সচিত্র রেল অবতার/নেশাখোরের ইসারা
রেল অবতার।



নেশাখোরের ইসারা।



আবশ্যক হইলে রেলের লোকেরা এক ষ্টেসন হইতে অন্য ষ্টেসনে বিনা পয়সায় টেলিগ্রাম পাঠাইয়া থাকেন। অবশ্য এ বন্দোবস্তটা তাঁহাদের নিজেদের মধ্যে। কোম্পানীর এমন কিছু নিয়ম নাই, যে, তাঁহারা এ সুবিধাটা ভোগ করিতে পারিবেন। এক ষ্টেসন হইতে অপর ষ্টেসন পর্যন্ত তারের সংযোগ থাকিলেই খবর পাঠান যায়। এই রকম খবর পাঠানোর নাম—“প্র্যাকটিশ্” দেওয়া। গরীব, অল্পবেতনের কর্ম্মচারীরা, প্রয়োজন মত এরূপ ‘প্র্যাকটিশ্’ ত দিয়াই থাকে—বেশী মাহিনার বড় বড় রেলের সাহেবেরাও এ সুবিধাটা ছাড়েন না।
রাত্রি প্রায় ৯॥ টার সময়, সান্তাহারের বড় তারবাবু একটু ব্যস্ত ভাবে আসিয়া, অপর একটি তারবাবুকে বলিলেন—“ওহে কালী, সারাঘাটকে ডেকে ধ’রত। একটা জরুরী প্র্যাকটিশ্ আছে—এ টা, সেখান থেকে দারজিলিং মেল ছাড়্ বার আগেই দিতে হবে। এই সময়েই দিতে পার্লে ভাল হয়—না হলে, কাজের ভিড়ে সারাঘাটকে আর ডেকে পাওয়া যাবে না।”
কালী বাবু ‘সারাঘাট’—‘সারাঘাট’—করে ডাকতে আরম্ভ করলেন।
বড় তারবাবু একটা টেলিগ্রাফের ফারম নিয়ে, ‘প্রাকটিশ্’ খানি লিখলেন—
—“দুই বোতল গঙ্গার (এখানে পদ্মার) জল আজ রাত্রিকার দারজিলিং মেলে নিশ্চয়ই পাঠাইয়া দিবে।”
এই ‘প্র্যাকটিশ’ টা দেওয়া হলো—সারাঘাটের বড় তারবাবু হারুবাবুকে।
দারজিলিং মেল ছাড়িবার বেশী বিলম্ব নাই, এমন সময় প্রাক্টিশ্ খানা সারাঘাটে পৌঁছিল। হারুবাবু তখন আফিসে ছিলেন না—স্টেশনে ঘুরিয়া বেড়াইতে ছিলেন। আর সময় বেশী নাই দেখিয়া ছোট তারবাবু হারুবাবুর অপেক্ষা না করিয়া, সোরাব্জীর হোটেল থেকে দুইটী খালি বোতল চাহিয়া লইয়া পদ্মার জল ভরিয়া লইয়া আসিলেন।
গার্ডের মারফত যখন পাঠাইতে যাইবেন, তখন হারুবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। ছোট তার বাবু বলিলেন—“মাষ্টার মশায় সান্তাহার থেকে দুই বোতল গঙ্গাজল পাঠাবার ‘প্রাকটিশ’ দিয়েছিলেন। আপনি ছিলেন না—কাজেই আমি দুটো বোতল জল পুরে, এই গার্ড সাহেবকে দিতে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই কোন পূজো আচ্ছা হ’বে—তা না হলে কি, দারজিলিং মেলেই গঙ্গাজল পাঠাতে বলেছেন?”
হারুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন—“প্র্যাকটিশ্’টা মধু খুড়ো দিয়েছেন ত’? তা হলে—তুমি বোতল দুটো আফিসে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। এখন সময় নেই—ব্যাপারটা পরে বল্ব।”
এই বলে, হারুবাবু সোরাব্জীর হোটেলের দিকে দৌড়ুলেন। ম্যানেজারকে দুই বোতল ব্রাণ্ডী বার্ করে দিতে বল্লেন। বোতল দুটো পেয়েই—বোঁ করে গার্ড সাহেবকে দিয়ে এলেন। মেল ট্রেন ছেড়ে দিলে।
* * *
ব্যাপারটি কি, শোন্বার জন্য ছোট তারবাবু উদ্গ্রীব হ’য়ে বসে ছিলেন। হারুবাবু ফিরে এলে, জিজ্ঞাসা করলেন— “আচ্ছা মশায়, ব্যাপারটা কি বলুন দেখি? আমিত জানবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছি!”
