সময় অসময় নিঃসময়/জনৈক শিক্ষাজীবীর আত্মদর্শন
জনৈক শিক্ষাজীবীর আত্মদর্শন
যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শনের গল্পটা সবাই জানে। অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ'—এইমাত্র বলার জন্যে তাকে নরক দেখতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা যারা মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছি অহরহ, এমন কী নিজেদের নরক নিজেরাই তৈরি করে চলেছি প্রতিদিন—আমাদের জন্যে কী ব্যবস্থা? ৫ সেপ্টেম্বর ঘটা করে শিক্ষক দিবস করি এখনন, ইনিয়ে-বিনিয়ে সাত-সতেরো কথা বলি জাতির মেরুদণ্ড সম্পর্কে—তারপর, আবারও ফিরে যাই নরক’ তৈরির কার্যক্রমে। বুননা রামনাথের কথা অবশ্য ইদানীং কেউ বলে-টলে না; ই-মেল আর ইণ্টারনেটের যুগে শিক্ষকের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিও দ্রুত অবান্তর হয়ে যাচ্ছে। অন্য যে-কোনো পেশার মতো শিক্ষকতাও একটা পেশা। ‘দীয়তাম ভুজ্যতা’রব উঠেছে ভুবন জুড়ে। বেসরকারিকরণের মাহাত্মকীর্তনে আমরা সবাই দোহার। ব্যাঙ্কের বাবুরা কাজ করে না, খাল কেটে কুমির ঢুকিয়ে দাও।ইনসিওরেন্স সেক্টর হাজার-হাজার কোটির ব্যবসা করছে। দেশীয় তিমিকে বিদেশি তিমিঙ্গিলদের সুস্পষ্ট কবলে ফেলে দাও। বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছে কেমনে দিই ফাকি। রেল-বিমান খুব খারাপ চলছে, বাসের মতো সব প্রাইভেট করে দাও। সামাজিক মালিকানার দরকার নেই, চার-পাঁচ-ছজন ধনির শ্রীবৃদ্ধি মানেই তো দেশের শ্রীবৃদ্ধি।‘বিড়াল’প্রবন্ধে মহামূখ। বঙ্কিমচন্দ্র কী লিখেছিলেন—সেসব ব্যাকডেটেড কথা মনোেযোগের অযোগ্য। বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষা পাওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই আর।
স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাটবাট যেমন আছে থাকুক। দিল্লী ও দিসপুর থেকে নতুন নতুন ঠগীর ফাঁস আসুক। ব্যাঙ্ক-বিমা-রেল-বিমান-ইস্পাত-বিদ্যুৎ—সর্বত্র রামরাজ্য ও হনুমান-রাজ্য চালু হচ্ছে, তেমনি শিক্ষাতেও হোক। সমাজের উঁচুতলার মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া উচ্চশিক্ষার দরকারটা কী? অন্যদের জন্যে আছে হাতে-কলমে কাজ শিখে নেওয়ার ব্যবস্থা। কোথায় আছে, তা স্পষ্ট বলারও প্রয়োজন নেই। কোথাও আছে একটা কিছু—এইটুকু জানলেই হল। ইঁদুর দৌড়ে ঢুকে যাক সবাই, কোথায় যাচ্ছে। জেনেই। ইতিমধ্যে শিক্ষাদানের সামাজিক অঙ্গীকার ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা মুছে যাক। আমরা ‘পি-পু ফি-শু’র দলে ছিলাম, আছি, থাকব। মন অসাড়, চেতনা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ঘাতকের খঙ্গ ঘাড়ের উপর নেমে এলেও চোখে পলক পর্যন্ত পড়ে না। কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে নিম্নবর্গীয় কেউ যেতে না পারে, এইজন্যে হাজার টাকা থেকে লক্ষ টাকা পর্যন্ত ফিজ ধার্য হচ্ছে। কেউ কোনও প্রশ্ন করছে না, ‘ওহে রামরাজ্যের ভেক-ওয়ালা স্বদেশি ঢোলওয়ালার দল—সাগরপারের কোন প্রভুদের খেদমত করছ এভাবে!’ আমাদের পাঠশালা-মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো শুকিয়ে মরছে। ওখানে যে বাংলায় পড়ানো হয়, ওখানে ছেলেমেয়েদের পাঠালে ওরা আনস্মার্ট হবে। দাঁতে-দাঁত চেপে, চোখ পিটপিট করে ইংরেজি বলবে না, বোম্বাইয়া ফিল্মর্মাকা হিন্দি বলবে না। অতএব অল্প-মাইনেতে ঘানির বলদ হয়ে-যাওয়া মাস্টারমশাই ও দিদিমনিতে ছয়লাপ ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলি। স্কুল? সত্যিই কি এদের স্কুল বলা যায়? না, আসলে এসব ব্যবসাকেন্দ্র। কাদের হাতে পুতুলনাচের সুতো এবং কী তাদের পরিচয়—এসব প্রশ্ন কখনো কারো মনে জাগে না। কত বড়ো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছে মগজ ধোলাইয়ের কারিগরেরা, এ বিষয়ে মাথাব্যথা নেই কারো। এইসব ‘হেভি স্মার্ট’ শিশু-কিশোরেরা যখন তরুণ-তরুণী হচ্ছে, তাদের প্রকৃত পরিণতি কী হচ্ছে—এই খোঁজখবর কিন্তু নেওয়া হয় না। পরিসংখ্যানের সাহায্যে আরও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, সোনার হরিণের পেছনে ধাবমান আজকালকার আদিখ্যেতাপূর্ণ মা-বাবাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতাই বা কী! যে-কোনো মূল্যে সফল হওয়াই একমাত্র পরমার্থ—এই যারা একচক্ষু হরিণের মতো যাবতীয় পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে পায়ের নিচে পিষে মারছে, তাদের ভবিতব্যই বা কী! বেসরকারিকরণের উন্মত্ত তাণ্ডবে ভেসে গেছে সব কিছু। শিক্ষকের জোব্বা পরে সমাজে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা। এরা এতটাই বেপরোয়া এখন, যে, সকালে ও রাত্তিরে নয় কেবল, দুপুরবেলায়ও পেশাদারি সততাকে প্রকাশ্যে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাড়িতে হাট বসিয়ে দিচ্ছে। একেকজন ছাত্রের পেছনে পাঁচ-ছজন রোবট শিক্ষাব্যবসায়ীর ছায়া। এই নিয়ে নিরেট অভিভাবকদের মধ্যেও প্রতিযোগিতাকার ছেলে-মেয়ে কোন বিষয়ের জন্যে কজনকে রেখেছে। এই ‘রেখেছে’ ক্রিয়াপদটা কানে খট করে লাগে; চাই বা না চাই ‘রক্ষিতা’র অনুষঙ্গ সামাজিক দুঃস্মৃতি থেকে উঠে আসে।
আর, শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা ন্যক্কারজনক ভূমিকায় নেমে পাক মাখছেন দুহাতে। ভয় দেখাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের, ‘আমার কাছে না পড়ে অমুকের কাছে পড়লে টাইট দেব।...আমার সঙ্গে বোর্ডে বা ভার্সিটিতে অমুক চন্দ্র তমুকের ব্যবস্থা করা আছে।...নম্বর কমাননা বা বাড়ানো আমার বাঁ-হাতের খেলা। আর তারই সঙ্গে মানানসই চোখাচোখা বাক্যবান প্রয়োগ করা হয় ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে। এরাই আজকের শিক্ষক। তারা জাতির কারিগর বটে, তবে বজ্জাতির। কী শেখে ছাত্রেরা এদের কাছে? শেখে, নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে চারপাশ সম্পর্কে অন্ধ থাকা শেখে, নিজের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে যারা আছে, তারা সবাই অশ্রদ্ধেয়, মনোযোগের অযোগ্য এবং অস্তিত্বশূন্য অবয়ব মাত্র। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা শেখে, তা হল, শিক্ষকের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেহাত ডানহাত ও বাঁ হাতের। তারা শেখে এবং দেখে যে শিক্ষকের আত্মম্ভরী-জোব্বার নিচেই রয়েছে। আসল কাকতাড়ুয়া মূর্তি। এরা যখন ধাপে ধাপে স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা অন্য কোনো বিশিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যায়, তাদের সঙ্গে সংলগ্ন কালো ছায়া ঢেকে ফেলে সব কিছু। এরা চৈতন্যে মড়কের বার্তাবহ হয়ে বিষাক্ত ছত্রাক ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। দ্রুত পচে যেতে থাকে সব কিছু: শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নৈরাজ্যের রৌরব ঘনীভূত হতে থাকে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে। বস্তুত হতে থাকে নয়, হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের দোসর চূড়ান্ত বিমানবায়নের গ্রহণ লেগেছে ভারতের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও, বাপে তাড়ানো মায়ে-খেদানো আমাদের বরাক উপত্যকায়।
২
যেহেতু এই এলাকা চিরকালই পাণ্ডব-বর্জিত, এখানকার আকাশে-বাতাসে পুষ্ট হয় কেবল হীনমন্যতা। আলো-হাওয়া-রোদ কোথায় যেন কোন অদৃশ্য ও অমোঘ প্রতিবন্ধকে ঠিকরে যায়। ঝাপসা কাচের আড়ালে সব দৃশ্যই দৃশ্যের কুহক হয়ে ওঠে, সব বার্তাই সত্যভ্রমের বার্তা। নইলে চরম কূপমণ্ডুকতার ও যুক্তিহীনতার অবারিত সমাবেশ এখানকার জনমানসে মৌলবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রতিক ভেদবুদ্ধিকে তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনা-পর্বেও এতখানি অবারিত করে তুলত না। গত কুড়ি বছরে ধাপে ধাপে যাঁদের অবনমন সম্পূর্ণ হয়েছে, সেই শিক্ষক সমাজ তাই আজ আর চেতনার প্রহরী নন। তাদের আর কোনো অর্থেই বুদ্ধিজীবী বলা চলে না। ব্যবসা-সর্বস্ব মনোবত্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলেই কোনো ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাদের টিকিটিও দেখা যায় না। অথচ ১৯৬১, ১৯৭২ ও ১৯৮৬-এর ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে তাঁদের অনেকেই ছিলেন অগ্রণীর ভূমিকায়।
মোটামুটি ভাবে গত তিন দশকে কেন এই অন্ধকারের অন্ধলিপি তৈরি হল, তা আজ তলিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। অসুখের বহুমাত্রিক অভিব্যক্তির সঙ্গে লড়াই করার বদলে কেন গোটা সমাজ ভেসে গেল বৈনাশিক অপচেতনায়—এর পেছনে কি গভীর আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রভুত্ববাদীদের যৌথ চক্রান্ত রয়েছে? আজ ধ্বস্ত হয়ে গেছে ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষাদান-বিধি। বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ এনে দিয়ে বিজ্ঞান-শিক্ষাকেও কতকগুলি পূর্বনির্ধারিত প্রকল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন পাঠ্য-বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বহু গুণ বেড়ে গেলেও কম্পিউটার ও ইণ্টারনেটের প্রকৃত তাৎপর্য চিন্তা-চেতনার মধ্যে শুষে নিয়ে শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাপ্রকরণকে যথাযথভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার কোনো গভীর আয়োজন নেই।
৩
