সময় অসময় নিঃসময়/সাহিত্যতত্ত্বের সহজপাঠ
সাহিত্যতত্ত্বের সহজ পাঠ
গত কয়েক বছরে বাঙালির পাঠাভ্যাস নামক অচলায়তনের প্রাচীরে বেশ কিছু ফাটল দেখা দিয়েছে। পড়ার চিরাচরিত ধরন কিছুতেই বজায় থাকছে না। চিন্তা-চর্চার কোনো ক্ষেত্রই আর সুনির্দিষ্ট দীক্ষিতজনদের মধ্যে রুদ্ধ নয়। বহুদিন যে যাঁর সীমানার মধ্যে নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বিগ্নভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা করে গেছেন। সামাজিক জীবনে বড়োসড়ো ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাত ঘটলে প্রাচীরগুলি হয়তো কেঁপে উঠেছে কিম্বা পাথর খসে।; কিন্তু চিন্তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় এইসব উৎপাত শুষে নিতেও দেরি হয়নি। সময়-স্বভাবের কথা বিদ্বজ্জনেরা বিবেচনা করেছেন হয়তো এবং বিবর্তনশীল সময়ের অনুশীলন করে নতুন কিছু উপাদানও আত্মস্থ করেছেন, কিন্তু কাঠামোর খোলনলচে পাল্টে নেওয়ার কথা ভাবেননি। মানুষের অস্তিত্বগত নির্যাস এবং তার হওয়া ও হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া কীভাবে সময়ের গ্রন্থিল বাস্তবতায় সম্পৃক্ত এবং অন্তর্বস্তু ও প্রকরণ কেন অজস্রবার বদলে যাচ্ছে—তার যথার্থ অনুশীলন হয়নি।
একুশ শতকের প্রত্যুষে আমরা দেখছি, আমাদের চেনাজানা পৃথিবী গত একশ বছরে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতি অন্যদিকে নিজেরই গড়া সাজানো বাগানকে ঘাতকের নির্মমতায় উপড়ে ফেলছে। মানুষ। ইতিহাসের সংজ্ঞা ও প্রকরণ বদলে যাচ্ছে মুহুর্মুহু, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তঃসার খোঁজার বদলে আমরা নিজেদের অজান্তে বহিরঙ্গসর্বস্ব হয়ে পড়েছি। বাইরের জগতে তুমুল আলোড়ন-ই চলছে না শুধু, উদ্দাম গতি তৈরির তাড়নায় আজকের সব চিহ্ন ও প্রত্যয় আগামী কালই মুছে যাচ্ছে। যে-কোনো মূল্যে নতুন হওয়া ও নতুন থাকার তাগিদ সব বিশ্বাস, দায়বোধ ও মূল্য-চেতনাকে অবান্তর করে দিচ্ছে। ফলে কোথাও কোনো স্থিরতা নেই, কেন্দ্র নেই কাজে কিংবা চিন্তায়; আছে কেবল চাওয়া পাওয়ার মাদকে নিজে আচ্ছন্ন হয়ে অন্যকেও আচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়া। বিশ শতক মানুষকে কেবল লেনিন, মাও সে তুং, চে গুয়েভারা দেয়নি—হিটলার, আইখম্যানদেরও দিয়েছে। এযুগে মহাত্মা গান্ধী-নেতাজী-সুভাষচন্দ্র-ফিদেল কাস্ত্রো যেমন রয়েছেন, তেমনি পাশাপাশি রয়েছে মুসোলিনি-গর্বাচভ-বিল ক্লিণ্টনের মতো ইতিহাসের খলনায়কেরাও। এ যুগ ফ্রয়েড-সার্স-আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ-কাম-মার্কেজের যতখানি, ঠিক ততটাই প্রতিভাবাদর্শের অজস্র স্থপতিদেরও। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে।
মোদ্দা কথা হল, বিশ শতকের বহুরৈখিক মানবিক উপার্জন ধ্বস্ত হয়ে গেছে হিরোশিমা নাগাসাকিতে, ইরাকে বসনিয়ায়, নাৎসি বন্দী শিবিরে, ইথিওপিয়ায়, সোমালিয়ায় ক্ষুৎপীড়িত মানুষের মিছিলে। গত তিন দশকে ঐশ্লামিক মৌলবাদ, হিন্দু মৌলবাদ, নব্য নাৎসিবাদ ইত্যাদির পুনরুত্থানে মুক্ত আলো-হাওয়া-রোদ অনেকটা বিষিয়ে গেছে। এই সময় আত্মপ্রতারণার, পারস্পরিক প্রবঞ্চনারও। ইতিহাস, সামাজিক প্রগতি, মানবিক মূল্যবোেধ ইত্যাদি বিষয়কে মহাআখ্যান বলে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে, এরা যে প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ধাঁচের ও চরিত্রের নয়া উপনিবেশবাদী কৃৎকৌশলগুলিকে আরও পোক্ত করতে চাইছে এবং মানুষকে নির্বাসন দিচ্ছে তারই যত্নে-গড়া জগৎ থেকে—এই অনস্বীকার্য সত্য থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার আয়োজন এখন সর্বত্র। এই মুহূর্তে যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা।
আবার এরাই সব ধরনের মৌলিক জিজ্ঞাসা থেকে আমাদের মনোেযোগ সরিয়ে দিতে চায়। এবং এরাই, অগভীর সফরি-সঞ্চরণে অভ্যস্ত থেকে যাবতীয় জিজ্ঞাসু প্রতিবেদনকে তত্ত্বকথা বলে পরিহাস করে আসর জমিয়ে তোলে। এতে অযোগ্যতা ও অক্ষমতা জনিত কিছু অস্বস্তি থেকেও খুব সহজলভ্য পরিত্রাণের পথ এরা পেয়ে যায়। তাদের অগভীরতা, অন্তঃসারশূন্যতা, আঙ্গিক-সর্বস্বতা, সময়-নিরপেক্ষতা আড়ালে চলে যায়। চিন্তা ও মননের সংকীর্ণতা, অনুভূতি ও উপলব্ধির অভাব, ধারাবাহিক অধ্যয়নে অনীহা, বিশ্লেষণে ব্যর্থতা যখন সীমাহীন, তখনই ‘তত্ত্ব’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র এরা আঁৎকে ওঠে। ঘোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় যাদের জীবনের মূলমন্ত্র, এদের জন্যে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হল প্রবাদের সেই অণুগল্পটি:‘কত রবি জুলেরে? কেবা আঁখি মেলেরে!
