সময় অসময় নিঃসময়/নিভন্ত এ চুল্লিতে সই একটু আগুন দে
নিভন্ত এ চুল্লিতে সই একটু আগুন দে
ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে। ইতিহাস পুড়ছে। সভ্যতা পুড়ছে। সংস্কৃতি পুড়ছে। দাউ দাউ আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছে এতদিনকার সমস্ত উপার্জন। সব কিছু ইন্ধন এখন। আসলে সময় নিজেই দাহ্য, নিজেই দাহক। পরিণাম বলে কিছুই নেই। পরিণাম এক বিভ্রম মাত্র, পরিণাম এক প্রহসন। ধারালো কুয়াশা ছেয়ে ফেলেছে চরাচর। তাই যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা। ইতিহাসের মৃত্যুর কথা বলে, সংস্কৃতির মৃত্যুর কথা বলে, মতাদর্শের মৃত্যুর কথা বলে, মানুষের মৃত্যুর কথা বলে। মুখ নয় শুধু, গোটা অবয়ব ঢেকে যাচ্ছে আঁচক্ বিজ্ঞাপনে। মুখ নয় শুধু, মায়াবী আরশিতে চলে। মুখোসের দেখাদেখি। জানাশোনা নয়, স্রেফ তাকিয়ে থাকা। কারণ, জানারও মৃত্যু হয়ে গেছে। মানুষ যে-দুনিয়ায় অস্তিত্বকেও প্রত্নতত্ত্বের বিষয় করে তোলে—সেখানে নির্দিষ্ট অবস্থান বলে কিছু থাকতে পারে না। সিচ্যুয়েশন নেই, নেই সিচ্যুয়েটেনেস। অতএব নেই সত্য-মিথ্যা, আলো-অন্ধকারের দ্বৈততা।
তাহলে, এখন প্রত্যাশাও নেই কোথাও। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া কেবল জরাজীর্ণ অভ্যাসের প্রাতিষ্ঠানিকতা। লক্ষ্য নেই কিছু, যাত্রাও নেই কোথাও। আসছে-আসছে ভাবতে-ভাবতে হৈ হৈ করে নয়, গড়াতে-গড়াতে চলে এল এবং গেল ধাঁধাছড়াননা ২০০০ সাল। নতুন অ্যালিসেরা সব চলেছে ওয়াণ্ডারল্যাণ্ডে, আয়নার বাইরে থেকে আয়নার ভেতরে। বাস্তব ধুলোমাটি ঢাকা রইল পেছনে। এখন থেকে সবই কুহকের বাস্তবতা। ত্রৈলোক্যনাথের কঙ্কাবতীর মতো ঘোরের ভেতরে চলে যাব সবাই। যা আছে সমস্ত বোহেঁসের লেবিরিনথ: স্তরের পর স্তর, সিঁড়ির পরে সিড়ি। বাস্তব থেকে ছুটি নিয়ে কুহকের গোলকধাঁধায় মিশে যাব। সামনে আছে ইশারা অবিরত: ক্লোনিং, কসমেটিক সার্জারি, সেক্স-ডল, ডেনিম-রেমণ্ড-পিটার ইংল্যাণ্ড দিয়ে মোড়া আর প্রায়-নগ্ন লাস্যময়ী তরুণী পরিবৃত সম্পূর্ণ মানুষের নতুন আধুনিকোত্তর চিহ্নায়ক, শৌর্য ও সাফল্যের নব্য চিহ্নায়ন প্রকরণের প্লাবন। এ এক বিকল্প জীবনের পাঠ। এই পাঠের জন্যে আমাদের তৈরি করে নিচ্ছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি যাদের দাপটে অতি দ্রুত মুছে যাচ্ছে রাষ্ট্র। সার্বভৌমত্ব, স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত্বের বিষয় হয়ে পড়েছে।
