সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/পঞ্চম সর্গ
পঞ্চম সর্গ
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/d/d7/Rule_Segment_-_Tear_Left_-_20px.svg/20px-Rule_Segment_-_Tear_Left_-_20px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/2/28/Rule_Segment_-_Circle_-_6px.svg/6px-Rule_Segment_-_Circle_-_6px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/2/28/Rule_Segment_-_Circle_-_6px.svg/6px-Rule_Segment_-_Circle_-_6px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/2/28/Rule_Segment_-_Circle_-_6px.svg/6px-Rule_Segment_-_Circle_-_6px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/3/30/Rule_Segment_-_Tear_Right_-_20px.svg/20px-Rule_Segment_-_Tear_Right_-_20px.svg.png)
হাসে নিশি তারাময়ী ত্রিদশ-আলয়ে।
কিন্তু চিন্তাকুল এবে বৈজয়ন্ত-ধামে
মহেন্দ্র; কুসুম-শয্যা ত্যজি মৌনভাবে
বসেন ত্রিদিব-পতি রত্ন-সিংহাসনে;—
সুবর্ণ-মন্দিরে সুপ্ত আর দেব যত।
অভিমানে স্বরীশ্বরী কহিলা সুম্বরে;
“কি দোষে, সুরেশ, দাসী দোষী তব পদে?
শয়ন-আগারে তবে কেন না করিছ
পদার্পণ? চেয়ে দেখ, ক্ষণেক মুদিয়ে,
উন্মীলিছে পুনঃ আঁখি, চমকি তরাসে
মেনকা, ঊর্ব্বশী, দেখ, স্পন্দহীন যেন!
চিত্র-পুত্তলিকা-সম চারু চিত্রলেখা!
তব ডরে ডরি দেবী বিরামদায়িনী
নিদ্রা, নাহি যান, নাথ, তোমার সমীপে,
আর কারে ভয় তাঁর? এ ঘোর নিশীথে,
কে কোথা জাগিছে, বল? দৈত্যদল আসি
ব’সেছে কি থানা দিয়া স্বর্গের দুয়ারে?”
উত্তরিলা অসুরারি; “ভাবিতেছি, দেবি,
কেমনে লক্ষ্মণ-শূর নাশিবে রাক্ষসে?
অজেয় জগতে, বীরেন্দ্র রাবণি!”
“পাইয়াছে অস্ত্র, কান্ত!” কহিলা পৌলোমী
অনন্ত-যৌবনা;—“যাহে বধিলা তারকে
মহাসুর তারকারি; তব ভাগ্য-বলে,
তব পক্ষ বিরূপাক্ষ; আপনি পার্ব্বতী,
দাসীর সাধনে সাধ্বী কহিলা, সুসিদ্ধ
হবে মনোরথ কালি; মায়া দেবীশ্বরী
বধের বিধান কহি দিবেন আপনি;—
তবে এ ভাবনা, নাথ, কহ কি কারণে?”
উত্তরিলা দৈত্যরিপু;—“সত্য যা কহিলে,
দেবেন্দ্রাণি! প্রেরিয়াছি অস্ত্র লঙ্কাপুরে;
কিন্তু কি কৌশলে মায়া রক্ষিবে লক্ষ্মণে
রক্ষোযুদ্ধে, বিশালাক্ষি! না পারি বুঝিতে।
জানি আমি মহাবলী সুমিত্রা-নন্দন;
কিন্তু দন্তী কবে, দেবি, আঁটে মৃগরাজে?
দম্ভোলি-নির্ঘোষ আমি শুনি, সুবদনে!
মেঘের ঘর্ঘর ঘোর; দেখি ইরম্মদে;
বিমানে আমার সদা ঝলে সৌদামিনী;
তবু থরথরি হিয়া কাঁপে, দেবি, যবে
নাদে রুষি মেঘনাদ, ছাড়ে হুহুঙ্কারে
অগ্নিময় শর-জাল বসাইয়া চাপে
মহেষ্বাস; ঐরাবত অস্থির আপনি
তার ভীম-প্রহরণে!” বিষাদে নিশ্বাসি
নীরবিলা সুরনাথ; নিশ্বাসি বিষাদে
(পতি-খেদে সতী-প্রাণ কাঁদে রে সতত!)
বসিলা ত্রিদিব দেবী দেবেন্দ্রের পাশে।
ঊর্ব্বশী, মেনকা, রম্ভা, চারু চিত্রলেখা
দাঁড়াইলা চারিদিকে; সরসে যেমতি
সুধাকর-কর-রাশি বেড়ে নিশাকালে
নীরবে মুদিত পদ্মে। কিম্বা দীপাবলী
অম্বিকার পীঠতলে শারদ-পার্ব্বণে,
হর্ষে মগ্ন বঙ্গ যবে পাইয়া মায়েরে,
চির-বাঞ্ছা। মৌনভাবে বসিলা দম্পতী;
হেনকালে মায়াদেবী উতরিলা তথা।
রতন-সম্ভবা বিভা দ্বিগুণ বাড়িল
দেবালয়ে; বাড়ে যথা রবি-কর-জালে
মন্দার কাঞ্চন-কান্তি নন্দন-কাননে।
সসম্ভ্রমে প্রণমিলা দেব-দেবী দোঁহে
পাদপদ্মে। স্বর্ণাসনে বসিলা আশীষি
মায়া। কৃতাঞ্জলিপুটে সুরকুল-নিধি
সুধিলা; “কি ইচ্ছা, মাতঃ, কহ এ দাসেরে?”
উত্তরিলা মায়াময়ী;—“যাই, আদিতেয়
লঙ্কাপুরে; মনোরথ তোমার পূরিব;
রক্ষঃকুল-চূড়ামণি চূর্ণিব কৌশলে
আজি। চাহি দেখ, ওই পোহাইছে নিশি।
অবিলম্বে, পুরন্দর, ভবানন্দময়ী
ঊষা দেখা দিবে হাসি উদয়-শিখরে;
লঙ্কার পঙ্কজ রবি যাবে অস্তাচলে!
