সচিত্র রেল অবতার/শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি
শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি।
বিনােদ মণ্ডল জাতিতে আগুরি অর্থাৎ উগ্র ক্ষত্রিয়। উপাধিটি শুনিলেই স্বতঃই মনে হয়, এই জাতিকে “উগ্র” নামক বিশেষণে ভূষিত করিবার কোন একটি নিগুঢ় কারণ আছে। আমরা জাতিতত্ত্বের খবর রাখি না, তবে কল্পনায় এ পর্য্যন্ত বলিতে পারি যে, ইঁহাদের প্রকৃতিগত ঔদ্ধত্যই এই বিশেষ আখ্যা পাইবার একমাত্র কারণ। সামরিক হিসাবে যত হউক না হউক, রাগের বেলায় ইঁহাদের পূর্বপুরুষেরা অন্যান্য ক্ষত্রিয় জাতিদিগকে হারাইয়া দিয়াছিলেন। প্রতিবেশীদিগের সহিত নিত্য কলহ করিতেন বলিয়া, অনান্য ক্ষত্রিয় জাতি জোট বাঁধিয়া, এই দুর্দ্ধর্ষ জাতিকে আপনাদের দেশ হইতে তাড়াইয়া দিবার বাসনা করেন। বঙ্গদেশে পাঠানই সাব্যস্ত হয়, কারণ বাঙ্গালার কলাইয়ের দাল ও শীতল জলবায়ুর গুণে, ইঁহাদের উগ্র মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা হইবার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল। ইহার জন্যই বােধ হয় আমরা এই “ক্ষত্রিয় জাতিকে” আত্মীয় স্বজন বিরহিত হইয়া এই বঙ্গদেশে বাস করিতে দেখিয়া আসিতেছি।
বিনোদ মণ্ডলের পূর্ব্ব পুরুষেরা যাহাই করুন না কেন, তাহার বাপ ঠাকুরদাদা কিম্বা প্রপিতামহ কখনও যে তলােয়ার ধরিয়া, লাঙ্গল-ফলকের তাড়নায় জমি চষিয়া খাইত, এ কথা আমরা ইতিহাস না জানিয়াও বেশ বলিতে পারি। হাঁটুর উপরে কাপড় পরিয়া, গামছা কাঁধে লইয়া, লাঙ্গলের বোঁটা ধরিয়া গরু তাড়াইতে তাড়াইতে, যে তাহাদের সহিত নানারূপ সুমধুর সম্বন্ধ স্থাপন করিত, তাহাও আমরা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি। দুইটা গরুর মধ্যে সর্ব্বদা থাকিয়া থাকিয়া, তাহাদের বুদ্ধি তত প্রশংসনীয় ছিলনা। তবে মা ধরিত্রীর কৃপায় ও তাহাদের স্বাভাবিক অধ্যবসায়ের গুণে, ক্ষেত্রগুলি রত্ন প্রসব করিত। অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন, তাহাদের উদ্বৃত্তের মাত্রা বাড়াইত বই কমাইত না। তাই বিনোদ মণ্ডলদের অবস্থা স্বচ্ছল—তাহারা ধনী বলিয়াও খ্যাত ছিল।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ প্রভৃতি ভদ্রলােকদিগের অনুকরণে, গ্রামের মাইনর স্কুলে বিনােদকে ভর্ত্তি করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাহাতে যাহা হইবার তাহা হইল। বিদ্যা বুদ্ধি যত হউক বা না হউক্, বিনােদ কৃষি কিম্বা সাংসারিক কর্ম্মে মােটেই হাত দিত না। টেরি কাটিয়া, কোঁচা দোলাইয়া, ভদ্রলােকদিগের মধ্যে শুদ্ধ ভাষায় কথাবার্ত্তা কহিয়া, বিনােদ আপনার ভদ্রতা প্রতিপন্ন করিবার জন্য সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকিত।
গােবরে শালুক ফোটার মত, বিনোদ আগুরি-কুল উজ্জ্বল করিয়াছিল। তাহার বুদ্ধি বড়ই প্রখর ছিল—সে শঠতায় কাহারও নিকট হারিবার পাত্র ছিল না।
এত বুদ্ধি থাকিলেও, বিনােদ মাইনর পাশ করিতে পারিল না। ঈর্ষাপূর্ণ ভদ্রলােকেরা বলিল—“চাষা ভূষার ছেলের আবার কখন লেখা পড়া হ’য়ে থাকে?” স্বজাতিরা বলিল—“বিনােদের যে লেখা পড়া হইয়াছে তাহাই ঢের। তমসুক, পাট্টা কবুলতি যখন লিখিতে শিখিয়াছে, তখন আপনার গণ্ডা বুঝিয়া লইতে পারিবে। চাষা ভূষার ছেলের আর বেশী বিদ্যায় কাজ কি?”