‘বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ, কেমনে দিই ফাঁকি/আধেক ধরা পড়েছি গো, আধেক আছে বাকি’—এ গানের আদি তাৎপর্য যা-ই থাকুক, এখন তা নয়া উপনিবেশবাদের জালে মাছির মতো বন্দী ভারতরাষ্ট্রের মর্মগাথা। হয়তো এ ভাষাও অতীতের ভাষা। কারণ, চার অধ্যায়ের এলা যেমন অতীনকে বলেছিল—তেমনি তো আমাদের দেশের বর্তমান কর্ণধারেরাও রাষ্ট্রকে বিশ্বপুঁজিবাদের স্বেচ্ছাবৃত মুৎসুদ্দি করে তুলে দিবারাত্র এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন: ‘দস্যু আমার, কেড়ে নিতে হবে না গো, নাও এই নাও। দুয়ার-ভেঙে এসে যাচ্ছেন জ্যোর্তিময় পশ্চিমীরা: প্রথম গেছে লজ্জা এবার যাবে একে একে সমস্ত ভূষণ। সবেমাত্র গেল বীমাশিল্প, তারপর যাবে ব্যাঙ্কিং। না, মুৎসুদ্দি রাষ্ট্র নিজের বলে কিছু রাখবে না আর। তোমার চরণে আমার পরাণে বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি/সব সমর্পিয়া একমন হৈয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী’-এই তো গাইছেন রাষ্ট্রনায়কের ছদ্মবেশে ইজারাদার মত্সবদারেরা। মার্কিনী শাহানশাহ গোটা দুনিয়ার ইজারা নিয়েছেন; তার রক্তচক্ষু ও জ্বভঙ্গে তৈরি হচ্ছে কত ইরাক-বসনিয়া-চেচেনিয়াকারগিল-ইন্দোনেশিয়া-আফগানিস্তানের রঙ্গভূমি। হর্ষদ মেহেতা-নরসিমা রাওমনমোহন সিং মশায়েরা পালাগানের সূত্রধার ছিলেন, তারপর নাচনকোঁদন করে ডুগডুগি বাজাতে-বাজাতে মঞ্চে এসে গেলেন স্বদেশি নামাবলী পরা পুরুতের দল। এঁরা একদিকে রুপার্ট মারডুকের মতো তিমিঙ্গিলদের কাছে তুলে দিয়েছেন তথ্যবিনোদনের কামধেনু, অন্যদিকে ত্রিশূলধারী শেয়ালদের লেলিয়ে দিচ্ছেন মহারাষ্ট্রে, রাজস্থানে, উত্তরপ্রদেশে, গুজরাটে। বিশুদ্ধ স্বদেশি মতে চরণ শাহ সতী হলো।
অযোধ্যায়-কাশীতে-মথুরায়-মোচ্ছব আবার লাগবে কি?
উলঙ্গের দেশে পোষাকের প্রয়োজন কী! একদিকে সামন্তবাদের অঘোরপন্থা ওঁ নমঃ শিবায়, শ্রী শ্রী হনুমান জাতীয় অন্তহীন ভিস্যুয়ালের সন্ত্রাসে মনকে পাথর করে দিচ্ছে, অন্যদিকে আধুনিকোত্তর প্রতিনন্দন কম্পিউটার প্রযুক্তিতে ভর করে বিজ্ঞানকেও বিভ্রম বলে প্রতিপন্ন করছে। অজস্র অধিবাস্তব বিদেশি ছবির মধ্য দিয়ে (যেমন ইণ্ডিপেণ্ডেস ডে, টার্মিনেটর, ফারস্কেপ, নাইটম্যান ইত্যাদি) দর্শক একসময় অসম্ভাব্য ভবিষ্যতের কৃষ্ণবিবরে ঢুকে যায় এবং যথাপ্রাপ্ত বাস্তবকে অসম্পূর্ণ, রিক্ত, পরিত্যাজ্য বলে মনে হতে থাকে তার। শনির থানে ভিড় বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত, মসজিদে-গুরুদ্বারে উপচে পড়ে বাঘে-গরুতে সহাবস্থান। এত সব উদ্ভটের পরস্পর সন্নিবেশ কাদের স্বার্থে মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে গত দশ বছরে, এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে না কোনো। কারণ, আমরা প্রশ্ন করতে শিখি না এবং প্রশ্ন করতে দেওয়াও হয় না আমাদের। সব কিছু মান্যতা পেয়ে যায় বলে অন্তরে-বাহিরে আমাদের উৎকট নগ্নতাও প্রতিভাবাদর্শের সমর্থন পেয়ে যায়। যেভাবে মহাকাশযান পৃথিবীর অভিকর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতায় দূর মহাশূন্যে পৌছে যায়, তেমনি প্রচণ্ড এসকেপ ভেলোসিটি নিয়ে আমরাও শতাব্দীর প্রদোষবেলায় ইতিহাস থেকে, সত্য থেকে, বাস্তবতা থেকে, সংস্কৃতি থেকে নামহীন রূপহীন