২
মূল প্রশ্নটা হল: তত্ত্ব কী এবং তত্ত্বের কেন প্রয়োজন? এই প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার আলোচিত হয়েছে। তবু আরও একবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
‘তত্ত্ব’ এর আভিধানিক অর্থ হল স্বরূপ বা যাথার্থ। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তুস্বরূপই তত্ত্ব। কোনো ঘটনা-বিন্যাস বা ভাব-বিন্যাসের সারাৎসার যখন অনুসন্ধান করি এবং সেই অনুসন্ধানের বার্তা বা প্রতিবেদন তৈরি করি, তখনই তত্ত্বকথা জন্ম হয়। তার মানে, তত্ত্ব হল বিশেষ দৃষ্টি এবং দার্শনিকেরই অন্য নাম তাত্ত্বিক। ইংরেজি ভাষান্তরে তত্ত্বকে বলি “Theory'। এতেও রয়েছে দেখারই প্রসঙ্গ। ল্যাটিন ও গ্রিক উৎসমূলে পাচ্ছি ‘Theoria' যার আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ (Webster's 3rd New international Dictionary, 1986: 2371 অনুযায়ী) হল ‘act by viewing, contemplation, consideration'। আর, একই উৎসজাত ফরাসি ‘Theorein' এর অর্থও ‘to look at, behold, contemplate, consider'। ওই একই অভিধানে শব্দটির প্রাচীন প্রয়োগ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, Theory হল Imaginative contemplation of reality, Direct intellectual apprehension, insight, অর্থাৎ বাস্তবতার কল্পনা-নিষিক্ত উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষ বৌদ্ধিক উপপত্তি বা অন্তদৃষ্টি হল তত্ত্বের সারাৎসার। যিনি প্রতীয়মানের নির্মোক ভেদ করে গভীরে দৃষ্টিপাত করতে পারেন, তিনিই তাত্ত্বিক।
উল্টো করে বলা যায়, সাহিত্যের কিংবা সমাজের কিংবা দর্শনের কোনো প্রতিবেদন থেকে নির্যাস খুঁজে নিতে চাইলে অন্তদৃষ্টির অধিকারী হওয়া আবশ্যিক। যাদের মনোযোগ কেবল বহিরঙ্গে সীমিত থাকে, তারা আসলে খোলসের চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে শাঁসের দিকে নজর দিতে ভুলে যায়। এরা চোখ থাকতেও অন্ধ, মন থাকতেও মননহীন। এইসব দৃষ্টিহীন জনেরাই প্রকরণ-সর্বস্ব হয় এবং বহু প্রজন্ম ধরে সুনির্দিষ্ট প্রথাসিদ্ধ পথে চলতে পারলে স্বস্তি বোধ করে। অতএব এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে এ ধরনের মানুষ-জনেরা তত্ত্বের ওপরে সবচেয়ে বেশি খঙ্গহস্ত। এই অচলায়তনের দ্বাররক্ষীরা সমালোচনার নামে নিরপেক্ষ বাক্যপিণ্ডের সমাবেশ ঘটিয়ে থাকে। প্রচলিত চিন্তা-পদ্ধতি বলতে যা বোঝায় তাকেই নির্বিচারে মান্যতা দিয়ে যায়। এদের মনে কখনো কোনো জিজ্ঞাসা জাগে না। তাই পাঠকও তাদের রাশিরাশি ভারাভারা বাক্যস্রোত থেকে নিজের মনে কোনো প্রশ্ন উঠে আসতে দেখেন না।
দেখা যাচ্ছে, ধ্রুপদী গ্রিক ও রোমান মনীষা দৃষ্টির বিশেষত্বকেই সত্য সন্ধানের মুখ্য হোতা বলে জেনেছিল। অতএব তত্ত্ব মানে গভীর বিশ্বাস ও অবস্থান গ্রহণের প্রস্তাবনা। প্রাগুক্ত অভিধান দৃষ্টি ও তাত্ত্বিকতাকে অভিন্ন বলে জেনে এদের গভীরতর ব্যঞ্জনাকে প্রসারিত করে জানিয়েছে যে তত্ত্ব বা Theory হল ‘(a) belief, policy or procedure proposed or followed as the basis of action; a principle or plan of action; (b) an ideal or hypothetical set of facts, principles of circumstances, (c) the body of generalisations and principles developed in association with practice in a field of activity; (d) the coherent set of hypothetical, conceptual and pragmatic principles forming the general frame of reference for a field of enquiry; (e) a hypothetical entity of structure explaining or relating an observed set of facts' ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, গ্রিক বিশ্ববীক্ষায় দেখা বা বীক্ষণ ছিল সমস্ত বৌদ্ধিক উপলব্ধির কেন্দ্রবিন্দু। তাই দৃষ্টির বহুধা-বিচ্ছুরণ মূল অভিধা থেকে ক্রমাগত নানা ধরনের ব্যঞ্জনা নিঙড়ে নিয়েছে। শুধু কি বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ায়, গ্রিক জীবনের আরও দুটি প্রধান পরিসরে তত্ত্বের মূলাধার ‘দেখা’কে আমরা প্রসারিত হতে লক্ষ করি। যেমন জ্যামিতিক উপপাদ্য বা Theorem উদ্ভূত হয়েছে গ্রিক (এবং ল্যাটিন) Theorema থেকে যার আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে Sight বা Spectacle। ফরাসি ভাষায় Theoros হল Spectator অর্থাৎ দর্শক। সুতরাং এখানেও দেখারই রকমফের।
এই দৃষ্টির বিচ্ছুরণ থেকে দেখা দিচ্ছে বস্তুতে বস্তুতে, প্রতীকে প্রতীকে, বস্তুতে প্রতীকে বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েন। এই দৃষ্টিই রয়েছে Theater বা নাট্য-ক্রিয়ায়। গ্রিক Theatron ইংরেজিতে বোঝাচ্ছে To see, view, action of seeing। আসলে মূল গ্রিক শব্দের পূর্বপদ এই দৃষ্টির ক্রিয়া বোঝায় আর প্রত্যয়-সূচক উত্তরপদ বোঝায় means, instrument or place। এভাবে ভাষার অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতধর্মিতায় চেতনার উন্মেষপর্ব থেকে বিশিষ্ট দৃষ্টিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তত্ত্ব বা Theory-র অব্যাহত যাত্রা কোনো নতুন কথা নয়। গত ত্রিশ বা চল্লিশ বছরে যদি তাত্ত্বিক প্রতিবেদনের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব খুব বেশি মাত্রায় লক্ষ্যগোচর হয়ে থাকে, এর মানে নিশ্চয় এই নয় যে এ কোনো নতুন প্রবণতা। মানুষ যেদিন থেকে অস্তিত্ব ও জগতের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে সচেতন হয়েছে, সেদিন থেকেই তত্ত্বেরও সূচনা হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ যদি কেউ ঘুম ভেঙে উঠে বলেন, এসব তত্ত্বত্ত্ব আবার কেন—তাহলে তিনি আত্মপ্রতারণা করছেন মাত্র।
৩
যাঁরা খুব বিজ্ঞের মতো গাছ আগে না ফল আগে’ গোছের যুক্তি দেখিয়ে বলেন, আগে সাহিত্য পরে তত্ত্ব কিংবা আগে সমাজ পরে তত্ত্ব (অথবা আগে অভিজ্ঞতা পরে উপলব্ধির সূত্র) তারা শুধু বিভ্রান্তি ছড়ান। যেখানে কোনো বিভাজন নেই, সেখানে জলবিভাজন রেখা কল্পনা করে তারা নিজেদের চিন্তাদৈন্য ও অগভীরতাকে ধরিয়ে দেন মাত্র। এঁদের অধিকাংশ জেগে-জেগে ঘুমোন বলে তাঁদের ঘুম কেউ ভাঙাতে পারে না। যদি কেউ বুঝব না’ বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে থাকেন, তাকে বোঝাবে কে? আসলে এই বোঝা এবং না-বোঝার ব্যাপারটাও পুরোপুরি অভ্যাসের বিষয়। যেভাবে ভাবতে এবং বুঝতে আমরা বহু প্রজন্ম ধরে অভ্যস্ত, তাতে কোনো ছেদ ঘটলে বা ব্যতিক্রম হলে সমস্ত বোধ তোলপাড় করে প্রত্যাখ্যানের জেদ দেখা দেয়। যা কিছু অভ্যাসের বাইরে, তাকেই সন্দেহের চোখে দেখে অধিকাংশ মানুষ। স্বভাবত সাবধানী মন অতি সতর্কতাবশত ভেবে নেয়, নিয়ম মাফিক কিছু না হলেই বিপত্তির আশঙ্কা। এর চেয়ে ভালো স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপদ সরলীকৃত পথে চলা। সময়ের রূপান্তর এহেন চিত্তবৃত্তিতে কথার কথা মাত্র, চোখের সামনে চেনা-জানা জগৎ অপরিচিত হয়ে গেলেও কিছুতেই স্বেচ্ছাবৃত বৃত্তবন্দিত্ব থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে চায় না। একটি বিখ্যাত সংস্কৃত শ্লোকের কথা মনে পড়ছে:
তাতস্য জলোয় ইতি ক্রবাণাঃ।
ক্ষারং জলং কাপুরুষাঃ পিবন্তি॥
তার মানে, ‘এ আমার পিতৃপুরুষের তৈরি কুয়ো, এই বলে দূষিত কুয়োর জল কাপুরুষেরাই খেয়ে নেয়। বলা বাহুল্য, কাপুরুষ বলতে এখানে গোঁয়ার-গোবিন্দ, মূর্খ অবিবেচকদেরই বোঝানো হচ্ছে।
জীবনের সর্বস্তরে এখন মুহুর্মুহু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। মহাকাশ-প্রযুক্তির কল্যাণে একদিকে ইণ্টারনেট এবং অন্যদিকে দূরদর্শনের অজস্র চ্যানেলে পৃথিবীর যাবতীয় তথ্য ও বিনোদন হাতের মুঠোয় এসে গেছে। বিশ্বায়নের নামে নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ভোগবাদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমাদের চিন্তাচেতনা আজ দুমড়ে মুচড়ে অষ্টাবক্র হয়ে যাচ্ছে। সত্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। কায়া হয়ে যাচ্ছে মায়া আর মায়া হয়ে উঠছে কায়িক অস্তিত্ব। দৈনন্দিন জীবনে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্কে অতীতের প্রাসঙ্গিকতা থাকছে না কোথাও। সব কিছুতে আমরা পরিবর্তন মেনে নিচ্ছি। বস্তুত স্বতশ্চল ভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে যাচ্ছে। অথচ সাহিত্যের পাঠ বিশ্লেষণে আমরা অদ্ভুতভাবে রক্ষণশীল। নতুনভাবে পড়তে, ভাবতে ও বিশ্লেষণ করতে আমরা নারাজ। কেউ যদি নতুনভাবে কথা বলতে চায়, নতুন ওই বাচনকে তত্ত্বকথা বলে উড়িয়ে দিয়ে আমরা ভারি স্বস্তি বোধ করি।‘তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি হয়ে উঠেছে নিন্দাবাচক। বিচিত্র আত্মবিরোধিতার এই প্রদর্শনী সমানে চলেছে।
সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে আরও একটা মজার ব্যাপার দেখা যায়। একদিকে বিশ্বায়নকে মান্যতা দিয়ে আমরা পিটার ইংল্যাণ্ড শার্ট কিম্বা নিউ পোর্ট জিন অথবা রিকার্ডি রামের মতো পানীয়কে আমাদের ঈপ্সিত আধুনিকোত্তর জীবনের চিহ্নায়ক করে নিতে পারি, কিন্তু সাগরপারের কোনো তত্ত্ব-প্রস্থানের ছায়ামাত্র দেখে ব্যাখ্যাতীত শুচিবায়ুর প্রভাবে ‘গেল গেল’বলে আর্তনাদ শুরু করে দিই। পদার্থবিদ্যায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ কি বিদেশের বস্তু বলে উপেক্ষিত হতে পারে কখনো? হকিং-এর সময় ও কৃষ্ণবিবর বিষয়ক ভাবনা কি ভারতীয় উপমহাদেশের বৈজ্ঞানিকেরা বিদেশি তত্ত্ব বলে উপেক্ষা করতে পারেন? অথবা ভাষা-বিজ্ঞানে কেউ কি আজ সোস্যুর ও চমস্কিকে এড়িয়ে যেতে পারেন? প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অলীক ব্যবধান বিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৌছাতে পৌছাতে মুছে গেছে। অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স যদি বিভিন্ন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য বিভাগে অবশ্যপাঠ্য বলে স্বীকৃত হয়ে থাকে, তাহলে নতুন কালের নতুন দাবি অনুযায়ী ফুকো-দেরিদা-বার্ত-বদ্রিলার-বাখতিন প্রমুখ তাত্ত্বিকদের ভাবনা কেন অনুশীলন করা যাবে না? অ্যারিস্টটল-পরবর্তী পৃথিবী কতবার ওলটপালট হয়ে গেছে; কিন্তু দেশে দেশে সাহিত্য আলোচনায় তার অমোঘ উপস্থিতি তর্কাতীত। তবু এও সত্য যে সার্বিক বিনির্মাণের এ পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে সাহিত্যচিন্তা রুদ্ধ থাকতে পারে না। ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালির সাহিত্য-চিন্তাও নতুন বিশ্বপরিস্থিতির অভিঘাত অস্বীকার করতে পারে না। অন্ধ হলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে?
চিন্তাচেতনায় কোনো ভূগোলের সীমারেখা স্বীকৃত নয়। তা যদি হত, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার রুদ্ধ থাকত তার উৎসভূমিতে। মানুষের পৃথিবীতে যত কিছু নতুন উদ্ভাসন হয়ে চলেছে, তাতে প্রত্যেকের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। যদিও জ্ঞান আর প্রতাপ অন্যোন্য-সম্পৃক্ত এবং তথ্য-উপনিবেশবাদ অত্যন্ত সক্রিয়—মননবিশ্ব এক ও অবিভাজ্য। সেখানে নতুন ধরনের ‘হ্যাভ’ আর ‘হ্যাভনট’-এর বিভাজন মেনে নেবে না কেউ। যেহেতু তাৎপর্য সর্বদা প্রসঙ্গ-নির্ভর, প্রতিটি গ্রহীতা সমাজ নতুন চিন্তা-চেতনাকে নির্বিচারে একইভাবে প্রয়োগ করবে না। নিজের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজন অনুযায়ী যতখানি নেওয়ার নেবে, বাকিটুকু বর্জন করবে। বস্তুত একই তত্ত্ববীজ ভিন্ন ভিন্ন মননভূমিতে আলাদা-আলাদা ফসল উৎপাদন করতে পারে, করে থাকেও। তত্ত্ববীজের উপযোগিতা পরখ করতে গিয়ে চিন্তার অভ্যাসে রৈখিকতা ভেঙে যায়। শেষ পর্যন্ত তার প্রায়োগিক সম্ভাবনা যতটুকু থাক না কেন, বহুদিনের প্রাতিষ্ঠানিক মনন সম্পর্কে তাতে যে-প্রশ্ন দেখা দেয়—এর গুরুত্ব অনেকখানি। বিশেষত সাহিত্যিক পাঠকৃতির বিশ্লেষণে নিরন্তর বিনির্মাণ সবচেয়ে জরুরি। মননের প্রাতিষ্ঠানিক ধরন প্রশ্নের সম্ভাবনাকে শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়। তাই নতুন নতুন জিজ্ঞাসা উসকে দেওয়ার অর্থ যাবতীয় বদ্ধতা-নিষ্ক্রিয়তা-অনীহার জটাজাল থেকে চেতনাগঙ্গার মুক্তি। এই প্রক্রিয়াকে গতিময় করে তোলে নতুন নতুন তত্ত্ববীজের সাহসী ও নিরবচ্ছিন্ন কর্ষণ। অর্থাৎ চিন্তাবীজের ব্যবহার-উপযোগিতা আর ফসলের জমি তৈরির কাজ একই প্রক্রিয়ার এপিঠ আর ওপিঠ।
৪
বাঙালির চিন্তাবিশ্বে উনিশ শতক যে অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল, তাতে বহুদিনের রৈখিকতা ও অভ্যাসের গতি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আঠারো শতক পর্যন্ত ব্যাপ্ত সামাজিক ধারাবাহিকতায় বিপুল ছেদ নিয়ে এসেছিল প্রতীচ্যের অজস্র ভাববীজ। সেদিনকার রক্ষণশীল সমাজ যাবতীয় নতুনের বিরুদ্ধে উৎকটভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু ইতিহাসের চাকা সব অচলায়তন গুড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গেছে। অবশ্য, একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লক্ষ করার মতো। নবীন প্রজন্মের যারা নির্বিচারে ও প্রসঙ্গ-বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতীচ্যের ভাববীজকে মান্যতা দিয়েছিলেন—নিজেদের মুদ্রাদোষে ক্রমে তারা আলাদা, কক্ষচ্যুত ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন। অন্যদিকে নবাগত তত্ত্ববীজ ও কর্ষণযোগ্য ভূমির দ্বিবাচনিক সম্পর্ক যাঁরা যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন, তারাই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে সোনালি ফসল ফলিয়েছেন। গ্রহণ ও বর্জনের এই দ্বিরালাপ আসলে সময়েরই আহ্বান। সময়ের কণ্ঠস্বর যাঁরা শুনেও শোনেননি, তারাই বিশ্লেষণশূন্য নিরক্ত মননের কিংবা মননহীনতার পরিচয় দিয়ে অনিবার্যভাবে সময়-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ফলে সময়ের মূল স্রোত তাদের নির্মমভাবে পরিত্যাগ করে নতুন ভগীরথদের শঙ্খনাদ শুনে এগিয়ে গেছে।
