সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/ষষ্ঠ সর্গ
ষষ্ঠ সর্গ
ত্যজি সে উদ্যান, বলী সৌমিত্রী-কেশরী
চলিলা, শিবিরে যথা রিরাজেন প্রভু
রঘু-রাজ; অতি দ্রুতে চলিলা সুমতি,
হেরি মৃগরাজে বনে, ধায় ব্যাধ যথা,
অস্ত্রালয়ে—বাছি বাছি লইতে সত্বরে
তীক্ষ্ণতর প্রহরণ নশ্বর-সংগ্রামে।
কতক্ষণে মহাযশাঃ উত্তরিল যথা,
রঘুরথী। পদযুগে নমি, নমস্কারি
মিত্রবর বিভীষণে, কহিলা সুমতি;—
“কৃতকার্য্য আজি, দেব, তব আশীর্ব্বাদে
চিরদাস! স্মরি পদ, প্রবেশি কাননে,
পূজিনু চামুণ্ডে, প্রভু, সুবর্ণ-দেউলৈ।
ছলিতে দাসেরে সতী কত যে পাতিলা
মায়াজাল, কেমনে তা নিবেদি চরণে,
মূঢ় আমি? চন্দ্রচূড়ে দেখিনু দুয়ারে
রক্ষক; ছাড়িলা পথ বিনা রণে তিনি
তব পুণ্যবলে, দেব, মহোরগ যথা
যায় চলি হতবল মহৌষধ-গুণে।
পশিল কাননে দাস; আইল গর্জ্জিয়া
সিংহ; বিমুখিনু তাহে; ভৈরব-হুঙ্কারে
বহিল তুমুল ঝড়! কালাগ্নি-সদৃশ
দানবাগ্নি বেড়িল দেশ; পুড়িল চৌদিকে
বনরাজী; কতক্ষণে নিবিলা আপনি
বায়ুসখা; রায়ুদেব গেলা চলি দূরে।
সুরবালাদলে এবে দেখিনু সম্মুখে
কুঞ্জবন-বিহারিণী; কৃতাঞ্জলি-পুটে,
পূজি, বর মাগি দেব, বিদাইনু সবে।
অদূরে শোভিল বনে দেউল, উজলি
সুদেশ! সরসে পশি, অবগাহি দেহ,
নীলোৎপলাঞ্জলি দিয়া পুজিনু মায়েরে
ভক্তিভাবে। আবির্ভাবি বর দিলা মায়া
কহিলেন দয়াময়ী;—‘সুপ্রসন্ন আজি
রে সতী-সুমিত্রা-সুত, দেব-দেবী যত
তোর প্রতি। দেব-অস্ত্র প্রেরিয়াছে তোরে
বাসব; আপনি আমি আসিয়াছি হেথা
সাধিতে এ কার্য্য তোর, শিবের আদেশে।
ধরি দেব-অস্ত্র, বলি! বিভীষণে লয়ে,
যা চলি নগর-মাঝে, যথায় রাবণি,
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে, পূজে বৈশ্বানরে।
সহসা, শার্দ্দূলাক্রমে আক্রমি রাক্ষসে,
নাশ তারে, মোর বরে পশিবি দুজনে
অদৃশ্য; পিধানে যথা অসি, আবরিব
মায়াজালে আমি দোঁহে। নির্ভয়-হৃদয়ে
যা চলি, রে যশস্বি!’—কি ইচ্ছা তব, কহ,
নৃমণি? পোহায় রাতি, বিলম্ব না সহে।
মারি রাবণিরে, দেব, দেহ আজ্ঞা দাসে।”
উত্তরিলা রঘুনাথ; “হায় রে, কেমনে—
যে কৃতান্ত-দূতে দূরে হেরি, ঊর্দ্ধশ্বাসে
ভয়াকুল জীবকুল ধায় বায়ুবেগে
প্রাণ লয়ে; দেব-নর ভস্ম যার বিষে,—
কেমনে পাঠাই তোরে সে সর্প-বিবরে,
প্রাণাধিক? নাহি কাজ সীতায় উদ্ধারি।
বৃথা, হে জলধি! আমি বাঁধিমু তোমারে;
অসংখ্য রাক্ষসগ্রাম বধিনু সংগ্রামে;
আনিনু রাজেন্দ্রদলে এ কনকপুরে
সসৈন্যে; শোণিতস্রোতঃ, হায়, অকারণে,
বরিষার জলসম, আর্দ্রিল মহীরে।
রাজ্য, ধন, পিতা, মাতা, স্ববন্ধুবান্ধবে—
হারাইনু ভাগ্যদোষে; কেবল আছিল
অন্ধকার-ঘরে দীপ মৈথিলী; তাহারে
(হে বিধি, কি দোষে দাস দোষী তব পদে?)
নিবাইল দুরদৃষ্ট! কে আর আছে রে
আমার সংসারে, ভাই, যার মুখ দেখে
রাখি এ পরাণ আমি? থাকি এ সংসারে?
চল ফিরি, পুনঃ মোরা যাই বনবাসে,
লক্ষ্মণ! কুক্ষণে ভুলি আশার ছলনে,
এ রাক্ষসপুরে, ভাই, আইনু আমরা।”
উত্তরিলা বীরদর্পে সৌমিত্রি-কেশরী;
“কি কারণে, রঘুনাথ! সভয় আপনি
এত? দৈববলে বলী যে জন, কাহারে
ডরে সে ত্রিভুবনে? দেব-কুলপতি
সহস্রাক্ষ পক্ষ তব; কৈলাস-নিবাসী
বিরূপাক্ষ; শৈলবালা ধর্ম্ম সহায়িনী।
দেখ চেয়ে লক্ষাপানে; কালমেঘ-সম
দেবক্রোধ আবরিছে স্বর্ণময়ী আভা—
চারিদিকে! দেব-হাস্য উজলিছে, দেখ,
এ তব শিবির, প্রভু! আদেশ দাসেরে,
ধরি দেব-অস্ত্র আমি পশি রক্ষোগৃহে;
অবশ্য নাশিব রক্ষে ও পদ-প্রসাদে।
বিজ্ঞতম তুমি, নাথ! কেন অবহেল
দেব-আজ্ঞা? ধর্ম্মপথে সদা গতি তব,
এ অধর্ম্ম-কার্য্য, আর্য্য, কেন কর আজি?
কে কোথা মঙ্গলঘট ভাঙ্গে পদাঘাতে?”
কহিলা মধুরভাষে বিভীষণ বলী
মিত্র;— “যা কহিলা সত্য, রাঘবেন্দ্র রথী।
দুরন্ত কৃতান্ত-দূত-সম পরাক্রমে
রাবণি, বাসব-ত্রাস অজেয় জগতে।
কিন্তু বৃথা ভয় আজি করি মোরা তারে।
স্বপনে দেখিনু আমি, রঘুকুলমণি!