চরিত্রহীন শূন্যতায় নিষ্ক্রান্ত হয়েছি। এখন আমরা প্রতিমুহূর্তে চিহ্নায়ক তৈরি করছি এবং ভেঙে ফেলছি। স্মৃতির ভারমুক্ত হয়ে সত্তার দায়মুক্ত হয়ে জমিয়ে তুলছি শুধু পুঞ্জপুঞ্জ অভ্যাসের ছাই। বর্তমানে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতে নিমিষে ভবিষ্যৎ অতীত হয়ে যাচ্ছে। যা যা হয়ে যাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসে ক্রমাগত পেছনপানে হাঁটছে যা যা আছে। এবং যা যা হতে পারত।
কিন্তু পুঞ্জ-পুঞ্জ ছাইয়ের মধ্যে কোথাও কি নেই এতটুকু আগুনের ইশারা? প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাস আরো বিকৃত, আরো আরো জরাগ্রস্ত হচ্ছে বলে কি আশ্চর্য থাকবে না কোথাও? আধুনিকোত্তর প্রতিজীবনের উদ্ধত মহড়া সত্ত্বেও সত্যের দ্বিবাচনিক উপস্থিতি তো অনস্বীকার্য। সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটবে নয়, ফুল ফুটছে। আছে, আছে, আশ্চর্য আছে, সংস্কৃতির কুসুম আছে। বিশ্বপুঁজিবাদ, বিশ্বমৌলবাদ, মরিয়াও-না-মরতে-থাকা সামন্তবাদের গাঁটছড়া সত্ত্বেও নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো নিঃসঙ্গ, পবিত্র, জেদি, অধ্যবসায়ী আগুন জ্বলছে। জেগে থাকার, জাগিয়ে রাখার আগুন। তা যদি না হত, শতচ্ছিন্ন বাঙালির ছন্নছাড়া ভুবনে নিশ্চয় ছোট পত্রিকার সমিধ আহরণ অব্যাহত থাকত না। আনখশির বিদূষণের উন্মত্ততা সত্ত্বেও পণ্যসর্বস্বতা-ভোগবাদ-কপটতা-অসূয়ার চক্রব্যুহ পেরিয়ে গিয়ে প্রতিস্রোত তৈরির দৃষ্টান্ত দেখা যেত না। পুরুলিয়া-বালুরঘাট-মেদিনীপুর- ধানবাদ- আগরতলাগৌহাটি-শিলচর-বগুড়া-সিলেট-চট্টগ্রাম-রাজশাহ-বরিশাল-গাইবান্ধার মতো জনপদে বেরোত না প্রতিস্রোতপন্থী ছোট কাগজ। স্বাতন্ত্রেই তাদের অভিজ্ঞান, তাদের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ। কেননা লিটল ম্যাগাজিনের সেনানীদের চেয়ে বেশি কে জানে আর, সমস্ত তাৎপর্যই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়! লেখা মানে যুদ্ধ, পত্রিকা মানে যুদ্ধক্ষেত্র; এই যুদ্ধে সিসিফাসের মতো অধ্যবসায় আছে শুধু, কেবলই পাথর চুড়োয় তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া নতুনভাবে শুরু করে যাওয়া। একটি সংখ্যার প্রকাশ মানে পরবর্তী সংখ্যার জন্য যুদ্ধাস্ত্রে শান দিতে শুরু করা, কেবলই এক লক্ষ্য থেকে অন্য লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাওয়া। এই যাওয়ার নাম জীবনানুশীলন, যার আরেক নাম সংস্কৃতি।