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লইব লক্ষ্মণে,
অসুরারি! মায়া জালে বেড়িব রাক্ষসে।
নিরস্ত্র, দুর্ব্বল বলী দৈব অস্ত্রাঘাতে,
অসহায় (সিংহ যেন আনায়-মাঝারে)
মরিবে,—বিধির বিধি কে পারে লঙ্ঘিতে?
মরিবে রাবণি রণে; কিন্তু এ বারতা
পাবে ধরে রক্ষঃপতি, কেমনে রক্ষিবে
তুমি রামানুজে, রামে, ধীর বিভীষণে
রঘু-মিত্র? পুত্রশোকে বিকল, দেবেন্দ্র
পশিবে সমরে শূর কৃতান্ত সদৃশ
ভীমবাহু! কার সাধ্য বিমুখিবে তারে?
ভাবি দেখ, সুরনাথ, কহিনু যে কথা!”
উত্তরিলা শচীকান্ত নমুচিসূদন;—
“পড়ে যদি মেঘনাদ সৌমিত্রির শরে
মহামায়া! সুরসৈন্যসহ কালি আমি
রক্ষিব লক্ষ্মণে, পশি রাক্ষস-সংগ্রামে।
না ডরি রাবণে, দেবি! তোমার প্রসাদে।
মার তুমি আগে মাতঃ, মায়াজাল পাতি,
কর্ব্বুর-কুলের গর্ব্ব, দুর্ম্মদ সংগ্রামে,
রাবণি। রাঘবচন্দ্র দেব-কুলপ্রিয়;
সমরিবে প্রাণপণে অমর, জননি!
তার জন্য। যাব আমি আপনি ভূতলে
কালি, দ্রুত ইরম্মদে দগ্ধির কর্ব্বুরে।”
“উচিত এ কর্ম্ম তব, অদিতি-নন্দন
বজ্রি!” কহিলেন মায়া; “পাইনু পিরীতি
তর বাক্যে, সুরশ্রেষ্ঠ! অনুমতি দেহ,
যাই আমি লঙ্কাধামে।” এতেক কহিয়া
চলি গেলা শক্তীশ্বরী আশীষি দোঁহারে।
দেবেন্দ্রের পদে নিদ্রা প্রণমিল আসি।
ইন্দ্রাণীর কর-পদ্ম ধরিয়া কৌতুকে,
প্রবেশিলা মহা-ইন্দ্র শয়ন-মন্দিরে—
সুখালয়! চিত্রলেখা, ঊর্ব্বশী, মেনকা,
রম্ভা, নিজ গৃহে সবে পশিলা সত্বরে।
খুলিলা নূপুর, কাঞ্চী, কঙ্কণ, কিঙ্কিণী
আর যত আভরণ; খুলিলা কাঁচলি;
শুইলা ফুল-শয়নে সৌর-কর-রাশি-
রূপিণী সুর-সুন্দরী। সুস্বনে বহিল
পরিমলময় বায়ু, কভু বা অলকে,
কভু উচ্চ-কুচে, কভু ইন্দু-নিভাননে
করি কেলি, মত্ত যথা মধুকর, যবে
প্রফুল্লিত-ফুলে অলি পায় বনস্থলে!
স্বর্গের কনক-দ্বারে উতরিলা মায়া
মহাদেবী; সুনিনাদে আপনি খুলিল
হৈমদ্বার। বাহিরিয়া বিশ্ব-বিমোহিনী,
স্বপন-দেবীরে স্মরি, কহিলা সুস্বরে;
“যাও তুমি লঙ্কাধামে, যথায় বিরাজে
শিবিরে সৌমিত্রি-শূর। সুমিত্রার বেশে
বসি শিরোদেশে তার, কহিও, রঙ্গিণি,
এই কথা,—‘উঠ, বৎস, পোহাইল রাতি।
লঙ্কার উত্তর-দ্বারে বনরাজী-মাঝে
শোভে সরঃ; কলে তার চণ্ডীর দেউল
স্বর্ণময়; স্নান করি সেই সরোবরে,
তুলিয়া বিবিধ ফুল, পূজ ভক্তিভাবে
দানব দলনী মায়ে। তাঁহার প্রসাদে,
বিনাশিবে অনায়াসে দুর্ম্মদ-রাক্ষসে,
যশস্বি! একাকী বৎস যাইও সে বনে।’
অবিলম্বে, স্বপ্নদেবি, যাও লঙ্কাপুরে।
দেখ, পোহাইছে রাতি, বিলম্ব না সহে!”
চলি গেলা স্বপ্নদেবী, নীল-নভঃস্থল
উজলি, খসিয়া যেন পড়িল ভূতলে
তারা। ত্বরা ঊরি যথা শিবির-মাঝারে
বিরাজেন রামানুজ, সুমিত্রার বেশে
বসি শিরোদেশে তাঁর, কহিলা সুস্বরে
কুহকিনী;—“উঠ, বৎস! পোহাইল রাতি।
লঙ্কার উত্তর-দ্বারে বনরাজী-মাঝে
শোভে সরঃ; কূলে তার চণ্ডীর দেউল
স্বর্ণময়; স্নান করি সেই সরোবরে,
তুলিয়া বিবিধ ফুল, পূজ ভক্তিভাবে
দানব-দলনী মায়ে। তাঁহার প্রসাদে,
বিনাশিবে অনায়াসে দুর্ম্মদ-রাক্ষসে
যশস্বি! একাকী, বৎস, যাইও সে বনে।”
চমকি উঠিয়া বলী চাহিলা চৌদিকে;
হায় রে, নয়নজলে ভিজিল অমনি
বক্ষঃস্থল। “হে জননি!” কহিলা বিষাদে
বীরেন্দ্র;—“দাসের প্রতি কেন বাম এত
তুমি? দেহ দেখা পুনঃ, পূজি পা-দুখানি;
পূরাই মনের সাধ লয়ে পদধূলি,
মা আমার! যবে আমি বিদায় হইনু,
কত যে কাঁদিলে তুমি, স্মরিলে বিদরে
হৃদয়! আর কি, দেবি, এ বৃথা জনমে
হেরিব চরণ-যুগ?” মুছি অশ্রুধারা,
চলিলা বীর-কুঞ্জর কুঞ্জর-গমনে
যথা বিরাজেন প্রভু রঘু-কুল-রাজা।
কহিলা অনুজ, নমি অগ্রজের পদে;—
“দেখিনু অদ্ভুত স্বপ্ন রঘুকুল-পতি!