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী, শিরোদেশে বসি,
উজলি শিবির, দেব, বিমল কিরণে,
কহিলা অধীনে সাধ্বী,—‘হায়! মত্ত মদে
ভাই তোর, বিভীষণ! এ পাপ-সংসারে
কি সাধে করি রে বাস, কলুষদ্বেষিণী
আমি? কমলিনী কভু ফোটে কি সলিলে
পঙ্কিল? জীমূতাবৃত গগনে কে কবে
হেরে তারা? কিন্তু তোর পূর্ব্বকর্ম্মফলে
সুপ্রসন্ন তোর প্রতি অমর! পাইবি
শূন্য রাজ-সিংহাসন, ছত্রদণ্ডসহ,
তুই! রক্ষঃকুলনাথ-পদে আমি তোরে
করি অভিষেক আজি বিধির বিধানে,
যশস্বি! মারিবে কালি সৌমিত্রি-কেশরী
ভ্রাতৃপুত্ত্র মেঘনাদ; সহায় হইবি
তুই তার। দেব-আজ্ঞা পালিস্ যতনে,
রে ভাবী কর্ব্বুররাজ!’ উঠিনু জাগিয়া,—
স্বর্গীয় সৌরভে পূর্ণ শিবির দেখিনু,
স্বর্গীয় বাদিত্র, দূরে শুনিনু গগনে
মৃদু। শিবিরের দ্বারে হেরিনু বিস্ময়ে
মদনমোহনে মোহে যে রূপমাধুরী!
গ্রীবাদেশ আচ্ছাদিছে কাদম্বিনীরূপী
কবরী; ভাতিছে কেশে রত্নরাশি,—মরি
কি ছার তাহার কাছে বিজলীর ছটা
মেঘমালে! আচম্বিতে অদৃশ্য হইলা
জগদম্বা। বহুক্ষণ রহিনু চাহিয়া
সতৃষ্ণ-নয়নে আমি, কিন্তু না ফলিল
মনোরথ; আর মাতা নাহি দিল দেখা।
শুন দাশরথি রথি, এ সকল কথা
মন দিয়া। দেহ আজ্ঞা, সঙ্গে যাই আমি
যথা যজ্ঞাগারে পূজে দেব-বৈশ্বানরে
রাবণি। হে নরপাল, পাল সযতনে
দেবাদেশ! ইষ্টসিদ্ধি অবশ্য হইবে
তোমার, রাঘব-শ্রেষ্ঠ! কহিনু তোমারে।
উত্তরিলা সীতানাথ সজল-নয়নে,—
“স্মরিলে পূর্ব্বের কথা, রক্ষঃকুলোত্তম!
আকুল পরাণ কাঁদে! কেমনে ফেলিব
এ ভ্রাতৃ-রতনে আমি এ অতল জলে?
হায়, সখে, মন্থরার কুপন্থায় যবে
চলিলা কৈকেয়ী-মাতা, মম ভাগ্যদোষে
নির্দ্দয়; ত্যজিনু যবে রাজ্যভোগ আমি
পিতৃসত্য-রক্ষা-হেতু; স্বেচ্ছায় ত্যজিল
রাজ্যভোগ প্রিয়তম ভ্রাতৃ-প্রেম-বশে!
কাঁদিলা সুমিত্রা মাতা উচ্চে; অবরোধে
কাঁদিলা ঊর্ম্মিলা-বধূ; পৌরজন যত—
কত যে সাধিলা সবে, কি আর কহিব?
না মানিল অনুরোধ। আমার পশ্চাতে
(ছায়া যথা) বনে ভাই পশিল হরষে,
জলাঞ্জলি দিয়া সুখে তরুণ-যৌবনে।
কহিলা সুমিত্রা মাতা,— ‘নয়নের মণি
আমার, হরিলি তুই, রাঘব! কে জানে,
কি কুহক-বলে তুই ভুলালি বাছারে?
সঁপিনু এ ধন তোরে। রাখিস্ যতনে
এ মোর রতনে তুই, এই ভিক্ষা মাগি।’
“নাহি কাজ, মিত্রবর! সীতার উদ্ধারি;
ফিরি যাই বনবাসে। দুর্ব্বার সমরে
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস, রথীন্দ্র রাবণি!
সুগ্রীব বাহুবলেন্দ্র; বিশারদ রণে
অঙ্গদ সু-যুবরাজ; বায়ুপুত্ত্র হনূ
ভীমপরাক্রম পিতা প্রভঞ্জন যথা;
ধূম্রাক্ষ, সমর-ক্ষেত্রে ধূমকেতুসম
অগ্নিরাশি; নল নীল; কেশরী-কেশরী
বিপক্ষের পক্ষে শূর; আর যোধ যত,
দেবাকৃতি, দেববীর্য্য; তুমি মহারথী;—
এ সবার সহকারে নারি নিবারিতে
যে রক্ষে, কেমনে, কহ, লক্ষ্মণ একাকী
যুঝিবে তাহার সঙ্গে? হায়, মায়াবিনী
আশা, তেঁই, কহি, সখে, এ রাক্ষসপুরে,
অলঙ্ঘ্য সাগর লঙ্ঘি, আইনু আমরা।”
সহসা আকাশ-দেশে, আকাশ-সম্ভবা
সরস্বতী নিনাদিলা মধুর-নিনাদে;—
“উচিত কি তব, কহ, হে বৈদেহীপতি!
সংশয়িতে দেববাক্য, দেবকুলপ্রিয়
তুমি? দেবাদেশ, বলি! কেন অবহেল?
দেখ চেয়ে শূণ্যপানে।” দেখিলা বিস্ময়ে
রঘুরাজ, অহিসহ যুঝিছে অম্বরে
শিখী। কেকারব মিশি ফণীর স্বননে,
ভৈরব-আরবে দেশ পূরিছে চৌদিকে!
পক্ষচ্ছায়া আবরিছে, ঘনদল যেন,
গগন, জ্বলিছে মাঝে, কালানল-তেজে
হলাহল! ঘোর-রণে রণিছে উভয়ে।
মুহুর্ম্মুহুঃ ভয়ে মহী কাঁপিলা, ঘোষিল
উথলিয়া জলদল। কতক্ষণ পরে,
গতপ্রাণ শিখিবর পড়িলা ভূতলে;
গরজিলা অজগর - বিজয়ী সংগ্রামে।
কহিলা রাবণানুজ;—“স্বচক্ষে দেখিলা
অদ্ভুত ব্যাপার আজি; নিরর্থ এ নহে,
কহিনু, বৈদেহীনাথ, বুঝ ভাবি মনে।
নহে ছায়াবাজী ইহা; আশু যা ঘটিবে
এ প্রপঞ্চরূপে দেব, দেখালে তোমারে;
নির্বীরিবে লঙ্কা আজি সৌমিত্রি-কেশরী!”