হারুবাবু হাসিয়া বলিলেন—“ওহে তোমরা ছেলে মানুষ, তোমাদের কাছে বল্তেও লজ্জা হয়, না বল্লেও, চলে না। তোমরা দু দিন রেলে ঢুকেছ বইত নয়! আমাদের কথার ইসারা জান্বে কেমন করে? মধুখুড়ো কস্মিন কালেও পূজো আচ্ছা করে না। তার দরকার হলো কিনা— গঙ্গাজল!—ক্ষেপেছ? দু বোতল মদের দরকার হয়েছিল, তাই ‘প্র্যাক্টিশ’ দিয়েছিল। দারজিলিং মেলে জিনিষটে দিয়ে পাঠালে ভোর্ রাত ফুর্ত্তি চলবে, তাই দারজিলিং মেলেই পাঠাবার হুকুম! এটা হচ্ছে আমাদের নেশাখোরের ইসারা। হরদম্ ত, গঙ্গাজল, এখানে সেখানে চেয়ে পাঠাচ্ছে, আমরাও পাঠিয়ে দিচ্ছি। এ ‘প্র্যাক্টিশ’টা দেখলে কে বলবে যে মধু খুড়ো দু বোতল গঙ্গাজল না চেয়ে, দু বোতল আসল ব্রাণ্ডী চেয়ে পাঠিয়েছেন? তুমিও ত বুঝতে পার নাই। ওহে এটা আমাদের ঠারেঠোরে ইসারা। কিছুদিন রেলে থাক্লেই এ সব জান্তে কিছু বাকি থাকবে না। তবে এ ইসারার বিপত্তিও আছে; তবে একটা গল্প বলি শোন:—
“নীলরতন বাঁড়ুয্যে সান্তাহারের একটু দূরে একটা ছোট ষ্টেসনের মাষ্টার ছিলেন। যে যায়গায় তিনি থাক্তেন, সেখানে চাল, ডাল, জিনিষ পত্র বড় কিছু পাওয়া যেত না। সব জিনিষই সান্তাহার থেকে আনিয়ে নিতে হ’ত। সান্তাহারের এসিষ্টাণ্ট এক সময় তাঁর তারবাবু ছিলেন; তিনিই জিনিষপত্র পাঠিয়ে দিতেন।
বাঁড়ুয্যে মশায় ত্বরিতানন্দের ভক্ত ছিলেন; অর্থাৎ—একটু বেশী মাত্রায় গঞ্জিকা সেবন করতেন। সান্তাহারের নিকট নওগাঁয় গাঁজার আড্ডা; একটু সস্তাও পাওয়া যায়। কাজেই বাঁড়ুয্যে মশায় সান্তাহার থেকেই গাঁজা আনাতেন।
লোক না বুঝতে পারে সেই জন্য এসিষ্টাণ্ট বাবুকে বলা ছিল—দরকার পড়িলে তিনি তারে ‘প্র্যাকটিশ’ দিবেন। চাউল দরকার জানাইলেই—গাঁজা দরকার, বুঝিতে হইবে। একমণ লিখিলে—এক ভরি, দুইমণ লিখিলে—দুইভরি। এইরূপ যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়। আসল চাউলের, কিম্বা অন্য জিনিষের দরকার হলে, তিনি চিঠিতে জানাইবেন।
বলিয়াছি ত—বাঁড়ুয্যে মশায় একটু পাকা রকমের গাঁজা খোর। কাজেই এরূপ ‘প্র্যাকটিশ্’ প্রায়ই আসিত। সঙ্কেত জানাছিল বলিয়া গাঁজা পাঠাইবার ও তাঁহার পাইবার কোন গোলমাল হইত না।
একদিন বাঁড়ুয্যে-গিন্নি বল্লেন—“ওগো দেখ, তোমাকে বল্তে ভুলে গেছি—আমাদের চাল ফুরিয়ে গেছে। আজই চিঠি লিখে দাও, কাল যেন সকালেই চাল এসে পড়ে, না হলে রান্না চড়বে না।”
বাঁড়ুয্যেমশায় চিঠি লিখবেন বল্লেন, কিন্তু কাজের গতিকে চিঠি দিতে ভুলে গেলেন। মনে কল্লেন, তার পর দিন সকালেই একটা ‘প্র্যাকটিশ্’ দিয়ে দিবেন বেলা দশটার মধ্যেই চাল এসে পড়বে।
খুব সকালে একখানা ‘প্র্যাকটিশ্’ লিখে, তাঁর ছোটবাবুকে পাঠিয়ে দিতে বল্লেন। ছোটবাবুরও চালের দরকার ছিল; কাজেই, তিনিও তাঁর জন্য একমণ পাঠিয়ে দেবার জন্য, বাঁড়ুয্যে মশায়কে লিখ্তে বল্লেন। বাঁড়ুয্যে মশায় ‘প্র্যাকটিশ্’ দিলেন:—
—“দুইমণ চাউল প্রথম ট্রেণেতেই পাঠাইয়া দিবে। রাঁধিবার কিছুই নাই।”
* * *