শিরোদেশে বসি মোর সুমিত্রা জননী
কহিলেন,—‘উঠ, বৎস! পোহাইল রাতি।
লঙ্কার উত্তর-দ্বারে বনরাজী-মাঝে
শোভে সরঃ; কূলে তার চণ্ডীর দেউল
স্বর্ণময়; স্নান করি সেই সরোবরে,
তুলিয়া বিবিধ ফুল, পূজ ভক্তিভাবে
দানব দলনী মায়ে। তাঁহার প্রসাদে,
বিনাশিবে অনায়াসে দুর্ম্মদ রাক্ষসে,
যশস্বি! একাকী, বৎস, যাইও সে বনে।’
এতেক কহিয়া মাতা অদৃশ্য হইলা।
কাঁদিয়া ডাকিনু আমি, কিন্তু না পাইনু
উত্তর। কি আজ্ঞা তব, কহ রঘুমণি?”
জিজ্ঞাসিলা বিভীষণে বৈদেহী-বিলাসী;—
“কি কহ, হে মিত্রবর, তুমি? রক্ষঃপুরে
রাঘব-রক্ষক তুমি বিদিত জগতে।”
উত্তরিলা রক্ষঃশ্রেষ্ঠ,—‘আছে সে কাননে
চণ্ডীর দেউল, দেব! সরোবর-কূলে।
আপনি রাক্ষস-নাথ পূজেন সতীরে।
সে উদ্যানে; আর কেহ নাহি যায় কভু
ভয়ে, ভয়ঙ্কর স্থল! শুনেছি দুয়ারে
আপনি ভ্রমেন শম্ভু—ভীম-শূল-পাণি।
যে পূজে মায়েরে সেথা, জয়ী সে জগতে।
আর কি কহিব আমি? সাহসে যদ্যপি
প্রবেশ করিতে বনে পারেন সৌমিত্রি,
সফল, হে মহারথি, মনোরথ তব।”
“রাঘবের আজ্ঞাবর্ত্তী, রক্ষঃকুলোত্তম!
এ দাস;” কহিলা বলী লক্ষ্মণ;—“যদ্যপি
পাই আজ্ঞা, অনায়াসে পশিব কাননে।
কে রোধিবে গতি মোর?” সুমধুর স্বরে
কহিলা রাঘবেশ্বর।—“কত যে সয়েছ
মোর হেতু, তুমি, বৎস! সে কথা স্মরিলে
না চাহে পরাণ মোর আর আয়াসিতে
তোমায়। কিন্তু কি করি? কেমনে লঙ্ঘিব
দৈবের নির্ব্বন্ধ, ভাই! যাও সাবধানে,—
ধর্ম্ম-বলে মহাবলী! আয়সী-সদৃশ
দেবকুল-আনুকূল্য রক্ষুক তোমারে।”
প্রণমি রাঘব-পদে, বন্দি বিভীষণে
সৌমিত্রি, কৃপাণ-করে, যাত্রা করি বলী
নির্ভয়ে উত্তর-দ্বারে চলিলা সত্বরে!
জাগিছে সুগ্রীর মিত্র বীতি-হোত্র-রূপী
বীর-বর-দলে তথা। শুনি পদধ্বনি,
গম্ভীরে কহিলা শূর;—‘কে তুমি? কি হেতু
ঘোর নিশাকালে হেথা? কহ শীঘ্র করি,
বাঁচিতে বাসনা যদি। নতুবা মারিব
শিলাঘাতে চূর্ণি শিরঃ।” উত্তরিলা হাসি
রামানুজ;—“রক্ষোবংশ ধ্বংস, বীরমণি,
রাঘবের দাস আমি।” আশু অগ্রসরি
সুগ্রীব, বন্দিলা সখা বীরেন্দ্র-লক্ষ্মণে।
মধুর সম্ভাষে তুষি কিষ্কিন্ধ্যা-পতিরে,
চলিলা উত্তর-মুখে ঊর্ম্মিলা-বিলাসী।
কতক্ষণে উতরিয়া উদ্যান-দুয়ারে
ভীমবাহু, সবিস্ময়ে দেখিলা অদূরে
ভীষণ-দর্শনমূর্ত্তি; দীপিছে ললাটে
শশিকলা মহোরগ-ললাটে যেমতি
মণি। জটাজূট শিরে, তাহার মাঝারে
জাহ্নবীর ফেনলেখা, শারদ-নিশাতে
কৌমুদীর রজোরেখা মেঘমুখে যেন।
বিভূতি ভূষিত অঙ্গ; শাল-বৃক্ষ সম
ত্রিশূল দক্ষিণ করে! চিনিলা সৌমিত্রি
ভূতনাথে। নিষ্কোষিয়া তেজস্কর অসি,
কহিলা বীর-কেশরী।—“দশরথ রথী,
রঘুজ-অজ-অঙ্গজ, বিখ্যাত ভুবনে,
তাঁহার তনয় দাস নমে তব পদে,
চন্দ্রচূড়! ছাড় পথ; পূজিব চণ্ডীরে
প্রবেশি কাননে; নহে দেহ রণ দাসে।
সতত অধর্ম্ম-কর্ম্মে রত লঙ্কাপতি;
তবে যদি ইচ্ছ রণ, তার পক্ষ হ’য়ে,
বিরূপাক্ষ! দেহ রণ, বিলম্ব না সহে।
ধর্ম্ম সাক্ষী মানি আমি আহ্বানি তোমারে;
সত্য যদি ধর্ম্ম, তবে অবশ্য জিনিব।”
যথা শুনি বজ্রনাদ, উত্তরে হুঙ্কারি
গিরিরাজ, বৃষধ্বজ কহিলা গম্ভীরে;—
“বাখানি সাহস তোর, শূর-চূড়ামণি
লক্ষ্মণ! কেমনে আমি যুঝি তোর সাথে?