মাধ্যমিক স্তরের সবচেয়ে নিচু ধাপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উঁচু ধাপ পর্যন্ত শিক্ষকতার চল্লিশ বছর ব্যাপী অভিজ্ঞতায় কিছু কিছু ভেতরের সমস্যা বোধহয় বুঝতে পেরেছি। তারপর চোখের সামনে দেখছি বাংলা বিদ্যাচর্চা সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষকগবেষকদের মনোভঙ্গির বিবর্তন। দেখেছি কীভাবে মাতৃভাষার মৌলিক ব্যবহারবিধি সম্পর্কে উদাসীন থেকেও এবং নতুন পাঠগ্রহণ সম্পর্কে অনীহা দেখিয়েও বাহ্যিক অর্থে ‘সফল হওয়া সম্ভব। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই পাঠ্যসূচি চালু থাকলে শিক্ষকেরা স্বস্তিবোধ করেন এবং ছাত্ররাও খুশি থাকে। আর, সবচেয়ে বেশি সুখী হন সেই সব শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা যাদের বাড়িতে এখন তিনবেলা বেসরকারিকরণের সুপবন বয়ে যাচ্ছে। একই কুমিরের ছানা দেখাতে দেখাতে তাদের দোতলা-তেতলা বাড়ি হয়, গাড়ি হয়, জৌলুস হয়, সামসুং-ভিডিওকনের জেল্লায় ঘরের চেকনাই বাড়ে। তাই পাঠ্যসূচি বদলানোর আশঙ্কা দেখা দেওয়া মাত্র এঁরা শোরগোল তোলেন, নানা অজুহাতে পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় বাধা দেন। কারণ, স্কুল-কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে এঁদের কাছে নতুন পাঠ্যক্রম মানে কেঁচে গণ্ডুষ করা যা কিনা তাদের বিবেচনায় অকারণ পণ্ডশ্রম। এঁদের একমাত্র নীতি হল; ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।
আসলে অধিকাংশ শিক্ষক এবং ছাত্রের কাছে পাঠ্যসূচি মানে কয়েকটি নির্দিষ্ট বই নয়, এদের প্রকৃত অর্থ হল মান্ধাতার আমল থেকে চলে-আসা কয়েকটি নির্দিষ্ট টপিক যাদের মধ্য থেকেও আবার চূড়ান্ত বাছাই করে কয়েকটি ছাঁচে-ঢালা প্রশ্ন পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার জন্যে তৈরি করা হবে। এবছর রাম এল তো ওবছর শ্যাম। থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাঁড়ি কমা পর্যন্ত বদলায়। এভাবে নতুন চিন্তা করতে অস্বীকার করে এবং পড়ানোকে খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে ছাত্রেরা তথাকথিত টেক্সট বই পর্যন্ত পড়ে না এবং রেফারেন্স বই-এর নাম পর্যন্ত না-জেনে পরীক্ষা-বৈতরণী দিব্যি পেরিয়ে যায়।
পরীক্ষক এবং অধ্যাপক নিযুক্তির প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকার ফলে আমার কিছু কিছু বোধোদয় হয়েছে। কী বরাক উপত্যকায় কী পশ্চিম বাংলায়, পরীক্ষায় পাওয়া মার্ক্স আর কোনোভাবেই জ্ঞানের পরিমাপক নয়। শতকরা পঞ্চান্নের বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও দশ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যও ভালোভাবে জানে না। নেট’ এবং শ্লেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে কুইজের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে ওরা যান্ত্রিকভাবে কিছু কিছু তৈরি হয় বটে, কিন্তু এর বাইরে গেলেই অথৈ জল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কারো কারো কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত যুগ-বিভাগ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের মতো বিখ্যাত লেখকদের দশটি বইয়ের নামও প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারে না। অন্য লেখকদের কথা ছেড়েই দিলাম। গত দশ-পনেরো বছরে প্রাতিষ্ঠনিক বাংলা বিদ্যাচর্চার যেসব বইপত্র বেরিয়েছে, তাদের সম্পর্কে কোনো কৌতূহল নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক সৃজনশীল সাহিত্যের কথা না তোলাই ভালো। আধুনিকতা বা রেনেসাঁস বা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলি সম্পর্কে ধারণা খুব ভাসা-ভাসা এবং নিতান্ত অগোছালো। এ এক ভয়াবহ সংকটের ছবি।