বিনোদ ঘরে থাকিয়াই চাষ বাস দেখিবে—জিনিষ, জমি বন্ধক রাখিয়া মহাজনী করিবে—আত্মীয় স্বজনেরা এরূপ মনে করিলেও, বিনোদ চাকরী করাই যুক্তিসঙ্গত মনে করিল। ছেলেবেলা হইতেই সে ভদ্রলোকের লিষ্টির মধ্যে নাম ঢুকাইতে চায়। এখন লেখা পড়া শিখিয়া ঘরে বসিয়া থাকিলে, আপনাকে ভদ্র বলিয়া প্রতিপন্ন করিবে কিরূপে?
বাক্স হইতে কিছু টাকা ভাঙ্গিয়া লইয়া, একদিন রাত্রে বিনোদ বাড়ী হইতে পলাইয়া গেল। যেখানে রেলের বড় অফিস আছে—তাহা সে জানিত। টিকিট কাটিয়া, সে সেখানে রওনা হইল।
নূতন জায়গায় আসিলেও, বিনোদ রেলের লোকের সহিত অল্প সময়েই ভাবসাব্ করিয়া লইল। চাকরী কিছু খালি আছে কিনা, ও কেমন করিয়া যোগাড় করা যাইতে পারে, তাহাও জানিয়া লইতে, তাহার বেশী কিছু সময় লাগিল না।
বিনোদের বয়স ১৬৷১৭ বৎসরের বেশী হইবে না। চেহারাটিও নেহাত মন্দ নয়। নানা অসুবিধার কথা বলিয়া কহিয়া সে রেলওয়ে মেসের ভিতর আপনার স্থান করিয়া লইল।
সেই সময় একটি টিকিট-কালেক্টারের চাকরী খালি ছিল, কিন্তু উমেদার অসংখ্য। সকলেই তাহাকে সেই চাকরীটি যোগাড় করিবার জন্য উপদেশ দিল। কারণ, ঐ চাকরীটাতে মাহিনা ছাড়া দুপয়সা বেশ রোজগারের উপায় আছে।
যাঁর হাত দিয়া কার্যটি হইবে, সেই এস্ট্যাবলিসমেণ্ট ক্লার্ক (Establishment clerk) বাবু, একটু বেশী মাত্রায় ঘুষ খাইয়া থাকেন, এ কথা সে রেল বাবুদের নিকট জানিতে পারিয়াছিল।
একখানি দরখাস্ত দিয়া, তার পরদিন প্রাতঃকালে, সে সেই বাবুটির বাসার দিকে চলিল।
বাসার দরজার গোড়া হইতে “বাবু বাসায় আছেন?” বলিয়া দুই তিন বার ডাকিবার পর, একটি পাঁচ ছয় বৎসরের ছেলে বাহির হইয়া আসিল। বলিল—“বাবা বাড়ীতে নাই, কি জানি কোথায় গিয়াছেন।”
বিনোদ ছেলেটিকে কাছে ডাকিল। বলিল—“যাক—তাকে আমার তত বিশেষ দরকার নাই। তোমাকেই সন্দেশ খেতে দিতে এসেছি। এই নাও—খোকা, পাঁচটাকা তোমার মাকে দাওগে যাও। দেখ যেন ফেলে দিও না।”
এই বলিয়া টাকাগুলি খোকার পকেটে ফেলিয়া দিল। খোকা বাড়ীর মধ্যে ঢুকিলে পর, বিনোদ আস্তে আস্তে আপনাদের মেসের দিকে চলিয়া আসিল।
* * *
কেরাণীবাবু বাসায় আসিলে পর, গিন্নির নিকটে শুনিলেন কে একজন তাহার ছেলেকে পাঁচটাকা দিয়া গিয়াছে—অথচ নাম টাম কিছুই বলিয়া যায় নাই। তিনি কিছু ভাবিত হইলেন।
গিন্নি বলিলেন—“ওগো, তুমি ভাবছ কেন? আমি কি লোকটাকে দেখ্তে ছেড়েছি। যে সব বাবুরা প্রায়ই আসে, জিনিষপত্র, টাকাকড়ি দিয়ে যায়—তাদের মধ্যে কেউ নয়। এ একটা ছোকরা, বয়স ১৬|১৭, গোঁফ টোফ কিছুই উঠে নাই।”
কেরাণীবাবু বুঝিতে পারিলেন—বিনোদই এই কার্য্য করিয়াছে। সেই ছেলেটাই টিকিট-কালেক্টারের কাজের জন্য দরখাস্ত করিয়াছে। আর অরি যারা উমেদার—তাদের বয়স বেশী, গোঁফ্, টোফ্, উঠিয়াছে। একটু পরে বলিলেন: —
“দেখ, ছোঁড়াটা একটু বুদ্ধি খেলিয়ে গেছে। পাঁচটাকা আমি নেবোনা জেনে, সে খোকার হাতে টাকা দিয়ে গেছে। বলে গেছে—টাকাগুলো তার সন্দেশ খাবার জন্যে। মনে করেছে—এ কথা বল্লে, সে যে খোকাকে বড় ভাল বাসে, তাই আমি ধরে নেব—তার টাকাটা ফিরিয়ে দিতে না পেরে চাকরীটা তার করে দিতেই হবে। কিন্তু আমি সে বান্দা নই। এ কাজটার জন্য আমি ৫০৲ টাকা পাবার বেশ আশা করি—আর ইনি দিয়েছেন কিনা পাঁচ টাকা!”