এইজন্যে শিলচরে প্রতিস্রোতের তরুণেরা এখানে মুঠোয় মশাল ধরে রেখেছেন। অতন্দ্র অনিশ শতাব্দী স্বপ্নিল উদর্ক শতক্রতু ইত্যাদির অগ্ন্যাধান ব্যর্থ হয়নি। অন্ধকার যখন গাঢ়তম, বরাক উপত্যকার বাঙালিরা প্রতিস্রোত ও সাহিত্যের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন জেগে থাকার প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতিপূর্ণ চিহ্নায়ক। পরিসররিক্ত অবস্থানেও উত্তর পূর্বের বাঙালিরা একা এবং কয়েকজন’, ‘পূর্বদেশ গল্পপত্র’, ‘পাহাড়িয়া’, ‘মুখাবয়ব’-এর মতো সময়সেনানীর যুদ্ধ-বার্তা ঘোষণা করতে পারেন। মহানাগরিক কলকাতায় এবং ঢাকায় পান্থপাদপ খোঁজার প্রয়োজন নেই এখন। আমাদের নিভন্ত চুল্লিতে আগুন যোগান দিয়ে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের দিকে তাকিয়ে জীবন ও পাঠকৃতির ভ্রান্ত পাঠ থেকে আমরা নিয়ত জায়মান মুক্তপাঠে যাওয়ার সংকেত বুঝে নিতে পারছি। সমীরণ মজুমদার (অমৃতলোক), আফিফ ফুয়াদ (দিবারাত্রির কাব্য), এজাজ ইউসুফী (লিরিক), মোস্তাক আহমেদ দীন (বিকাশ), ফারুক সিদ্দিকী (বিপ্রতীপ), সরকার আশরাফ (নিসর্গ), অমিত দাস (উত্তরাধিকার), সুবল সামন্ত (এবং মুশায়েরা), অঞ্জন সেন (গাঙ্গেয়পত্র), উৎপল। ভট্টাচার্য (কবিতীর্থ), পাঠকৃতি (শুভেন্দু ইমাম) এবং এরকম আরো অনেক যোদ্ধা শৌর্য ও লাবণ্যের যুগলবন্দি অক্ষুন্ন রাখছেন। কত ভিন্নতা তাদের অবস্থানে। আধুনিকোত্তর কালবেলায় দাঁড়িয়ে তাদের সামূহিক উপস্থিতি আর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াণ-পটভূমিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বুঝতে পারি।
‘কোথাও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই’-জীবনানন্দের এই গহন উপলব্ধি হয়েছিল অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের আগ্রাসী চোরাবালি লক্ষ করে। আমিষ অন্ধকারে কত শত সূর্যকে ডুবে যেতে দেখেছিলেন তিনি, ক্লান্ত পৃথিবীর বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে তার চোখে পড়েছিল শতশত শূকরীর প্রসব-বেদনার আড়ম্বর। জীবনের অন্তর্নিহিত দ্বিবাচনিকতা পুনরাবিষ্কারে ও পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। আলো যে গভীরতর হয় অন্ধকারে এবং মানুষের মৃত্যু হলেও মানব বেঁচে থাকে—অলঙ্ এই সত্য তার উচ্চারণে ফিরে ফিরে এসেছে তাই। আধুনিকোত্তর পর্যায়ের ক্রমবর্ধমান গ্লানির আত্মবিদারক হাহাকারে দীর্ণ হতে হতে পুনঃপাঠ করতে পারি জীবনানন্দের সময়মনকেও। নিশ্চিত খুঁজে পাব আমরা অম্লান বিশল্যকরণী। দেখব, হাজারবার ইতিহাসকে মৃত বলে ঘোষণা করলেও তা তথ্যের কঙ্কালমাত্র নয়। এখনো ইতিহাস খুঁড়লে পাওয়া যায় শত শত জলঝর্নার ধ্বনি, উত্তরায়ণ মনস্কতার সংকেত। জীবনানন্দ যে উত্তর-ব্যক্তিসত্তার কথা বলেছিলেন, এখনই তো তার যথার্থ তাৎপর্য ও গঠনশৈলী আবিষ্কার করার সময়। শুধু দ্রষ্টা চক্ষু চাই আজ। তেমন চোখ যা শুধু তাকিয়ে থাকার জন্যে নয়, দেখার জন্যে। হয়তো তখন অনেক অদৃশ্য পর্দা সরে যাবে। অতিপরিচয়ের অভ্যস্ততা যে কুয়াশার আড়াল তৈরি করে, তা সরিয়ে দিয়ে পুরনো মুখের মধ্য থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে নতুন অবয়ব। নতুন সত্য, নতুন উপলব্ধি। দেখব, উত্তর-ব্যক্তিসত্তার প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের খুব কাছাকাছি। বুঝব, সংস্কৃতি জীবন সংগঠক, উন্মোচন ও প্রসারণ তার স্বভাবধর্ম।