কিন্তু এইজন্যে শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের একতরফা ভাবে দায়ি করলে চলবে না। পাঠ্যসূচিকে যতক্ষণ সময়গাপযোগী না করা হচ্ছে এবং পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি আমূল পাল্টানো না হচ্ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, পরিবর্তন-বিমুখ শিক্ষক-সমাজকে তাদের জাড্য থেকে বের করে আনা না হচ্ছে—অন্তত ততদিন বাংলা বিদ্যাচর্চার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আরো একটি জরুরি কথা সরাসরি ও কর্কশভাবে বলে নেওয়াটা প্রয়োজন। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগে যে অজাচার চলেছে, তা আগামী প্রজন্মের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়। শিক্ষকতার সঙ্গে ভাবাদর্শ ও সামাজিক দায়বোধের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বড় কারণ, আমলা-মন্ত্রী-রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি কিনে নেওয়া হচ্ছে। এরা ছাত্রদের কী পড়াবে? বরং একথা লেখা যেতে পারে, ভুল পড়ানোর চেয়ে না পড়ানো অনেক ভালো। যোগ্য ব্যক্তিদের বঞ্চিত করে অযোগ্য ব্যক্তিরা প্রতাপশালী মহলের সুপারিশে সর্বোচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ছে। যোগ্য ব্যক্তিদের তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা নিশ্চয় অপরাধ; কিন্তু যে-পদ কোনো অযোগ্য ব্যক্তির প্রাপ্য নয়, তাকে তা পাইয়ে দেওয়া আরো বেশি অপরাধ। কেননা এ ধরনের শিক্ষক নামধারী ব্যক্তিরা বিদ্যাচর্চার ধার ধারে না। তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে সন্ধান করলে দেখা যাবে, এদের জীবনের ত্রিসীমানায় লেখাপড়া ও গবেষণা নেই। কিন্তু এইসব ব্যক্তির ছিদ্রপথেই বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বেনোজল ঢুকে যায়, এদের রাহুগ্রাসে নৈরাজ্য ক্রমশ শক্তিশালী হয়। এরাই ঈর্ষা-অসূয়া-বিদ্বেষ ও চক্রান্তের চোরাবালি তৈরি করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এদেরই ক্লেদাক্ত উপস্থিতির জন্যে ছাত্র-ছাত্রীরা চিরকালের মতো প্রকৃত বিদ্যার উত্তাপ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়।
স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকতার কাজে যুক্ত থাকার ফলে লক্ষ করেছি, নিচু স্তরে এখন আর ব্যাকরণ পড়ানো হয় না। বাংলা ভাষার প্রাথমিক বিধিগুলি। -জানার ফলে প্রতিটি স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সংক্রামিত হয় অমার্জনীয় গুরুচণ্ডালি দোষ, বানান সম্পর্কে হাস্যকর অজ্ঞতা এবং পদান্বয়ে—গুরুতর ত্রুটি। বেছে বেছে। পড়ানোর ফলে ভাষার কাঠামো কিংবা সাহিত্যের তাৎপর্য সম্পর্কে কোনো উপলব্ধিই তৈরি হয় না। বিদ্যালয় স্তরে অজস্র বিচ্যুতি যখন অভ্যাসের অঙ্গ হয়ে