গিন্নি কোন উত্তর দিলেন না।
সন্ধ্যার অনেক পরে বিনোদ পুনরায় কেরাণী বাবুর বাসায় গেল। এদিক ওদিক কেহ আছে কিনা দেখিয়া মৃদুস্বরে ডাকিল—“বাবু, বাড়ী আছেন?”
কথা শুনিয়াই কেরাণীবাবু ক্ষিপ্রপদে বাহিরে আসিলেন। তিনি যেন বিনোদেরই অপেক্ষা করিতে ছিলেন।
বিনোদ বলিল—“মশায়, চাকরীটে আমার হয় না? গরীবের যদি কিছু উপকার করেন—সেই জন্যই আজ সকাল বেলা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর্তে এসেছিলাম। আপনি না থাকায়—দেখা হয় নাই।”
কেরাণী বাবু। ও—তুমিই বুঝি খোকাকে পাঁচ টাকা দিয়ে গেছ্লে? তা—ওকি, পাঁচ টাকার কর্ম্ম? খাসা চাক্রী—সাহেবদের মত সর্ব্বদা কোট পেণ্টুলেন্ প’রে থাকা। মাইনেও ১৫৲ টাকা, আর উপরি-আয়ের ত কথাই নাই। এমন কাজটি নিতে গেলে কি এত কমে সার্লে চলে? আমি পাঁচটাকা এনেছি—তুমি ফিরে নিয়ে যাও।
কেরাণীবাবু কিন্তু টাকা ফিরাইবার কোনই উদ্যোগ করিলেন না।
বিনোদ বলিল—“আজ্ঞে আমি গরীবের ছেলে—বেশী টাকা ঘর হইতে আনিতে পারি নাই। আপনি আমার চাকরী করিয়া দিন্, আপনি যাহা চান্—তাহা আমি মাহিনা হইতে দিতে পারিব।”
কেরাণীবাবু বলিলেন—“এরূপ ধারে কারবার চ’লবে না। যদি তুমি নগদ ৫০৲ টাকা দিতে পার, তাহা হইলে আমি চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি। এমন কাজের জন্য ৫০৲ টাকা দেবার লোক ঢের আছে।”
বিনোদ অনেক কাকুতি মিনতি করিল, কিন্তু কেরাণীবাবু কিছুতেই রাজী হইলেন না। আসিবার সময় কেরাণীবাবু পাঁচ টাকা ফিরাইয়া দিতে গেলে, বিনোদ বলিল—আমি ও পাঁচ টাকা যখন আপনার ছেলেকে দিয়াছি, তখন ফিরিয়া নিতে চাই না।”
কেরাণীবাবু দ্বিরুক্তি না করিয়া বাটীতে প্রবেশ করিলেন।
পরদিন সকাল আটটার সময় বিনোদ বড়সাহেবের বাংলার ফটকের কাছে, একটা গাছের নীচে দাঁড়াইয়া রহিল।
বেলা ৮॥০ টার সময় মেম্কে লইয়া, সাহেব হাওয়া খাইয়া ট্রলী (ঠেলা গাড়ী) করিয়া ফিরিয়া আসিলেন। বিনোদ কাছে যাইয়া তাঁহাদিগকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। সাহেব বলিলেন—“কি চাও বাবু?”
