সঞ্চয়িতা/প্রচ্ছন্ন (২)

প্রচ্ছন্ন

কোথা ছায়ার কোণে দাঁড়িয়ে তুমি কিসের প্রতীক্ষায়
কেন আছ সবার পিছে?
যারা ধুলা পায়ে ধায় গো পথে তোমায় ঠেলে যায়,
তারা তোমায় ভাবে মিছে।
আমি তোমার লাগি কুসুম তুলি, বসি তরুর মূলে,
আমি সাজিয়ে রাখি ডালি—
ওগো, যে আসে সেই একটি-দুটি নিয়ে যে যায় তুলে,
আমার সাজি হয় যে খালি।

ওগো, সকাল গেল, বিকাল গেল, সন্ধ্যা হয়ে আসে—
চোখে লাগছে ঘুমঘোর।
সবাই ঘরের পানে যাবার বেলা আমায় দেখে হাসে,
মনে লজ্জা লাগে মোর।
আমি বসে আছি বসনখানি টেনে মুখের ’পরে
যেন ভিখারিনির মতো,
কেহ শুধায় যদি ‘কী চাও তুমি’ থাকি নিরুত্তরে
করি দুটি নয়ন নত।

আজি কোন্ লাজে বা বলব আমি তোমায় শুধু চাহি,
আমি বলব কেমন করে—
শুধু তোমারি পথ চেয়ে আমি রজনী দিন বাহি,
তুমি আসবে আমার তরে!
আমার দৈন্যখানি যত্নে রাখি, রাজৈশ্বর্যে তর
তারে দিব বিসর্জন—
ওগো, অভাগিনির এ অভিমান কাহার কাছে কব?
তাহা রইল সংগোপন।

আমি সুদূর-পানে চেয়ে চেয়ে ভাবি আপন-মনে
হেথা তৃণে আসন মেলে—
তুমি হঠাৎ কখন আসবে হেথায় বিপুল আয়োজনে
তোমার সকল আলো জ্বেলে।
তোমার রথের ’পরে সোনার ধ্বজা ঝলবে ঝলমল,
সাথে বাজবে বাঁশির তান—
তোমার প্রতাপ-ভরে বসুন্ধরা করবে টলমল,
আমার উঠবে নেচে প্রাণ।

তখন পথের লোকে অবাক হয়ে সবাই চেয়ে রবে,
তুমি নেমে আসবে পথে।
হেসে দু হাত ধ’রে ধুলা হতে আমায় তুলে লবে—
তুমি লবে তোমার রথে।
আমার ভূষণ-বিহীন মলিন বেশে ভিখারিনির সাজে
তোমার দাঁড়াব বাম পাশে,
তখন লতার মতো কাঁপব আমি গর্বে সুখে লাজে
সকল বিশ্বের সকাশে।


ওগো, সময় বয়ে যাচ্ছে চলে, রয়েছি কান পেতে—
কোথা  কই গো চাকার ধ্বনি!
তোমার এ পথ দিয়ে কত-না লোক গর্বে গেল মেতে
কতই জাগিয়ে রনরনি।
তবে তুমিই কি গো নীরব হয়ে রবে ছায়ার তলে,
তুমি  রবে সবার শেষে!
হেথায় ভিখারিনির লজ্জা কি গো ঝরবে নয়ন-জলে—
তারে রাখবে মলিন বেশে?

শান্তিনিকেতন
২ আষাঢ় ১৩১৩