পড়ে, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেইসব শুধরে নেওয়ার আর কোনো উপায়ই থাকে না। বরাক উপত্যকার বাঙালি হিসেবে আমাদের কিছু বিশেষ সমস্যা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার সঙ্গে যারা যুক্ত, ওই সমস্যার গভীরতা কখনো তারা বিশ্লেষণ করেননি বা সমস্যা থেকে উদ্ভূত সংকটের নিরসন করার কথাও ভাবেননি। বিপুল বৈচিত্র্য সম্পন্ন বাঙালির ভুবনে উপভাষা ও বিভাষার প্রচলন রয়েছে। বেশ কিছু অঞ্চলে। কিন্তু ক কের বাঙালিরা যেভাবে উপভাষাকেন্দ্রিক অস্তিত্ব গড়ে তুলেছেন এবং বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নিজেদের বিড়ম্বনার কারণ নিজেরাই হয়েছেন—এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। ফলে এর সুযোগ কখনো কখনো বিভেদকামী মূখ শয়তানেরা নিয়েছে। আঞ্চলিক প্রভূত্ববাদীদের প্রশ্রয়ে বাংলার প্রতিস্পর্ধী এক বরাকী’ ভাষার প্রস্তাবনা করেছে। উনিশে মে-র চেতনা ইদানীং যেভাবে পুনর্জাগরিত হয়েছে, তাতে আশা করা যায়, এই স্পর্ধিত দুঃসাহস আর কেউ দেখাবে না। কিন্তু এর জন্যে আমরাও কি দায়ি নই অনেকটা! অন্য কোথাও উপভাষা ব্যবহারকারী জনতা মূল ভাষার প্রতি আনুগত্য শিথিল করেনি। আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে করে ফেলেছি। নইলে স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-আনুষ্ঠানিক সভায়ও কেন উপভাষা ব্যবহার করি আমরা? আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তো থাকবেই, কিন্তু তাই বলে শুদ্ধ উচ্চারণে শুদ্ধ পদান্বয়ে আমারই ভাষার শিষ্ট চলিত রূপ কেন বলতে পারব না? কেন এই উপত্যকার কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্র-ছাত্রী গবেষক-গবেষিকা আনুষ্ঠানিক সভায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারে উপভাষা আঁকড়ে থাকবেন? উনিশে মে-র শহিদেরা তো সিলেটি বিভাষার জন্যে প্রাণ দেননি, বাংলা ভাষার জন্যেই দিয়েছিলেন। এই অত্যন্ত মৌলিক ও প্রাঞ্জল কথাটি এখানকার উচ্চশিক্ষিত সমাজেও বারবার বুঝিয়ে বলতে হবে কেন? এ কি স্বতঃসিদ্ধ সত্য নয়?
ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-উত্তরবঙ্গ-বিশ্বভারতী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো উপভাষাভাষীদের প্রাধান্য। কিন্তু সেখানে তো একথা বলারই প্রয়োজন পড়ে না। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ঘরে-বাইরে লড়াই নিজেদের ভাষিক সত্তা ও স্বাতন্ত্র প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে। এই সর্বাত্মক লড়াইকে আমরাই কি দুর্বল করে দিচ্ছি না? অথচ আমরা প্রান্তিকায়িত অঞ্চলের মানুষ বলে নিজেদের পিছিয়ে-পড়া অবস্থানকে এগিয়ে-থাকা অঞ্চলের বিদ্যাচর্চার প্রতিস্পর্ধী করে তোলার জন্যে বাড়তি উদ্যম, একমুখিনতা ও অধ্যবসায়ের বড় প্রয়োজন ছিল। বরং নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মেরে চলেছি। আমাদের সংবাদপত্রগুলিতে ভুল বাংলা বানান ও ভুল পদান্বয়ের ছড়াছড়ি। সবচেয়ে বড় কথা, অসমিয়া-হিন্দি বাক্যাংশ ব্যবহার করে খিচুড়ি ভাষা তৈরি করছি আমরাই। এতে যে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের চতুর বিদূষণের শিকার হচ্ছি, এই সচেতনতা কেন থাকবে না আমাদের? নিচু শ্রেণীতে পাঠ্যবই তৈরির নামে পরিকল্পিত ভাবে বাংলা ভাষার গ্রন্থনাকে শিথিল ও ধ্বস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করার বদলে আমরা, বিশেষ ভাবে সমস্ত স্তরে বাংলা ভাষার শিক্ষক ও শিক্ষিকারা, প্রবাদের ‘কত রবি জ্বলে রে কে বা আঁখি মেলে রে’-এর দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছি।