প্রবেশি শিবিরে তবে রঘুকুলমণি,
সাজাইলা প্রিয়ানুজে দেব-অস্ত্রে। আহা,
শোভিলা সুন্দর বীর স্কন্দ তারকারি
সদৃশ। পরিলা বক্ষে কবচ সুমতি
তারাময়; সারসনে ঝল-ঝল-ঝলে
ঝলিল ভাস্বর অসি মণ্ডিত রতনে।
রবির পরিধি–সম দীপে পৃষ্ঠদেশে
ফলক; দ্বিরদ-রদ-নির্ম্মিত, কাঞ্চনে
জড়িত, তাহার সঙ্গে নিষঙ্গ দুলিল
শরপূর্ণ। বামহস্তে ধরিলা সাপটি
দেবধনু ধনুর্দ্ধর; ভাতিল মস্তকে
(সৌরকরে গড়া যেন) মুকুট, উজলি
চৌদিক্; মুকুটোপরি নড়িল সঘনে
সুচূড়া, কেশরিপৃষ্ঠে নড়য়ে যেমতি
কেশর! রাঘবানুজ সাজিলা হরষে,
তেজস্বী—মধ্যাহ্নে যথা দেব অংশুমালী!
শিবির হইতে বলী বাহিরিলা বেগে—
ব্যগ্র, তুরঙ্গম যথা শৃঙ্গকুলনাদে,
সমরতরঙ্গ যবে উথলে নির্ঘোষে।
বাহিরিলা বীরবর; বাহিরিলা সাথে
বীরবেশে বিভীষণ, বিভীষণ রণে।
বরষিলা পুষ্প দেব; বাজিল আকাশে
মঙ্গল-বাজনা; শূন্যে নাচিল অপ্সরা,
স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল পূরিল জয়রবে।
আকাশের পানে চাহি, কৃতাঞ্জলিপুটে
আরাধিলা রঘুবর;—“তব পদাম্বুজে,
চায় গো আশ্রয় আজি রাঘব-ভিখারী,
অম্বিকে! ভুলো না, দেবি! এ তব কিঙ্করে।
ধর্ম্মরক্ষা হেতু মাতঃ, কত যে পাইনু
আয়াস, ও রাঙাপদে অবিদিত নহে।
ভুঞ্জাও ধর্ম্মের ফল, মৃত্যুঞ্জয়-প্রিয়ে!
অভাজনে; রক্ষ, সতি, এ রক্ষঃ-সমরে,
প্রাণাধিক ভাই এই কিশোর লক্ষ্মণে!
দুর্দ্দান্ত দানবে দলি, নিস্তারিলা তুমি,
দেবদলে, নিস্তারিণি! নিস্তার অধীনে,
মহিষ-মর্দ্দিনি, মর্দ্দি দুর্ম্মদ-রাক্ষসে।”
এইরূপে রক্ষোরিপু স্তুতিলা সতীরে।
যথা সমীরণ বহে পরিমল-ধনে
রাজালয়ে, শব্দবহ আকাশ বহিলা
রাঘবের আরাধনা কৈলাস-সদনে।
হাসিলা দিবিন্দ্র দিবে; পবন অমনি
চালাইলা আশুতরে সে শব্দবাহকে।
শুনি সে সু-আরাধনা, নগেন্দ্রনন্দিনী,
আনন্দে, তথাস্তু বলি, আশীষিলা মাতা।
হাসি দেখা দিলা ঊষা উদয়-অচলে,
আশা যথা, আহা মরি, আঁধার-হৃদয়ে,
দুঃখ-তমোবিনাশিনী। কূজনিল পাখী
নিকুঞ্জে; গুঞ্জরি অলি, ধাইলা চৌদিকে
মধুজীবী; মৃদুগতি চলিলা শর্ব্বরী,
তারাদলে লয়ে সঙ্গে; ঊষার ললাটে
শোভিল একটী তারা শত-তারা-তেজে!
ফুটিল কুন্তলে ফুল, নব তারাবলী!
লক্ষ্য করি রক্ষোবরে রাঘব কহিলা;—
“সাবধানে যাও, মিত্র! অমূল্য-রতনে
রামের, ভিখারী রাম অর্পিছে তোমারে,
রথিবর! নাহি কাজ বৃথা বাক্যব্যয়ে;—
জীবন মরণ মম আজি তব হাতে।”
আশ্বাসিলা মহেষ্বাসে বিভীষণ বলী;—
“দেবকুলপ্রিয় তুমি, রঘুকুলমণি!
কাহারে ডরাও প্রভু? অবশ্য নাশিবে
সমরে সৌমিত্রি-শূর মেঘনাদ-শূরে।”
বন্দি রাঘবেন্দ্রপদ, চলিলা সৌমিত্রি
সহ মিত্র বিভীষণ। ঘন ঘনাবলী
বেড়িল দোঁহারে, যথা বেড়ে হিমানীতে
কুজ্ঝটিকা গিরিশৃঙ্গে, পোহাইলে রাতি।
চলিলা অদৃশ্যভাবে লঙ্কামুখে দোঁহে।
যথায় কমলাসনে বসেন কমলা—
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী—রক্ষোবধূবেশে,
প্রবেশিলা মায়াদেবী সে স্বর্ণ-দেউলে।
হাসিয়া সুধিলা রমা, কেশব-বাসনা;—
“কি কারণে মহাদেবি! গতি এবে তব
এ পুরে? কহ, কি ইচ্ছা তোমার রঙ্গিণি?
উত্তরিলা মৃদু হাসি মায়া শক্তীশ্বরী;—
“সম্বর নীলাম্বুসুতে, তেজঃ তব আজি;
পশিবে এ স্বর্ণপুরে দেবাকৃতি রথী
সৌমিত্রি; নাশিবে শূর, শিবের আদেশে,
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে দম্ভী মেঘনাদে।
কালানলসম তেজঃ তব, তেজস্বিনি!
কার সাধ্য বৈরিভাবে পশে এ নগরে?
সুপ্রসন্ন হও, দেবি! করি এ মিনতি,
রাঘবের প্রতি তুমি। তার, বরদানে,
ধর্ম্মপথগামী রামে, মাধব-রমণি!”
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি কহিলা ইন্দিরা;—
“কার সাধ্য, বিশ্বধ্যেয়া! অবহেলে তব
আজ্ঞা? কিন্তু প্রাণ মম কাঁদে গো স্মরিলে
এ সকল কথা! হায়, কত যে আদরে
পূজে মোরে রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, রাণী মন্দোদরী,
কি আর কহিব তার? কিন্তু নিজ দোষে
মজে রক্ষঃকুলনিধি। সম্বরিব দেবি!
তেজঃ—প্রাক্তনের গতি কার সাধ্য রোধে?
কহ সৌমিত্রিরে তুমি পশিতে নগরে
নির্ভয়ে। সন্তুষ্ট হ’য়ে বর দিনু আমি,
সংহারিবে এ সংসারে সুমিত্রানন্দন
বলী-অরিন্দম মন্দোদরীর নন্দনে।”
চলিলা পশ্চিম-দ্বারে কেশব-বাসনা
সুরমা, প্রফুল্ল ফুল প্রত্যূষে যেমতি
শিশির-আসারে ধৌত। চলিলা রঙ্গিণী,
সঙ্গে মায়া। শুকাইল রম্ভাতরুরাজি;
ভাঙ্গিল মঙ্গলঘট; শুষিলা মেদিনী
বারি। রাঙ্গাপায়ে আসি মিশিল সত্বরে
তেজোরাশি, যথা পশে, নিশা অবসানে,
সুধাকর-কর-জাল রবি-করজালে।
শ্রীভ্রষ্টা হইল লঙ্কা; হারাইলে, মরি,
কুন্তলশোভন মণি ফণিনী যেমতি।
গম্ভীর নির্ঘোষে দূরে ঘোষিলা সহসা
ঘনদল; বৃষ্টি ছলে গগন কাঁদিলা,
কল্লোলিলা জলপতি, কাঁপিলা বসুধা,
আক্ষেপে, রে রক্ষঃপুরি, তোর এ বিপদে,
জগতের অলঙ্কার তুই স্বর্ণময়ি!
প্রাচীরে উঠিয়া দোঁহে হেরিলা অদূরে
দেবাকৃতি সৌমিত্রিরে, কুজ্ঝটিকাবৃত
যেন দেব ত্বিষাম্পতি, কিম্বা বিভাবসু
ধূমপুঞ্জে। সাথে সাথে বিভীষণ রথী—
বায়ুসখাসহ বায়ু—দুর্ব্বার সমরে।
কে আজি রক্ষিবে, হায়, রাক্ষস-ভরসা
রাবণিরে? ঘন বনে, হেরি দূরে যথা
মৃগবরে, চলে ব্যাঘ্র গুল্ম-আবরণে,
সুযোগ-প্রয়াসী; কিম্বা নদীগর্ভে যথা
অবগাহকেরে দূরে নিরখিয়া, বেগে
যমচক্ররূপী নক্র ধায় তার পানে
অদৃশ্যে, লক্ষ্মণ-শূর, বধিতে রাক্ষসে,
সহ মিত্র বিভীষণ, চলিলা সত্বরে।
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, বিদায়ি মায়ারে,
স্বমন্দিরে গেলা চলি ইন্দিরা-সুন্দরী।
কাঁদিলা মাধবপ্রিয়া! উল্লাসে শুষিলা
অশ্রুবিন্দু বসুন্ধরা— শুষে শুক্তি যথা
যতনে, হে কাদম্বিনি, নয়নাম্বু তব,
অমূল্য মুকুতাফল ফলে যার গুণে,
ভাতে যবে স্বাতী-সতী গগনমণ্ডলে।
প্রবল মায়ার বলে পশিলা নগরে
বীরদ্বয়। সৌমিত্রির পরশে খুলিল
দুয়ার অশনি-নাদে; কিন্তু কার কাণে
পশিল আরাব? হায়! রক্ষোরথী যত
মায়ার ছলনে অন্ধ, কেহ না দেখিলা
দুরন্ত কৃতান্ত-দূতসম রিপুদ্বয়ে,
কুসুমরাশিতে অহি পশিল কৌশলে!
সবিস্ময়ে রামানুজ দেখিলা চৌদিকে
চতুরঙ্গবল দ্বারে;— মাতঙ্গে নিষাদী,
তুরঙ্গমে সাদী-বৃন্দ মহারথী রথে,
ভূতলে শমনদূত পদাতিক যত—
ভীমাকৃতি ভীমবীর্য্য; অজেয় সংগ্রামে।
কালানল-সম বিভা উঠিছে আকাশে।
হেরিলা সভয়ে বলী সর্ব্বভুক্রূপী
বিরূপাক্ষ মহারক্ষঃ, প্রক্ষ্বেড়নধারী,
সুবর্ণ স্যন্দনারূঢ়, তালবৃক্ষাকৃতি
দীর্ঘ তালজঙ্ঘা শূর— গদাধর যথা
মুর-অরি; গজপৃষ্ঠে কালনেমী, বলে
রিপুকুলকাল বলী, বিশারদ রণে,
রণপ্রিয়, বীরমদে প্রমত্ত সতত
প্রমত্ত, চিক্ষুর রক্ষঃ যক্ষপতিসম,—
আর আর মহাবলী, দেব-দৈত্য-নর—
চিরত্রাস। ধীরে ধীরে, চলিলা দুজনে;
নীরবে উভয় পার্শ্বে হেরিলা সৌমিত্রি
শত শত হেম-হর্ম্ম্য, দেউল, বিপণি,
উদ্যান, সরসী, উৎস; অশ্ব অশ্বালয়ে,
গজালয়ে গজবৃন্দ; স্যন্দন অগণ্য
অগ্নিবর্ণ, অস্ত্রশালা, চারু নাট্যশালা,
মণ্ডিত রতনে, মরি! যথা সুরপুরে।
লঙ্কার বিভব যত কে পারে বর্ণিতে—
দেবলোভ, দৈত্যকুল-মাৎসর্য্য? কে পারে
গণিতে সাগরে রত্ন, নক্ষত্র আকাশে?
নগরমাঝারে শূর হেরিলা কৌতুকে
রক্ষোরাজ রাজগৃহ। ভাতে সারি সারি
কাঞ্চনহীরকস্তম্ভ; গগন পরশে
গৃহচূড়া, হেমকূটশৃঙ্গাবলী যথা
বিভাময়ী। হস্তিদন্ত স্বর্ণকান্তি-সহ
শোভিছে গবাক্ষে, দ্বারে, চক্ষু বিনোদিয়া,
তুষার-রাশিতে শোভে প্রভাতে যেমতি
সৌরকর! সবিস্ময়ে চাহি মহাযশাঃ
সৌমিত্রি, শূরেন্দ্র মিত্র বিভীষণ-পানে,
কহিলা;—“অগ্রজ তব ধন্য রাজকুলে;
রক্ষোবর, মহিমার অর্ণব জগতে।
এ হেন বিভব, আহা, কার ভবতলে?”
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি উত্তরিলা বলী
বিভীষণ;—“যা কহিলা সত্য, শূরমণি!
এ হেন বিভব, হায়, কার ভবতলে?
কিন্তু চিরস্থায়ী কিছু নহে এ সংসারে।
এক যায় আর আসে, জগতের রীতি,—
সাগরতরঙ্গ যথা! চল ত্বরা করি,
রথিবর! সাধ কাজ বধি মেঘনাদে;
অমরতা লভ দেব, যশঃসুধা–পানে!”
সত্বরে চলিলা দোঁহে, মায়ার প্রসাদে
অদৃশ্য। রাক্ষসবধূ, মৃগাক্ষিগঞ্জিনী
দেখিলা লক্ষ্মণ-বলী সরোবরকূলে,
সুবর্ণ-কলসী কাঁখে, মধুর অধরে
সুহাসি। কমল-কুল ফোটে জলাশয়ে
প্রভাতে। কোথাও রথী বাহিরিছে বেগে
ভীমকায়; পদাতিক, আয়সী আবৃত,
ত্যজি ফুল-শয্যা; কেহ শৃঙ্গ নিনাদিছে
ভৈরবে নিবারি নিদ্রা; সাজাইছে বাজী
বাজীপাল। গর্জ্জি গজ সাপটে প্রমদে
মুদ্গর; শোভিছে পট্ট-আবরণ পিঠে,
ঝালরে মুকুতাপাতি; তুলিছে যতনে
সারথি বিবিধ অস্ত্র স্বর্ণধ্বজ রথে।
বাজিছে মন্দিরবৃন্দে প্রভাতী বাজনা,
হায় রে সুমনোহর, বঙ্গগৃহে যথা
দেবদলোৎসব বাদ্য, দেবদল যবে,
আবির্ভাবি ভবতলে, পূজেন রমেশে।
অবচয়ি ফুলচয়, চলিছে মালিনী
কোথাও, আমোদি পথ ফুলপরিমলে,
উজলি চৌদিকে রূপে, ফুলকুল-সখী
ঊষা যথা! কোথাও বা দধি দুগ্ধ ভারে
লইয়া ধাইছে ভারী,—ক্রমশঃ বাড়িছে
কল্লোল, জাগিছে পুরে পুরবাসী যত।
কেহ কহে—“চল, ওহে উঠিগে প্রাচীরে।
না পাইব স্থান যদি না যাই সকালে,
হেরিতে অদ্ভুত যুদ্ধ! জুড়াইব আঁখি
দেখি আজ যুবরাজে সমর-সাজনে,
আর বীরশ্রেষ্ঠ সবে।” কেহ উত্তরিছে
প্রগল্ভে,—“কি কাজ কহ, প্রাচীর উপরে?
মুহূর্ত্তে নাশিবে রামে, অনুজ লক্ষ্মণে
যুবরাজ, তাঁর শরে কে স্থির জগতে?
দহিবে বিপক্ষদলে; শুষ্ক-তৃণে যথা
দহে বহ্নি, রিপুদমী! প্রচণ্ড আঘাতে
দণ্ডি তাত বিভীষণে, বাঁধিবে অধমে!
রাজপ্রসাদের হেতু অবশ্য আসিবে
রণজয়ী, সভাতলে; চল সভাতলে।”
কত যে শুনিলা বলি, কত যে দেখিলা,
কি আর কহিবে কবি? হাসি মনে মনে,
দেবাকৃতি, দেববীর্য্য, দেব-অস্ত্রধারী
চলিলা যশস্বী, সঙ্গে বিভীষণ রথী,—
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগার শোভিল অদূরে।
কুশাসনে ইন্দ্রজিৎ পূজে ইষ্টদেবে
নিভৃতে; কৌষিক-বস্ত্র, কৌষিক-উত্তরী,
চন্দনের ফোঁটা ভালে, ফুলমালা গলে।
পুড়ে ধূমদানে ধূপ; জ্বলিছে চৌদিকে
পূতঘৃত রসে দীপ! পুষ্প রাশি রাশি,
গণ্ডারের শৃঙ্গে গড়া কোষা কোষী, ভরা,
হে জাহ্নবি! তব জলে, কলুষনাশিনী
তুমি। পাশে হেমঘণ্টা, উপহার নানা,
হেম-পাত্রে; রুদ্ধ দ্বার,—ব’সেছে একাকী
রথীন্দ্র, নিমগ্ন তপে চন্দ্রচূড় যেন—
যোগীন্দ্র—কৈলাস-গিরি তব উচ্চ-চূড়ে।
যথা ক্ষুধাতুর ব্যাঘ্র পশে গোষ্ঠ-গৃহে
যমদূত, ভীমবাহু লক্ষ্মণ পশিলা
মায়াবলে দেবালয়ে। ঝন্ঝনিল অসি
পিধানে, ধ্বনিল বাজী তূণীর ফলকে,
কাঁপিল মন্দির ঘন বীরপদভরে।
চমকি মুদিত-আঁখি মেলিলা রাবণি।
দেখিলা সম্মুখে বলী দেবাকৃতি রথী—
তেজস্বী মধ্যাহ্নে যথা দেব অংশুমালী!
সাষ্টাঙ্গে প্রণমি শূর, কৃতাঞ্জলিপুটে,
কহিলা,—“হে বিভাবসু, শুভক্ষণে আজি
পূজিল তোমারে দাস, তেঁই, প্রভু, তুমি
পবিত্রিলা লঙ্কাপুরী ও পদ-অর্পণে!
কিন্তু কি কারণে, কহ, তেজস্বি! আইলা
রক্ষঃকুলরিপু নর লক্ষ্মণের রূপে
প্রসাদিতে এ অধীনে? এ কি লীলা তব
প্রভাময়?” পুনঃ বলী নমিলা ভূতলে।
উত্তরিলা বীরদর্পে রৌদ্র দাশরথি;—
“নহি বিভাবসু আমি, দেখ নিরখিয়া,
রাবণি! লক্ষ্মণ নাম, জন্ম রঘুকুলে।
সংহারিতে, বীরসিংহ, তোমায় সংগ্রামে
আগমন হেথা মম; দেহ রণ মোরে
অবিলম্বে।” যথা পথে সহসা হেরিলে
ঊর্দ্ধফণা ফণীশ্বরে, ত্রাসে হীনগতি
পথিক, চাহিলা বলী লক্ষ্মণের পানে।
সভয় হইল আজি ভয়শূন্য হিয়া!
প্রচণ্ড উত্তাপে পিণ্ড, হায় রে, গলিল!
গ্রাসিল মিহিরে রাহু, সহসা আঁধারি
তেজঃপুঞ্জ। অম্বুনাথে নিদাঘ শুষিল!
পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে।
বিস্ময়ে কহিলা শূর;—“সত্য যদি তুমি
রামানুজ, কহ, রথি! কি ছলে পশিলা
রক্ষোরাজপুরে আজি? রক্ষঃ শত শত,
যক্ষপতিত্রাস বলে, ভীম-অস্ত্রপাণি
রক্ষিছে নগরদ্বার; শৃঙ্গধরসম
এ পুর-প্রাচীর উচ্চ; প্রাচীর উপরে
ভ্রমিছে অযুত যোধ চক্রাবলী-রূপে,—
কোন্ মায়াবলে, বলি! ভুলালে এ সবে?
মানবকুলসম্ভব দেবকুলোদ্ভবে
কে আছে রথী এ বিশ্বে, বিমুখয়ে রণে
একাকী এ রক্ষোবৃন্দে? এ প্রপঞ্চে তবে
কেন বঞ্চাইছ দাসে, কহ তা দাসেরে,
সর্ব্বভুক্? কি কৌতুক এ তব, কৌতুকি?
নহে নিরাকার দেব, সৌমিত্রি, কেমনে
এ মন্দিরে পশিবে সে? এখনও দেখ
রুদ্ধদ্বার। বর, প্রভু, দেহ এ কিঙ্করে,
নিঃশঙ্ক করিব লঙ্কা বধিয়া রাঘবে
আজি, খেদাইব দূরে কিষ্কিন্ধা- অধীপে,
বাঁধি আনি রাজপদে দিব বিভীষণে
রাজদ্রোহী। ওই শুন, নাদিছে চৌদিকে
শৃঙ্গ-শৃঙ্গনাদিগ্রাম। বিলম্বিলে আমি,
ভগ্নোদ্যম রক্ষঃচমূ বিদাও আমারে!”
উত্তরিলা দেবাকৃতি সৌমিত্রি কেশরী;—
‘কৃতান্ত আমি রে তোর, দুরন্ত রাবণি!
মাটী কাটি দংশে সর্প আয়ুহীন জনে।
মদে মত্ত সদা তুই, দেববলে বলী;
তবু অবহেলা, মূঢ়, করিস্ সতত
দেবকুলে! এত দিনে মজিলি দুর্ম্মতি!
দেবাদেশে রণে আমি আহ্বানি রে তোরে!
এতেক কহিয়া বলী উলঙ্গিলা অসি
ভৈরবে। ঝলসি আঁখি কালানল-তেজে:
ভাতিল কৃপাণবর, শত্রুকরে যথা
ইরম্মদময় বজ্র! কহিলা রাবণি;—
“সত্য যদি রামানুজ তুমি, ভীমবাহু
লক্ষ্মণ; সংগ্রাম-সাধ অবশ্য মিটাব
মহাহবে আমি তব, বিরত কি কভু
রণরঙ্গে ইন্দ্রজিৎ? আতিথেয় সেবা,
তিষ্ঠি লহ, শূরশ্রেষ্ঠ! প্রথমে এ ধামে—
রক্ষোরিপু তুমি, তবু অতিথি হে এবে।
সাজি বীরসাজে আমি। নিরস্ত্র যে অরি,
নহে রথিকুল প্রথা আঘাতিতে তারে।
এ বিধি, হে বীরবর, অবিদিত নহে,
ক্ষত্ত্র তুমি, তব কাছে; কি আর কহিব?”
জলদপ্রতিম-স্বনে কহিলা সৌমিত্রি;—
“আনায় মাঝারে বাঘে পাইলে কি কভু
ছাড়ে রে কিরাত তারে? বধিব এখনি,
অবোধ! তেমতি তোরে। জন্ম রক্ষঃকুলে
তোর, ক্ষত্ত্রধর্ম্ম, পাপি! কি হেতু পালিব
তোর সঙ্গে? মারি অরি, পারি যে কৌশলে।”
কহিলা বাসবজেতা;—(অভিমন্যু যথা
হেরি সপ্ত শূরে শূর তপ্ত-লৌহাকৃতি
রোষে!) “ক্ষত্ত্রকুলগ্নানি, শত–ধিক্ তোরে,
লক্ষ্মণ! নির্লজ্জ তুই। ক্ষত্ত্রিয়-সমাজে
রোধিবে শ্রবণপথ ঘৃণায়, শুনিলে
নাম তোর রথিবৃন্দ! তস্কর যেমতি,
পশিলি এ গৃহে তুই; তস্কর-সদৃশ
শাস্তিয়া নিরস্ত তোরে করিব এখনি।
পশে যদি কাকোদর গরুড়ের নীড়ে,
ফিরি কি সে যায় কভু আপন বিবরে,
পামর? কে তোরে হেথা আনিল দুর্ম্মতি?”
চক্ষের নিমিষে কোষা তুলি ভীমবাহু
নিক্ষেপিলা ঘোরনাদে লক্ষ্মণের শিরে।
পড়িলা ভূতলে বীর ভীম-প্রহরণে,
পড়ে তরুরাজ যথা প্রভঞ্জনবলে
মড়মড়ে! দেব-অস্ত্র বাজিল ঝন্ঝনি,
কাঁপিল দেউল যেন ঘোর ভূকম্পনে।
বহিল রুধির-ধারা। ধরিলা সত্বরে
দেব অসি ইন্দ্রজিৎ;— নারিলা তুলিতে
তাহায়। কার্ম্মুক ধরি কর্ষিলা; রহিল
সৌমিত্রির হাতে ধনু! সাপটিলা কোপে
ফলক; বিফল বল, সে কাজ সাধনে।
যথা শুণ্ডধর টানে শুণ্ডে জড়াইয়া
শৃঙ্গধরশৃঙ্গে, বৃথা টানিল তূণীরে
শূরেন্দ্র! মায়ার মায়া কে বুঝে জগতে?
চাহিলা দুয়ার পানে অভিমানে মানী।
সচকিতে বীরবর দেখিলা সম্মুখে
ভীমতম শূল-হস্তে, ধূমকেতুসম
খুল্লতাত বিভীষণে—বিভীষণ রণে।
“এতক্ষণে”— অরিন্দম কহিলা বিষাদে;—
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল
রক্ষঃপুরে। হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ? নিকষা-সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ! শূলী-শম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ! ভ্রাতৃপুত্ত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।
উত্তরিল বিভীষণ;— “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;—
“হে পিতৃব্য! তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে।
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে,
কে তুমি? জনম তব কোন্ মহাকুলে?
কেবা সে অধম রাম? স্বচ্ছ-সরোবরে
করে কেলি রাজহংস, পঙ্কজ কাননে;
যায় কি সে কভু, প্রভু! পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র-কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরি, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্মণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথি, এ কি মহারথি-প্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা। ছাড়হ পথ, আসিব ফিরিয়া
এখনি। দেখিব আজি, কোন্ দেববলে
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি।
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের। কি দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্ব্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে।
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ নন্দন কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ, তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি, ভ্রাতৃ-পুত্ত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
মহামন্ত্রবলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদনে লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষ্যি রাবণ-আত্মজে;—
“নহি দোষী আমি, বৎস! বৃথা ভর্ৎস মোরে
তুমি। নিজ কর্ম্মদোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা মজিলা আপনি।
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কাল-সলিলে!
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী; —“ধর্ম্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি—কোন্ ধর্ম্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি—এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পর পর সদা।
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর! কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা। হেন সহবাসে
হে পিতৃব্য, বর্ব্বরতা কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচসহ নীচ সে দুর্ম্মতি।”
হেথায় চেতনা পাই মায়ার যতনে
সৌমিত্রি, হুঙ্কারে ধনু টঙ্কারিলা বলী।
সন্ধানি বিঁধিলা শূর খরতর শরে
অরিন্দম ইন্দ্রজিতে, তারকারি যথা
মহেষ্বাস শরজালে বিঁধেন তারকে।
হায় রে, রুধির-ধারা (ভূধর -শরীরে
বহে বরিষার কালে জলস্রোতঃ যথা)
বহিল, তিতিয়া বস্ত্র, তিতিয়া মেদিনী।
অধীর ব্যাথায় রথী, সাপটি সত্ত্বরে
শঙ্খ, ঘণ্টা, উপহার-পাত্র ছিল যত
যজ্ঞাগারে, একে একে নিক্ষেপিলা কোপে।
যথা অভিমন্যু রথী, নিরস্ত্র সমরে
সপ্তরথী- অস্ত্রবলে, কভু বা হানিলা
রথচূড়া, রথচক্র; কভু ভগ্ন অসি,
ছিন্ন চর্ম্ম, ভিন্ন বর্ম্ম, যা পাইলা হাতে।
কিন্তু মায়াময়ী মায়া, বাহু প্রসারণে,
ফেলাইলা দূরে সবে, জননী যেমতি
খেদান মশকবৃন্দে সুপ্ত-সুত হ’তে
করপদ্ম-সঞ্চালনে। সরোষে রাবণি
ধাইলা লক্ষ্মণপানে গর্জ্জি ভীমনাদে,
প্রহারকে হেরি যথা সম্মুখে কেশরী।
মায়ার মায়ায় বলী হেরিলা চৌদিকে
ভীষণ মহিষারূঢ় ভীম দণ্ডধরে;
শূলহস্তে শূলপাণি; শঙ্খ, চক্র, গদা
চতুর্ভুজে চতুর্ভুজ, হেরিলা সভয়ে
দেবকুল রথিবৃন্দে সুদিব্য বিমানে।
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি দাঁড়াইলা বলী
নিষ্কল, হায় রে মরি, কলাধর যথা
রাহুগ্রাসে; কিম্বা সিংহ আনায়-মাঝারে!
ত্যজি ধনু, নিষ্কোষিলা অসি মহাতেজাঃ
রামানুজ; ঝলসিলা ফলক-আলোকে
নয়ন। হায় রে, অন্ধ অরিন্দম বলী
ইন্দ্রজিৎ, খড়্গাঘাতে পড়িলা ভূতলে
শোণিতার্দ্র। থরথরি কাঁপিলা বসুধা;
গর্জ্জিলা উথলি সিন্ধু। ভৈরব-আরবে
সহসা পূরিল বিশ্ব। ত্রিদিবে, পাতালে,
মর্ত্যে, মরামর জীব প্রমাদ গণিলা
আতঙ্কে। যথায় বসি হৈম-সিংহাসনে
সভায় কর্ব্বুর-পতি, সহসা পড়িল
কনক-মুকুট খসি, রথচূড়া যথা
রিপুরথী কাটি যবে পড়ে রথতলে।
সশঙ্ক লঙ্কেশ-শূর স্মরিলা শঙ্করে।
প্রমীলার বামেতর নয়ন নাচিল।
আত্মবিস্মৃতিতে, হায়, অকস্মাৎ সতী
মুছিল! সিন্দূরবিন্দু সুন্দর ললাটে।
মূর্চ্ছিলা রাক্ষসেন্দ্রাণী মন্দোদরী-দেবী
আচম্বিতে। মাতৃকোলে নিদ্রায় কাঁদিল
শিশুকুল আর্তনাদে, কাঁদিল যেমতি
বজ্রে বজ্রকুলশিশু, যবে শ্যাম-গুণমণি,
আঁধারি সে ব্রজপুর, গেলা মধুপুরে।
অন্যায় সমরে পড়ি, অসুরারি-রিপু,
রাক্ষসকুল-ভরসা, পরুষ বচনে
কহিলা লক্ষ্মণ-শূরে; —“বীরকুলগ্লানি,
সুমিত্রানন্দন, তুই! শতধিক্ তোরে!
রাবণনন্দন আমি, না ডরি শমনে।
কিন্তু তোর অস্ত্রাঘাতে মরিনু যে আজি;
পামর, এ চিরদুঃখ রহিল রে মনে
দৈত্যকুলদল ইন্দ্রে দমিনু সংগ্রামে
মরিতে কি তোর হাতে? কি তাপে বিধাতা
দিলেন তাপ দাসে, বুঝিব কেমনে?
আর কি কহিব তোরে? এ বারতা যবে
পাইবেন রক্ষোনাথ, কে রক্ষিবে তোরে,
নরাধম? জলধির অতল-সলিলে
ডুবিস্ যদিও তুই, পশিবে সে দেশে
রাজরোষ—বাড়বাগ্নিরাশিসম তেজে।
দাবাগ্নিসদৃশ তোরে দগ্ধিবে কাননে
সে রোষ, কাননে যদি পশিস্, কুমতি!
নারিবে রজনী, মূঢ়, আবরিতে তোরে।
দানব, মানব, দেব, কার সাধ্য হেন
ত্রাণিবে, সৌমিত্রি! তোরে, রাবণ রুষিলে?
কেবা এ কলঙ্ক তোর ভুঞ্জিবে জগতে
কলঙ্কি?” এতেক কহি, বিষাদে সুমতি
মাতৃপিতৃপাদপদ্ম স্মরিলা অন্তিমে।
অধীর হইলা বীর ভাবি প্রমীলারে
চিরানন্দ। লোহসহ মিশি অশ্রুধারা,
অনর্গল বহি, হায়, আর্দ্রিল মহীরে।
লঙ্কার পঙ্কজ-রবি গেলা অস্তাচলে।
নির্ব্বাণ পাবক যথা, কিম্বা ত্বিষাম্পতি
শান্তরশ্মি, মহাবল রহিলা ভূতলে।
কহিলা রাবণানুজ সজল-নয়নে—
“সুপট্ট শয়নশায়ী তুমি, ভীমবাহু!
সদা, কি বিরাগে এবে পড়ি হে ভূতলে?