অবস্থানগত যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে কোনো-এক হরিমাধব মুখোপাধ্যায় যখন বালুরঘাটে ত্রিতীর্থের মতো অসামান্য লড়াকু নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করেন কিংবা ওই একই শহরে অজিতেশ ভট্টাচার্য ৩৪ বছর ধরে মধুপণীর মতো সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেন তারা নিশ্চয় উত্তর-ব্যক্তিসত্তার প্রতিভূ হিসেবে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেন। তেমনি বরাক উপত্যকার সবচেয়ে পশ্চাৎপদ শহর হাইলাকান্দিতে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের ‘সাহিত্য’ তিন দশকব্যাপী যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে চিহ্নয়কে রূপান্তরিত হয়। বাঙালির বিভিন্ন জনপদে সমীরণ মজুমদার, অখিল দত্ত, দেবব্রত দেব, উত্তম দাশ, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরকার আশরাফ, ফারুক সিদ্দিকী, বিভাস চক্রবর্তী, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, অঞ্জন সেন, হাসান আজিজুল হকেরা প্রমাণ করছেন, অনেকান্তিক মৃত্যু-উপত্যকায় পারাপারহীন সন্ধ্যা নেমে এলেও মানুষ অপরাজেয়। ইতিহাস ও সভ্যতা যতই পুড়ে যাক, উত্তরব্যক্তিসত্তা অজর অক্ষয়। এইজন্যে শিলচরের মতো প্রান্তিক জনপদেও আমাদের উদ্যোগহীন স্বপ্নহীন সংকল্পহীন মেকি অস্তিত্বের স্থবিরতাকে সমূহ লজ্জিত করে ৭২ বছরের চিরতরুণ মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন নাচের ললিত ছন্দ। ধ্রুপদী ও লোকায়ত শিল্প-ভাবনার সুষম সমন্বয়ে তার প্রতিটি সঞ্চালনে প্রতি মুদ্রায় নাচ নয়, আসলে জীবনের অফুরান সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা পুষ্পিত হয়ে ওঠে। অবক্ষয়বাদের সমস্ত কৃৎকৌশলকে পরাভূত করে মুকুন্দদাস আমাদের ফিরিয়ে দেন যেন জীবনকে নতুনভাবে ভালোবাসার জোর, বিশ্বাসের শক্তি, দেখার ক্ষমতা। মানুষ যে আজও কত বিস্ময়ের দীপাধার, নৃত্যগুরুর প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি অঙ্গ-সঞ্চালনে সেই বার্তা উঠে আসে। আমরা তখন পাশের মানুষটিকে মানবিক স্পর্ধায় বলতে পারি, আছে, আললা আছে সব অবভাস পেরিয়ে।
এমন উচ্চারণে স্থিতধী আত্মদীপ হওয়ার নামই তো সংস্কৃতি। এই হওয়ার আর হয়ে ওঠার কোনো সমাপ্তিবিন্দু নেই, নতুন নতুন আরম্ভ আছে শুধু। সব ধরনের ধারাবাহিকতা মুছে ফেলার সন্ত্রাসী চক্রান্ত সত্ত্বেও ফিরে দেখা আছে। বাঙালির তিন ভুবনে রূপকথার রাক্ষসখোসদের নিদালির মন্ত্র আধুনিকোত্তর আঙ্গিকে ব্যবহৃত হচ্ছে। যখন, ঘুমঘোরে অনেকের আত্মা আচ্ছন্ন। ধর্মের মাদক, আঞ্চলিকতার মাদক, বিশ্বায়নের মাদক সুস্বাদু ঘুমের ঘেরাটোপ তৈরি করে দিয়েছে আমাদের জন্যে। আমরা আজ জানি, আমরা কী এবং কারা! কী আমার পরিচয়, মা’ এই অবোধ প্রশ্ন জাগে না বলে মাঝরাতে বারবার ভিত্তারা হতে হয় আমাদের। পাঠ দিতে পারে, দেয় শুধু সংস্কৃতি! বিভাস চক্রবর্তী মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ কিংবা হরিমাধব মুখখাপাধ্যায় ‘দেবাংশী’ নাটকে ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণকে প্রয়োগের মৌল আধেয় করে তোলেন আর সেলিম আলদীন পরম্পরার নিবিষ্ট পুনঃপাঠে নাট্যবস্তুকে আধারিত করেন-বুঝে নিই, আমরা যা ছিলাম তাতেই তারা অস্তিত্বের নির্যাস সন্ধান করেন। শওকত আলী যখন তন্নিষ্ঠ আন্তরিকতায় তুর্কি আক্রমণের অব্যবহিত পূর্ববর্তী বাংলাদেশের উপন্যাসবীজ আহরণ করে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখেন কিংবা সেলিনা হোসেন ‘নীল ময়ূরীর যৌবন লেখার জন্যে চর্যাপদের সময় ও পরিসরকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করেন-বুঝি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতিবেদনে শেষ কথা নেই কোনো। আছে শুধু প্রাক্তন আলোক-উৎস থেকে দীপ জ্বালানো নবীন অধ্যবসায়। আর, এভাবে নিজেদের পরিচয় যাচাই করে নেওয়া। যে-পথ হারিয়ে গেছে কখননা, সে-পথে পুরনো রীতিতে। পথিক হওয়া যায় না হয়তো, পথ পুনর্নির্ণয় নিশ্চয় করা যায়। কারণ, শুধু একান্তিক বিচ্ছেকে মান্যতা দিয়ে ইতিহাসের প্রান্ত পাঠ করি; বিচ্ছেদ ও ধারাবাহিকতার দ্বিরালাপ আবিষ্কার করে বরং সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারি।
সৃষ্টি এভাবেই হতে পারে, হয়ে থাকে। কেননা সার্থক সৃষ্টি কোনোনা-কোনোভাবে পুনঃসৃষ্টি মাত্র। অস্তিত্বের অনুশীলন করে সংস্কৃতির আনন্দকুসুম ফুটিয়ে তোলা। এ যে আপ্তবাক্য নয়, তার চমৎকার প্রমাণ পেয়েছি বাংলাদেশের বগুড়ায়। ধূসর অতীতের পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের স্মৃতি বাহ্যত এখন নিরালম্ব। পাহাড়পুর বিহার ও মহাস্থানগড়ের প্রায় অদৃশ্য ধ্বংসাবশেষে আর শীর্ণকায়া করতোয়া নদীর প্রায়-অনুপস্থিত উপস্থিতিতে ইতিহাসের সমস্ত চিহ্নায়ক কার্যত বিলুপ্ত। তবু সন্দেহ নেই, বগুড়ার আকাশে-বাতাসে স্পন্দিত অনুরণিত হচ্ছে ইতিহাস। একবার (২৩ অক্টোবর, ১৯৯৯) ইংরেজ আমলের জরাজীর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘কথা পুণ্ড্রবর্ধন’ নামে নাটক দেখার সুযোগ হয়েছিল। কার্তিক মন্দিরের দেবদাসী কমলা ও কাশ্মীরের সিংহাসনচ্যুত রাজা জয়াপীড়ের শিল্পিত প্রেম, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজকন্যার চক্রান্ত, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও বৌদ্ধধর্মের বিরোধ, অন্তঃসারশূন্য আচারধর্ম ও মানবিক উপলব্ধির দ্বন্দ্বের পটে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত জয়াপীড়ের পুণ্ড্রবর্ধন আক্রমণ এবং স্বদেশকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েও