প্রসন্ন প্রসন্নময়ী আজি তোর প্রতি,
ভাগ্যধর!” ছাড়িলা দুয়ার দুয়ারী
কপর্দ্দী; কানন-মাঝে পশিলা সৌমিত্রি।
ঘোর সিংহনাদ বীর শুনিলা চমকি!
কাঁপিল নিবিড় বন মড় মড় রবে
চৌদিকে। আইল ধাই রক্তবর্ণ-আঁখি
হর্য্যক্ষ, আস্ফালি পুচ্ছ, দন্ত কড়মড়ি!
‘জয় রাম’ নাদে রথী উলঙ্গিলা অসি!
পলাইল মায়া-সিংহ, হুতাশন-তেজে
তমঃ যথা। ধীরে ধীরে চলিলা নির্ভয়ে
ধীমান্। সহসা মেঘ আবরিলা চাঁদে
নির্ঘোষে! বহিল বায়ু হুহুঙ্কার স্বনে।
চকমকি ক্ষণপ্রভা শোভিল আকাশে,
দ্বিগুণ আঁধারি দেশ ক্ষণ-প্রভা দানে।
কড়-কড়-কড়ে বজ্র পড়িল ভূতলে
মুহুর্ম্মুহুঃ। বাহু-বলে উপাড়িল তরু,
প্রভঞ্জন। দাবানল পশিল কাননে।
কাঁপিল কনকলঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি
দূরে, লক্ষ লক্ষ শঙ্খ রণক্ষেত্রে যথা
কোদণ্ড-টঙ্কার-সহ মিশিয়া ঘর্ঘরে।
অটল অচল যথা দাঁড়াইলা বলী
সে রৌরবে। আচম্বিতে নিবিল দাবাগ্নি;
থামিল তুমুল ঝড়; দেখা দিল পুনঃ
তারাকান্ত; তারাদল শোভিল গগনে।
কুসুম-কুন্তলা-মহী হাসিলা কৌতুকে।
ছুটিল সৌরভ; মন্দ সমীর স্বনিলা।
সবিস্ময়ে ধীরে ধীরে চলিলা সুমতি।
সহসা পূরিল বন মধুর-নিক্বণে।
বাজিল বাঁশরী, বীণা, মৃদঙ্গ, মন্দিরা,
সপ্তস্বরা; উথলিল সে রবের সহ
স্ত্রী-কণ্ঠ-সম্ভব-রব, চিত্ত বিমোহিয়া।
দেখিলা সম্মুখে বলী, কুসুম-কাননে,
বামাদল, তারাদল ভূপতিত যেন!
কেহ অবগাহে দেহ, স্বচ্ছ সরোবরে,
কৌমুদী নিশীতে যথা। দুকূল-কাঁচলি
শোভে কূলে, অবয়ব বিমল সলিলে,
মানস সরসে, মরি, স্বর্ণ-পদ্ম-যথা।
কেহ তুলে পুষ্পরাশি, অলঙ্কারে কেহ
অলক, কাম-নিগড়! কেহ ধরে করে
দ্বিরদ-রদ-নির্ম্মিত, মুকুতা-খচিত
কোলম্বক। ঝকঝকে হেম-তার তাহে,
সঙ্গীত-রসের ধাম। কেহ বা নাচিছে
সুখময়ী; কুচযুগ পীবরমাঝারে
দুলিছে রতন-মালা, চরণে বাজিছে,
নূপুর, নিতম্ব-বিম্বে ক্কণিছে রশনা!
মরে নর কালফণী নশ্বর-দংশনে;—
কিন্তু এ সবার পৃষ্ঠে দুলিছে যে ফণী
মণিময়, হেরি তারে কাম-বিষে জ্বলে
পরাণ। হেরিলে ফণী পলায় তরাসে,
যার দৃষ্টিপথে পড়ে কৃতান্তের দূত;
হায় রে, এ ফণী হেরি কে না চাহে এরে
বাঁধিতে গলায়, শিরে উমাকান্ত যথা,
ভুজঙ্গ-ভূষণ শূলী? গাইছে জাগিয়া
তরুশাখে মধুসখা; খেলিছে অদূরে
জলযন্ত্র; সমীরণ বহিছে কৌতুকে,
পরিমল-ধন লুটি কুসুম-আগারে।
অবিলম্বে বামাদল, ঘিরি অরিন্দমে,
গাইল;—“স্বাগত, ওহে রঘুচূড়ামণি!
নহি নিশাচরী মোরা, ত্রিদিব নিবাসী।
নন্দন-কাননে, শূর, সুবর্ণ-মন্দিরে
করি বাস, করি পান অমৃত উল্লাসে
অনন্ত বসন্ত জাগে যৌবন-উদ্যানে;
উরজ কমল-যুগ প্রফুল্ল সতত;
না শুকায় সুধারস অধর সরসে,
অমরী আমরা, দেব! বরিনু তোমারে
আমা সবে; চল, নাথ, আমাদের সাথে।
কঠোর তপস্যা নর করে যুগে যুগে
লভিতে যে সুখভোগ, দিব তা তোমারে,
গুণমণি! রোগ শোক আদি কীট যত
কাটে জীবনের ফুল এ ভবমণ্ডলে,
না পশে যে দেশে, মোরা আনন্দে নিবাসি
চিরদিন।” করপুটে কহিলা সৌমিত্রি;—
“হে সুরসুন্দরীবৃন্দ, ক্ষম এ দাসেরে!
অগ্রজ আমার রথী বিখ্যাত জগতে
রামচন্দ্র, ভার্য্যা তাঁর মৈথিলী; কাননে
একাকিনী পাই, তাঁরে আনিয়াছে হরি
রক্ষোনাথ। উদ্ধারিব, ঘোর যুদ্ধে নাশি
রাক্ষসে, জানকী-সতী; এ প্রতিজ্ঞা মম
সফল হউক, বর দেহ সুরাঙ্গনে!