বিদেশের ঠাকুর ফেলে স্বদেশের কুকুর উপাসনাকে যতই একমাত্রিক ভাবে শ্লাঘ্য মনে করা হোক না কেন, ইতিহাসের পাতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিন্তু খুব বেশি মর্যাদার অধিকারী নন। বঙ্কিমচন্দ্র গুপ্তকবিকে যতই প্রশংসা করুন না কেন, তিনি নিজে কিন্তু উপন্যাসের মতো সময়-সচেতন ও দ্বিবাচনিক কল্পনায় ঋদ্ধ নতুন প্রকাশ-মাধ্যমটি প্রতীচ্যের ভাবজগৎ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন। প্রতীচ্যের তত্ত্ববিশ্ব থেকে আহৃত সাহিত্য-মাধ্যমকে বঙ্কিমচন্দ্র উনিশ শতকের জাগরণ-উন্মুখ বাঙালি চেতনার পক্ষে যথাসাধ্য উপযোগী করে তুলেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তেমনি মহাকাব্যের ভাববীজ ও প্রকরণ সন্ধান করতে গিয়ে ভারতীয় আধার ও প্রতীচ্যের আধেয়ের মধ্যে অপূর্ব দ্বিবাচনিক গ্রন্থনা সম্ভব করে তুলেছিলেন। Blank verse কোন জাদুমন্ত্রে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রূপান্তরিত হল, তা যদি অনুধাবন করি, তাহলে বুঝব, পয়ারের বেড়ি তাঁর পক্ষে ভেঙে ফেলা সম্ভবই হত না যদি তিনি প্রতীচ্যের চেতনাবিশ্বকে অস্বীকার করতেন। আসলে প্রতিভার অভিজ্ঞানই হল সংশ্লেষণের ক্ষমতা।
গোটা বিশ শতক জুড়ে আমরা বারবার দেখলাম, সাহিত্যের অন্তর্বস্তু ও আঙ্গিক পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথ ধরে এগিয়ে যেতে চাইছে। সর্বদা এই উদ্যম যে সফল হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তবুও অব্যাহত থাকছে নিরবচ্ছিন্ন আত্মবিনির্মাণ। এই অসংখ্যবার বাঁক ফেরার পেছনে কিন্তু রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বপরিসর থেকে অনবরত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আত্তীকরণের প্রবণতা। চিন্তায় যখনই নতুন বিভঙ্গ তৈরি হচ্ছে, সাহিত্যে তার অভিঘাত অনিবার্যভাবে এসে পড়ছে। বাঙালির মনন পর্বে-পর্বান্তরে নতুন নতুন তত্ত্ব-প্রস্থান থেকে আধেয় সংগ্রহ করে গেছে বলেই স্রোত সরে গিয়ে চরভূমি বড়ো হয়ে দেখা দেয়নি। কোনো সন্দেহ নেই যে চিন্তা-প্রবাহকে সঞ্জীবিত করার জন্যে বহির্জগৎ থেকে নিয়মিত নতুন নতুন উপকরণের যোগান চাই। অন্তত বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক পাঠ-অভিজ্ঞতা এই সিদ্ধান্তকে অনিবার্য করে তোলে। বিশ শতকের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক প্রেরণাকে নানা মাত্রায় শুষে নিয়ে বাঙালির সৃষ্টিশীলতা এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে পরিক্রমা করেছে। মার্ক্সবাদ-অস্তিত্ববাদ - পরাবাস্তববাদ থেকে শুরু করে হাল আমলের আকরণবাদ-আকরণোত্তরবাদ-নারীচেতনাবাদ-উপনিবেশোত্তর চেতনাবাদ ওই পরিক্রমায় কত বিচিত্র ধুপছায়া ও উচ্চাবচতা এনে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রণালীবদ্ধ বিশ্লেষণ ছাড়া এত অজস্র তত্ত্ববীজের অঙ্কুরোদ্গম ও পুষ্পয়ন সম্পর্কে যথার্থ ধারণা করা অসম্ভব।
সাহিত্যতত্ত্ব জীবনের বাইরে যেতে পারে না কখননা। জীবনতত্ত্ব আর সাহিত্যতত্ত্ব একই সত্যের দু-রকম উপলব্ধি মাত্র; জীবনে যা কিছু ঘটে এবং সাহিত্যিক প্রতিবেদনে যা কিছু প্রকাশিত হয়, সমস্তই কোনো-না-কোনো তত্ত্বের পুষ্টিদান করে। জীবনে তত্ত্ব মিশে থাকে জলে মাছের মতো। তেমনি সাহিত্যে তত্ত্ব থাকে ধমনীতে রক্ত-প্রবাহের মতো কিম্বা জৈব অস্তিত্বে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। অর্থাৎ তত্ত্বের অন্তবৃত অস্তিত্ব বুঝে নিতে হয় স্বভাবের পথে। তাই কোথাও যদি সামঞ্জস্য ব্যাহত হয় বা আতিশয্য প্রকট হয়ে পড়ে, তাতে তাত্ত্বিক বিন্যাসের সৌন্দর্য ও মহিমা ক্ষুন্ন হয়। সুতরাং সাহিত্যতত্ত্বের সার্থক অভিব্যক্তি বা অনুশীলন কখনো সামঞ্জস্যবোধকে পীড়িত করতে পারে না। কিন্তু যারা এই বিষয়টিকে গভীরভাবে বুঝতে চান, তাদের জন্যে রয়েছে আবশ্যিক কিছু শর্ত!প্রণালীবদ্ধ ও নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ছাড়া জীবন থেকে উৎসারিত সাহিত্যতত্ত্বের গভীরে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় না। এই উপলব্ধি অর্জনের জন্যে কোনো সরলীকৃত সহজিয়া মার্গ নেই।
আরও একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। তত্ত্বের অনুধাবন মানে জীবনের অনুধাবন আর জীবনের অনুধাবন মানে সময়-চিহ্নিত পরিসরের অনুধাবন। এইজন্যে কোনো সাহিত্যতত্ত্বই সময় ও পরিসর নিরপেক্ষ নয়। ফলে বিবর্তনশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কোনো বিশিষ্ট সাহিত্যতত্ত্বের উদয়, বিকাশ ও অস্তকে বুঝে নিতে হয়। বিশ শতকের গোড়ায় যে সাহিত্যতত্ত্ব প্রাসঙ্গিক ছিল, একুশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নতুন সময় নিয়ে এসেছে নতুন প্রয়োজন, নতুন বিনির্মাণ, তত্ত্ব ও প্রয়োগের নতুন বিন্যাস। অবশ্য এইসঙ্গে এও মনে রাখতে হয় যে গ্রহীতার দেশকালজাত যথাপ্রাপ্ত পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হয় কোন তত্ত্ব কতটা স্বীকৃত, বর্জিত, পরিমার্জিত, পুনর্বিন্যস্ত হবে।
যেমন ধরা যাক প্রতীচ্যের আধুনিকতা বিষয়ক আকল্প ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে, বিশেষভাবে বাঙালির ভাববিশ্বে, অনেকখানি পুনর্বিন্যস্ত হয়েছিল। বিলম্বিত পুঁজিবাদের পর্যায়ে আধুনিকোত্তরবাদের সূচনা হল যখন, বাঙালির চেতনায় তার অভিঘাত বহুধা বিচ্ছুরিত হল। নয়া ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির মধ্যেও এত দ্রুত পটপরিবর্তন হয়ে চলেছে যে গত তিন দশকে উত্তরআধুনিকতা ও আধুনিকোত্তরবাদী চিন্তার সহাবস্থান আমরা লক্ষ করছি। এই বিতর্ক এখনও অমীমাংসিত। প্রবল অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্র-বিচ্যুতির আবহে এমন ধরনের আশ্চর্য নতুন সাহিত্যিক পাঠকৃতি রচিত হয়ে চলেছে যে এদের বিশ্লেষণ করতে গেলে পুরোনো পাঠাভ্যাস সংহিতায় আর কুলোচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক তত্ত্বের উপযুক্ত সমর্থন ছাড়া এখন কোনো ধরনের প্রতীতি অসম্ভব।
৫
মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস ঠিক কী কী কারণে পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক উপন্যাসকল্প রচনার ভিড় থেকে আলাদা—প্রথাসিদ্ধ বিশ্লেষণ দিয়ে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব। তেমনি ভোগবাদ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যার অধিগত, কেবলমাত্র তেমন সমালোচকই গত চার দশকের সাহিত্যিক পণ্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও অনান্দনিক চরিত্র যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন। আমাদের আধুনিকতার ঔপনিবেশিক চরিত্র যার কাছে স্পষ্ট, তিনিই কেবল বাংলা কবিতা-ছোটগল্প-উপন্যাস-নাটকে অভিব্যক্ত ব্যাধির সংক্রমণ শনাক্ত করতে পারেন। কাকে বলে চিহ্নায়ন প্রকরণ, এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই যাঁর নেই, তিনি কীভাবে কবিতার ভাষায় শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের যুগলবন্দির তাৎপর্য বুঝবেন! জীবনানন্দ-শঙ্খ ঘোষ-শক্তি চট্টোপাধ্যায়-জয় গোস্বামী-রাহুল পুরকায়স্থ-মন্দাক্রান্তা সেনদের চেতনাবিশ্ব কেন পরস্পরভিন্ন, চিহ্নবিজ্ঞানের উদ্ভাসন ছাড়া সম্পূর্ণ অধিগত হওয়া অসম্ভব। আখ্যানের সময় ও পরিসরের দ্বিরালাপ যদি না বুঝি কিংবা ঔপনিবেশিক কাহিনি বয়নের ধরনকে প্রত্যাখ্যান করার তাগিদকে যদি তত্ত্বগত ভাবে বুঝে না নিই, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, দেবেশ রায়, কমলকুমার মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নবারুণ ভট্টাচার্যদের কথনবিশ্বের স্বাতন্ত্র কখনো উপলব্ধি করব কি? পাঠকৃতির আকরণোত্তর বিন্যাস ও বিনির্মাণের বহুস্বরিক দ্যোতনা সম্পর্কে যিনি উদাসীন কিম্বা পাঠকের সার্বভৌম পরিসর বিষয়ে সাম্প্রতিক চিন্তাধারা থেকে যিনি লক্ষ যোজন দূরে—হাসান আজিজুল হক, রমানাথ রায়, সুবিমল মিশ্র, উদয়ন ঘোষ, কমল চক্রবর্তীদের লেখা পড়া বা না পড়া তার পক্ষে সমান।
তেমনি নারীচেতনাবাদী দর্শন ও নন্দন সম্পর্কে যিনি জিজ্ঞাসু নন, তার পক্ষে সাহিত্যের সমস্ত প্রধান স্থাপত্যের গভীরে বিরাজমান ঋদ্ধ অন্তঃস্বরগুলি অস্তিত্বশূন্য হয়েই থাকবে। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রবাদ-প্রতিম নাট্যসংলাপের প্রতিধ্বনি করে বলা যায়, অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত্রি! কিংবা পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস ও সংস্কারে যেসব লেখিকা আনখশির প্রোথিত, তাঁদের রচনা কেন তাৎপর্যহীন, এর উত্তর পাওয়া সম্ভব শুধু নারীচেতনাবাদের দর্পণে। নারীর আত্মকথামূলক রচনার সাম্প্রতিক আললাচনাগুলি থেকে বুঝতে পারি, প্রাসঙ্গিক তত্ত্বভাবনায় নিষ্ণাত হওয়ার ফলেই এতদিনকার অন্ধকার পরিসর ক্রমাগত আলোকিত হয়ে উঠছে। আশালতা সিংহ, জ্যোতির্ময়ী দেবীদের রচনা নবার্জিত শ্রদ্ধা ও মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু হয়েছ। আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, সেলিনা হোসেন, সুচিত্রা ভটাচার্যদের চেতনাবিশ্ব কি যথার্থ তত্ত্বভাবনা ছাড়া বিশ্লেষণ করা আদৌ সম্ভব?
আখ্যানতত্ত্ব ও প্রতিবেদনতত্ত্ব কীভাবে সাম্প্রতিক তত্ত্ববিশ্বের পুরোধা চিন্তাবিদদের অবদানে অভাবনীয় সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, সে-সম্পর্কে উদাসীন থাকার নিজেদের মনন-জিজ্ঞাসাকে পঙ্গু করে দেওয়া। বিশ্বায়ন কি কেবল দুনিয়াজোড়া বাজারের হট্টমেলায় ক্রেতা-বিক্রেতা হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্যে? রবীন্দ্রনাথ যেদিন ‘যত্র বিশ্ব ভবতি একনীড়ম’-এর ভাবকল্প দিয়েছিলেন আমাদের, সেদিনই তো সমস্ত নঞর্থক প্রবণতা মুছে দিয়ে সদর্থক বিশ্বায়নের বার্তা প্রচারিত হয়েছিল। মানববিশ্বে যা কিছু জ্ঞেয় ও আগ্রহ-উদ্দীপক, তাতে যে-কোনো মানুষের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। অতএব আখ্যান আর কাহিনি মনোলোভা মায়ামৃগ মাত্র নয় কিংবা প্রতিবেদনও নয় যে-কোনো সন্দর্ভ। মানুষের চিন্তাবিশ্ব থেকে উৎসারিত অজস্র বিচ্ছুরণে আখ্যান ও প্রতিবেদন আজ অনেকান্তিক ও অনেকার্থদ্যোতক। তত্ত্ব-নিরপেক্ষতা আসলে অসাড় চিত্তবৃত্তির লক্ষণ। আজ সর্বব্যাপ্ত রাজনৈতিক অর্থনীতির পেষণে কীভাবে অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে পুরনো চিহ্নায়ক মুছে গিয়ে চিহ্নায়নের নতুন প্রকরণ জেগে উঠছে—এ বিষয়ে যিনি অবহিত নন, তার পক্ষে আজকের আখ্যান ও প্রতিবেদনের অভিনবত্ব উপলব্ধি অসম্ভব।
দেবেশ রায়ের ‘একটি ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন’, নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’, স্বপন সেনের ‘মুখোশযোদ্ধা’ রবিশঙ্কর বলের ‘পোখরান ৯৮' ইত্যাদি কেন ঔপন্যাসিকতার নব্য গ্রন্থনার নিদর্শন, তা শুধুমাত্র বিবর্তনশীল আখ্যানতত্ত্বের নিরিখে বুঝে নেওয়া সম্ভব। সত্তর পরবর্তী ভারতবর্ষের দ্রুত বিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবচেতনা, বহুরৈখিক বাস্তবতা, চেতনার অনেকান্তিকতা কীভাবে লেখক-কথক স্বরের নতুন অন্তর্বয়ন এবং মুক্ত পাঠকৃতির বিশ্বাসে প্রতিফলিত হচ্ছে—তা যখন বুঝে নিই, অভিজিৎ সেনের ‘রহুচণ্ডালের হাড়’ ও ‘দেবাংশী’, ভগীরথ মিশ্রের ‘চারণভূমি’ ও ‘মৃগয়া’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষবিপক্ষ’ ও ‘জলতিমির’, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্বজনভূমি’ ও ‘চরপূর্ণিমা’, আফসার আমেদের ‘বিবির মিথ্যা তালাক ও তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিসসা’ ও ‘কালো বোরখার বিবি ও কুসুমের গন্ধ এবং চল্লিশজন লোক ইত্যাদি উপন্যাসের প্রকৃত স্বাতন্ত্র চিহ্নিত করতে পারি। একইভাবে কবিতা ও ছোটগল্প থেকে আমরা নতুন ধরনের নির্যাস পেয়ে যাই। আরও একটি কথা এখানে বলতে চাই। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, সুবিমল মিশ্র, কমল চক্রবর্তী, অজিত রায়, বারীন ঘোষাল, মলয় রায়চৌধুরীর মতো লিখিয়েরা কেন একই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে উদ্ভুত হয়েও সমান্তরাল সৃজনশীল পরিসরের সূত্রধর এবং কেনই বা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-বিশ্বের পক্ষেও তারা প্রত্যেকে নিজস্ব অপরতার সন্ধানী—এই মীমাংসা উপযুক্ত তত্ত্বের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব।
বস্তুত শুধুমাত্র বাংলা কথাসাহিত্যেই নয়, গত তিন দশকে প্রবন্ধ-সাহিত্যেরও আমূল রূপান্তর ঘটে গেছে। এতদিন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার প্রয়োজনে রচিত ও তথাকথিত সৃষ্টিশীল প্রেরণায় রচিত প্রবন্ধের জলবিভাজন রেখা তৈরি করে অকারণ কটু বিতর্ক চলত। কিন্তু রোলাঁ বার্ত, জাক দেরিদা ও জাঁ বদ্রিলারের কল্যাণে সৃষ্টিশীলতার সংজ্ঞা আমূল বদলে গেছে। প্রাগুক্ত জলবিভাজন রেখা এখন পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। কেন এই মৌলিক রূপান্তর ঘটে গেছে, এর উত্তর রয়েছে সাম্প্রতিক বিশ্বপরিস্থিতিতে। মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিসর যখন যন্ত্র-প্রযুক্তির দৌলতে খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে এবং নতুন নতুন চিহ্নায়ন প্রকরণ তৈরি হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে ও প্রতিটি চিন্তা-প্রস্থানে, সে-সময় প্রবন্ধের প্রতিবেদনও বহুস্বরিক ও বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় অভ্যস্তজনেরা অজস্র কুম্ভের ভূমিকা নিয়ে নকল বুদির গড় রক্ষায় ব্যস্ত। তফাত অবশ্য একটু আছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কুম্ভ কাউকে কটু মন্তব্য করেনি, অকারণ হিংস্রতায় কিংবা অসূয়ায় কাউকে আঘাত করা দূরে থাক, দাঁত খিচানোর কথাও ভাবেনি। কিন্তু যারা প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা বিদ্যাচর্চার দ্বারপাল, সময়ের দাবি অবচেতনে বুঝতে পেরে কিন্তু সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করে তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। পায়ের নিচে জমি দ্রুত সরে যাচ্ছে, তা অনুমান করেও দুর্মর অভ্যাসের শেকল ভেঙে তত্ত্ববিশ্বের নতুন সত্যকে স্বীকার করতে পারছে না। তাদের তত্ত্বশূন্য রচনা পুঞ্জপুঞ্জ কথার ফানুস বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে ভেবে এরা সদলবলে ঝাপিয়ে পড়েছে। সব ধরনের তাত্ত্বিক রচনার উপর।
সময়ের পাঠ গ্রহণে অনিচ্ছুক ওইসব ছদ্মপড়ুয়াদের সংঘ-রচনার জন্যে সাহিত্য থেকে আজ জীবন নির্বাসিত। সাহিত্যের বিশ্লেষণে সমাজতত্ত্ব, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস ইত্যাদির গুরুত্ব এইসব রক্ষণশীল জনেরা মৌখিকভাবে স্বীকার করেন হয়তো, কার্যত কিন্তু বহু প্রজন্ম লালিত চিন্তার অচলায়তন থেকে এঁরা একচুলও সরে আসেন না। রবীন্দ্রনাথের গোরা, রক্তকরবী, কালান্তর এবং এরকম অন্যান্য বই তাদের জন্যে কখনো অনেকার্থদ্যোতক পাঠকৃতি হয়ে ওঠে না। শ্রেণীকক্ষের ভেতরে ও বাইরে প্রতি মুহূর্তে বাংলা বিদ্যাচর্চা নিহত হচ্ছে তাই। আমাদের যে-কোনো সহজিয়া পাঠ তাই ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে নিরালম্ব বায়ুভুক ফানুসের মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অস্তিত্বতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা জাগিয়ে দিয়ে যেসব তত্ত্বভাবনা জ্ঞানাঞ্জন-শলাকার মতো অভ্যাসের জাড্য ও অন্ধকার দূর করে দেয়, তাতে আমাদের বড়ো ভয়। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা, বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের বিপুল দৈন্যের মধ্যেও এমন কয়েকজন চিন্তাবিদকে পাওয়া গেছে, যারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রবন্ধ কেবল নির্দিষ্ট বিষয়ের গণ্ডিতে রুদ্ধ রচনা মাত্র নয়। তাদের বয়ানে মিশে থাকে দার্শনিক চিন্তার দ্যুতি, সমাজতত্ত্বের নির্যাস, ইতিহাসের চলিষ্ণুতা।
৪
শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধে আমরা যে-ধরনের পাঠকৃতির মুখোমুখি হই, তা কি কেবল বিষয়-গৌরবে আমাদের আকৃষ্ট করে? নাকি তার প্রতিটি বাক্যে গভীর দার্শনিক বাচনের দ্যুতি বিকীর্ণ হয়? অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রবন্ধে বিপুল মানব-বিশ্বের অনেকান্তিক অভিজ্ঞতা কি একনীড় হয়ে ওঠে না? প্রবন্ধ মানে জিজ্ঞাসার বয়ন; মীমাংসার ছলে আরও জিজ্ঞাসা উসকে দেওয়া। মানবিকী বিদ্যার বিভিন্ন প্রাঙ্গন থেকে কুসুম চয়ন করে একটি মালা গেঁথে নেওয়াই প্রাবন্ধিকের অন্বিষ্ট। বিষয় সাহিত্য হোক বা না হোক, প্রবন্ধকে সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন অর্থাৎ নান্দনিকবোধে ঋদ্ধ হতেই হবে। আর, দার্শনিক উপলব্ধির সূত্রায়িত বিন্যাস ঘটবে তাতে। আমরা যখন প্রবন্ধ পড়ব, চেনা জগতের অচেনা আদল খুঁজে নিতে চাইব। অতি পরিচিত জগৎ ও জীবনের অভ্যস্ত ব্যাখ্যা পেয়ে যারা সন্তুষ্ট, প্রবন্ধ তাদের জন্যে নয়। প্রবন্ধ পড়ে প্রাবন্ধিকের সঙ্গে একমত হতে হবে, তা কিন্তু নয়। তিনি সাহিত্য ও সমাজ কিংবা সাহিত্য ও দর্শন কিংবা সাহিত্য ও ইতিহাসের বহুমাত্রিক যুগলবন্দি উপলব্ধি করবেন: এইটুকুই শুধু প্রত্যাশিত। তার মানে, কোনো প্রবন্ধে যদি কোথাও কোনো তত্ত্ববীজ বয়ানের মধ্যে বিকশিত না হয়, তাহলে তা ‘প্রবন্ধ’ অভিধার যোগ্যই নয়।
কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিকেরা যখন নিজেদের সৃজনী অভিজ্ঞতার নিরিখে সাহিত্যের হওয়া ও হয়ে ওঠা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন, তাঁদের রচনায় ভিন্ন মাত্রা নিশ্চয় প্রত্যাশিত। কিন্তু তাদের কাছেও আমরা চাইব দৃষ্টির প্রসার ও গভীরতা। সব সময় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়, একথা অবশ্য বলা যায় না। জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে উত্তম প্রাবন্ধিক ছিলেন। তাঁদের বয়ানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নান্দনিক ভাবাদর্শ ও সময়-চেতনার অভিব্যক্তি দেখেছি। নিবিড় পুনঃপাঠে তাদের প্রবন্ধ থেকে নানা ধরনের তত্ত্ববীজ আবিষ্কার করা সম্ভব। শঙ্খ-অলোকরঞ্জনের কথা আগেই লিখেছি। এছাড়া দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রবন্ধেও সমান সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই তালিকা দীর্ঘ নয়। কবিতার কথা’, ‘উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে’, ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ দার্শনিক মননে ঋদ্ধ, তা আজও আমরা ভালোভাবে লক্ষ করিনি। আসলে আমাদের সাহিত্যিক পাঠকৃতির ঐতিহ্যে ‘কবি ক্রান্তদশী কিংবা কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভুঃ ইত্যাদি নিছক প্রাজ্ঞোক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বলা ভালো, কথার কথা মাত্র হয়ে থেকেছে। এইসব উচ্চারণের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণের চেষ্টা হয়তো করেছি, কিন্তু এদের অন্তর্নিহিত গভীর তাৎপর্য কতটা সুদূরপ্রসারী, তা তলিয়ে ভাবিনি। অথচ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, ‘প্রাচীন সাহিত্য, সাহিত্যের পথে’ প্রভৃতি নিবিড় তাত্ত্বিকতায় পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও জীবনজিজ্ঞাসা কীভাবে সমার্থক হয়ে ওঠে, তা যদি ভালোভাবে লক্ষ করতাম, তাহলে আমাদের রবীন্দ্র-পাঠ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার চক্রব্যুহে রুদ্ধ হয়ে যেত। সব জিনিসকে টুকরো করে আনা আমাদের পদ্ধতি বলে রবীন্দ্রচর্চা আজও অসম্পূর্ণ। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে বলে শতবর্ষের ঢাকঢোল সত্ত্বেও জীবনানন্দচর্চাও অসম্পূর্ণ। তেমনি অন্য সব লিখিয়েদের রচনা-পাঠও ছজন অন্ধের হাতি দেখার কথা মনে করিয়ে দেয়। তত্ত্ব-চেতনাকে আমরা কখনো যথাযথ গুরুত্ব দিতে শিখিনি বলে আমাদের যাবতীয় সাহিত্য-পাঠ হয়ে রইল অধমনস্ক, লক্ষ্যশূন্য ও অগভীরতায় আক্রান্ত। তাসের দেশের সেনাদের মতো নিয়মমাফিক পা তুলে পা ফেলে খড়ির গণ্ডির মধ্যে আমরা প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে তৃপ্ত থাকতে চাই। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ করলেই শুচিবায়ুগ্রস্ত তর্জনি উদ্যত হয়ে ওঠে। কোথাও বা বিহ্বল কণ্ঠ অভিযোগ করে: ‘আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে!’
আসলে ভাষা সংযোগ সাধনের মাধ্যম হলেও তাতে যে অধিকারী অনধিকারী ভেদ অবশ্যস্বীকার্য, একথা প্রায়ই ভুলে যাই। সংযোগ হতে পারে শুধু দক্ষ দাতা ও প্রস্তুত বা উপযুক্ত গ্রহীতার মধ্যে। মনে পড়ে ‘বিসর্জন’ নাটকের একটি বিখ্যাত সংলাপ:
‘জয়সিংহ: জানো কি একেলা করে বলে?
অপর্ণা: জানি, যবে বসে আছি ভরা মনে—
দিতে চাই, নিতে কেহ নাই!’
যিনি নেবেন, তাকে তো নেওয়ার জন্যে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। মা-ঠাকুমার কোলে শুয়ে বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গল্প শোনা যেতে পারে; কিন্তু বয়স্ক কালের কথাতেও কি একই ধরন সম্ভব? পরিণত বয়ানের জন্যে আবশ্যিক পরিণত মন। মুশকিল এই, অনেক পরিণত শরীরে অপরিণত মন লুকিয়ে থাকে। কারো কারো শৈশব, কৈশোর কিছুতেই কাটতে চায় না। কেউ কেউ আবার জেগে জেগে ঘুমোতে অভ্যস্ত; কোনভাবেই এদের ঘুম ভাঙে না। চারদিকে ঘটনার ঘনঘটা যত আবর্তন তৈরি করুক, দৈশিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি চোখের সামনে যত ওলট পালট হয়ে যাক, ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানে যত জটিলতাই দেখা দিক—চোখের ঠুলি অনড় হয়ে এঁটে থাকে। চোখ খুলে দেখাতে চাইলেও এরা দেখতে নারাজ। মান্ধাতার আমলে যেভাবে পড়া, জানা, বোঝা চলত, তেমনি চললেই ভালো, এই হল এদের অভিপ্রায়। যে-ভাষা খবরের কাগজে নিত্যদিন ব্যবহৃত হয়, সাহিত্য বিশ্লেষণেও এঁরা সেই একই ভাষা প্রত্যাশা করেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদিও মোক্ষম কথা লিখে গেছেন—যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্যে কবিকে দোষারোপ করা অন্যায়’—তবু কোনো ইতর-বিশেষ হয়নি। বিনা আয়াসে সব বুঝে নেব, সমস্তই হবে জমা-খরচের হিসেবের মতো প্রাঞ্জল—এই মনোভঙ্গির কোনো বদল নেই। ব্যতিক্রম মাত্রেই উৎপাত হিসেবে নিন্দনীয়।
সমস্যার মূল কারণ, নতুন কিছু পড়তে অনীহা আর নতুনভাবে চিন্তা করতে আপত্তি। যখন প্রচলিত বিদ্যাচর্চা ও চিন্তাপ্রস্থানের সীমানা মুছে যাচ্ছে, সাহিত্যিক প্রতিবেদন কি নতুন কালের বার্তাকে ‘ওকে ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছিঃ ও যে চণ্ডালিনীর ঝি, নষ্ট হবে যে দই সেকথা জানো না কি বলে ছোঁয়া-বাঁচাননা দূরত্বে চলে যেতে পারবে? দর্শন-ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব-রাজনীতি-অর্থনীতি-বিজ্ঞানের সংশ্লেষণে যে অনেকান্তিক সন্দর্ভ তৈরি হয়ে চলেছে, তার বহুস্বরিক তাৎপর্য উপলব্ধির জন্যে সাহিত্যকেও নানা ধরনের তাত্ত্বিক আয়ুধে সজ্জিত হতে হচ্ছে। যে এই অনিবার্য সত্যকে অস্বীকার করছে, সে আত্মঘাতী হচ্ছে মাত্র। ভাষা দুরূহ নয়, দুরূহ হচ্ছে এই সময়; দুরূহ নয়, দুর্বোধ্য। কিন্তু মানুষ তো অপরাজেয় সৈনিক; সে এই দুর্বোধ্যতায় ত্রস্ত হবে কেন? বরং গোলকধাঁধায় প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের জন্যে নতুন নতুন দিশা খুঁজে নেবে। এই দিশা খোঁজার অভিব্যক্তি হল তত্ত্ব। সাহিত্য যেহেতু স্বভাবত জীবন-ঘনিষ্ঠ, তার প্রতিটি বয়ানে থাকবে তাত্ত্বিকতার মোহর। কখনো তা স্পষ্ট আর কখনো আভাসিত, এই মাত্র তফাত। যাকে সাহিত্য বলছি তা আসলে দর্শন। এই দর্শনে ব্যক্তি উপলক্ষ মাত্র, সমাজই প্রকৃত অন্বিষ্ট। অতএব এমন বাচন ব্যবহৃত হবে সাহিত্যে যা শুধু বর্ণনা দিয়ে ফুরিয়ে যাবে না, ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলবে পরাবাচনের আভা। একক বাচনের সঙ্গে সামূহিক বাচনের দ্বিরালাপ হবে ওই বয়ানের প্রধান আধেয়। এ কোনো তত্ত্বকথা নয়, এ হল চলমান জীবন থেকে পাওয়া অনুভূতির নির্যাস।
এইজন্যে সাহিত্যিক প্রতিবেদনে অভিব্যক্ত তত্ত্বজিজ্ঞাসায় পরিভাষার গ্রন্থনা অনিবার্য। পরিভাষা মানে তো কঠিন করে বলা কথা নয়; চিন্তার যে-বীজতলিকে অন্য কোনোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, পরিভাষা হল তার একমাত্র আশ্রয়। পরিভাষা থেকে অর্থের বহুধা বিচ্ছুরণ লক্ষ করে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই; একে বরং তার ঐশ্বর্যের দ্যুতি হিসেবে বন্দনা করাই কাম্য। পরিভাষার গ্রন্থনা যাঁদের কাছে দুরূহ, তারা অনুগ্রহ করে অধ্যবসায়ী হোন। বাংলা ভাষার একটু দূরবতী উৎসধারায় তারা অবগাহন করুন। প্রাথমিক দ্বিধা কেটে গেলেই বুঝবেন, কী অসামান্য সম্ভাবনার বীজতলি তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কিছুদিন আগে অন্য একটি প্রসঙ্গে যা লিখেছিলাম একটি প্রত্যয়ের ঘোষণা হিসেবে, আরো একবার তা ফিরিয়ে আনছি: কোনো সূক্ষ্ম ও গভীর ভাব-বিচ্ছুরণ প্রচলিত ভাষায় কুলোয় না। তাই ভাষার ভিত্তি খুঁড়তে হয়। প্রসারিত করতে হয় অন্তর্বর্ত ক্রিয়াপদের সম্ভাবনা। এমন কি উপসর্গের বা প্রত্যয়ের একক ও যুক্ত তাৎপর্য পুনর্নির্মাণ করতে হয়। কখনো কখনো ফিরে যেতে হয় প্রাতিপাদিকের আদি পরিসরে। সব কিছুই আছে ভাষার গভীরে; তাকে কেবল