বিনোদের ইংরাজী বিদ্যা মাইনর্ পর্যন্ত। সে ইংরাজী বলিবে কি করিয়া? তবে শুনিয়াছিল সাহেব ও মেম দুজনেই বেশ বাঙ্গলা জানেন। তাই বাঙ্গলাতেই বলিল—“হুজুর, আমার মা বাপ নাই—আপনারাই আমার মা বাপ্। অল্প লেখাপড়া শিখিয়াছি, কোথাও চাকরী যুটিতেছে না। একটা টিকিট কালেক্টারের কাজ খালি আছে শুনে, দরখাস্ত করেছি। কিন্তু তাও যে আপনার নিকট পৌঁছায় তার আশা নাই। এস্ট্যাবলিস্মেণ্ট বাবু পাঁচ টাকা নিয়েছেন—কিন্তু এখন কাজও করে দিচ্ছেন না—টাকাও ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। আমাকে এবার না খেয়ে মর্তে হবে। হুজুর, আমি শুনেছি, আপনি বড় দয়ালু, আমার একটা কাজ আপনাকে করে দিতেই হবে।”
নেহাৎ বালক দেখিয়া,সাহেব বিনোদের কথা গুলি ধীরভাবে শুনিতেছিলেন। তাহার আবদারের সহিত কথা গুলি শুনিয়া, সাহেব ও মেমের তাহার প্রতি কেমন একটু দয়া হইল। সাহেব বলিলেন—“তুমি আমার সঙ্গে আফিসে দেখা করিও। কাজ পাইবে, ভাবনা নাই।”
বিনোদ সেলাম করিয়া হাসিমুখে মেসে ফিরিয়া গেল।
বেলা দশটার সময় অফিসে আসিয়াই, সাহেব এস্ট্যাবলিস্মেণ্ট ক্লার্ককে ডাকিয়া পাঠাইলেন। যে ছোকরা টিকিট কালেক্টারের কাজের জন্য দরখাস্ত করিয়াছে, তাহার দরখাস্তখানি তাঁহাকে হাজির করিতে বলিলেন। কেরাণীবাবুর বুঝিতে বাকী রহিল না—বিনোদই সেই ছোকরা।
দরখাস্তখানি ও বিনোদকে সঙ্গে লইয়া আসিলে, সাহেব কেরাণীবাবুকে বলিলেন—“আমি এই ছোকরাটিকে টিকিট কালেক্টারের কাজে নিযুক্ত করিলাম। ইহার বাহাল করা চিঠি আজই বাহির করিয়া দাও। আর তুমি যে পাঁচটাকা ইহার নিকট হইতে ঘুষ লইয়াছ, তাহা এখনই ফিরাইয়া দিবে। ফের্ যদি ঘুষ খাইয়াছ শুনিতে পাই, তা হ’লে তোমাকে ডিস্মিস করিব—মনে রাখিও।”
কেরাণীবাবু আমতা আমতা করিয়া বলিলেন—“হুজুর, টাকা আমার ছেলের হাতে দিয়াছিল। আমি ফিরাইয়া দিতে চাহিলেও লয় নাই। আমার দোষ কি, হুজুর?”
সাহেব বলিলেন—“আমাকে বোকা বুঝাইও না। তোমাদের বিদ্যা বুদ্ধি জানিতে আমার বাকী নাই। বুড়া হইয়াছ—একটু সাবধানে কাজ করিও।”
কেরাণীবাবু আর দ্বিরুক্তি না করিয়া চলিয়া গেলেন।
বিনোদের উপর খুবই আক্রোশ হইল, কিন্তু সাহেবের ভয়ে কিছুই করিতে পারিলেন না।
বিনোদ সাহেব ও মেমের খুব প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিল। বুদ্ধিমান বিনোদ সুযোগ ছাড়িয়া দিবার ছেলে নয়। টপাটপ পরীক্ষাগুলা পাশ করিয়া এসিষ্টাণ্ট স্টেশন-মাষ্টার হইল। এ দিকে সাহেবও লম্বা ছুটী লইয়া বিলাত চলিয়া গেলেন।
কেরাণীবাবুর, বিনোদের উপর জাতক্রোধ ছিল। ঐ বড় সাহেব ছিলেন বলিয়া কিছুই করিতে পারেন নাই। এখন শোধ নিতে লাগিলেন। বিনোদ রিলিভিং লিষ্টে এখান, সেখান করিয়া বেড়ায়। দরখাস্ত করিয়াও কোন এক জায়গায় পাকা বাহাল হইতে পারে না।
একদিন সন্ধ্যার সময় রেলওয়ে-মেসে চাকরী সম্বন্ধীয়, নানা কথা হইতেছিল। এক জায়গার এসিষ্টাণ্টের পদ খানি হইয়াছিল। সে ষ্টেশনটিও ভাল—বেশ দু পয়সাও আছে। বিনোদও সে পদটার জন্য দরখাস্ত করিতে ছাড়ে নাই। কথায় কথায় শুনিল—তাহাদেরই মধ্যে একজন বেশী টাকা ঘুষ দিয়া সেই কাজটা পাইবার চেষ্টা করিতেছে। বোধ হয় তাহারই হইবে।
গতিক দেখিয়া, সময় সময় বিনোদেরও ঘুষ দিবার ইচ্ছা হইত। কি করিবে?—এমন করিয়া কতদিন কাটাইবে? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইত—সে ঘুষ দিবে কাহাকে?—সেই কেরাণী বাবুকে?—রামচন্দ্র!
