো। কিন্তু ওধারের ষ্টেশনের বোকা তারবাবুটা, আমাদের বড়সাহেবের একটা মোটা লাঠি সেই সময় ছেড়ে দিলে। সাহেব লাঠিটা ফেলে গেছ্লেন—তাঁর কাছে সেটা শিগগির পোঁছান চাই। সাহেবের ঠেলায়, তোমার জিনিষটা যে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি, তা সে ভুলে গিছ্লো। শেষকালে যা হবার তাই হলো। পথের মাঝখানে, হাঁড়ীতে আর লাঠিতে খুব জোরে ঠোকাঠুকি লাগলো। লাঠিটা শক্ত—সেটার কিছু হলো না, কিন্তু তোমার মাটীর হাঁড়ি লাঠির চোটে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সন্দেশ, কাপড়, মাটিতে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। সন্দেশগুলো ত মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গিছলো। আমি লোক পাঠিয়ে, কাপড় ও চাদর আনিয়ে রেখেছি, তুমি নিয়ে যেতে পার।”
এই বলে, দেরাজ থেকে একটু মাটিমাখা কাপড় ও চাদর বার করে, বুড়োর হাতে দিলেন।
বৃদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বল্লে—“আপনার দোষ কিছু নাই বাবু, যত কিছু আমার অদৃষ্টের দোষ! আমার বরাত খারাপ না হলে, কি ওখানকার তারবাবু, ভুল করে, লাঠিটা সেই সময় ছেড়ে দেয়?”
এই বলে ষ্টেশন-মাষ্টার ও তারবাবুকে প্রণাম করে, বৃদ্ধ দুঃখিত মনে চলে গেল।
ষ্টেশন-মাষ্টার তারবাবুর বুদ্ধি দেখে অবাক্!