পুনর্গঠন ও পুনরাবিষ্কার করে নেন পরিভাষা-ভাবুকেরা। পৃথিবীতে দ্রুত তত্ত্বচিন্তার পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। খুলে যাচ্ছে শাখাপথের দিগন্ত। শুধুমাত্র ভাষাতত্ত্ব আর সাহিত্যতত্ত্বে দেখতে পাচ্ছি কত বিচিত্র আয়তন। ইউরোপীয় ভাষাবিশ্ব আজ বাঙালির নিজস্ব ভুবনেও নতুন নতুন প্রবণতার বীজাধান করছে। চিন্তার বিশ্বায়নের যুগে পুনর্নির্ধারিত হচ্ছে সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস বিষয়ক সীমান্তের ধারণাও। অপরিচিত ভাববীজ ভাষার পুরোনো আকরণে গৃহীত হতে পারে না। তার জন্যে চাই পুরোপুরি নতুন উদ্যম, নতুন সংহিতা, নতুন কৃৎকৌশল। পরিভাষা এইজন্যে আবশ্যিক এখন। অপরিচয়ের দূরত্ব প্রথম পাঠে কিছুটা বাধা তৈরি করবেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপত্তি বিরোধিতা পর্যন্ত গড়াবে। ভাবের দুরূহতাকে ভাষার দুরূহতা বলে মনে করেন কেউ কেউ। বারবার পড়া ছাড়া এই ভ্রম কাটিয়ে ওঠার অন্য পথ নেই কোনো। পরিভাষা যখন সার্থক তাতে লক্ষ করি বহুস্বরিকতা। একে যদি বুঝে নিই সতর্কভাবে, দুরূহতা সংক্রান্ত আপত্তি খুব বেশি দিন টিকবে না। গত কয়েক বছরে বাঙালি তত্ত্বচিন্তায় নিবিষ্ট থেকে নিবিষ্টতর হচ্ছে। এসময় তাই ভাষাচেতনার নয় শুধু, পরিভাষাচেতনারও।
এরপর সম্ভবত খুব বেশি কথা বাকি থাকে না। এইটুকু শুধু বলা যে, পরিভাষা কোনো সত্যিকারের অধ্যবসায়ী পড়ুয়ার পক্ষে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। অভ্যাসের অবিরল প্রবাহে তা ছেদ তৈরি করে বলে যাঁরা হোঁচট খাচ্ছেন, তাদের শুধু সময়ের অভিজ্ঞান ও দাবি বুঝে নিতে হবে। জীবনযাপনে সব কিছু যখন বদলে যাচ্ছে, সাহিত্য-পাঠ আর বিশ্লেষণ-পদ্ধতিও বদলাতে বাধ্য। তত্ত্ব তো ওই রূপান্তরকে চেনার জন্যে, প্রবহমানতা ও পরিবর্তনের দ্বিরালাপকে বোঝার জন্যে। তত্ত্বকে যষ্ঠির মতো নয়, প্রদীপের মতো ব্যবহার করাই বিধি। সেই প্রয়োগ করাও হচ্ছে। প্রদীপে যষ্ঠিভ্রম তো রঞ্জুতে সর্পভ্রমের চেয়েও মারাত্মক। তত্ত্ব সূর্যের মতো নিরপেক্ষ, পর্বতে ও সমভূমিতে তার আলো ও উত্তাপ সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে কুয়াশা ও অন্ধকার, সেখানে তত্ত্ব আলো দেয় দৃষ্টিকে লক্ষ্যাভিমুখী করার জন্যে। আর, যেখানে আলোর আভাস থাকলেও তা অপরিস্ফুট, সেখানে তত্ত্বের কাজ উজ্জ্বলতা ও তীক্ষ্ণতা বাড়িয়ে দেওয়া। অন্ধকার ঘরেও একটি কোনে প্রদীপ জ্বালালে তা যেমন পুরো ঘরকে আলোকিত করে, তেমনি সাহিত্যতত্ত্বও সম্পূর্ণ প্রতিবেদন বা পাঠকৃতিকে উদ্ভাসিত করে তোলে। অনেক প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য তখন দৃষ্টিগোচর হয়, সামান্যের অন্তরালে আবিষ্কৃত হয় বিশেষের অস্তিত্ব।
নিজেদের বিশ্বাসে, অভিজ্ঞতায়, অনুভূতিতে তত্ত্বের উপস্থিতি যখন হৃৎস্পন্দনের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়—তখন সাহিত্যপাঠ কেবল শ্রম ও অধ্যবসায়ের বিষয় থাকে। তা হয়ে ওঠে কুঁড়ি থেকে ফুলের জেগে ওঠা দেখার মতো আনন্দদায়ী প্রকরণ। আরো নিবিড় ভাবে চিনি নিজেকে, জগৎকে, সম্পর্কের রুদ্ধ ও মুক্ত বিন্যাসকে; সাহিত্য-পাঠ ও জীবন-পাঠের যুগলবন্দিকে তখন আর কষ্ট করে বুঝতে হয় না। সাহিত্যতত্ত্বের তত্ত্ব অর্থাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে কোনো বাকৃবিস্তার না করেও বলা যায়, প্রকৃত জীবন আর কল্পিত জীবনের মধ্যে প্রলম্বিত সব অদৃশ্য পর্দা সরিয়ে দেওয়া সাহিত্যতত্ত্বের অন্যতম লক্ষ্য। প্রকৃত জীবন যতক্ষণ স্পষ্ট না হচ্ছে, অন্তত ততক্ষণ বিশ্লেষণী সমালোচনা পথ ও পাথেয় খুঁজে পাবে না।
সমালোচক তত্ত্বের দর্পণে নিজেকে দেখেন আবার সমান্তরাল ভাবে সাহিত্যকেও দেখেন। তত্ত্ব ও জীবনের মধ্যে দ্বিমেরুবিষমতা ভ্রান্ত ধারণা। বস্তুত সামাজিক জীবনই তো কোনো-না-কোনো ভাবে তাত্ত্বিকতার আধার। তেমনি তত্ত্বও বাস্তব সামাজিক প্রক্রিয়া। আমরাই তাকে অকারণে বিমূর্তায়িত করে তুলি। সাহিত্যতত্ত্ব পৃথিবীকে তাৎপর্য-বিশ্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সারাজীবন ধরে জেনে বা না-জেনে আমরা কেবল চিহ্নায়ক তৈরি করি। আমাদের এই স্বাভাবিক মানবিক প্রক্রিয়াকে সাহিত্যতত্ত্ব প্রণালীবদ্ধ ভাবে তুলে ধরে এবং প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষিতের দ্বিবাচনিকতায় যাবতীয় তাৎপর্যকে পরীক্ষা করে।
মানব-বিশ্বে তত্ত্ব দৃষ্টিশক্তির মতোই অপরিহার্য। অনবরত মুছে-যাওয়া আর নতুনভাবে তৈরি-হওয়া চিহ্নায়ন প্রকরণকে সংহত, সুস্থির ও দৃঢ় ভিত্তি দেওয়ার জন্যেই সাহিত্যতত্ত্ব। এমন নয় যে কোনো তত্ত্ব বৈপ্লবিক আর কোনো তত্ত্ব রক্ষণশীল। ব্যবহার-উপযোগিতার ওপর নির্ভর করে, জীবন-ব্যাপ্ত সন্ধানে কোন তত্ত্ব অন্বিষ্টর দিকে আমাদের কতটা এগিয়ে দেবে! কোটি টাকার প্রশ্ন হল, আমরা কি মীমাংসার অভ্যাস চাই, নাকি এক জিজ্ঞাসা থেকে অন্য জিজ্ঞাসায় বয়ে যেতে চাই?