নর-কুলে জন্ম মোর; মাতৃ হেন মানি
তোমা সবে।” মহাবাহু এতেক কহিয়া
দেখিলা তুলিয়া আঁখি, বিজন সে বন।
চলি গেছে বামাদল স্বপনে যেমতি,
কিম্বা জলবিম্ব যথা সদা সদ্যোজীবী!—
কে বুঝে মায়ার মায়া, এ মায়া সংসারে?
ধীরে ধীরে পুনঃ বলী চলিলা বিস্ময়ে।
কতক্ষণে শূরবর হেরিলা অদূরে
সরোবর, কুলে তার চণ্ডীর দেউল,
সুবর্ণ সোপান শত মণ্ডিত রতনে।
দেখিলা দেউলে বলী দীপিছে প্রদীপ;
পীঠতলে ফুলরাশি; বাজিছে ঝাঁঝরী,
শঙ্খ ঘণ্টা; ঘটে বারি। ধূপ, ধূপদানে
পুড়ি, আমোদিছে দেশ, মিশিয়া সুরভি
কুসুম-বাসের সহ। পশিয়া সলিলে
শূরেন্দ্র, করিলা স্নান; তুলিলা যতনে
নীলোৎপল; দশদিশ পূরিল সৌরভে।
প্রবেশি মন্দিরে তবে বীরেন্দ্র কেশরী
সৌমিত্রি, পূজিলা বলী সিংহবাহিনীরে
যথাবিধি। “হে বরদে!” কহিলা সাষ্টাঙ্গে
প্রণমিয়া রামানুজ,—“দেহ বর দাসে।
নাশি রক্ষঃশূরে, মাতঃ, এই ভিক্ষা মাগি।
মানব-মনের কথা, হে অন্তর্য্যামিনি!
তুমি যত জান, হায়, মানব-রসনা
পারে কি কহিতে তত? যত সাধ মনে,
পূরাও সে সবে, সাধ্বি!” গরজিল দূরে
মেঘ! বজ্রনাদে লঙ্কা উঠিল কাঁপিয়া
সহসা। দুলিল, যেন ঘোর ভূকম্পনে,
কানন, দেউল, সরঃ—থর থর থরে!
সম্মুখে লক্ষ্মণ-বলী দেখিলা কাঞ্চন-
সিংহাসনে মহামায়ে! তেজঃ রাশি রাশি
ধাঁধিল নয়ন ক্ষণ বিজলী ঝলকে।
আঁধার দেউল বলী হেরিলা সভয়ে
চৌদিক! হাসিলা সতী; পলাইল তমঃ
দ্রুতে; দিব্য-চক্ষু লাভ করিলা সুমতি।
মধুর স্বর-তরঙ্গ বহিল আকাশে।
কহিলেন মহামায়া;—“সুপ্রসন্ন আজি,
রে সতী-সুমিত্রা-সুত! দেবদেবী যত
তোর প্রতি। দেব-অস্ত্র প্রেরিয়াছে তোরে
বাসব, আপনি আমি আসিয়াছি হেথা
সাধিতে এ কার্য্য তোর, শিবের আদেশে।
ধরি দেব-অস্ত্র, বলি! বিভীষণে লয়ে,
যা চলি নগর-মাঝে, যথায় রাবণি,
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে, পূজে বৈশ্বানরে।
সহসা, শার্দ্দূলাক্রমে আক্রমি রাক্ষসে,
নাশ তারে। মোর বরে পশিবি দুজনে
অদৃশ্য; নিকষে যথা অসি, আবরিব
মায়াজালে আমি দোঁহে, নির্ভয় হৃদয়ে,
যা চলি, রে যশস্বি।” প্রণমি শূরমণি
মায়ার চরণ-তলে, চলিলা সত্বরে
যথায় রাঘব শ্রেষ্ঠ! কূজনিল জাগি
পাখিকুল ফুলবনে, যন্ত্রিদল যথা
মহোৎসবে পূরে দেশ মঙ্গল-নিক্বণে।
বৃষ্টিলা কুসুম-রাশি শূরবর-শিরে
তরুরাজী; সমীরণ বহিলা সুস্বনে।
“শুভক্ষণে গর্ভে তোরে লক্ষ্মণ, ধরিল
সুমিত্রা জননী তোর।” কহিলা আকাশে
আকাশ-সম্ভবা বাণী;—“তোর কীর্ত্তি-গানে
পূরিবে ত্রিলোক আজি, কহিনু রে তোরে।
দেবের অসাধ্য কর্ম্ম সাধিলি সৌমিত্রি,
তুই! দেবকুল-তুল্য অমর হইলি!”