কি কহিবে রক্ষোরাজ হেরিলে তোমারে
এ শয্যায়? মন্দোদরী, রক্ষঃকুলেন্দ্রাণী?
শরদিন্দুনিভাননা প্রমীলা সুন্দরী?
সুরবালা গ্লানি-রূপে দিতিসুতা যত
কিঙ্করী? নিকষা সতী বৃদ্ধা-পিতামহী?
কি কহিবে রক্ষঃকুল, চূড়ামণি তুমি
সে কুলের? উঠ, বৎস, খুল্লতাত আমি
ডাকি তোমা—বিভীষণ; কেননা শুনিছ,
প্রাণাধিক! উঠ, বৎস, খুলিব এখনি
তব অনুরোধে দ্বার। যাও অস্ত্রালয়ে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ঘুচাও আহবে।
হে কর্ব্বুরকুলগর্ব্ব! মধ্যাহ্নে কি কভু
যান চলি অস্তাচলে দেব-অংশুমালী,
জগৎ-নয়নানন্দ? তবে কেন তুমি
এ বেশে, যশস্বি! আজি পড়ি হে ভূতলে?
নাদে শৃঙ্গনাদী, শুন, আহ্বানি তোমারে;
গর্জ্জে গজরাজ, অশ্ব হ্রেষিছে ভৈরবে;
সাজে রক্ষঃ-অনীকিনী, উগ্রচণ্ডা রণে।
নগর-দুয়ারে অরি, উঠ অরিন্দম।
এ বিপুল কুলমান রাখ এ সমরে।
এইরূপে বিলাপিলা বিভীষণ-বলী
শোকে। মিত্রশোকে শোকী সৌমিত্রি-কেশরী
কহিলা;—“সম্বর খেদ, রক্ষঃচূড়ামণি!
কি ফল এ বৃথা খেদে? বিধির বিধানে
বধিনু এ যোধে আমি, অপরাধ নহে
তোমার। যাইব, চল, যথায় শিবিরে
চিন্তাকুল চিন্তামণি দাসের বিহনে।
বাজিছে মঙ্গলবাদ্য শুন কাণ দিয়া
ত্রিদশ-আলয়ে, শূর!” শুনিলা সুরথী
ত্রিদিব-বাদিত্র—ধ্বনি স্বপনে যেমতি
মনোহর। বাহিরিলা আশুগতি দোঁহে,
শার্দ্দূলী অবর্ত্তমানে, নাশি শিশু যথা
নিষাদ, পবনবেগে ধায় উর্দ্ধশ্বাসে
প্রাণ ল’য়ে, পাছে ভীমা আক্রমে সহসা,
হেরি গতজীব শিশু বিবশা বিষাদে।
কিম্বা যথা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা রথী,
মারি সুপ্ত পঞ্চ-শিশু পাণ্ডব-শিবিরে
নিশীথে, বাহিরি গেলা মনোরথগতি,
হরষে তরাসে ব্যগ্র, দুর্য্যোধন যথা
ভগ্ন-ঊরু কুরুরাজ কুরুক্ষেত্র রণে।
মায়ার প্রসাদে দোঁহে অদৃশ্য চলিলা
যথায় শিবিরে শূর মৈথিলীবিলাসী।
প্রণমি চরণাম্বুজে, সৌমিত্রি-কেশরী
নিবেদিলা করপুটে;—ও পদ প্রসাদে,
রঘুবংশ-অবতংস! জয়ী রক্ষোরণে
এ কিঙ্কর। গতজীব মেঘনাদ-বলী
শত্রুজিৎ।” চুম্বি শিরঃ, আলিঙ্গি আদরে
অনুজে, কহিলা প্রভু সজলনয়নে;—
“লভিনু সীতায় তাজি তব বাহুবলে,
হে বাহুবলেন্দ্র! ধন্য বীরকুলে তুমি!
সুমিত্রা-জননী ধন্য! রঘুকুলনিধি
ধন্য পিতা দশরথ, জন্মদাতা তব।
ধন্য আমি তবাগ্রজ। ধন্য জন্মভূমি
অযোধ্যা। এ যশঃ তব ঘোষিবে জগতে
চিরকাল। পূজ কিন্তু বলদাতা দেবে,
প্রিয়তম; নিজবলে দুর্ব্বল সতত
মানব; সুফল ফলে দেবের প্রসাদে।”
মহামিত্র বিভীষণে সম্ভাষি সুস্বরে,
কহিলা বৈদেহীনাথ;—“শুভক্ষণে, সখে!
পাইহু তোমারে আমি এ রাক্ষসপুরে।
রাঘবকুলমঙ্গল তুমি রক্ষোবেশে।
কিনিলে রাঘবকুলে আজি নিজগুণে,
মিত্রকুলরাজ তুমি, কহিনু তোমারে!
চল সবে, পূজি তাঁরে, শুভঙ্করী যিনি
শঙ্করী।” কুসুমাসার বৃষ্টিলা আকাশে
মহানন্দে দেববৃন্দ; উল্লাসে নাদিল,
“জয় সীতাপতি জয়!” কটক চৌদিকে।
আতঙ্কে কনক-লঙ্কা জাগিলা সে রবে।
ইতি শ্রীমেঘনাদবধকাব্যে বধো নাম ষষ্ঠঃ সর্গঃ।
ষষ্ঠ সর্গ।
অহিসহ যুঝিছে...গরজিলা অজগর—বিজয়ী সংগ্রামে—the pea-cock is the natural destroyer of the serpent. As a pea-cock is to a serpent, so is Indrajit to Lakshmana. As the pea-cock is quite strangely killed by the serpent, so Indrajit will also be killed by Lakshmana. This is the meaning of the fight between the pea-cock and the serpent.
প্রপঞ্চরূপ—(1) show of opposition; show of inversion; বৈপরীত্যরূপ i.e. show of what does not usually happen. (2) Detailed manifestation বিস্তারিত রূপ।
নীলাম্বু-সুতা—the daughter of the Ocean. Lakshmi is so called, as she came out of the Ocean when it was churned.
শুষে শুক্তি যথা... .........গগনমগুলে—here is an allusion to the saying that the rain which falls under this star produces pearls. This rain is called in Bengali স্বাতী নক্ষত্রের জল।
স্বচ্ছ-সরোবরে ... ধাম?—the gueese play amidst lotuses in a clear pond. Do they ever go to dirty water, the abode of the masses of moss?
গুণবান্ যদি...পর সদা—though the enemy is meritorious and the friend is devoid of any merit, the friend is desirable rather than the enemy who is always an enemy.
জননী যেমতি etc.—as the mother drives away mosquitoes with the motion of her lotus-like hand, from her sleeping son.
সুপট্ট শয়নশায়ী—accustomed to lie down upon a bed made of good cloths.
সুরবালা-গ্লানি—the cause of the heart-burning of the daughters of gods.