সঞ্চয়িতা/রাহুর প্রেম
রাহুর প্রেম
শুনেছি আমারে ভালোই লাগে না, নাই বা লাগিল তোর।
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লোহার শিকল-ডোর।
তুই তো আমার বন্দী অভাগী, বাঁধিয়াছি কারাগারে,
প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে।
জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি,
যেথায় বসিবি, যেথায় দাঁড়াবি,
বসন্তে শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণ প্রাণ চিরশৃঙ্খল চরণ জড়ায়ে ধ’রে—
একবার তোরে দেখেছি যখন কেমনে এড়াবি মোরে?
চাও নাহি চাও, ডাক’ নাই ডাক’,
কাছেতে আমার থাক’ নাই থাক’,
যাব সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি—
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ, এ অশ্রুজল, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্যের মতন বাজিবে সাথে সাথে দিবানিশি।
নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া;
কিবা সে রোদনে, কিবা সে হাসিতে,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে
কভু সম্মুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিন প্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে,
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখ-পানে।
যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার আঁধার মুরতি আঁকা—
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে, জগৎ পড়িবে ঢাকা।
দুঃস্বপনের মতো চিরকাল তোমারে রহিব ঘিরে,
দিবসরজনী এ মুখ দেখিব তোমার নয়ননীরে।
চিরভিক্ষার মতন দাঁড়ায়ে রব সম্মুখে তোর।
‘দাও দাও’ ব’লে কেবলি ডাকিব, ফেলিব নয়নলোর।
কেবলি সাধিব, কেবলি কাঁদিব, কেবলি ফেলিব শ্বাস,
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে করিব রে হাহুতাশ।
মোর এক নাম কেবলি বসিয়া জপিব কানেতে তব,
কাঁটার মতন দিবসরজনী পায়েতে বিঁধিয়ে রব।
গত জনমের অভিশাপ-সম রব আমি কাছে কাছে।
ভাবী জনমের অদৃষ্ট-হেন বেড়াইব পাছে পাছে।
যেন রে অকূল সাগর-মাঝারে ডুবেছে জগৎ-তরী,
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী—
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি,
যুঝিস ছাড়াতে, ছাড়িব না তবু মহাসমুদ্র-’পরি ৷
পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ,
পলে পলে তোর বাহু বলহীন,
দোঁহে অনন্তে ডুবি নিশিদিন, তবু আছি তোরে ধরি।
রোগের মতন বাঁধিব তোমারে দারুণ আলিঙ্গনে—
মোর যাতনায় হইবি অধীর,
আমারি অনলে দহিবে শরীর,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর কিছু না রহিবে মনে
ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি, কেবল দেখিবি মোরে—
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি চাহিয়া দেখিছে তোরে।
নিশীথে বসিয়া থেকে থেকে তুই শুনিবি আঁধারঘোরে
কোথা হতে এক ঘোর উন্মাদ ডাকে তোর নাম ধ’রে
নিরজন পথে চলিতে চলিতে সহসা সভয় গণি
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি আমার হাসির ধ্বনি।
হেরো তমোঘন মরুময়ী নিশা—
আমার পরান হারায়েছে দিশা,
অনন্ত ক্ষুধা অনন্ত তৃষা করিতেছে হাহাকার।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে,
এ ঘোর পিপাসা যুগযুগান্তে মিটিবে কি কভু আর!
বুকের ভিতরে ছুরির মতন,
মনের মাঝারে বিষের মতন,
রোগের মতন, শোকের মতন রব আমি অনিবার।
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে, আশার পিছনে ভয়—
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরাময়।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া এই তো নিয়ম ভবে—
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে।