সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/চতুর্থ সর্গ
চতুর্থ সর্গ
নমি আমি, কবি-গুরু, তব পদাম্বুজে,
বাল্মীকি! হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি,
তব অনুগামী দাস, রাজেন্দ্র-সঙ্গমে
দীন যথা যায় দূর তীর্থ-দরশনে!
তব পদচিহ্ন ধ্যান করি দিবানিশি,
পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে,
দমনিয়া ভব-দম দুরন্ত শমনে—
অমর! শ্রীভর্ত্তৃহরি; সুরী ভবভূতি
শ্রীকণ্ঠ; ভারতে খ্যাত বরপুত্ত্র যিনি
ভারতীর, কালিদাস—সুমধুরভাষী;
মুরারি-মুরলীধ্বনি-সদৃশ মুরারি
মনোহর; কীর্ত্তিবাস কীর্ত্তিবাস কবি,
এ বঙ্গের অলঙ্কার! হে পিতঃ, কেমনে,
কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে
মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি?
গাঁথিব নূতন মালা, তুলি সযতনে
তব কাব্যোদ্যানে ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে
বিবিধ ভূষণে ভাষা; কিন্তু কোথা পাব
(দীন আমি!) রত্নরাজী, তুমি নাহি দিলে,
রত্নাকর? কৃপা, প্রভু, কর অকিঞ্চনে।
ভাসিছে কনক-লঙ্কা আনন্দের নীরে,
সুবর্ণ-দীপ-মালিনী, রাজেন্দ্রাণী যথা
রত্নহারা! ঘরে ঘরে বাজিছে বাজনা;
নাচিছে নর্ত্তকী-বৃন্দ, গাইছে সুতানে
গায়ক; নায়কে লয়ে কেলিছে নায়কী,
খল খল খল হাসি মধুর অধরে!
কেহ বা সুরতে রত, কেহ শীধু পানে।
দ্বারে দ্বারে ঝোলে মালা গাঁথা ফল-ফুলে;
গৃহাগ্রে উড়িছে ধ্বজ; বাতায়নে বাতি;
জনস্রোতঃ রাজপথে বহিছে কল্লোলে,
যথা মহোৎসবে, যবে মাতে পুরবাসী।
রাশি রাশি পুষ্প-বৃষ্টি হইছে চৌদিকে—
সৌরভে পূরিয়া পুরী। জাগে লঙ্কা আজি
নিশীথে, ফিরেন নিদ্রা দুয়ারে দুয়ারে,
কেহ নাহি সাধে তাঁরে পশিতে আলয়ে,
বিরাম বর প্রার্থনে!—“মারিবে বীরেন্দ্র
ইন্দ্রজিৎ, কালি রামে; মারিবে লক্ষ্মণে;
সিংহনাদে খেদাইবে শৃগাল-সদৃশ
বৈরি-দলে সিন্ধুপারে; আনিবে বাঁধিয়া
বিভীষণে; পলাইবে ছাড়িয়া চাঁদেরে
রাহু; জগতের আঁখি জুড়াবে দেখিয়া
পুনঃ সে সুধাংশু-ধনে;” আশা মায়াবিনী,
পথে, ঘাটে, ঘরে, দ্বারে, কাননে,
গাইছে গো এই গীত আজি রক্ষঃপুরে—
কেননা ভাসিবে রক্ষঃ আহ্লাদ-সলিলে?
একাকিনী শোকাকুলা, অশোক কাননে,
কাঁদেন রাঘব-বাঞ্ছা, আঁধার-কুটীরে
নীরবে! দুরন্ত চেড়ী, সতীরে ছাড়িয়া,
ফেরে দুরে মত্ত সবে উৎসব-কৌতুকে—
হীন-প্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী
নির্ভয়-হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে!
মলিন বদনা দেবী, হায় রে, যেমতি
খনির তিমির-গর্ভে (না পারে পশিতে
সৌর-কর-রাশি যথা।) সূর্য্যকান্ত মণি;
কিম্বা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশি তলে।
স্বনিছে পবন, দূরে রহিয়া রহিয়া,
উচ্ছ্বাসে বিলাপী যথা। নড়িছে বিষাদে
মর্ম্মরিয়া পাতাকুল। বসেছে অরবে
শাখে পাখী। রাশি রাশি কুসুম পড়েছে
তরুমূলে; যেন তরু, তাপি মনস্তাপে,
ফেলিয়াছে খুলি সাজ! দূরে প্রবাহিণী,
উচ্চ-বীচি-রবে কাঁদি, চলিছে সাগরে,
কহিতে বারিশে যেন এ দুঃখ-কাহিনী!
না পশে সুধাংশু-অংশু সে ঘোর বিপিনে;
ফোটে কি কমল কভু সমল-সলিলে?
তবুও উজ্জ্বল বন ও অপূর্ব্ব-রূপে!
একাকিনী বসি দেবী, প্রভা-আভাময়ী
তমোময় ধামে যেন! হেন কালে তথা,
সরমাসুন্দরী আসি, বসিলা কাঁদিয়া
সতীর চরণ-তলে; সরমা-সুন্দরী—
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী রক্ষোবধূ-বেশে!
কতক্ষণে চক্ষুজল মুছি সুলোচনা
কহিলা মধুর স্বরে;—“দুরন্ত-চেড়ীরা,
তোমারে ছাড়িয়া, দেবি, ফিরিছে নগরে,
মহোৎসবে রত সবে আজি নিশাকালে;
এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে
পা-দুখানি! আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া
সিন্দুর; করিলে আজ্ঞা, সুন্দর ললাটে
দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে
এ বেশ? নিষ্ঠুর, হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি!
কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ? কেমনে হরিল
ও বরাঙ্গ-অলঙ্কার, বুঝিতে না পারি!”
কৌটা খুলি, রক্ষোবধূ যত্নে দিলা ফোঁটা
সীমন্তে! সিন্দুর বিন্দু শোভিল ললাটে,
গোধুলি-ললাটে, আহা! তারা-রত্ন যথা।
দিয়া ফোঁটা, পদধূলি লইলা সরমা।
“ক্ষম লক্ষ্মি! ছুঁইনু ও দেব-আকাঙ্ক্ষিত
তনু; কিন্তু চিরদাসী দাসী ও চরণে!”
এতেক কহিয়া পুনঃ বসিলা যুবতী
পদতলে; আহা মরি, সুবর্ণ-দেউটী
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
দশ দিশ। মৃদুস্বরে কহিলা মৈথিলী;—
“বৃথা গঞ্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখি!
আপনি খুলিয়া আমি ফেলাইনু দূরে
আভরণ, যবে পাপী আমারে ধরিল
বনাশ্রমে। ছড়াইনু পথে সে সকলে,
চিহ্নহেতু। সেই সেতু আনিয়াছে হেথা—
এ কনক-লঙ্কাপুরে—ধীর রঘুনাথে।
মণি, মুক্তা, রতন, কি আছে লো জগতে,
যাহে নাহি অবহেলি লভিতে সে ধনে?”
কহিলা সরমা; “দেবি! শুনিয়াছে দাসী
তব স্বয়ম্বর কথা তব সুধা-মুখে;
কেন বা আইলা বনে রঘুকুল-মণি।
কহ এবে দয়া করি, কেমনে হরিল
তোমারে রক্ষেন্দ্র, সতি! এই ভিক্ষা করি,—
দাসীর এ তৃষা তোষ সুধা-বরিষণে।
দূরে দুষ্ট চেড়ীদল; এই অবসরে
কহ মোরে বিবরিয়া, শুনি সে কাহিনী।
কি ছলে ছলিল রামে, ঠাকুর-লক্ষ্মণে
এ চোর? কি মায়াবলে রাঘবের ঘরে
প্রবেশি, করিল চুরি—হেন রতনে?”
যথা গোমুখীর মুখ হইতে সুস্বনে
ঝরে পূত বারিধারা, কহিলা জানকী,
মধুরভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি
সরমারে;—“হিতৈষিণী সীতার পরমা
তুমি, সখি! পূর্ব্বকথা শুনিবারে যদি
ইচ্ছা তব, কহি আমি, শুন মন দিয়া;—
“ছিনু মোরা, সুলোচনে! গোদাবরী-তীরে,
কপোত-কপোতী যথা উচ্চ-বৃক্ষ-চূড়ে
বাঁধি নীড় থাকে সুখে! ছিনু ঘোর বনে,
নাম পঞ্চবটী; মর্ত্ত্যে সুর-বন সম।
সদা করিতেন সেবা লক্ষ্মণ সুমতি।
দণ্ডক ভাণ্ডার যার, ভাবি দেখ মনে,
কিসের অভাব তার? যোগাতেন আনি
নিত্য ফল-মূল বীর-সৌমিত্রি; মৃগয়া
করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীবনাশে
সতত বিরত, সখি, রাঘবেন্দ্র বলী,—
দয়ার সাগর নাথ, বিদিত জগতে।
“ভুলিনু পূর্ব্বের সুখ; রাজার নন্দিনী,
রঘুকুলবধূ আমি; কিন্তু এ কাননে,
পাইনু, সরমা সই, পরম পিরীতি!
কুটীরের চারিদিকে কত যে ফুটিত
ফুলকুল নিত্য নিত্য, কহিব কেমনে?
পঞ্চবটী-বনচর মধু নিরবধি!
জাগা’ত প্রভাতে মোরে, কুহরি সুস্বরে
পিকরাজ! কোন্ রাণী, কহ, শশিমুখি!
হেন চিত্ত-বিনোদন বৈতালিক-গীতে
খোলে আঁখি? শিখীসহ, শিখিনী সুখিনী
নাচিত দুয়ারে মোর। নর্ত্তক-নর্ত্তকী,
এ দোঁহার সম, রামা, আছে কি জগতে?
অতিথি আসিত নিত্য করভ, করভী,
মৃগশিশু, বিহঙ্গম, স্বর্ণ-অঙ্গ কেহ,
কেহ শুভ্র, কেহ কাল, কেহ বা চিত্রিত,
যথা বাসবের ধনু ঘনবর-শিরে;
অহিংসক জীব যত। সেবিতাম সবে
মহাদরে, পালিতাম পরম যতনে,
মরুভূমে স্রোতস্বতী তৃষাতুরে যথা,
আপনি সুজলবতী বারিদ-প্রসাদে।
সরসী আরসী মোর! তুলি কুবলয়ে,
(অতুল রতনসম) পরিতাম কেশে;
সাজিতাম ফুলসাজে; হাসিতেন প্রভু,
বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি কৌতুকে।
হায়, সখি, আর কি লো পাব প্রাণনাথে?
আর কি এ পোড়া আঁখি এ ছার জনমে
দেখিবে সে পা-দুখানি—আশার সরসে
রাজীব, নয়ন-মণি? হে দারুণ-বিধি!
কি পাপে পাপী এ দাসী তোমার সমীপে?”
এতেক কহিয়া দেবী কাঁদিলা নীরবে!
কাঁদিলা সরমা-সতী তিতি অশ্রুনীরে।
কতক্ষণে চক্ষু-জল মুছি রক্ষোবধূ
সরমা, কহিলা সতী সীতার চরণে;—
“স্মরিলে পূর্ব্বের কথা ব্যথা মনে যদি
পাও, দেবি, থাক্ তবে; কি কাজ স্মরিয়া?—
হেরি তব অশ্রুবারি ইচ্ছি মরিবারে!”
উত্তরিলা প্রিয়ম্বদা (কাদম্বা যেমতি
মধু-স্বরা)—“এ অভাগী, হায় লো সুভগে!
যদি না কাঁদিবে, তবে কে আর কাঁদিবে
এ জগতে? কহি, শুন, পূর্ব্বের কাহিনী।
বরিষার কালে, সখি, প্লাবন-পীড়নে
কাতর প্রবাহ, ঢালে, তীর অতিক্রমি,
বারিরাশি দুই পাশে; তেমতি যে মনঃ
দুঃখিত, দুঃখের কথা কহে সে অপরে।
তেঁই আমি কহি, তুমি শুন লো সরমে!
কে আছে সীতার আর এ অররু-পুরে?
“পঞ্চবটী বনে মোরা গোদাবরী-তটে
ছিনু সুখে। হায়, সখি, কেমনে বর্ণিব
সে কান্তার-কান্তি আমি? সতত স্বপনে
শুনিতাম বন-বীণা বন-দেবী-করে;
সৌরকর রাশি-বেশে সুরবালা-কেলি
পদ্মবনে; কভু সাধ্বী-ঋষিবংশবধূ
সুহাসিনী, আসিতেন দাসীর কুটীরে,
সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে।
অজিন (রঞ্জিত, আহা, কত শত রঙে!)
পাতি বসিতাম কভু দীর্ঘ তরু-মূলে,
সখী ভাবে সম্ভাষিয়া ছায়ায়; কভু বা
কুরঙ্গিণী-সঙ্গে রঙ্গে নাচিতাম বনে;
গাইতাম গীত, শুনি কোকিলের ধ্বনি।
নব-লতিকার, সতি, দিতাম বিবাহ
তরুসহ; চুম্বিতাম, মঞ্জরিত যবে
দম্পতি, মঞ্জরীবৃন্দে, আনন্দে সম্ভাষি
নাতিনী বলিয়া সবে! গুঞ্জরিলে অলি,
নাতিনী-জামাই বলি বরিতাম তারে।
কভু বা প্রভুর সহ ভ্রমিতাম সুখে
নদীতটে; দেখিতাম তরল-সলিলে
নূতন গগন যেন, নব তারাবলী,
নব নিশাকান্ত-কান্তি! কভু বা উঠিয়া
পর্ব্বত-উপরে, সখি, বসিতাম আমি
নাথের চরণ তলে, ব্রততী যেমতি
বিশাল রসাল-মূলে; কত যে আদরে
তুষিতেন প্রভু মোরে, বরষি বচন-
সুধা, হায়, কব কারে? কর বা কেমনে?
শুনেছি কৈলাসপুরে কৈলাস-নিবাসী
ব্যোমকেশ, স্বর্ণাসনে বসি গৌরী-সনে,
আগম, পুরাণ, বেদ, পঞ্চতন্ত্র কথা
পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে;
শুনিতাম সেইরূপে আমিও, রূপসি,
নানা কথা! এখনও এ বিজন বনে,
ভাবি, আমি শুনি যেন সে মধুর বাণী!
সাঙ্গ কি দাসীর পক্ষে, হে নিষ্ঠুর বিধি!
সে সঙ্গীত?” নীরবিলা আয়ত-লোচনা
বিষাদে। কহিলা তবে সরমা সুন্দরী;—
“শুনিলে তোমার কথা, রাঘব-রমণি,
ঘৃণা জন্মে রাজ-ভোগে! ইচ্ছা করে, ত্যজি
রাজ্যসুখ, যাই চলি হেন বনবাসে!
কিন্তু ভেবে দেখি যদি, ভয় হয় মনে।
রবিকর যবে, দেবি, পশে বনস্থলে
তমোময়, নিজগুণে আলো করে বনে
সে কিরণ; নিশি যবে যায় কোন দেশে,
মলিন বদন সবে তার সমাগমে!
যথা পদার্পণ তুমি কর, মধুমতি!
কেন না হইবে সুখী সর্ব্বজন তথা,
জগৎ-আনন্দ তুমি, ভুবনমোহিনী!
কহ দেবি, কি কৌশলে হরিল তোমারে
রক্ষঃপতি? শুনিয়াছে বীণা-ধ্বনি দাসী,
পিকবর-রব নব-পল্লব-মাঝারে
সরস মধুর মাসে; কিন্তু নাহি শুনি
হেন মধুমাখা কথা কভু এ জগতে!
দেখ চেয়ে, নীলাম্বরে শশী, যাঁর আভা
মলিন তোমার রূপে, পিইছেন হাসি
তব বাক্য-সুধা, দেবি, দেব-সুধানিধি!
নীরব কোকিল এবে আর পাখী যত,
শুনিবারে ও কাহিনী, কহিনু তোমারে।
এ সবার সাধ, সাধ্বি, মিটাও কহিয়া।”
কহিলা রাঘর-প্রিয়া;—“এইরূপে সখি,
কাটাইনু কত কাল পঞ্চবটী বনে
সুখে। ননদিনী তব, দুষ্টা শূর্পণখা,
বিষম জঞ্জাল আসি ঘটাইল শেষে!
শরমে, সরমা সই, মরি লো স্মরিলে
তার কথা। ধিক্ তারে! নারী কুল-কালি।
চাহিল, মারিয়া মোরে, বরিতে বাঘিনী,
রঘুবরে। ঘোর রোষে সৌমিত্রি-কেশরী
খেদাইলা দূরে তারে, আইল ধাইয়া
রাক্ষস, তুমুল রণ বাজিল কাননে।
সভয়ে পশিনু আমি কুটীর-মাঝারে।
কোদণ্ড-টঙ্কারে, সখি, কত যে কাঁদিনু,
কব কারে? মুদি আঁখি, কৃতাঞ্জলি-পুটে
ডাকি দেবতাকুলে রক্ষিতে রাঘবে!
আর্ত্তনাদ, সিংহনাদ উঠিল গগনে।
অজ্ঞান হইয়া আমি পড়িনু ভূতলে।
“কতক্ষণ এ দশায় ছিনু যে স্বজনি,
নাহি জানি; জাগাইলা পরশি দাসীরে
রঘুশ্রেষ্ঠ। মৃদুস্বরে (হায় লো, যেমতি
স্বনে মন্দ সমীরণ কুসুমকাননে
বসন্তে!) কহিলা কান্ত,—‘উঠ, প্রাণেশ্বরি,
রঘুনন্দনের ধন! রঘুরাজ-গৃহ-
আনন্দ! এই কি শয্যা সাজে হে তোমারে
হেমাঙ্গি!’ সরমা সখি, আর কি শুনিব
সে মধুর ধ্বনি আমি?” সহসা পড়িলা
মূর্চ্ছিত হইয়া সতী; ধরিলা সরমা।
যথা যবে ঘোর-বনে নিষাদ, শুনিয়া
পাখীর ললিত গীত বৃক্ষশাখে, হানে
স্বর লক্ষ্য করি শর; বিষম আঘাতে
ছটফটি পড়ে ভূমে বিহঙ্গী, তেমতি
সহসা পড়িলা সতী সরমার কোলে!
কতক্ষণে চেতন পাইলা সুলোচনা।
কহিলা সরমা কাঁদি;—“ক্ষম দোষ মম,
মৈথিলি! এ ক্লেশ আজি দিনু অকারণে,
হায়, জ্ঞানহীন আমি!” উত্তর করিলা
মৃদুস্বরে সুকেশিনী রাঘব-বাসনা;—
“কি দোষ, তোমার, সখি! শুন মন দিয়া,
কহি পুনঃ পূর্ব্ব-কথা। মারীচ কি ছলে
(মরুভূমে মরীচিকা ছলয়ে যেমতি!)
ছলিল, শুনেছ তুমি শূর্পণখা-মুখে।
হায় লো, কুলগ্নে, সখি, মগ্ন লোভ-মদে,
মাগিনু কুরঙ্গে আমি। ধনুর্ব্বাণ ধরি,
বাহিরিলা রঘুপতি, দেবর লক্ষ্মণে
রক্ষাহেতু রাখি ঘরে! বিদ্যুৎ-আকৃতি
পলাইল মায়া-মৃগ, কানন উজলি,
বারণারি-গতি নাথ ধাইলা পশ্চাতে—
হারানু নয়ন-তারা আমি অভাগিনী!
“সহসা শুনিনু, সখি, আর্ত্তনাদ দূরে—
‘কোথা রে লক্ষ্মণ ভাই, এ বিপত্তিকালে?
মরি আমি!’ চমকিলা সৌমিত্রি-কেশরী।
চমকি ধরিয়া হাত, করিনু মিনতি;—
‘যাও বীর বায়ুগতি পশ এ কাননে;
দেখ, কে ডাকিছে তোমা? কাঁদিয়া উঠিল
শুনি এ নিনাদ, প্রাণ! যাও ত্বরা করি—
বুঝি রঘুনাথ তোমা ডাকিছেন, রথি!’
কহিলা সৌমিত্রি; ‘দেবি! কেমনে পালিব
আজ্ঞা তব? একাকিনী কেমনে রহিবে
এ বিজন বনে তুমি? কত যে মায়াবী
রাক্ষস ভ্রমিছে হেথা, কে পারে কহিতে?
কাহারে ডরাও তুমি, কে পারে হিংসিতে
রঘুবংশ-অবতংসে এ তিন ভুবনে,
ভৃগুরাম-গুরু বলে?’—আবার শুনিনু
অর্ত্তনাদ;—‘মরি আমি! এ বিপত্তিকালে
কোথা রে লক্ষ্মণ ভাই? কোথায় জানকি?’
ধৈরয ধরিতে আর নারিনু, স্বজনি!
ছাড়ি লক্ষ্মণের হাত, কহিনু কুক্ষণে;—
‘সুমিত্রা শাশুড়ী মোর বড় দয়াবতী;
কে বলে ধরিয়াছিলা গর্ভে তিনি তোরে,
নিষ্ঠুর? পাষাণ দিয়া গড়িলা বিধাতা
হিয়া তোর! ঘোর বনে নির্দ্দয় বাঘিনী
জন্ম দিয়া পালে তোরে, বুঝিনু, দুর্ম্মতি!
রে ভীরু, রে বীর-কুলগ্লানি, যাব আমি,
দেখিব করুণ-স্বরে কে স্মরে আমারে
দূর-বনে?’—ক্রোধভরে আরক্ত-নয়নে
বীরমণি, ধরি ধনু, বাঁধিয়া নিমিষে
পৃষ্ঠে তূণ, মোর পানে চাহিয়া কহিলা;—
‘মাতৃ-সম মানি তোমা, জনকনন্দিনি!
মাতৃ-সম! তেঁই সহি এ বৃথা গঞ্জনা।
যাই আমি; গৃহমধ্যে থাক সাবধানে।
কে জানে কি ঘটে আজি? নহে দোষ মম;
তোমার আদেশে আমি ছাড়িনু তোমারে।’
এতেক কহিয়া শূর পশিলা কাননে।
“কত যে ভাবিনু আমি বসিয়া বিরলে,
প্রিয়সখি, কহিব তা, কি আর তোমারে?
বাড়িতে লাগিল বেলা; আহ্লাদে নিনাদি,
কুরঙ্গ, বিহঙ্গ আদি মৃগশিশু যত,
সদাব্রত-ফলাহারী, করভ করভী
আসি উতরিলা সবে। তা সবার মাঝে
চমকি দেখিনু যোগী, বৈশ্বানর-সম
তেজস্বী, বিভূতি অঙ্গে, কমণ্ডলু করে,
শিরে জটা। হায়, সখি, জানিতাম যদি
ফুলরাশি মাঝে দুষ্ট কালসর্প-বেশে,
বিমল সলিলে বিষ, তা হ’লে কি কভু
ভূমে লুটাইয়া শিরঃ নমিতাম তারে?
কহিল মায়াবী;—‘ভিক্ষা দেহ, রঘুবধূ!
(অন্নদা এ বনে তুমি!) ক্ষুধার্ত্ত অতিথে!’
“আবরি বদন আমি ঘোমটায়, সখি!
করপুটে কহিনু;—অজিনাসনে বসি,
বিশ্রাম লভুন প্রভু তরুমূলে; অতি
ত্বরায় আসিবে ফিরি রাঘবেন্দ্র যিনি,
সৌমিত্রি ভ্রাতার সহ। কহিল দুর্ম্মতি;—
(প্রতারিত রোষ আমি নারিনু বুঝিতে)
‘ক্ষুধার্ত্ত অতিথি আমি, কহিনু তোমারে।
দেহ ভিক্ষা; নহে কহ, যাই অন্য স্থলে।
অতিথি-সেবায় তুমি বিরত কি আজি,
জানকি! রঘুর বংশে চাহ কি ঢালিতে
এ কলঙ্ক কালি, তুমি, রঘু-বধূ! কহ,
কি গৌরবে অবহেলা কর ব্রহ্মশাপে?
দেহ ভিক্ষা; শাপ দিয়া নহে যাই চলি।
দুরন্ত রাক্ষস এবে সীতাকান্ত-অরি—
মোর শাপে।’—লজ্জা ত্যজি, হায় লো স্বজনি,
ভিক্ষা-দ্রব্য লয়ে আমি বাহিরিনু ভয়ে,—
না বুঝে পা দিনু ফাঁদে; অমনি ধরিল
হাসিয়া ভাসুর তব আমায় তখনি।
“একদা, বিধুবদনে, রাঘবের সাথে
ভ্রমিতেছিনু কাননে; দূর গুল্ম-পাশে
চরিতেছিল হরিণী। সহসা শুনিনু
ঘোর-নাদ; ভয়াকুলা দেখিনু চাহিয়া
ইরম্মদাকৃতি বাঘ ধরিল মৃগীরে!
‘রক্ষ, নাথ,’ বলি আমি পড়িনু চরণে।
শরানলে শূরশ্রেষ্ঠ ভস্মিলা শার্দ্দূলে,
মুহূর্ত্তে। যতনে তুলি বাঁচাইনু আমি
বন-সুন্দরীরে সখি! রক্ষঃকুল-পতি,
সেই শার্দ্দূলের রূপে, ধরিল আমারে!
কিন্তু কেহ না আইল বাঁচাইতে, ধনি!
এ অভাগী-হরিণীরে এ বিপত্তি-কালে!
পূরিনু কানন আমি হাহাকার রবে।
শুনিনু ক্রন্দন-ধ্বনি; বনদেবী বুঝি,
দাসীর দশায় মাতা কাতরা, কাঁদিলা!
কিন্তু বৃথা সে ক্রন্দন! হুতাশন তেজে
গলে লৌহ; বারি-ধারা দমে কি তাহারে?
অশ্রুবিন্দু মানে কি লো কঠিন যে হিয়া?
“দূরে গেল জটাজূট; কমণ্ডলু দূরে!
রাজরথি-বেশে মূঢ় আমায় তুলিল
স্বর্ণ-রথে। কহিল যে কত দুষ্টমতি,
কভু রোষে গর্জ্জি, কভু সুমধুর স্বরে,
‘স্মরিলে, শরমে ইচ্ছি মরিতে, সরমা!
“চালাইল রথ রথী। কালসর্প-মুখে
কাঁদে যথা ভেকী, আমি কাঁদিনু, সুভগে,
বৃথা। স্বর্ণ-রথচক্র, ঘর্ঘরি নির্ঘোষে,
পূরিল কানন-রাজী, হায়, ডুবাইয়া
অভাগীর আর্ত্তনাদ! প্রভঞ্জন-বলে
ত্রস্ত তরুকুল, যবে নড়ে মড়মড়ে,
কে পায় শুনিতে যদি কুহরে কপোতী?
ফাঁপর হইয়া, সখি, খুলিনু সত্বরে,
কঙ্কণ, বলয়, হার, সিঁথি, কণ্ঠমালা,
কুণ্ডল, নূপুর, কাঞ্চী; ছড়াইনু পথে;
তেঁই লো এ পোড়া দেহে নাহি, রক্ষোবধু,
আভরণ। বৃথা তুমি গঞ্জ দশাননে।”
নিরবিলা শশিমুখী। কহিলা সরমা;—
“এখনও তৃষাতুরা এ দাসী, মৈথিলি;
দেহ সুধা-দান তারে। সফল করিলা
শ্রবণ-কুহর আজি আমার।” সুস্বরে
পুনঃ আরম্ভিলা তবে ইন্দু-নিভাননা;—
“শুনিতে লালসা যদি, শুন লো, ললনে!
বৈদেহীর দুঃখ-কথা কে আর শুনিবে?—
“আনন্দে নিষাদ যথা ধরি ফাঁদে পাখী
যায় ঘরে, চালাইল রথ লঙ্কাপতি;
হায় লো, সে পাখী যথা কাঁদে ছটফটি
ভাঙ্গিতে শৃঙ্খল-তার কাঁদিনু সুন্দরি।
হে আকাশ, শুনিয়াছি তুমি শব্দবহ,
(আরাধিনু মনে মনে) এ দাসীর দশা
ঘোর-রবে কহ যথা রঘুচূড়ামণি,
দেবর লক্ষ্মণ মোর, ভুবন-বিজয়ী।
হে সমীর! গন্ধবহ তুমি; দূত-পদে
বরিনু তোমায় আমি, যাও ত্বরা করি,
যথায় ভ্রমেন প্রভু। হে বারিদ! তুমি
ভীমনাদী, ডাক নাথে গম্ভীর নিনাদে।
হে ভ্রমর! মধুলোভি, ছাড়ি ফুলকুলে
গুঞ্জর নিকুঞ্জে, যথা রাখবেন্দ্র বলী,
সীতার বারতা তুমি; গাও পঞ্চস্বরে
সীতার দুঃখের গীত, তুমি মধু-সখা
কোকিল! শুনিবে প্রভু, তুমি হে গাইলে
এইরূপে বিলাপিনু, কেহ না শুনিল।
“চলিল কনক-রথ; এড়াইয়া দ্রুতে
অভ্রভেদী গিরিচূড়া, বন, নদ, নদী,
নানাদেশ। স্ব-নয়নে দেখেছ, সরমা!
পুষ্পকের গতি তুমি; কি কাজ বর্ণিয়া?
“কতক্ষণে সিংহনাদ শুনিনু সম্মুখে
ভয়ঙ্কর। থরথরি আতঙ্কে কাঁপিল
বাজিরাজি, স্বর্ণ-রখ চলিল অস্থিরে।
দেখিনু মেলিয়া আঁখি, ভৈরব-মূরতি
গিরি-পৃষ্ঠে বীর, যেন প্রলয়ের কালে
কালমেঘ! ‘চিনি তোরে’, কহিলা গম্ভীরে
বীরবর,—চোর তুই, লঙ্কার রাবণ।
কোন্ কুলবধূ আজি হরিলি দুর্ম্মতি?
কার ঘর আঁধারিলি, নিবাইয়া এবে
প্রেদ-দ্বীপ? এই তোর নিত্যকর্ম্ম, জানি।
অস্ত্রিদল-অপবাদ ঘুচাইব আজি
বধি তোরে তীক্ষ্ণ শরে! আয় মুঢ়মতি!
ধিক্ তোরে, রক্ষোরাজ! নির্লজ্জ পামর
আছে কি রে তোর সম এ ব্রহ্ম-মণ্ডলে?’
“এতেক কহিয়া, সখি, গর্জ্জিলা শূরেন্দ্র।
অচেতন হ’য়ে আমি পড়িনু স্যন্দনে।
“পাইয়া চেতন পুনঃ দেখিনু, র’য়েছি
ভুতলে। গমনমার্গে রথে রক্ষোরথী
যুঝিছে সে বীর-সঙ্গে হুহুঙ্কার-নাদে।
অবলা রসনা, ধনি, পারে কি বর্ণিতে
সে রণে? সভয়ে আমি মুদিনু নয়নে।
সাধিনু দেবতাকুলে, কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
সে বীরের পক্ষ হয়ে নাশিতে রাক্ষসে
অরি মোর; উদ্ধারিতে বিষম-সঙ্কটে
দাসীরে। উঠিনু ভাবি পশিব বিপিনে,
আছাড় খাইয়া, যেন ঘোর ভূকম্পনে।
আরাধিনু বসুধারে,—‘এ বিজন দেশে,
মা আমার, হয়ে দ্বিধা, তর বক্ষঃস্থলে
লহ অভাগীরে, সাধ্বি! কেমনে সহিছ
দুঃখিনী মেয়ের জ্বালা? এস শীঘ্র করি।
ফিরিয়া আসিবে দুষ্ট; হায় মা, যেমতি
তস্কর আইসে ফিরি, ঘোর নিশাকালে,
পুতি যথা রত্নরাশি রাখে সে গোপনে—
পরধন। আসি মোরে তরাও, জননি!’
“বাজিল তুমুল যুদ্ধ গগনে, সুন্দরি!
কাঁপিলা বসুধা; দেশ পূরিল আরবে।
অচেতন হৈনু পুনঃ। শুন, লো ললনে!
মন দিয়া শুন, সই, অপূর্ব্ব-কাহিনী।—
দেখিনু স্বপনে আমি,বসুন্ধরা সতী
মা আমার! দাসী-পাশে আসি দয়াময়ী
কহিলা, লইয়া কোলে, সুমধুর বাণী;
‘বিধির ইচ্ছায়, বাছা, হরিছে গো তোরে
রক্ষোরাজ! তোর হেতু সবংশে মজিবে
অধম! এ ভার আমি সহিতে না পারি,
ধরি গো গর্ভে তোরে লঙ্কা বিনাশিতে!
যে কুক্ষণে তোর তনু ছুঁইল দুর্ম্মতি
রাবণ, জানিনু আমি, সুপ্রসন্ন বিধি
এত দিনে মোর প্রতি! আশীষিনু তোরে,
জননীর জ্বালা দূর করিলি, মৈথিলি!
ভবিতব্য-দ্বার আমি খুলি; দেখ্ চেয়ে!’—
“দেখিনু সম্মুখে, সখি, অভ্রভেদী-গিরি;
পঞ্চ জন বীর তথা নিমগ্ন সকলে
দুঃখের সলিলে যেন। হেন কালে আসি
উতরিলা রঘুপতি লক্ষ্মণের সাথে।
বিরস-বদন নাথে হেরি, লো স্বজনি!
উতলা হইনু কত, কত যে কাঁদিনু,
কি আর কহিব তার? বীর পঞ্চজনে
পূজিল রাঘব-রাজে, পূজিল অনুজে,
একত্র পশিলা সবে সুন্দর নগরে।
“মারি সে দেশের রাজা তুমুল-সংগ্রামে
রঘুবীর, বসাইলা রাজ সিংহাসনে,
শ্রেষ্ঠ যে পুরুষবর পঞ্চজন মাঝে।
ধাইল চৌদিকে দূত; আইল ধাইয়া
লক্ষ লক্ষ বীরসিংহ ঘোর কোলাহলে!
কাঁপিল বসুধা, সখি, বীর-পদভরে।
সভয়ে মুদিনু আঁখি! কহিলা হাসিয়া
মা আমার,—‘কারে ভয় করিস্ জানকি?
সাজিছে সুগ্রীব রাজা উদ্ধারিতে তোরে,
মিত্রবর। বধিল যে শূরে তোর স্বামী,
বালি নাম ধরে রাজা বিখ্যাত জগতে।
কিষ্কিন্ধ্যা নগর ওই। ইন্দ্রতুল্য বলি-
বৃন্দ চেয়ে দেখ্ সাজে।’ দেখিনু চাহিয়া
চলিছে বীরেন্দ্রদল, জলস্রোতঃ যথা
বরিষায়, হুহুঙ্কারি! ঘোর মড়মড়ে
ভাঙ্গিল নিবিড় বন; শুকাইল নদী;
ভয়াকুল বনজীব পলাইল দূরে;
পূরিল জগৎ, সখি, গম্ভীর নির্ঘোষে।
“উতরিলা সৈন্যদল সাগরের তীরে।
দেখিনু, সরমা সখি, ভাসিল সলিলে
শিলা। শৃঙ্গধরে ধরি, ভীম পরাক্রমে
উপাড়ি ফেলিল জলে, বীর শত শত।
বাঁধিল অপূর্ব্ব সেতু শিল্পিকুল মিলি।
আপনি বারীশ পাশী, প্রভুর আদেশে,
পরিলা শৃঙ্খল পায়ে! অলঙ্ঘ্য সাগরে
লঙ্ঘি, বীরমদে পার হইল কটক।
টলিল এ স্বর্ণপুরী বৈরী পদ চাপে,—
‘জয় রঘুপতি, জয়!’ ধ্বনিল সকলে।
কাঁদিনু হরষে, সখি! সুবর্ণ-মন্দিরে
দেখিনু সুবর্ণাসনে রক্ষঃকুল-পতি।
আছিলা সে সভাতলে ধীর ধর্ম্মসম
বীর এক; কহিল সে, ‘পূজ রঘুবরে;
বৈদেহীরে দেহ ফিরি; নতুবা মরিবে
সবংশে!’ সংসার মদে মত্ত রাঘবারি,
পদাঘাত করি তারে কহিল কুবাণী।
অভিমানে গেলা চলি সে বীর-কুঞ্জর
যথা প্রাণনাথ মোর।” কহিলা সরমা;—
“হে দেবি, তোমার দুঃখে কত যে দুঃখিত
রক্ষোরাজানুজ বলী, কি আর কহিব?
দুজনে আমরা, সতি, কত যে কেঁদেছি
ভাবিয়া তোমার কথা, কে পারে কহিতে?”
“জানি আমি,” উত্তরিলা মৈথিলী রূপসী;
“জানি আমি বিভীষণ উপকারী মম
পরম। সরমা সখি, তুমিও তেমতি!