নীররিলা সরস্বতী; কূজনিল পাখী
সুমধুরতর-স্বরে সে নিকুঞ্জ-বনে।
কুসুম-শয়নে যথা সুবর্ণ-মন্দিরে
বিরাজে বীরেন্দ্র বলী ইন্দ্রজিৎ, তথা
পশিল কূজন-ধ্বনি সে সুখ-সদনে।
জাগিলা বীর-কুঞ্জর কুঞ্জবন-গীতে।
প্রমীলার করপদ্ম করপদ্মে ধরি
রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে যেমতি
নলিনীর কাণে অলি কহে গুঞ্জরিয়া
প্রেমের রহস্য-কথা, কহিলা (আদরে
চুম্বি নিমীলিত আঁখি)—“ডাকিছে কূজনে,
হৈমবতী ঊষা তুমি, রূপসি, তোমারে
পাখিকুল। মিল, প্রিয়ে, কমললোচন।
উঠ, চিরানন্দ মোর! সূর্য্যকান্তমণি-
সম এ পরাণ, কান্তে; তুমি রবিচ্ছবি;—
তোজোহীন আমি, তুমি মুদিলে নয়ন।
ভাগ্য-বৃক্ষে ফলোত্তম তুমি হে জগতে
আমার! নয়ন-তারা! মহার্হ রতন।
উঠি দেখ, শশিমুখি, কেমনে ফুটিছে,
চুরি করি কান্তি তব মঞ্জু-কুঞ্জবনে
কুসুম!” চমকি রামা উঠিলা সত্বরে,
গোপিনী-কামিনী যথা বেণুর সুরবে।
আবরিলা অবয়ব সুচারুহাসিনী
সরমে। কহিলা পুনঃ কুমার আদরে;—
“পোহাইল এতক্ষণে তিমির-শর্ব্বরী;
তা না হ’লে ফুটিতে কি তুমি, কমলিনি
জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়? চল, প্রিয়ে, এবে
বিদায় হইব নমি জননীর পদে।
পরে যথাবিধি পূজি দেব-বৈশ্বানরে,
ভীষণ অশনি-সম শর-বরিষণে
রামের সংগ্রাম-সাধ মিটাব সংগ্রামে।
সাজিলা রাবণ-বধূ, রাবণ-নন্দন,
অতুল জগতে দোঁহে; বামাকুলোত্তমা
প্রমীলা, পুরুষোত্তম মেঘনাদ বলী।
শয়ন-মন্দির হ’তে বাহিরিলা দোঁহে—
প্রভাতের তারা যথা অরুণের সাথে।
লজ্জায় মলিনমুখী পলাইল দূরে
(নিশির অমৃতভোগ ছাড়ি ফুলদলে)
খদ্যোত; ধাইল অলি পরিমল-আশে;
গাইল কোকিল ডালে মধু পঞ্চস্বরে,
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য; নমিল রক্ষক;
‘জয় মেঘনাদ’ নাদ উঠিল গগনে।
রতন-শিবিকাসনে বসিলা হরষে
দম্পতী। বহিল যান যান-বাহ-দলে
মন্দোদরী মহিষীর সুবর্ণ-মন্দিরে।
মহাপ্রভাধর গৃহ; মরকত, হীরা,
দ্বিরদ-রদ-মণ্ডিত, অতুল জগতে!
নয়ন-মনোরঞ্জন যা কিছু সৃজিলা
বিধাতা, শোভে সে গৃহে। ভ্রমিছে দুয়ারে
প্রহরিণী, প্রহরণ কালদণ্ড-সম
করে; অশ্বারূঢ়া কেহ, কেহ বা ভূতলে।
তারাকারা দীপাবলী দীপিছে চৌদিকে।
বহিছে রসন্তানিল, অযুত-কুসুম-
কানন-সৌরভ-বহ। উথলিছে মৃদু
বীণাধ্বনি, মনোহর স্বপনে যেমতি।
প্রবেশিলা অরিন্দম, ইন্দু-নিভাননা
প্রমীলা-সুন্দরী-সহ, সে স্বর্ণ-মন্দিরে।
ত্রিজটা নামে রাক্ষসী আইল ধাইয়া।
কহিলা বীর কেশরী; “শুন লো ত্রিজিটে,
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করি আমি আজি
যুঝিব রামের সনে পিতার আদেশে,
নাশিব রাক্ষস-রিপু; তেঁই ইচ্ছা করি,
পূজিতে জননী-পদ। যাও বার্ত্তা লয়ে;
কহ, পুত্ত্র পুত্ত্রবধূ দাঁড়ায়ে দুয়ারে
তোমার, হে লঙ্কেশ্বরি!” সাষ্টাঙ্গে প্রণমি,
কহিল শূরে ত্রিজটা—(বিকটা রাক্ষসী),
“শিবের মন্দিরে এবে রাণী মন্দোদরী
যুবরাজ! তোমার মঙ্গল হেতু তিনি,
অনিদ্রায়, অনাহারে পূজেন উমেশে।
তব সম পুত্ত্র, শূর, কার এ জগতে?
কার বা এ হেন মাতা?” এতেক কহিয়া
সৌদামিনী-গতি দূতী ধাইল সত্বরে।
গাইল গায়িকাদল সুযন্ত্র-মিলনে;—
“হে কৃত্তিকে হৈমবতি! শক্তিধর তব
কার্ত্তিকেয়, আসি দেখ, তোমার দুয়ারে
সঙ্গে সেনা সুলোচনা! দেখ আসি সুখে,
রোহিণী-গঞ্জিনী বধূ; পুত্ত্র, যাঁর রূপে
শশাঙ্ক কলঙ্কী মানে। ভাগ্যবতী তুমি!
ভুবন-বিজয়ী শূর ইন্দ্রজিৎ বলী—
ভুবনমোহিনী সতী প্রমীলা সুন্দরী।”
বাহিরিলা লঙ্কেশ্বরী শিবালয় হতে।
প্রণয়ে দম্পতী পদে। হরষে দুজনে
কোলে করি, শিরঃ চুম্বি, কাঁদিলা মহিষী।
হায় রে, মায়ের প্রাণ, প্রেমাগার ভবে
তুই, ফুলকুল যথা সৌরভ-আগার,
শুক্তি মুকুতার ধাম, মণিময় খনি।
শরদিন্দু পুত্ত্র, বধূ শারদ-কৌমুদী;
তারাকিরীটিনী-নিশি-সদৃশী আপনি
রাক্ষসকুল-ঈশ্বরী। অশ্রু-বারিধারা
শিশির, কপোল-পর্ণে পড়িয়া শোভিল!
কহিলা বীরেন্দ্র; “দেবি! আশীষ দাসেরে;
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করি যথাবিধি,
পশিব সমরে আজি, নাশিব রাঘবে।
শিশু ভাই বীরবাহু; বধিয়াছে তারে
পামর! দেখিব মোরে নিবারে কি বলে?
দেহ পদ-ধূলি, মাতঃ! তোমার প্রসাদে
নির্ব্বিঘ্ন করিব আজি তীক্ষ্ণ শর-জালে
লঙ্কা। বাঁধি দিব আনি তাত বিভীষণে
রাজদ্রোহী! খেদাইব সুগ্রীব অঙ্গদে
সাগর-অতল-জলে।” উত্তরিলা রাণী,
মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে;—
“কেমনে বিদায় তোরে করি রে বাছনি!
