সময় অসময় নিঃসময়/ইলিয়াসের যুগলবন্দি

ইলিয়াসের ‘যুগলবন্দি’

 আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দুটি কালজয়ী উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’ নিয়ে আলোচকদের যতখানি আগ্রহ, প্রায় ততটাই অনাগ্রহ তার ছোটগল্প সম্পর্কে। অথচ এই প্রবলভাবে বিবর্তনশীল সাহিত্য-মাধ্যমেও তিনি অনন্য সৃষ্টিপ্রতিভার স্থায়ী শিলমোহর খোদাই করে দিয়েছেন। অন্য ঘর অন্য স্বর’ (১৯৭৬), ‘খোয়ারি’ (১৯৮২), ‘দুধভাতে উৎপাত’ (১৯৮৫), ‘দোজখের ওম’ (১৯৮৯), ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৭) নামে পাঁচটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ইলিয়াসের বেশ কিছু ছোটগল্প আমাদের ভিৎ-সুদ্ধ নাড়িয়ে দেয়। এই নিবন্ধের জন্যে ‘দোজখের ওম’ থেকে ‘যুগলবন্দি’ গল্পটি নিয়েছি।

 সরাসরি ছোটগল্পের বয়নবিশ্বে প্রবেশ করার আগে প্রাক্কথন হিসেবে কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি লেখকের অনুজ খালিকুজ্জামান ইলিয়াস রচনা সমগ্র (১ম খণ্ড) এর ভূমিকায় কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ-ঋদ্ধ মন্তব্য করেছেন। প্রথমে সেদিকে দৃষ্টিপাত করছি। ভূমিকাকার লিখেছেন, ‘পরিচিত অভিজ্ঞতার প্রায় সর্বস্তরে জীবনকে নির্মোহ দৃষ্টিতে একেবারে এর গভীরতম শাঁস পর্যন্ত অশেষ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে শিল্পকর্মে তা বেপরোয়া ভাবে প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা দেখতে পাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায়। প্রকৃতি তাকে এই বিশ্ব পর্যবেক্ষণের ও উপলব্ধির সময় বেশিদিন দেয়নি। হয়তো সেজন্যই এই নাজুক ও স্বল্পায়ু সময়ে তিনি মর্মভেদী দৃষ্টিকে শানিত করে দেখেছেন তার ইন্দ্রিয় ও বোধির চেনা বিশ্বকে। এই দেখা একাধারে নির্মম এবং কৌতুকবহ। নির্মম, কেননা সত্যনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ সব সময়ই নির্মম এবং কৌতুকপ্রদ কেননা মানুষের অসতর্ক ও দুর্বল মুহূর্ত কি ভঙ্গি কি বোস বাক্য বা কাজকে তিনি যেমন অবলীলায় প্রকাশ করেন তাতে পাঠক একই সঙ্গে অস্বস্তি, বিব্রত এবং কৌতুক বোধ না করে পারে না। আর এই দুই অনুভূতি উসকে দেওয়ার শক্তি বড় মাপের লেখকেরই বৈশিষ্ট্য। যে বাস্তবতার আলোয় তিনি জীবন দর্শন করেন তা কখনোই একেবারে চাঁচাছোলা যান্ত্রিক বাস্তবতা নয়। খড়খড়ে শুষ্ক চোখে ইলিয়াস বিশ্ব দেখেননি। চোখে কেবলি খরা নিয়ে সম্ভবত খুব বেশি দূর এগোনো কি খুব বড় মাপের শিল্প রচনা করা যায় না। চোখ তার সিক্তই, কিন্তু সেই সজল চোখ বহির্বিশ্ব এবং অন্তর্বিশ্বকে ঝাপসা না করে বরং আলোর দ্যুতিতে উজ্জ্বলতর করেছে এবং তার উজ্জ্বল, স্বচ্ছ দৃষ্টিপথে যাই পড়েছে তা জীবন্ত এবং সরস হয়ে উঠেছে!' এই বক্তব্য থেকে গল্পকারের জীবনবীক্ষা সম্পর্কে বেশ কিছু সূত্র পেয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে যার দেখার ধরন নির্মম ও কৌতুকবহ—তিনি নিঃসন্দেহে যুগপৎ নিরাসক্ত ও সংলগ্ন। আলোচ্য ‘যুগলবন্দি’ গল্পটিও এর প্রমাণ দিচ্ছে। বুরোক্র্যাট সরোয়ার কবিরের কৃপাভিক্ষু আসগর হোসেন এবং কবিরের অ্যালসেশিয়ান আরগসের নামে যে ইচ্ছাকৃত ধ্বনিসাম্য রয়েছে, কার্নিভালের শ্লেষ সেখানেই উতরোল হয়ে ওঠে। বয়ানের শেষে আসগর যখন তার ডান হাতের কজিতে আরগসের শেকলের একটা দিক বেশ টাইট করে জড়িয়ে নেয়, মানুষ ও কুকুরের এমন একাত্মতা ব্যাধিগ্রস্ত বিমানবায়িত সমাজব্যবস্থার অভ্রান্ত প্রমাণ। বিশেষত গল্পকার যখন লেখেন: ‘আসগর সিগ্রেটে বেশ কয়েকটা সুখটান দেয় আর অনুভব করে যে আরগস খুব আরাম ও তৃপ্তির সঙ্গে বাউয়েলস ক্লিয়ার করছে। শিকলের ধাতব বিনুনি বেয়ে সেই তৃপ্তি আসগরের শরীরে চমৎকার মৌতাত ছড়িয়ে দিচ্ছে’—সে-সময় মনে হয় ভাষার অন্তরালে চাবুক উদ্যত হয়ে উঠছে স্থিতাবস্থাপন্থীদের উদ্দেশে। নিঃসন্দেহে শুধু একটা নিটোল গল্প পরিবেশন করাই লক্ষ্য নয় ইলিয়াসের। তিনি পাঠকের মনে বিশেষ কিছু অনুভব সঞ্চারিত করে দিতে চান।

 প্রাগুক্ত ভূমিকায় গল্পকারের বাস্তবতা সন্ধানে ‘স্বকীয় ধাঁচ’-এর কথা বলা হয়েছে। খুব ঠিক কথা। সার্থক ছোটগল্প হতে পারে ওই ধাঁচ বা আকল্পের নিজস্বতায় যা কিনা কাহিনির কাঠামোয়, সংলাপে, বয়নের বিশিষ্ট ধরনে ফুটে ওঠে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব হল অনুপুঙ্খের বিন্যাস কেননা এইসব অনুপুঙ্খ আসলে বাচনের চিহ্নায়ক। ভূমিকাকার মন্তব্য করেছেন: ‘জীবনের অস্থিমজ্জা সারাৎসারের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকতে গিয়ে ইলিয়াস ব্যবহার করেন পর্যাপ্ত ডিটেলস। কেবল বস্তুজগত কি দৃশ্যজগতের সাদামাটা বিবরণ নয়, মানসিক জীবনের সঙ্গে এই জগতের সম্পর্ক এবং মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৃষ্ট তরঙ্গও তিনি খুব গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বর্ণনা করেন ব্যাপক স্থান ও সময় জুড়ে। প্রকৃতি ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের এই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বিবরণ তাকে সাহায্য করে একটি নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান পেতে এবং সেই অবস্থানে থেকে তিনি স্বচ্ছন্দে সৃষ্টি করেন তাঁর গল্পের জগৎ। ’

 এই মন্তব্যের যথার্থতা ‘যুগলবন্দি’র অনুপুঙ্খ ব্যবহারেও ফুটে উঠেছে। বয়ানের প্রথম অনুচ্ছেদে অনুপুঙ্খ-প্রয়োগের দক্ষতা এমন যে শুধুমাত্র আসগরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎই হয় না আমাদের, তার শ্রেণীগত অবস্থান-ভীরুতা-পরগাছাবৃত্তিও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে উচ্চবিত্ত সরোয়ার বি কবিরের হাস্যকর অন্তঃসারশূন্যতা এবং মুখোসের আড়ালে আসল কাকতাড়ুয়া মূর্তিও গোপন থাকে না। অর্থাৎ ইলিয়াসের সানুপুঙ্খ বয়ান সূক্ষ্মভাবে বহুস্বরিক; এক ঢিলে একাধিক পাখি মারতে পারেন তিনি। ছোটগল্পের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ হিসেবে এই অন্তর্নাট্য ঋদ্ধ অংশটি অনবদ্য এবং লক্ষ্যভেদী। তা সরাসরি পাঠককে প্রতিবেদনের মর্মস্থলে নিয়ে যায়:

 ‘আসগর।’

 কার্পেটে বসে আসগর হোসেন তখন খালি সব বোতল থেকে ফোঁটা ফোঁটা তলানি ঢালছিল নিজের জিভে। মস্ত ড্রয়িং রুমের আরেক মাথায় সরোয়ার বি কবিরের হুইস্কিশোষা গলা গমগম করে উঠলে প্রথমে সাড়া দেয় বারান্দায় বসে থাকা এ্যালসেশিয়ানটি। তারপর চমকে উঠে আসগর। অতিথিদের বিদায় দিয়ে সরোয়ার কবির এই তো ভেতরে গেলো, ১৫ মিনিটের মধ্যে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা আঁচ করতে পারলে এখন বোতল ঠোটে ধরার সাহস আসগরের হয়? মিনিট দশেক আগেও বারান্দায় বসে সে আরগসের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, সরোয়ার কবির ফিরে আসবে জানলে তাই অব্যাহত রাখা যেতো। আসগরের লাকটাই এরকম, সায়েবের ফেবারিট কাজগুলো যখন করে সায়েব তখন লক্ষ্যই করে না। সরোয়ার কবিরের গলা পর্যন্ত এখন ডিম্পলে শিভাজ রিগ্যালে টইটম্বুর, সাহিত্য কি কোষ্ঠকাঠিন্য কি নিজের ব্রিলিয়াণ্ট অ্যাকাদেমিক ক্যারিয়ার নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে তো রাতটা বসে বসেই কাবার।

 এই যে বয়ান, কানির্ভালের শ্লেষ-তিক্ত হাসি যেন তার প্রতিটি বাক্যকে ভেতর থেকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। যে-সমাজে পারাপারহীন অসাম্য অকাট্য বাস্তব, মানুষ সেখানে পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সামাজিক পরিসরের ভেতরকার পাশবিকতা আসগর হোসেনকে দাক্ষিণ্যের জন্যে কাঙাল করেনি শুধু, তাকে পোষা কুকুরের চেয়েও নিচু অবস্থানে নিয়ে গেছে। একদিকে সরোয়ার কবিরের মতো অপমানুষদের বিলাসিতার অপব্যয় আকাশ ছুঁইছুঁই, অন্যদিকে আসগরের মতো অস্তেবাসী ব্রাত্য মানুষ মিলিয়ে যায় ছায়াচ্ছন্নতায়। মাঝখানে অ্যালসেশিয়ান আরগস চূড়ান্ত বিদ্রুপের মতো বিরাজমান। প্রকৃতপক্ষে এই গল্পের প্রথম বাক্যে শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের অন্তেবাসী ও তার হাস্যকর অবস্থান শ্লেষতিক্ত চিহ্নায়কে উপস্থাপিত। ঘরে বউ না থাকলেও সোফায় বসার সাহস হয় না আসগরের। ভালো খাদ্য ও পানীয়কে সে কেবল দূর থেকে আড়চোখে দেখতে পারে। আর, নিতান্ত ছিচকে ভিখিরির মতো কার্পেটে বসে খালি সব মদের বোতল থেকে ফোঁটা ফোঁটা তলানি নিজের জিভে ঢালতে পারে। দারিদ্রই চৌর্যবৃত্তি’—এই কথাটি প্রবচনের মর্যাদা পেয়েছে, আমরা জানি। আসলে সম্পদই মানুষের পৃথিবীতে অজস্র ধুপছায়ার অঞ্চল এবং নিরালোক বৃত্ত তৈরি করে। সেই বৃত্তের বিধিবিন্যাস আলাদা। একজন সংবেদনশীল গল্পকার ওই সমান্তরাল পরিসরের প্রতি তর্জনি সংকেত করেন না কেবল, মানিয়ে নেওয়ার ছলে কীভাবে হতমান মানুষ ধাপে ধাপে নামতে নামতে পশুর স্তরে পৌছে যায়—তাও নির্মম নিরাসক্তি দিয়ে প্রকাশ করেন। অ্যালসেশিয়ানের নামকরণ করতে হোমারের মহাকাব্যিক জগৎ থেকে ‘আরগস’ কে বেছে নেয় যারা, তাদের কাছে কুকুরের সম্রম ও আভিজাত্য ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসগর বিলিতি কুকুরের কাছাকাছি মর্যাদায়ও থাকতে পারে না, প্রভুকে খুশি করার প্রয়োজনে কুকুরকেও তোয়াজ করতে হয় তাকে। মানুষের এই অবনমন শ্রেণীবিভক্ত সমাজেই ঘটে। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তব তো এই যে নিজের অবনমন এবং বাধ্যতামূলক নরকের বলয় সম্পর্কে সেই মানুষটি স্বয়ং চেতনাশূন্য, বোধহীন। মনে পড়ে যায় ওয়ার্সওয়ার্থের প্রবাদপ্রতিম পঙক্তি, ‘What man has made of man'!

 অতএব বারান্দায় বসে আসগর প্রভুর কুকুরের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় একমাত্র এই আশায় যে তার খেদমত প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে। কিন ‘সায়েবের ফেভারিট কাজগুলো যখন করে সায়েব তখন লক্ষই করে না’, এ জাতীয় বিবৃতিতে উতরোল হয়ে ওঠে শেষ। বয়ানে ইংরেজি শব্দের প্রয়োগও গল্পকারের সূক্ষ্ম বোধের প্রমাণ: যেমন ‘ফেভারিট’। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা কিংবা ভাবা আসলে নিজেকে সম্রান্ত করে তোলার অবচেতন প্রয়াসেরই অভিব্যক্তি। কখনো-কখনো অবশ্য তাতে মিশে যায় তীব্র শ্লেষ ও স্যাটায়ার। আর, যৌন অনুষঙ্গের সূক্ষ্ম ব্যবহারে পারদর্শী ইলিয়াস বাচনের এই বিভঙ্গকে প্রসারিত করে যান ক্রমাগত। দৃষ্টান্ত হিসেবে নিচে যে-অংশটি উদ্ধৃত করছি, তা অন্তর্বয়নের জন্যেই আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। সাহিত্যের সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য আর ব্রিলিয়াণ্ট অ্যাকাদেমিক ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলে যে সরোয়ার কবির, সে কোনো ব্যক্তি নয়, সে তার শ্রেণীর প্রতিনিধি। গল্পকারের কঠিন ব্যঙ্গ ওই শ্রেণীবদ্ধ মানুষের কাকতাড়ুয়া মূর্তি ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে।

 ‘আসগর আড়চোখে সার্ভে করে; না, চেহারা দেখে তার মুড বোঝবার জো নাই। তবে মিসেস জেসমিন বি কবিরের মেজাজ বোধহয় ফর্মে নাই, বেডরুমে লোকটা সুবিধা করতে পারেনি। আহা, এতোবড় জাঁদরেল অফিসার—যার হাত দিয়ে লক্ষপতি কোটিপতিদের রোজগারের খানিকটা চালান হয়ে আসে রাষ্ট্রীয় তহবিলে—দ্যাখো বৌয়ের মেজাজের জন্য মাসে কম করে হলেও ৪/৫ দিন তাকে কাটাতে হয় ড্রয়িং রুমে, স্রেফ সোফায় কি ডিভানে আধশোয়া অবস্থায়।

 এক পলকে মনে পড়ে যায় হাসান আজিজুল হকের অনবদ্য ছোটগল্প ‘পাব্লিক সার্ভেণ্ট’ এর কথা। যুগলবন্দি’র সঙ্গে তার তফাত অনেক; তবু কোথাও যেন আত্মিক সাদৃশ্য রয়েছে। সরোয়ার কবিরেরাই শেষপর্যন্ত মামুন রশীদে রূপান্তরিত হয়ে যায়। একই গোত্রের মানুষ এরা; দুজন দু-পর্যায়ের। রাষ্ট্রযন্ত্র এদের দৌলতেই টিকে থাকে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতাপের আজ্ঞাবহ ভৃত্য হয়ে পার্থিব সম্পদে ফুলে-ফেঁপে উঠতে গিয়ে এরা যে নিজেদের মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ করে তুলছে, তার আভাস পাই জেসমিনের কাছে সরোয়ারের খানিকটা জব্দ হওয়াতে। আর, এর উৎকট পরিণতি লক্ষ করি মামুন রশীদের চোখের সামনে তার স্ত্রী শায়েলার ধর্ষণে। হাসান দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের তাবেদার হয়েও রাষ্ট্রশক্তিরই ভাড়াটে গুণ্ডাদের দ্বারা নিজের স্ত্রীকে ধর্ষিত হতে দেখে আমলা মামুন। আসলে এ হল ছোটগল্পের নিজস্ব চিহ্নায়ক খচিত বাচন। গাদাগাদা অপরাধের তলায়...থ্যাতা ইদুরের মতো গাজলা তুলে’ মরে যারা, মামুন এবং সরোয়ার তাদেরই প্রতিনিধি। ধর্ষণের সাতদিন পরে শায়েলা নীরবতা ভেঙে স্বামীকে ধিক্কার দেয় এভাবে: ‘তোমার নিজের সম্মানও তোমার কাছে এতটুকু নেই। একটা কেম্নো বা একটা গিরগিটির সঙ্গেও তোমার তুলনা চলে না। সেটা সারা দেশের কেউ না জানলেও আমি জানি। ছ্যাকড়া গাড়ির গাড়োয়ান হয়ে চাবুক হাকড়াচ্ছো... তোমার মত চামচিকে বেঁচে থাকে কবে যে মরবে? একেই সম্ভবত ‘Poetic justice’ বলে। অর্থাৎ এই ধিক্কার কেবল শায়েলার নয়, সংবেদনশীল সব পাঠকের এবং স্বয়ং গল্পকারেরও। অন্তত এখানে পাঠক ও লেখকের পরিসরের মধ্যে কোননা দ্বন্দ্ব নেই। আগেই লিখেছি, হাসানের ‘পাব্লিক সার্ভেণ্ট’ হল সম্ভাব্য সমাপ্তিবিন্দু; আর, ইলিয়াসের যুগলবন্দি’কে বলতে পারি সূচনাবিন্দু। সরোয়ার কবিরেরা অমোঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অবধারিত ভাবে মামুন রশীদের পরিণতিতে পৌছে যায়।

 এই নিরিখে দেখলে বুঝতে পারি কীভাবে ‘যুগলবন্দি’তে উপস্থাপিত পৌর সমাজের একফালি ছবির পেছনে রয়ে গেছে রাজনৈতিক সমাজেরই অলক্ষ্যগোচর অথচ দুরপনেয় ছায়া। আমাদের এখানে মনে পড়ে যায় স্বয়ং ইলিয়াসের অসাধারণ একটি প্রবন্ধের কথা। বাংলা ছোট গল্প কি মরে যাচ্ছে?’ নামক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তথাকথিত ছোট সুখ ও ঘোট দুঃখের পেছনে রয়ে যায় সমাজ ও সময়ের অনেক বড় উপকূলরেখা। এইজন্যে ছোট সুখ বা ছোট দুঃখ বলে কিছু হয় না। যেমন এই ‘যুগলবন্দি’ গল্পেও আসগর ও আরগসের নামগত সাদৃশ্য পুঁজিবাদের বিমানবায়ন প্রক্রিয়ার চিহ্নায়ক। আসগর সর্বহারা নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত বর্গে তার অবস্থান। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেও একটি বল্ট কিংবা পেরেক। চরম বিকারগ্রস্ত মনস্তত্ত্ব নিয়ে সে কেবল সুযোগের সন্ধান করে বেড়ায়। সরোয়ার কবিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ইলিয়াস কার্নিভালের আবহ তৈরি করেছেন: ‘আসগর হোসেন কি?—না, তার বোনের চাচাতো না মামাতো দেওরের বন্ধু। এটা কোন সম্পর্ক হল? আসলে তো চাকরির উমেদার?” যেহেতু আসগর স্বপ্ন দেখে যে সারোয়ারের সাহায্যে সে ম্যাকডোনাল্ড অ্যাণ্ড রবিনসন্স-এ চাকরি পাবে এবং চাকরি হলে ফার্নিশড ফ্ল্যাটে আধুনিক তরুণীকে বিয়ে করে রাত কাটাবে—বড়লোকের উমেদারি করতে গিয়ে সে নির্দ্বিধায় নিজেকে ভৃত্যের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। সে বি.এ. পাশ করেছে, তার পরিবারে মা, বাবা, ভাইবোন আছে। রিটায়ার্ড পোস্ট মাস্টারের ছেলে হিসেবে নিজের শ্রেণীগত অবস্থানে সে মোটেই খুশি নয়। তার কাছে নৈতিকতা বা দায়িত্ববোধের কোনো গুরুত্ব নেই। আমেরিকান জাহাজের এক নাবিককে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পটাতে পেরেছিল বলে বন্দর থেকে একটা ফ্রিজ সরিয়ে নিয়েছিল। যে সমাজ-ব্যবস্থায় ফ্রিজ থাকাটা সামাজিক চিহ্নায়কে পরিণত, সোজাপথে সেই স্তরে পৌছাতে পারে না। আসগর।

 অতএব সম্পর্কিত ভাই সিকান্দারকে সরোয়ার সাহেব চাকরি দেওয়ার পরে আসগর তার স্থলাভিষিক্ত হয়। শুধু সরোয়ার নয়, তার স্ত্রী জেসমিনের মনোরঞ্জন করার জন্যে সে সর্বদা শশব্যস্ত। রাত পৌনে একটায়ও তাকে কমলালেবু খুঁজে আনার জন্যে বেরিয়ে পড়তে হয়। এ ধরনের কাজ করতে সে যে অভ্যস্ত, গল্পকার তা আমাদের জানিয়েছেন নানা ভাবে। বিনিময়ে সায়েবের একটু আধটু অর্থ আত্মসাৎ, সিগারেটের প্যাকেট থেকে কয়েকটা সরিয়ে নেওয়া: এসব সে করে খুব তৎপরতার সঙ্গে। যেহেতু রৈখিক বৃত্তান্ত তুলে ধরা কাম্য নয় ইলিয়াসের, তিনি শ্লেষের বারুদ পুরে দিয়েছেন প্রতিবেদনে। সংবেদনশীল পাঠক ওই বারুদে অগ্নিসংযোগ করবেন কিনা, সে তাঁর ইচ্ছা। কিন্তু বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া এই হতে পারে যে আসগরের ভেতর থেকে অন্য আরেক আসগর বেরিয়ে আসতে পারে। কেননা ‘যুগলবন্দি’র পরাপাঠ এই যে ‘Things are not what they seem!' যেহেতু অন্য উপায় নেই, শ্লেষ দিয়েই নির্মোক উন্মোচনের ইশারা করেছেন ইলিয়াস।

 অতএব বৌয়ের কাছে নাজেহাল জাঁদরেল অফিসারের কথা ভেবে ‘আসগর এতটা দুঃখিত হয় যে তার দুঃখ নিজেই বরণ করে নেওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এ ধরনের দুঃখকষ্ট ভোগ করার কপাল যে তার কবে হবে! এ এক ধরনের বয়ান। আরেকটি ধরন লক্ষ করি এসব অভিব্যক্তিতে: ‘কুশনঢাকা মোড়ায় বসে বসেই আসগর অ্যাটেনশন হয়। একই সঙ্গে অভিভূত চোখে তাকায়, সায়েব কীরকম পোলাইট, কী তার এটিকেট!’ নিজেকে খেদমতগার হিসেবে তৈরি করতে গিয়ে তার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই আর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যারা উচ্ছিষ্টজীবী, তাদের জন্যে পূর্বনির্ধারিত ছাঁচের চেয়ে বড়ো কোনো সত্য নেই। নেই কোনো পৌর্বাপর্যও। অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে মরিয়া বলেই আসগর যেন জ্যামুক্ত তীরের মতো সারোয়ারের মনোরঞ্জনের প্রতি ধাবমান। এইজন্যে ‘কবির ভাই, বলে ডাকলেও তার কোনো অর্ডার ক্যারি আউট করার সময় আসগর স্যার বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। রাতদুপুরে মদে টইটুম্বুর জেসমিন ফ্যাট বাড়াতে চায় না বলে কমলালেবু খেতে চায়; সরোয়ার স্ত্রীর ইচ্ছাপূরণ করতে ব্যর্থ। সুতরাং আসগরকে গাড়ি নিয়ে বেরোতেই হয়। কিন্তু তার আগে বয়ানের চাপা শ্লেষ সতর্ক পাঠক লক্ষ করেন নিশ্চয়:

 ‘আপেল খেলে হয় না?' জিগ্যেস করেই আসগরের ভয় হয় যে এই কথায় সরোয়ার কবির তাকে কর্মবিমুখ অলস ও অপদার্থ যুবক হিসাবে চিহ্নিত না করে। সঙ্গে সঙ্গে তাই একটু মেরামত করতে হয়, ‘রাত্রে কমলালেবু খেলে অনেক সময় এ্যাসিড হতে পারে।

 ‘আপেল থেকেই বরং এ্যাসিড হওয়ার চান্স বেশি। এরপর কলা সম্বন্ধে পরামর্শ দেওয়াটা রিস্কি। আর এদের সোসাইটিতে কলার পজিশনও ওর কাছে স্পষ্ট নয়।

 সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে সরোয়ার কবির বলে, ‘শি ওয়াণ্টস অরেঞ্জ। ইট হেল্পস হার টু রিডিউস হার ওয়েট। টক তো চর্বিনাশক।

 ‘জি, টক সব সময় চর্বিনাশক। সরোয়ার কবিরের ইংরেজির মতো তার কঠিন কঠিন বাঙলা কথাও রপ্ত করার জন্য আসগর সদা সচেতন।

 অর্থাৎ এখানে স্পষ্ট যে খাদ্যাভ্যাসে এবং ব্যবহারে শ্রেণীবাস্তবতা উপস্থিত। আর, বুঝতে পারি যথাপ্রাপ্ত অবস্থানের সীমাবদ্ধতা কত অনতিক্রম্য। আসগরের নড়বড়ে অবস্থানই তাকে করুণ জীবে পরিণত করেছে। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। গল্পকার সরোয়ার কবিরের পুরো নামটা ব্যবহার করছেন, কিন্তু আসগর শুধুই আসগর। বদান্যতা বিতরণ করে বলেই কি প্রথমোক্ত জন পূর্ণাঙ্গ এবং ভিখিরিতুল্য গ্রহীতা বলে আসগর হোসেনের নাম সংক্ষিপ্ত ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে? বস্তুত শেষোক্ত জন তো কুকুরের সঙ্গে ব্যবহারেও স্বাধীন নয়। নিচের অংশটি লক্ষ করা যাক:‘গাড়ি বার করার সময় এ্যালসেশিয়ানটা গরর গরর করলে আসগর ডাকে, আরগস। দূর। ডাকটা হার্শ হয়ে গেল। সরোয়ার কবির শুনে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে মোলায়েম ও আদুরে করে বলে, আরগস’। এবার গলাটা বেশি নিচু হয়ে গিয়েছিল। সরোয়ার কবির শুনলো তো?’ শেষের বাক্যটি যেন শ্লেষের চাবুক হয়ে আমাদের মানবিকতা বিষয়ক গর্বের উপর আছড়ে পড়ে।

 ইলিয়াস যে কত বড়ো নির্মাণশিল্পী ছিলেন, এর প্রমাণ রয়েছে ঠিক তার অব্যবহিত পরবর্তী অনুচ্ছেদে। এখানে তিনি সচেতন ভাবেই প্রতিবেদনের রৈখিকতা ভেঙে দিয়েছেন। নইলে ছোটগল্পের আখ্যানে হয়তো বা গল্প বলছি, শোনো জাতীয় আদল ফুটে উঠত। কেউ কেউ অবশ্য বলতেও পারেন, লেখকস্বর এখানে গল্পের বাস্তবতাকে খানিকটা আড়াল করে দিয়েছে। এতক্ষণ যে আসগরকে দেখেছি, তাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য এক অপরিচিত ও ঈষৎ পরাবাস্তব অস্তিত্ব পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে। তাহলে গল্পকার কি বোঝাতে চান আমাদের, যে, এধরনের সম্ভাব্য অপরসত্তা প্রচ্ছন্ন থাকে প্রতিটি রুদ্ধাবকাশ অস্তিত্বের মধ্যে? গল্পত্ব এখানেই যখন বাস্তবের আঁটোসাঁটো গাঁথুনি এমনি আচমকা বিনির্মিত হয়ে যায়। হয়তো এ হেন অপরতার উদ্ভাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় না; আলো ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে ওঠে কেবল অন্ধকারকে গাঢ়তর করার জন্যেই। ঢাকার রাজপথে নিশুতি রাতে বেরিয়ে আসগর নিজেরই অজ্ঞাত সেই অপরসত্তার মুখোমুখি হচ্ছে অথচ তার গভীর তাৎপর্য সে নিজে বুঝতে পারছে না। আর, পারছে না বলেই লেখকস্বরকেই মধ্যস্থতা করতে হচ্ছে বয়ানে। এই দৃষ্টিকোন থেকে এবার লক্ষ করতে পারি আসগরের বিরল অনুভূতির বিবরণকে: ‘এরকম অদ্ভুত লাগেনি কোনোদিন কোথাও পাতলা কোথাও ঘন কুয়াশার আড়ালে পাহাড়গুলো ভারি রহস্যময়। পাহাড়ের এখানে ওখানে আলো জ্বলে, কুয়াশায় সেইসব আলো এখন ঝাপসা। কখনো ১টি আলো ২টি ৩টি আলোয় ভাগ হয়ে লুকোচুরি খেলে। গাড়ির হেডলাইটের আলো কুয়াশা ছিড়তে ছিড়তে নিজেই গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, ফ্যাকাসে অন্ধকার বড়ো অপরিচিত মনে হয়। গাড়ির জানলা খোলা, সেদিক দিয়ে পাহাড়ের ঠাণ্ডা নিশ্বাস এসে মুখে লাগে। জানলাটি উঠিয়ে দিতে বাধো বাধো ঠেকে, মনে হয় কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারে। পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো সরে সরে যাচ্ছিলো, হঠাৎ করে চোখে পড়ে একটু দূরে পাহাড়ের মাথায় ন্যাড়া ঢ্যাঙা গাছের পাতা ঝরা ডালে ডিমে তা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে রয়েছে কৃষ্ণপক্ষের কালচে রক্তের রঙের চাদ। ডাল ভেঙে শালার চাঁদ পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়লে মহা কেলেঙ্কারি!

 সন্দেহ নেই যে বাচনে লেগেছে পরাবাচনের আভা কেননা এই বিন্যাসের মর্মমূলে। রয়েছে পরাবাস্তবের দ্যুতি। এই বিশিষ্ট বাঙ্গির পরিণত রূপ আমরা দেখেছি ‘খোয়াবনামা’র অসামান্য ঔপন্যাসিক সন্দর্ভে। একে বলা যেতে পারে ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতার অভিব্যক্তি যা কিনা পলকে রুদ্ধ নিরেট বাস্তব পরিসরের মধ্যেও গোপন সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করে নেয়। এখানে যেন আসগরের মধ্যে ঘটে গেছে আমূল রূপান্তর; যদিও তা স্থায়ী হয়নি কেননা স্থায়িত্ব অসম্ভব। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। এমনকি, পরাভাষার বিন্যাসেও সূক্ষ্মভাবে শ্রেণীর ছাপ রয়ে যায় মূলত বাচনভঙ্গিতে। এইবার সমগ্র গল্পের প্রেক্ষিতে যদি এই আপাত দলছুট অংশের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব, গোটা পাঠকৃতি কতকগুলি স্পষ্ট পর্যায়ে বিন্যস্ত। হয়তো বা ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের আকরণের সঙ্গেও এদের তুলনা করা যেতে পারে। স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ হয়ে বয়ান যখন সমে পৌঁছেছে, যুগলবন্দির প্রতীতি স্পষ্ট তখন। প্রারম্ভিক উপস্থাপনা থেকে কমলালেবুর খোঁজে নিশুতিরাতে আসগরের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত যেন স্থায়ী। তখন বাদী ও সম্বাদী সুরের মতো আসগর ও আরগসের উপস্থিতি এবং আলাপের মতো সরোয়ার কবির সহ বিভিন্ন অনুপুঙ্খ। তারপর বিপরীতের দর্পণে সুরের দ্বিবাচনিকতা প্রতিষ্ঠা করে এই গল্পের অন্তরা অর্থাৎ পরাবাচনে স্পন্দিত বয়ান। ঠিক এর পরের পর্যায়ে নিরালোক বাস্তবের আরেক স্তরের কথাবার্তা। তখন আসগর গাড়ি চালিয়ে গেছে বাড়িতে অর্থাৎ নিজের বাসায়।

 এখানে তার নিজস্ব নরকটিকে আমরা দেখতে পাই যা আসলে তার শ্রেণী-অভিজ্ঞানসূচক প্রেক্ষিত। প্রারম্ভিক অংশের (স্থায়ী) উচ্ছিষ্টজীবী আসগর এখানে (সঞ্চারী) দাপুটে মানু, যে তার নির্ভরশীল মা-বাবার ওপর চোটপাট করে। অর্থাৎ এক মানুষের ভেতরে কত আলাদা আলাদা মানুষ কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে—গল্পকার তা-ই দেখাতে চান। এইজন্যে বাবা-মা সম্পর্কে তার অশ্রদ্ধা চট করে ফনা তুলে ফুসে ওঠে:‘সারাজীবন কিপটেমি করে জমাননা পয়সায় দালান তুলে লোকটার ঘুম কীরকম গাঢ় হয়েছে। রিটায়ার করার পর কাজ নাই কম্ম নাই খালি ঘুমাও, না? দাঁড়াও তোমার ঘুমের ঘোর ঘোচাচ্ছি, দাঁড়াও!' এরপর মায়ের সঙ্গে তার কথাবার্তা এবং নিজের নিত্যদিনকার প্রিয় খাদ্যের মেনু শুনে রাগে দুঃখে তার গা জ্বলে যাওয়া, তার বাবাকে দেখে সরোয়ার কবিরের জাঁদরেল চেহারার বাপের কথা মনে পড়া এবং পরবর্তী কথোপকথন প্রমাণ করে, কীভাবে সীমাবদ্ধ শ্রেণী-অবস্থানের হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠার করছে আসগর। কিন্তু কিছুতেই তার উঞ্ছবৃত্তি কাটিয়ে উঠতে পারে না। সরোয়ারের দেওয়া টাকা থেকে ত্রিশ টাকা বাবাকে দিয়ে সে নিজের বড়োমানুষি চাল অব্যাহত রাখে, জেসমিনের জন্যে কেনা কমলালেবু থেকে এক ডজন সরিয়ে রাখে এবং একটি নিজে খেয়ে নেয়। ভাত খাওয়ার জন্যে মায়ের অনুরোধকে ‘বাঙাল মার্কা কথাবার্তা’ মনে করে সে ভেতরে ফুঁসে ওঠে। জেসমিনের সঙ্গে মায়ের প্রতিতুলনায় তার হীনতাবোেধ জেগে ওঠে বলে সে ক্ষুব্ধ বোধ করে। সে এভাবে আসলে নিজের সামাজিক উৎসকেই অস্বীকার করতে চায়। বাবার পরনে ময়লা বেনিয়ান দেখে দামি স্লিপিং স্যুটের কথা বলে আসগর নিজের কাকতাড়ুয়া মূর্তিকেই স্পষ্ট করে তোলে। আর, এখানেই বয়ানের তৃতীয় পর্যায়টিও শেষ হয়ে যায়।

 চতুর্থ পর্যায়ে আসগর ফিরে আসে সরোয়ার কবিরের ড্রয়িং রুমে। তখন সবাই ঘুমন্ত। নাটকের স্বগত সংলাপের ধরনে আসগর নিজের চিন্তা ও পরিকল্পনার কথা আমাদের জানায়। সে মনে মনে কেবলই ভাবতে থাকে কীভাবে সরোয়ার কবিরের কাছে আসল কথাটা পাড়বে। এভাবে অত্যন্ত কৌশলে ইলিয়াস প্রধান কুশীলবের উপর নানাদিক থেকে আলোকসম্পাত করেছেন। এতে পাঠকৃতির রৈখিকতাও এড়ানো গেছে। এবং এক ধরনের অন্তর্নাট্যের আভাস তৈরি হয়েছে। আমরা আরো লক্ষ করি যে ছোটগল্পের স্বভাব-ধর্ম অনুযায়ী ‘যুগলবন্দি’তেও সময়ের বিন্যাস নির্দিষ্ট আকল্পের দ্যোতনা নিয়ে এসেছে। কেননা বয়ানের শুরু রাত পৌনে একটার কাছাকাছি। রাত দেড়টায় কমলালেবু জোগাড় করে আসগর গেছে মাদারবাড়িতে, রাত আড়াইটা নাগাদ সে ফিরে এসেছে সরোয়ার কবিরের বাড়িতে। পরবর্তী পর্যায়ের সূচনা সকাল পৌনে সাতটায়। তারপর ধীরে ধীরে রোদ যখন ছড়িয়ে পড়ছে লনে, সরোয়ার ও জেসমিনের উচ্চবিত্ত সুলভ জীবন-যাপনের একটা ছবি স্পষ্ট হল। সময়ের আকল্পে যখন দুপুরের আভাস আসে, অল্পক্ষণের জন্যে আসগর ছায়াচ্ছন্নতা থেকে রোদের সীমানায় এসে দাঁড়ায়।

 সে-সময় ক্ষণিকের জন্যে কেন্দ্রীয় কুশীলবের চাপা-পড়া মানুষের মূর্তি হঠাৎ বেরিয়ে আসে। অবশ্য সেই মুহূর্তেও তার ব্যক্তিগত স্বর্গের বিচ্ছিন্ন অবভাস অটুট থাকে: ‘কাল বিকাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক ফোঁটা হুইস্কি আর কমলালেবুর গোটাচারেক কোয়া ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। রাত্রে মা এত করে মাছ দিয়ে ভাত খেতে বলল। মা দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে কী রোগ হচ্ছে কে জানে? ম্যাকডোনাল্ড এ্যাণ্ড রবিনসনের কাজটা পেলে খেয়ে না খেয়ে দিনরাত এখানে পড়ে থাকতে হবে না। কোম্পানির ভালো বাড়ি আছে কুলশিতে। ফার্নিশড বাড়ি। যা যা দরকার সব পাওয়া যাবে। এমনকি ফর্সা, বয়কাট চুল, ডায়াটিং করা, স্লিম, ন্যাকান্যাকা করে কথাকওয়া ১টা বউ পর্যন্ত। কিন্তু তার এই ব্যক্তিগত স্বর্গে ‘কেরানি মেণ্টালিটি সম্পন্ন বাবা কিংবা নিচুতলার খাওয়ার রুচি নিয়ে থাকা মায়ের কোনো স্থান নেই। সে চায় সবাইকে তার ছাঁচে গড়ে তুলতে। কিন্তু সব কিছু ইচ্ছেমতো হয় না বলে নিজেরই উপর অক্ষম ক্রোধে সে হঠাৎ আরগসকে চড় মারার জন্যে বা ঁহাতটা উপরে তোলে। আর, সেই মুহূর্তের বর্ণনায় ইলিয়াস কার্নিভালের হাসিকে উতরোল করে তোলেন: ‘পাগল। সে কি পাগল হয়ে গেলো? বুদ্ধিমানের মতো চট করে ডান হাত দিয়ে নিজের বাম হাতটা নামিয়ে নেয়। ডান হাতের চাপে বাম হাতের কব্জি লাল হয়ে গেলো।’

 এই ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতকে ফিরিয়ে আনা চমৎকার এক প্রতীকী ক্রিয়া। ছোটগল্পের পক্ষে উপযুক্ত এই বাচন। এবং, এরপরই আমরা প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে পৌছে যাই। সময় তখন বিকেল অর্থাৎ কম-বেশি আঠারো ঘণ্টার মধ্যে পাঠকৃতির সাতটি স্তর বিন্যস্ত হয়েছে। নিশ্চয় পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো আসগরের ভেতর-মহলকেও দেখে নেওয়ার জন্যে, কিন্তু সরোয়ার জেসমিনও বাদ পড়ে না। আসগরের মধ্যে আরগসের ছায়া মাঝেমাঝেই জানান দেয়। ইলিয়াস গল্পভাষার অনুপুঙ্খ দিয়ে বুঝিয়ে দেন, আসলে আসগরের ভূমিকা অনুগত পোষা কুকুরেরই। প্রভুর কাছে তার লেজ নাড়া, অন্যের কাছে তর্জন। তাই ‘সরোয়ার কবির হাসলে আসগরও অগত্যা হাসে,’ ‘আসগর দরজায় ধাই ধাঁই করে ঘুষি মারে আর চ্যাঁচায়’, ‘রাগ করার সুযোগ পেয়ে আসগর ‘খ্যাঁক করে উঠলো’, ‘কৃতজ্ঞতায় সে জিভ নাড়ে’। এখানে বলা যেতে পারে, আসগরের জিভ নাড়া হলো আরগসের লেজ নাড়ার বিকল্প। অতএব কচিৎ কখনো ‘সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাবে’ ভাবলেও খাঁচা থেকে বেরোনোর কোনো পথ খোঁজে না আসগর। কবির ভাইকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতেই হবে’ এই সিদ্ধান্ত থেকে কুকুর আরগসকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে সে ব্যবহার করতে চায়। সরোয়ার যখন ভোরে লনে ব্যায়াম করে ‘আরগসকে আদর করে তখন সরোয়ার কবিরের ইমপ্রেশনটা জাস্ট ভালো করা। ব্যাস, দিস মাচ। সায়েবকে তখন শুধু খুশি করা। কথাটা বলবে সরোয়ার কবির যখন অফিস যাবে তার আগে আগে। কিন্তু ঠিক পরিকল্পনা মতো কাজ হয় না। সুযোগ কেবলই পিছলে যায়।’ এই প্রক্রিয়াও তাৎপর্যপূর্ণ। কমলালেবুর প্রসঙ্গ থেকে আরগসের মিল বাড়িয়ে দেওয়ার কথা থেকে আসে বাউয়েলস ক্লিয়ার হওয়ার প্রসঙ্গ। কার্নিভালের স্পর্শে এই অংশটি খুব চিত্তাকর্ষক।

 এই এক পর্যায় যখন সরোয়ার কবির ও তার স্ত্রী জেসমিনকে উপলক্ষ করে উচ্চবর্গীয়ের হাস্যকর অন্তঃসারশূন্যতা ও জান্তব অস্তিত্ব উন্মোচিত হয়েছে। তাই সরোয়ারের প্রধান বিবেচনা কথায় কথায় কোষ্ঠ নিয়ে কথা তোলা। কিন্তু তা আবার জেসমিনের রুচিতে বাধে, সে ফিগারের ব্যালান্স নষ্ট হওয়া নিয়ে চিন্তিত। সরোয়ার কোষ্ঠ পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সিগ্রেট টেনে যায়, ভোরবেলায় জগিং ও ব্যায়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য পাকস্থলি পরিষ্কার করা। তবে কোনো-এক বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে সে যা বলে, তাতে তার শ্রেণীগত জান্তবতা স্পষ্ট। ইলিয়াসের স্যাটায়ার এখানে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে: ‘ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়ে শর্ট একটা ইণ্টারকোর্স সলভস ইওর প্রবলেম। কয়েকটা স্ট্রোক দিলেই তলপেটে চাপ পড়বে, এরপর রেগুলার ডোজ অফ থ্রি সিগারেটস এ্যাণ্ড ইউ গেট ইউর বাওয়েলস ক্লিয়ার।’ এর সঙ্গে সে জড়িয়ে নেয় জেসমিনের ফিগার স্লিম রাখার জন্যে ব্যাকুলতাকেও:‘ভোরবেলা ঘুম থেকে না উঠেও যে, এক্সারসাইস করতে পাচ্ছো এতেও তোমার ফিগার স্লিম থাকবে। এক নম্বর সাঁতার আর দুই নম্বর সেক্সয়াল ইণ্টারকোর্স, ইন দি আর্লি মর্নিং—আইদার অফ দিস টু কিপস ইওর ফিগার স্লিম।’ অতএব বলতে ইচ্ছে করে, ‘যুগলবন্দি’ নামটি বহুস্বরিক। একদিকে আরগস ও আসগর, অন্যদিকে সরোয়ার ও জেসমিন—জান্তবতাই তাদের অদৃশ্য-এক অভিন্ন সূত্রে বেঁধে রাখে। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঈষৎ খিটমিটের এবং স্ত্রীর কাছে সরোয়ারের জড়সড় হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে আরগসের বাউয়েলস ক্লিয়ারের প্রসঙ্গ ব্যবহার করে আসগর।

 এবার বয়ানও পৌঁছায় উপসংহারে। বিকেলে আব্দুলের জিম্মা থেকে আরগসকে নিয়ে বাইরে যায় আসগর। সে যে ডান হাতের কজিতে শেকলের একটি প্রান্ত বেশ টাইট করে জড়িয়ে নেয়—এই আপাত-তুচ্ছ বিবৃতি গভীর দ্যোতনাগর্ভ। কুকুরের সঙ্গে মানুষের বাঁধা হয়ে যাওয়াতে কোনো অস্বস্তি জাগে না মনে। বরং নিশ্চেতন মনে আসে নিরাপত্তা ও আশ্বাসের বোধ। কুকুরের পাকস্থলি পরিষ্কার হওয়ার সঙ্গে অদৃশ্য শেকলে জড়িয়ে গেছে আসগর নামক এক সুযোগ-সন্ধানী মানুষের প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। এই শেকল বিমানবায়িত সমাজ-ব্যবস্থার যেখানে উচ্চবর্গীয় অবস্থান অর্জনের সুবাদে চরম অন্তঃসারশূন্য মানুষও সর্বত্র দাপট দেখিয়ে বেড়াতে পারে। অথচ শেকল ছিড়তে পারে আসগরের মতো উজীবী প্রান্তিক মানুষেরা। গল্পকারের মুন্সিয়ানায় যুগলবন্দি কেবল মানুষ ও পশুর জান্তব সত্তার মধ্যে ব্যক্ত হয়নি, আরো বড়ো আরো অমোঘ শেকলের ছায়ায় বেজে চলেছে অন্য এক তিক্ত কষায় যুগলবন্দির মূর্ছনাও। আসগরের ভাবনায় সরোয়ার কবিরের উপস্থিতি যেভাবে প্রকট হয়েছে, তার শব্দমধ্যবর্তী শূন্যায়তনের যথার্থ ভাষ্য করলেই ওই যুগলবন্দি অনুভব করতে পারি। এঞ্জিনিয়রদের সে সিমেণ্ট-বালির অনুপাত সম্বন্ধে উপদেশ দেয়, এ্যাণ্টিবায়োটিক কোথায় প্রয়োেগ করা উচিত তা শিখিয়ে দেয় ডাক্তারদের, কলেজের বুড়ো প্রফেসার দ্যাখা করতে এলে তাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ক্লাসে রোলকল করার সঠিক ও আধুনিক পদ্ধতি বুঝিয়ে দিয়েছিল। ঝাড়ুদারকে ঝাড়ু ধরার কায়দা দেখিয়ে দেয়, আইন গাইনের যথাযথ উচ্চারণ সম্বন্ধে তার এলেম জবরদস্ত আলেমদের স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। মেয়েদের পটাবার বিদ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত লম্পটদের সে হার মানাতে পারে, কুকুর কখন কী খেতে ভালোবাসে সংশ্লিষ্ট কুকুরদের চেয়ে সে ভালো জানে!’অথচ এমন লোককে জেসমিন ‘রাস্টিক’ বলে গালাগাল দেয়। স্ত্রীর সামান্য অসন্তুষ্টিও তাকে বিচলিত করে।

 তাই গল্প পড়া যখন শেষ হয়ে আসে, আমাদের বিশেষ ভাবে লক্ষ করতে হয়: ‘পাকস্থলিতে শেষ শীতের নির্মল হাওয়া বইতে থাকলে আরগসের আরাম ও তৃপ্তিতে আসগরের ডান হাতে বাঁধা শেকলে রিনি ঝিনি আওয়াজ ওঠে, আরগসের সঙ্গে আসগরও রীতিমতো দৌড়াতে থাকে সরোয়ার কবিরের কাছে পৌছানোর জন্যে। এই ধাবমানতায় গল্পের বয়ান সমাপ্ত হয়; আমরাও অনুভব করি, চিহ্নায়িত এই ক্রিয়াপদের বিচ্ছুরণ অব্যাহত থাকবে এ সমাজে। এ যুগলবন্দি সহজে থামবে না। কিন্তু একথা ভেবেও কি খটকা জাগে না কে বেশি করুণ জীব: আসগর না সরোয়ার? কার কাকতাড়ুয়া মূর্তি শেষ পর্যন্ত প্রবলতর হয়ে উঠল পাঠকের মনে? অন্তত গল্পকারের অভিপ্রেত কি নয় কার্নিভালের তুমুল হাসির তোড়ে সরোয়ারের আমলাতান্ত্রিক পরিসর থেকে সব প্রসাধন মুছে নেওয়া? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আসগরকেও যেন তত কালো মনে হয় না আর।

 এক প্রশ্ন থেকে অন্য প্রশ্নের বিচ্ছুরণে নিয়ে যায় বলেই ‘যুগলবন্দি’র পুনঃপাঠ চলতে থাকবে আরো অনেকদিন।