আছে যে বাঁচিয়া হেথা অভাগিনী সীতা,
সে কেবল, দয়াবতি, তব দয়াগুণে।
কিন্তু কহি, শুন মোর অপূর্ব্ব স্বপন!—
“সাজিল রাক্ষসবৃন্দ বুঝিবার আশে।
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য; উঠিল গগনে
নিনাদ। কাঁপিনু, সখি, দেখি বীরদলে,
তেজে হুতাশন সম, বিক্রমে কেশরী।
কত যে হইল রণ, কহিব কেমনে?
বহিল শোণিত-নদী! পর্ব্বত-আকারে
দেখিনু শবের রাশি, মহাভয়ঙ্কর!
আইল কবন্ধ, ভূত, পিশাচ, দানব,
শকুনি, গৃধিনী আদি যত মাংসাহারী
বিহঙ্গম; পালে পালে শৃগাল; আইল
অসংখ্য কুক্কুর; লঙ্কা পূরিল ভৈরবে।
“দেখিনু কর্ব্বুর-নাথে পুনঃ সভাতলে,
মলিন-বদন এবে, অশ্রুময় আঁখি,
শোকাকুল; ঘোর রণে রাঘব-বিক্রমে
লাঘব-গরব, সই; কহিল বিষাদে
রক্ষোরাজ—‘হায় বিধি, এই কি রে ছিল
তোর মনে?—যাও সবে, জাগাও যতনে
শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণে মম।
কে রাখিবে রক্ষঃকুলে সে যদি না পারে?’
“ধাইল রাক্ষস দল; বাজিল বাজনা
ঘোর রোলে; নারীদল দিল হুলাহুলি।
বিরাট-মূরতি-ধর পশিল কটকে
রক্ষোরথী। প্রভু মোর, তীক্ষ্ণতর শরে,
(হেন বিচক্ষণ শিক্ষা কার লো জগতে?)
কাটিলা তাহার শিরঃ; মরিল অকালে
জাগি, সে দুরন্ত শূর। ‘জয় রাম ধ্বনি’
শুনিনু হরষে, সই! কাঁদিল রাবণ।
কাঁদিল কনক-লঙ্কা হাহাকার-রবে।
“চঞ্চল হইনু, সখি, শুনিয়া চৌদিকে
ক্রন্দন। কহিনু মায়ে, ধরি পা-দুখানি,—
রক্ষঃকুল-দুঃখে বুক ফাটে, মা, আমার,
পরেরে কাতর দেখি সতত কাতরা
এ দাসী; ক্ষম, মা, মোরে। হাসিয়া কহিলা
বসুধা,—‘লো রঘুবধু, সত্য যা দেখিলি!
লণ্ডভণ্ড করি লঙ্কা দণ্ডিবে রাবণে
পতি তোর! দেখ্ পুনঃ নয়ন মেলিয়া।’
“দেখিনু, সরমা সখি, সুরবালাদলে,
নানা আভরণ হাতে মন্দারের মালা,
পট্টবস্ত্র! হাসি তারা বেড়িল আমারে।
কেহ কহে,—‘উঠ, সতি, হত এত দিনে
দুরন্ত রাবণ রণে।’ কেহ কহে,—‘উঠ,
রঘুনন্দনের ধন, উঠ, ত্বরা করি,
অবগাহ দেহ, দেবি, সুবাসিত জলে,
পর নানা আভরণ। দেবেন্দ্রাণী শচী
দিবেন সীতায় দান আজি সীতানাথে।’
“কহিনু, সরমা সখি, করপুটে আমি;
কি কাজ, হে সুরবালা, এ বেশ-ভূষণে
দাসীর? যাইব আমি যথা কান্ত মম
এ দশায়, দেহ আজ্ঞা; কাঙ্গালিনী সীতা,
কাঙ্গালিনীবেশে তারে দেখুন নৃমণি।’
“উত্তরিলা সুরবালা;—‘শুন লো মৈথিলি!
সমল খনির গর্ভে মণি; কিন্তু তারে
পরিষ্কারি রাজ-হস্তে দান করে দাতা!’
“কাঁদিয়া, হাসিয়া, সই, সাজিনু সত্বরে।
হেরিনু অদূরে নাথে, হায় লো, যেমতি
কনক-উদয়াচলে দেব অংশুমালী!
পাগলিনী প্রায় আমি ধাই ধরিতে
পদযুগ, সুবদনে!—জাগিনু অমনি!—
সহসা, স্বজনি, যথা নিবিলে দেউটী,
ঘোর অন্ধকার ঘর; ঘটিল সে দশা
আমার,—আঁধার বিশ্ব দেখিনু চৌদিকে
হে বিধি, কেননা আমি মরিনু তখনি?
কি সাধে এ পোড়া প্রাণ রহিল এ দেহে?”
নীরবিলা বিধুমুখী, নীরবে যেমতি
বীণা, ছিঁড়ে তার যদি। কাঁদিয়া সরমা
(রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী রক্ষোবধূরূপে)
কহিলা;—“পাইবে নাথে,জনক-নন্দিনি!
সত্য এ স্বপন তব, কহিনু তোমারে।
ভাসিছে সলিলে শিলা, পড়েছে সংগ্রামে
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস কুম্ভকর্ণ বলী
সেবিছেন বিভীষণ জিষ্ণু রঘুনাথে
লক্ষ লক্ষ বীরসহ। মরিবে পৌলস্ত্য
যথোচিত শাস্তি পাই; মজিবে দুর্ম্মতি
সবংশে। এখন কহ, কি ঘটিল পরে।
অসীম লালসা মোর শুনিতে কাহিনী।”
আরম্ভিলা পুনঃ সতী সুমধুর স্বরে;—
“মিলি আঁখি, শশিমুখি, দেখিনু সম্মুখে
রাবণে, ভূতলে হায়, সে বীর কেশরী,
তুঙ্গ-শৈলশৃঙ্গ যেন চূর্ণ বজ্রাঘাতে!
“কহিল রাঘব-রিপু,—‘ইন্দীবর-আঁখি
উন্মীলি, দেখ লো চেয়ে, ইন্দু নিভাননে!
রাবণের পরাক্রম। জগৎ-বিখ্যাত
জটায়ু হীনায়ু আজি মোর ভুজ-বলে!
নিজ দোষে মরে মূঢ় গরুড়-নন্দন।
কে কহিল মোর সাথে যুঝিতে বর্ব্বরে?’