আঁধারি হৃদয়াকাশ, তুই পূর্ণশশী
আমার। দুরন্ত-রণে সীতাকান্ত বলী;
দুরন্ত লক্ষ্মণ-শূর; কাল সর্প-সম
দয়া-শূন্য বিভীষণ! মত্ত লোভ-মদে,
স্ববন্ধু-বান্ধবে মুঢ় নাশে অনায়াসে,
ক্ষুধায় কাতর ব্যাঘ্র গ্রাসয়ে যেমতি
স্ব-শিশু! কুক্ষণে, বাছা! নিকষা-শাশুড়ী
ধরেছিলা গর্ভে দুষ্টে, কহিনু রে তোরে।
এ কনক-লঙ্কা মোর মজালে দুর্ম্মতি।”
হাসিয়া মায়ের পদে উত্তরিলা রথী;—
“কেন, মা ডরাও তুমি রাঘবে লক্ষ্মণে,
রক্ষোবৈরী? দুইবার পিতার আদেশে
তুমুল সংগ্রামে আমি বিমুখিনু দোঁহে
অগ্নিময় শর-জালে। ও পদ-প্রসাদে,
চির-জয়ী দেব-দৈত্য-নরের সমরে
এ দাস। জানেন তাত বিভীষণ, দেবি।
তব পুত্ত্র-পরাক্রম; দম্ভোলি-নিক্ষেপী
সহস্রাক্ষ সহ যত দেব-কুল-রথী;
পাতালে নাগেন্দ্র, মর্ত্ত্যে নরেন্দ্র। কি হেতু
সভয় হইলা আজি, কহ, মা, আমারে?
কি ছার সে রাম, তারে ডরাও আপনি?”
মহাদরে শিরঃ চুম্বি কহিলা মহিষী;—
“মায়াবী মানব, বাছা, এ বৈদেহীপতি,
নতুবা সহায় তার দেবকুল যত!
নাগ-পাশে যবে তুই বাঁধিলি দুজনে,
কে খুলিল সে বন্ধন? কে বা বাঁচাইল,
নিশা-রণে যবে তুই বধিলি রাঘবে
সসৈন্যে? এ সব আমি না পারি বুঝিতে।
শুনেছি মৈথিলীনাথ আদেশিলে, জলে
ভাসে শিলা, নিবে অগ্নি; আসার বরষে!
মায়াবী মানব রাম। কেমনে, বাছনি!
বিদাইব তোরে আমি আবার যুঝিতে
তার সনে? হায়, বিধি, কেন না মরিল
কুলক্ষণা শূর্পণখা মায়ের উদরে।”
এতেক কহিয়া রাণী কাঁদিলা নীরবে।
কহিলা বীর-কুঞ্জর;—“পূর্ব্বকথা স্মরি,
এ বৃদ্ধা বিলাপ, মাতঃ, কর অকারণে।
নগর-তোরণে অরি; কি সুখ ভুঞ্জিব,
যত দিন নাহি তারে সংহারি সংগ্রামে!
আক্রমিলে হুতাশন কে ঘুমায় ঘরে?
বিখ্যাত রাক্ষস-কুল, দেব-দৈত্য-নর-
ত্রাস ত্রিভুবনে, দেবি! হেন কুলে কালি
দিব কি রাঘবে দিতে, আমি, মা, রাবণি
ইন্দ্রজিৎ? কি কহিবে শুনিলে এ কথা,
মাতামহ দনুজেন্দ্র ময়? রথী যত
মাতুল? হাসিবে বিশ্ব। আদেশ দাসেরে,
যাইব সমরে, মাতঃ, নাশিব রাঘবে।
ওই শুন, কূজনিছে বিহঙ্গম বনে।
পোহাইল বিভাবরী। পুজি ইষ্টদেবে,
দুর্দ্ধর্ষ রাক্ষস-দলে পশিব সমরে।
আপন মন্দিরে, দেবি, যাও ফিরি এবে।
ত্বরায় আসিয়া আমি পূজিব যতনে
ও পদ-রাজীব-যুগ, সমর-বিজয়ী!
পাইয়াছি পিতৃ-আজ্ঞা, দেহ আজ্ঞা তুমি।
কে আঁটিবে দাসে, দেবি, তুমি আশীষিলে?”
মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে,
উত্তরিলা লঙ্কেশ্বরী;—“যাইবি রে যদি,—
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে
রক্ষুন এ কাল-রণে। এই ভিক্ষা করি
তাঁর পদযুগে আমি। কি আর কহিব?
নয়নের তারাহারা করি রে থুইলি
আমায় এ ঘরে তুই!” কাঁদিয়া মহিষী
কহিলা চাহিয়া তবে প্রমীলার পানে;
“থাক, মা, আমার সঙ্গে তুমি;—জুড়াইব,
ও বিধুদন হেরি, এ পোড়া পরাণ।
বহুলে তারার করে উজ্জ্বল ধরণী।”
বন্দি জননীর পদ বিদায় হইলা
ভীমবাহু! কাঁদি রাণী, পুত্ত্রবধূ সহ,
প্রবেশিলা পুনঃ গৃহে। শিবিকা ত্যজিয়া,
পদ-ব্রজে যুবরাজ চলিলা কাননে—
ধীরে ধীরে রথিবর চলিলা একাকী
কুসুম-বিবৃত পথে, যজ্ঞশালা-মুখে।
সহসা নূপুর-ধ্বনি ধ্বনিল পশ্চাতে।
চির-পরিচিত, মরি, প্রণয়ীর কাণে
প্রণয়িনী-পদশব্দ। হাসিলা বীরেন্দ্র,
সুখে বাহু-পাশে বাঁধি ইন্দীবরাননা
প্রমীলারে। “হায়! নাথ,” কহিলা সুন্দরী;—
“ভেবেছিনু, যজ্ঞগৃহে যাব তব সাথে,
সাজাইব বীর-সাজে তোমায়। কি করি?
