সঞ্চয়িতা/সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়

সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়

দেশশূন্য কালশূন্য জ্যোতিঃশূন্য মহাশূন্য-’পরি
চতুর্মুখ করিছেন ধ্যান।
সহসা আনন্দসিন্ধু হৃদয়ে উঠিল উথলিয়া,
আদিদেব খুলিলা নয়ান।

চারি মুখে বাহিরিল বাণী,
চারি দিকে করিল প্রয়াণ।
সীমাহারা মহা-অন্ধকারে,
সীমাশূন্য ব্যোমপারাবারে,
প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো,
আশাপূর্ণ অতৃপ্তির প্রায়,
সঞ্চরিতে লাগিল সে ভাষা।

আনন্দের আন্দোলনে ঘন ঘন বহে শ্বাস, 
অষ্ট নেত্রে বিস্ফুরিল জ্যোতি।
জ্যোতির্ময় জটাজাল কোটিসূর্যপ্রভা বহি 
দিগ্বিদিকে পড়িল ছড়ায়ে।

জগতের গঙ্গোত্রীশিখর হতে
শত শত স্রোতে
উচ্ছ্বসিল অগ্নিময় বিশ্বের নির্ঝর,
স্তব্ধতার পাষাণহৃদয়
শত ভাগে গেল বিদীরিয়া।

নূতন সে প্রাণের উল্লাসে
নূতন সে প্রাণের উচ্ছ্বাসে
বিশ্ব যবে হয়েছে উন্মাদ,
অনন্ত আকাশে দাঁড়াইয়া
চারি দিকে চারি হাত দিয়া
বিষ্ণু আসি কৈলা আশীর্বাদ।
লইয়া মঙ্গলশঙ্খ করে
কাঁপায়ে জগৎ-চরাচরে
বিষ্ণু আসি কৈলা শঙ্খনাদ।

থেমে এল প্রচণ্ড কল্লোল,
নিভে এল জ্বলন্ত উচ্ছ্বাস,
গ্রহগণ নিজ অশ্রুজলে
নিভাইল নিজের হুতাশ।
জগতের মহাবেদব্যাস
গঠিলা নিখিল-উপন্যাস,
বিশৃঙ্খল বিশ্বগীতি লয়ে
মহাকাব্য করিলা রচন।
চক্রপথে ভ্রমে গ্রহ তারা,
চক্রপথে রবি শশী ভ্রমে,
শাসনের গদা হস্তে লয়ে
চরাচর রাখিলা নিয়মে।
মহাছন্দ মহা-অনুপ্রাস
শূন্যে শূন্যে বিস্তারিল পাশ।


অতল মানসসরোবরে
বিষ্ণুদেব মেলিল নয়ন।
আলোককমলদল হতে
উঠিল অতুল রূপরাশি।
ছড়ালো লক্ষ্মীর হাসিখানি—
মেঘেতে ফুটিল ইন্দ্রধনু,
কাননে ফুটিল ফুলদল।
জগতের মত্ত কোলাহল
রাগিণীতে হল অবসান।
কোমলে কঠিন লুকাইল,
শক্তিরে ঢাকিল রূপরাশি।

মহাছন্দে বন্দী হল যুগ যুগ যুগ-যুগান্তর— 
অসীম জগৎ-চরাচর
অবশেষে শ্রান্তকলেবর,
নিদ্রা আসে নয়নে তাহার,
আকর্ষণ হতেছে শিথিল,
উত্তাপ হতেছে একাকার।
জগতের প্রাণ হতে
উঠিল আকুল আর্তস্বর—
‘জাগো জাগো জাগো মহাদেব,
অলঙ্ঘ্য নিয়মপথে ভ্রমি
হয়েছে বিশ্রান্ত কলেবর,
আমারে নূতন দেহ দাও।
গাও দেব, মরণসংগীত,
পাব মোরা নূতন জীবন।’

জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর,
তিন-কাল-ত্রিনয়ন মেলি
হেরিলেন দিক্-দিগন্তর।
প্রলয়পিনাক তুলি  করে ধরিলেন শূলী 
পদতলে জগৎ চাপিয়া,
জগতের আদি-অন্ত থরথর থরথর 
উঠিল কাঁপিয়া।
ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল জগতের সমস্ত বাঁধন। 
উঠিল অসীম শূন্যে গরজিয়া তরঙ্গিয়া 
ছন্দোমুক্ত জগতের উন্মত্ত আনন্দকোলাহল। 
মহা-অগ্নি উঠিল জ্বলিয়া—
জগতের মহাচিতানল।

খণ্ড খণ্ড রবি শশী, চূর্ণ চূর্ণ গ্রহ তারা 
বিন্দু বিন্দু আঁধারের মতো
বরষিছে চারি দিক হতে,
অনলের তেজোময় গ্রাসে
মুহূর্তেই যেতেছে মিশায়ে।
সৃজনের আরম্ভ-সময়ে
আছিল অনাদি অন্ধকার,
সৃজনের ধ্বংস-যুগান্তরে
রহিল অসীম হুতাশন।
অনন্ত-আকাশ-গ্রাসী অনলসমুদ্র-মাঝে 
মহাদেব মুদি ত্রিনয়ান
করিতে লাগিল। মহাধ্যান।