‘ধর্ম্ম কর্ম্ম সাধিবারে মরিনু সংগ্রামে,
রাবণ’;—কহিলা শূর অতি মৃদু স্বরে—
‘সম্মুখ সমরে পড়ি যাই দেবালয়ে!
কি দশা ঘটিবে তোর, দেখ্ রে ভাবিয়া!
শৃগাল হইয়া, লোভি, লোভিলি সিংহীরে!
কে তোরে রক্ষিবে, রক্ষঃ! পড়িলি সঙ্কটে,
লঙ্কানাথ, করি চুরি এ নারী-রতনে।”
“এতেক কহিয়া বীর নীরব হইলা;
তুলিল আমায় পুনঃ রথে লঙ্কাপতি।
“কৃতাঞ্জলি-পুটে কাঁদি কহিনু স্বজনি,
বীরবরে;—‘সীতা নাম, জনকদুহিতা,
রঘুবধূ দাসী, দেব! শূন্য ঘরে পেয়ে
আমায়, হরিয়াছে পাপী; কহিও এ কথা
দেখা যদি হয়, প্রভু রাঘবের সাথে।’
“উঠিল গগনে রথ গম্ভীর নির্ঘোষে।
শুনিনু ভৈরব রব; দেখিনু সম্মুখে
সাগর নীলোর্ম্মিময়। বহিছে কল্লোলে
অতল, অকূল জল, অবিরাম গতি;
ঝাঁপ দিয়া জলে, সখি, চাহিনু ডুবিতে;
নিবারিল দুষ্ট মোরে! ডাকিনু বারীশে,
জলচরে মনে মনে, কেহ না শুনিল,
অবহেলি অভাগীরে! অনম্বর-পথে
চলিল কনক-রথ মনোরথ-গতি।
“অবিলম্বে লঙ্কাপুরী শোভিল সম্মুখে।
সাগরের ভালে, সখি, এ কনক-পুরী,
রঞ্জনের রেখা! কিন্তু কারাগার যদি
সুবর্ণ-গঠিত, তবু বন্দীর নয়নে
কমনীয় কভু কি লো শোভে তার আভা?
সুবর্ণ-পিঞ্জর বলি হয় কি লো সুখী
সে পিঞ্জরে বন্ধ পাখী! দুঃখিনী সতত
যে পিঞ্জরে রাখ তুমি কুঞ্জ-বিহারিণী।
কুক্ষণে জনম মম, সরমা সুন্দরি!
কে কবে শুনেছে, সখি, কহ, হেন কথা?
রাজার নন্দিনী আমি, রাজ-কুল-বধূ,
তবু বদ্ধ কারাগারে।”—কাঁদিলা রূপসী,
সরমার গলা ধরি; কাঁদিলা সরমা।
কতক্ষণে চক্ষুজল মুছি সুলোচনা
সরমা কহিলা; “দেবি, কে পারে খণ্ডিতে
বিধির নির্ব্বন্ধ? কিন্তু সত্য যা কহিলা
বসুধা। বিধির ইচ্ছা, তেঁই লঙ্কাপতি
আনিয়াছে হরি তোমা। সবংশে মরিবে
দুষ্টমতি। বীর আর কে আছে এ পুরে
বীরযোনি? কোথা, সতি, ত্রিভুবন-জয়ী
যোধ যত? দেখ চেয়ে, সাগরের কূলে,
শবাহারী জন্তুপুঞ্জ ভুঞ্জিছে উল্লাসে
শবরাশি। কাণ দিয়া শুন, ঘরে ঘরে
কাঁদিছে বিধবা-বধূ! আশু পোহাইবে
এ দুঃখ-শর্ব্বরী তব। ফলিবে, কহিনু,
স্বপ্ন! বিদ্যাধরী-দল মন্দারের দামে
ও বরাঙ্গ, রঙ্গে আসি আশু সাজাইবে।
ভেটিবে রাঘবে তুমি, বসুধা-কামিনী,
সরস বসন্তে যথা ভেটেন মধুরে!
ভুলো না দাসীরে, সাধ্বি! যত দিন বাঁচি,
এ মনোমন্দিরে রাখি, আনন্দে পূজিব
ও প্রতিমা, নিত্য যথা, আইলে রজনী,
সরসী হরষে পূজে কৌমুদিনী-ধনে।
বহু ক্লেশ, সুকেশিনি, পাইলে এ দেশে।
কিন্তু নহে দোষী দাসী।” কহিলা সুস্বরে
মৈথিলী;—“সরমা সখি, মম হিতৈষিণী
তোমা সম আর কি লো আছে এ জগতে?
মরুভূমে প্রবাহিণী মোর পক্ষে তুমি,
রক্ষোবধু! সুশীতল ছায়ারূপ ধরি,
তপন-তাপিতা আমি, জুড়ালে আমারে।
মূর্ত্তিমতী দয়া তুমি এ নির্দ্দয় দেশে।
এ পঙ্কিল জলে পদ্ম! ভুজঙ্গিনী-রূপী
এ কাল-কনক-লঙ্কা-শিরে শিরোমণি।
আর কি কহিব, সখি! কাঙ্গালিনী সীতা,
তুমি লো মহার্হ রত্ন! দরিদ্র, পাইলে
রতন, কভু কি তারে অযতনে, ধনি!”
নমিয়া সতীর পদে, কহিলা সরমা;—
“বিদায় দাসীরে এবে দেহ, দয়াময়ি!
না চাহে পরাণ মম ছাড়িতে তোমারে,
রঘুকুল-কমলিনি! কিন্তু প্রাণপতি
আমার, রাঘব-দাস; তোমার চরণে
আসি কথা কই আমি, এ কথা শুনিলে
রুষিবে লঙ্কার নাথ, পড়িব সঙ্কটে।”
কহিলা মৈথিলী;—“সখি! যাও ত্বরা করি,
নিজালয়ে; শুনি আমি দূর-পদধ্বনি;
ফিরি বুঝি চেড়ীদল আসিছে এ বনে।”
আতঙ্কে কুরঙ্গী যথা, গেলা দ্রুতগামী
সরমা; রহিলা দেবী সে বিজন-বনে,
একটি কুসুম মাত্র অরণ্যে যেমতি।
ইতি শ্রীমেঘনাদবধ কাব্যে অশোকবনং নাম
চতুর্থঃ সর্গঃ।
চতুর্থ সর্গ।