হ্যাঁ, এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। প্রতিটি স্তরে পাঠ্যসূচিকে সময়োপযোগী ও যুক্তিসম্মত ভাবে পুনর্গঠিত করা হোক। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠদানের নতুন আদর্শ গড়ে তোলা হোক। অভিজ্ঞ শিক্ষাব্রতীরা সমস্ত স্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকা, গবেষক-গবেষিকা, সাংবাদিকদের নিয়ে একসঙ্গে আলাপ-আলোচনা-কর্মশালার ব্যবস্থা করুন। তাতে ব্যাকরণ-সচেতনতা, বানানবিধি, উচ্চারণ-বিধি, সাহিত্য-পাঠের নতুন প্রকরণ নিয়ে ব্যাপক ও গভীর আলোচনা হোক। পরের পর্যায়ে কর্মশিবির হোক সমস্ত স্তরের অন্তবৃত সঙ্গতিসম্পন্ন পাঠ্যসূচি, পরীক্ষাসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে। বাঙালির তৃতীয় ভুবন বলে নিজেদের অবস্থানকে শূন্যগর্ভ প্রশস্তি না করে তাকে সর্বতোভাবে সার্থকনামা করে তোলা হোক।
আসুন, উপভাষার শৌর্য ও লাবণ্য এবং তার খর চলিষ্ণুতা ও লোকায়ত ব্যাপ্তি আমরা, ‘কম’ বাঙালিরা শিষ্ট চলিত ভাষায় সংযুক্ত করি। ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ বলতে পারি যেন আরো বেশি গৌরবে ও সচেতন ভাবে। বাংলা ভাষার ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ নেমে এসেছে ইদানীং। তার মোকাবিলা করার জন্যে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা ও চিন্তাবিদদের মধ্যে নিয়মিত কার্যকরী বিনিময়ের ব্যবস্থা করি। গোড়া কেটে ডগায় জল ঢেলে কোনো লাভ নেই। নির্বাণে দীপে কি তৈলদান! হ্যালো মাম্মী হ্যালো ড্যাড্ডি ভ্যালেণ্টাইন ডে আর এস এম এস দেওয়া-নেওয়ার চোরাবালিতে নিমজ্জমান প্রজন্মের প্রতি কোনো দায়িত্ব যদি থাকে, তাহলে আর দেরি নয়। নকল ইংরেজিয়ানা আর হিন্দিয়ানার বুদ্বুদ-বিলাস শুধু পথভ্রষ্ট করতে পারে—এই আপ্তবাক্য বলে ওই দায় শেষ হবে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার নতুন দিগন্ত সন্ধান করতে হবে আমাদেরই। বেবিফুডে বিভ্রান্ত শুধু কিন্তু কিশোরেরা নয়, তাদের ধৃতরাষ্ট্র তুল্য অন্তরে-বাহিরে অন্ধ মা-বাবারাও। তাই মাতৃভাষা যে মাতৃদুগ্ধ সম, এই উপলব্ধি ফিরিয়ে আনতে গেলে ছোটোদের সঙ্গে বড়দের জন্যেও বিশল্যকরণীর ব্যবস্থা করতে হবে। আজ, এখনই, এই মুহূর্তে।
প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ, পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, বাংলা ভাষাবোধ পুনর্গঠনের পরীক্ষাগার হোক। ব্যাকরণকে অবহেলা করে নয়, ভাষা ও সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস কিংবা উপভাষা ও ভাষার ব্যবধান ভুলে গিয়ে নয়। কোর্স সিলেবাস, মার্ক ইত্যাদির চক্রব্যুহে অভিমুন্য হয়েও নয়। আন্তরিকতা ও অধ্যবসায়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নিয়ে।