মেসের একজন বলিল—“বিনোেদ! বুড়াে মুখুয্যের সঙ্গে গােলমাল করে ভাল ক’রনি। দেখছ ত, কেমন টেরটা পাচ্ছ। গােলমাল না থাক্লে, কিছু ঘুষ টুস দিয়ে এতদিন অনায়াসে এক জায়গায় পাকা বাহাল হ’য়ে যেতে পারতে। এমন কি—এই কাজটাও তােমার হ’য়ে যেতে পারত।”
সকলেই সেই কথায় সায় দিল।
বিনােদের চোখ মুখ লাল হইয়া উঠিল। সে চেঁচাইয়া বলিল—“ও বুড়াে বেটাকে ঘুষ টুস্ দেওয়া, কি খােসামুদি করা, আমা দিয়ে হবে না। আমি যদি বাপের বেটা হই—তা হলে, জোর করেই এ কাজটা আমি বুড়াের কাছ থেকে নেব। তােমরা পরে দেখ্তে পাবে।”
লােকেরা অবিশ্বাসের হাসি হাসিল।
পরদিন আফিসে যাইয়া বিনােদ কেরাণী বাবুকে বলিল— “দেখুন মুখুয্যে মশায় আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ কথা আছে—বড়ই জরুরী। আপনি যখন আফিস থেকে্ যাবেন, তখন কথাটা শুন্তে পাবেন।”
মুখুয্যে মশায় ত তখনই কথাটা শুনিবার জন্য অস্থির। বিনােদ কিন্তু কথাটা কিছুতেই তখন বলিল না।
আফিস ভাঙ্গিবার পর, যখন বুড়াে মুখুয্যে মশায় বাহিরে আসিলেন—তখন বিনােদ তাঁহাকে একটা নিরিবিলি জায়গায় ডাকিয়া লইয়া গেল। বলিল— “আর কিছু কথা নয় মুখুয্যে মশায়। এই বলছিলুম কি—যে চাকরীটে খালি হয়েছে, সেটা আমার চাই-ই। যদি ভাল চান্—তবে গােলমালটি না করে কালই চিঠিখানা বার করে দেবেন। না হ’লে জান্বেন—আপনার বরাতে, বউ বেটা নিয়ে পুড়ে মরা আছে। আমি আগুরির ছেলে—তাতে ডাঙ্গপিটে। আমার অসাধ্য কিছুই নাই জান্বেন। যদি না আপনাকে সবশুদ্ধ পুড়িয়ে মারি—তা হলে জান্বেন আমি বাপের বেটা নই।”
এই বলিয়া বিনােদ সেখান হইতে চলিয়া গেল। মুখুয্যে মশায় তাহাকে কতই ডাকিলেন সে ভ্রুক্ষেপও করিল না।
পরদিন বৈকালবেলায় হাসিতে হাসিতে, চিঠি লইয়া বিনােদ সবাইকে দেখাইতে লাগিল। সকলেই বলিল—“তাই ত হে বিনােদ, কেমন করে এ কাজটা করলে বল দেখি?—”
বিনােদ যাহা করিয়াছিল তাহা বলিল। সকলেই স্বীকার করিল—বিনােদ একটী ছেলে বটে!
সেই অবধি মুখুয্যেমহাশয় বিনােদকে দেখিলে, ভয়ে আধ খানা হইয়া যাইতেন। বিনােদও ভাল ষ্টেশন ছাড়া কখনও মন্দ ষ্টেশনে যায় নাই।