সান্তাহারের এসিষ্টাণ্টবাবু সবেমাত্র দুই দিন আগে দুই ভরি গাঁজা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আবার পাঠাইবার জন্য তার দেওয়ায়, বাঁড়ুয্যে মশায়ের উপর একটু বিরক্ত হইলেন। মনে মনে বল্লেন—“লোকটা যাচ্ছেতাই গাঁজাখোর হয়ে পড়েছে! দুই ভরি গাঁজা দুই দিনেই শেষ করে ফেলেছে—এক ছিলিমও গাঁজা নাই, যে সকাল বেলাটায় খায়। তাই প্র্যাকটিশ্ দিয়েছে। রাঁধিবার কিছুই নাই।”
বিরক্ত হইলেও, এসিষ্টাণ্টবাবু দুই ভরি গাঁজা প্রথম ট্রেণেই পাঠিয়ে দিলেন।
গাড়ী আসিল, কিন্তু চাল আসিল না। বাঁড়ুয্যে মশায় গার্ডের গাড়ী খুঁজিলেন, গার্ডকেও জিজ্ঞাসা করিলেন। গার্ড বলিল “চাল টাল কিছুই দেয় নাই, তবে একটা খামে করে চিঠি দিয়েছে, সেটা আমার গাড়ীতে আছে দেখুন।”
গাড়ী চলিয়া গেলে, বাঁড়ুয্যে মশায় চিঠি খুলিলেন। চিঠির ভিতরে এক মোড়ক গাঁজা—ওজন প্রায় দুই ভরি। একখানা চিঠিও আছে; তাতে এসিষ্টাণ্টবাবু, বাঁড়ুয্যে মশায়কে, একটু কম করে গাঁজা খেতে অনুরোধ করেছেন। এসিষ্টাণ্ট বাবু বাঁড়ুয্যে মশায়কে একটু ভক্তি শ্রদ্ধা করিতেন।
বাঁড়ুয্যে মশায় অন্য কিছু ভাবিবার সময় পাইলেন না। চাউল আসিল না—গিন্নিকে কি কৈফিয়ৎ দিবেন—এই ভয়ে তাঁহার অন্তরাত্মা শুখাইয়া গেল।
ছোটবাবু, চাউল আসিয়াছে কি না জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন—“তাই ত হে, চা’ল্ কেন এল না—তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে।”
ছোটবাবু আর কি বলিবেন?—
* * *
বাঁড়ুয্যে মশায় মুখ কেঁচু মেচু করে বাসার ভিতরে গেলেন। এদিকে অনেকক্ষণ দশটা বাজিয়া গিয়াছে। গিন্নিঠাকরুণ মেজাজ গরম করিয়া আছেন। বাঁড়ুয্যেকে দেখিয়া বলিলেন—
ওগো, তবে—কথাটা শুনবে? “বেশত তোমার আক্কেল! গাড়ীখানা কতক্ষণ চলে গেছে, এখনও তোমার চাল্ পাঠিয়ে দেওয়া নেই? এত বেলা হ’লো, আমি কখন রাঁধ্ব—? বুড়ো হচ্ছ—কোথা রোজ রোজ বুদ্ধি বাড়বে, না বাঁদর হচ্ছ।”
বাঁড়ুয্যে মশায় ভয়ে আরও জড়সড় হলেন; তিনি আম্তা আম্তা করে বল্লেন:—
“ওগো, চাল্ কি আর এসেছে, যে আমি তোমায় পাঠিয়ে দেবো? আমিত ঠিকমতই তার করেছিলুম; রান্না হবে না পর্যন্ত লিখে দিয়ে ছিলুম—যাতে চাল্ পাঠাতে ভুল না হয়। কিন্তু সে বড় ভুল করে ফেলেচে। সে দুমণ চাল্ না পাঠিয়ে দু ভরি গাঁজা পাঠিয়ে দিয়েছে। ওগো, তবে—কথাটা শুনবে?”
বাঁড়ুয্যে, গিন্নির রাগটা থামাইবার জন্য আরও নরম সুরে বলিতে লাগিলেন—
“আমি গাঁজা খাই, তাতো জান। গাঁজার কথাটা লেখা যায় না বলে, আমি সতীশকে লিখ্তুম—চাল্ পাঠাবে। অবশ্য আমাদের মধ্যে, বোঝা পড়া ছিল।
“এবার কিন্তু ভারী ভুলেছে। রান্নার জন্য দরকার, এত বিশেষ করে বুঝিয়ে দিলেও-গাঁজা না হয়ে, যে আসল চাল্ চেয়ে পাঠিয়েছি, তা সে বুঝ্তে পারে নাই। এখন কি করবে বল—ছোটবাবুদের ঘর থেকে কিছু চাল্ টাল নিয়ে এ বেলাটা চালিয়ে দাও। আমি আবার তাকে তার করছি।”
গিন্নি চেঁচিয়ে বল্লেন—“ওগো, তোমার আর তার পাঠিয়ে কাজ নাই। তোমার গাঁজাখোরের বুদ্ধি না হলে কি, চাল্ লিখলেও গাঁজা আসে? আমার বাপ একটা গাঁজাখোরের হাতে দিয়ে গেছেন বইত নয়। হা অদৃষ্ট! ওরে, কেন আমার মরণ হলো না”—ইত্যাদি বল্তে বল্তে গিন্নি থপ্ করে বসে পড়লেন। কান্নার সুর ক্রমেই চড়তে লাগলো।
বাঁড়ুয্যে মশায়, মন খারাপ হইতেছে দেখিয়া, আর এক ছিলিমের যোগাড় করিতে চলিলেন।