বন্দী করি স্ব-মন্দিরে রাখিলা শাশুড়ী।
রহিতে নারিনু তবু পুনঃ নাহি হেরি
পদযুগ। শুনিয়াছি, শশিকলা না কি
রবি-তেজে সমুজ্জ্বলা; দাসীও তেমতি,
হে রাক্ষস-কুল-রবি! তোমার বিহনে,
আঁধার জগৎ, নাথ, কহিনু তোমারে!”
মুকুতামণ্ডিত বুকে নয়ন বর্ষিল
উজ্জ্বলতর মুকুতা! শতদল-দলে
কি ছার শিশির-বিন্দু ইহার তুলনে?
উত্তরিলা বীরোত্তম;—“ এখনি আসিব,
বিনাশি রাঘবে রণে, লঙ্কা সুশোভিনি!
যাও তুমি ফিরি, প্রিয়ে, যথা লঙ্কেশ্বরী।
শশাঙ্কের অগ্রে, সতি, উদে লো রোহিণী।
সৃজিলা কি বিধি, সাধ্বি, ও কমল-আঁখি
কাঁদিতে? আলোকাগারে কেন লো উদিছে
পয়োবহ! অনুমতি দেহ, রূপবতি,—
ভ্রান্তিমদে মত্ত নিশি, তোমারে ভাবিয়া
ঊষা, পলাইছে, দেখ সত্বর গমনে,—
দেহ অনুমতি, সতি, যাই যজ্ঞাগারে।”
যথা যবে কুসুমেষু, ইন্দ্রের আদেশে,
রতিরে ছাড়িয়া শূর, চলিলা কুক্ষণে
ভাঙিতে শিবের ধ্যান; হায়রে তেমতি
চলিলা কন্দর্প-রূপী ইন্দ্রজিৎ বলী,
ছাড়িয়া রতি-প্রতিমা প্রমীলা-সতীরে!
কুলগ্নে করিলা যাত্রা মদন; কুলগ্নে
করি যাত্রা গেলা চলি মেঘনাদ বলী—
রাক্ষস-কুল ভরসা অজেয় জগতে!
প্রাক্তনের গতি, হায়, কার সাধ্য রোধে?
বিলাপিলা যথা রতি, প্রমীলা-যুবতী।
কতক্ষণে চক্ষু-জল মুছি রক্ষোবধূ,
হেরিয়া পতিরে দূরে কহিলা সুস্বরে;—
“জানি আমি কেন তুই গহন কাননে,
ভ্রমিস্ যে গজরাজ! দেখিয়া ও গতি,
কি লজ্জার আর তুই মুখ দেখাইবি,
অভিমানি? সরু মাঝা তোর রে কে বলে,
রাক্ষস-কুল-হর্য্যক্ষে হেরে যার আঁখি,
কেশরি? তুইও তেঁই সদা বনবাসী!
নাশিস্ বারণে তুই; এ বীর-কেশরী
ভীম-প্রহরণে রণে বিমুখে বাসবে,
দৈত্য-কুল-নিত্য-অরি, দেবকুল-পতি।”
এতেক কহিয়া সতী, কৃতাঞ্জলি-পুটে,
আকাশের পানে চাহি আরাধিলা কাঁদি;—
“প্রমীলা, তোমার দাসী, নগেন্দ্র-নন্দিনি!
সাধে তোমা, কৃপা-দৃষ্টি কর লঙ্কাপানে,
কৃপাময়ি! রক্ষঃ-শ্রেষ্ঠে রাখ এ বিগ্রহে।
অভেদ্য কবচ-রূপে আবর শূরেরে।
যে ব্রততী সদা, সতি, তোমারি আশ্রিত,
জীবন তাহার জীবে ওই তরুরাজে!
দেখো, মা, কুঠার যেন না পর্শে উহারে।
আর কি কহিবে দাসী? অন্তর্য্যামী তুমি।
তোমা বিনা, জগদম্বে! কে আর রাখিবে?
বহে যথা সমীরণ পরিমল-ধনে
রাজালয়ে, শব্দবহ আকাশ বহিলা
প্রমীলার আরাধনা কৈলাস-সদনে।
কাঁপিলা সভয়ে ইন্দ্র। তা দেখি, সহসা
বায়ুবেগে বায়ুপতি দূরে উড়াইলা
তাহায়। মুছিয়া আঁখি, গেলা চলি সতী,
যমুনা-পুলিনে যথা, বিদারি মাধবে,
বিরহ-বিধুরা গোপী যায় শূন্যমনে
শূন্যালয়ে, কাঁদি বামা পশিলা মন্দিরে।
ইতি শ্রীমেঘনাদবধ কাব্যে উদ্যোগো নাম পঞ্চমঃ সর্গঃ।
পঞ্চম সর্গ।
মুকুতামণ্ডিত বুকে নয়ন বর্ষিল উজ্জ্বলতর মুকুতা—the eyes rained brighter pearls on the breast adorned with pearls. The brighter pearls are evidently the drops of tears falling from the eyes of Pramila.
কি ছার শিরিশ-বিন্দু ইহার তুলনে—insignificant are the dew-drops in comparison with them.
শশাঙ্কের অগ্রে, সতি, উদে লো রোহিণী—The Rohini star rises sooner than the Moon. Indrajit means to say that as Rohini is the favourite consort of Chandra or the Moon, so is Pramila of him; and that as Rohini appears in the sky sooner than her dear husband, so Pramila should appear before Mandodari sooner than Meghanada.
ভ্রান্তিমদে মত্ত... সত্বর গমনে—the Night is overpowered with an error. She is said to have mistaken Pramila for Dawn and is flying away before her. Meghanada means to say that Pramila is as beautiful as Dawn.
জানি আমি কেন...গজরাজ—I know, Oh Lord of elephant, why you roam about in forests. You are proud of five gaits, and you see that the gait of my husband is finer than your. You are therefore ashamed to appear before public view.