ইস্‌টেশন

সকাল বিকাল ইস্‌টেশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালোবাসি।
ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে;
ভাঁটির ট্রেনে কেউ বা চড়ে, কেউ বা উজান ট্রেনে।
সকাল থেকে কেউ বা থাকে বসে,
কেউ বা গাড়ি ফেল করে তার শেষ মিনিটের দোষে।—
দিনরাত গড়্-গড়্ ঘড়্-ঘড়্
গাড়ি-ভরা মানুষের ছোটে ঝড়।
ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে
কভু পশ্চিমে কভু পূর্বে।

চলচ্ছবির এই-যে মূর্তিখানি
মনেতে দেয় আনি
নিত্য-মেলার নিত্য-ভোলার ভাষা—
কেবল যাওয়া-আসা।
মঞ্চতলে দণ্ডে পলে ভিড় জমা হয় কত—
পতাকাটা দেয় দুলিয়ে, কে কোথা হয় গত!
এর পিছনে সুখ দুঃখ ক্ষতি লাভের তাড়া
দেয় সবলে নাড়া— সময়ের ঘড়ি-ধরা অঙ্কেতে
ভোঁ ভোঁ ক’রে বাঁশি বাজে সংকেতে।
দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই—
কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই।

ওদের চলা ওদের প’ড়ে থাকায়
আর কিছু নেই, ছবির পরে কেবল ছবি আঁকায়।
থানিকক্ষণ যা চোখে পড়ে তার পরে যায় মুছে,
আত্ম-অবহেলার খেলা নিত্যই যায় ঘুচে।

ছেঁড়া পটের টুকরো জমে পথের প্রান্ত জুড়ে,
তপ্ত দিনের ক্লান্ত হাওয়ায় কোন্‌খানে যায় উড়ে।
‘গেল গেল’ ব’লে যারা ফুকরে কেঁদে ওঠে
ক্ষণেক-পরে কান্না-সমেত তারাই পিছে ছোটে।—
ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,
এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।
মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,
নিমিষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে।

চিত্রকরের বিশ্বভুবনখানি,
এই কথাটাই নিলেম মনে মানি।
কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা—
আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়, দেখার জিনিস এটা।
কালের পরে যায় চলে কাল, হয় না কভু হারা
ছবির বাহন চলাফেরার ধারা।
দুবেলা সেই এ সংসারের চলতি ছবি দেখা,
এই নিয়ে রই যাওয়া-আসার ইস্‌টেশনে একা।—
এক তূলি ছবিখানা এঁকে দেয়,
আর তূলি কালী তাহে মেখে দেয়।
আসে কারা এক দিক হতে ওই,
ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ওই।

শান্তিনিকেতন
৭ জুলাই ১৯৩৮