চক্রান্তের শিকার কমলার আত্মবিসর্জন: এই হল মোদ্দা বিষয়। কিন্তু এহ বাহ্য। বগুড়ার প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে বগুড়া থিয়েটারের এই অসামান্য নাট্যপাঠকৃতির রচনা এবং হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির সাধারণ ঐতিহ্যভাণ্ডারে উত্তরাধিকার সন্ধান—এই বিষয়টি এ সময়ের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ক। নাটক অভিনীত হওয়ার পরে সতেরো বছরের তরুণী থেকে পঁচাত্তর বছরের প্রবীণ অভিনেতার জ্বলন্ত উৎসাহ দেখেশুনে মানুষের ওপর এবং সংস্কৃতি নামক প্রাণভ্রমরের ওপর অস্খলিত বিশ্বাস যেন ফিরে পেয়েছি নতুন করে।
‘কথা পুণ্ড্রবর্ধন’-এর নাট্যকার তৌফিক হাসান ময়না গ্রন্থনাতে প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। কারণ সংস্কৃত ও পালি মন্ত্র এবং হিন্দুধর্মের আচার অনুষঙ্গ সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার মতো উৎসুক জন খুব বেশি নেই ওই অঞ্চলে। পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ নাটকের আগে এবং পরে জানালেন, সাধারণত সংস্কৃতি এবং বিশেষভাবে নাট্যসংস্কৃতির স্বার্থে তিনি বাঙালির উৎস-সন্ধানে যাত্রা করেছেন। পুণ্ড্র অঞ্চল মনসামঙ্গল কাব্যেরও পৃষ্ঠভূমি। অতএব তার পরবর্তী নাট্যবীজ আহরণের জন্যে তিনি বাঙালির ওই ঐতিহ্যভূমিকে খনন করবেন। শুনি আর অভিভূত হই। ভাবি, বরাক উপত্যকার কুয়োবাসী বাঙালি আমরা, নিজেদের আগে হিন্দু মনে করি কিংবা মুসলমান। বগুড়া থিয়েটার ২৯ মে ১৯৮০ থেকে নিভন্ত চুল্লিতে আগুন যোগান দেওয়ার যে অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, “রি সামাজিক তাৎপর্য মৌলবাদ-লাঞ্ছিত পরিসরে সবচেয়ে বেশি প্রকট। বগুড়ার বার্তা বরাকে নিয়ে যাওয়া যায় না? মনে পড়ে গেল উত্তরবঙ্গে বাগডোগরায় আরো একজনকে জানতাম। তিনি পেশায় চিকিৎসক, নেশায় নাট্যকার ও পরিচালক, ডাক্তার দেবপ্রসাদ কর। নিভন্ত চুল্লিতে আগুন যোগান দিয়ে যাচ্ছেন তিনিও। শশাষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন এবং অন্যদের দেখান। খাঁটি বাঙালি না হলে যে খাঁটি মানুষ হওয়া যায় না, এই জেনে তিনি বাঙালির হারানো পৃথিবী খুঁজে যাচ্ছেন দুর্মর জেদে ও বিপুল তিতিক্ষায়। লিখতে পারি শিলচরের ছন্দোময় তরুণ জয়ের (যার পোশাকি নাম সৌমিত্রশঙ্কর চৌধুরী) কিংবা গানে-গানে ভুবন পরিক্রমায় মগ্ন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের কথা। জয়ের নাচ আর শুভর গান যে ঘুম-ভাঙানিয়া সোনার কাঠি। তাই ওরা দুঃসহ আঁধারে জেগে থাকা ও জাগিয়ে রাখার ব্রত নিয়েছে। লিখতে পারি নাটকের শিল্প, সংবেদনাকে জীবনের মুখরিত সখ্যে নিয়ে-আসা শেখর দেবরায় ও বিশ্বজিৎ দাসের কথাও যারা বিদূষণের হিংস্র তাণ্ডবের মধ্যে নীল আকাশ আর নির্মল সুপবনের কথকতা করে। শৈশবের অমল ধবল পাল উড়ছে তাই শিলচরে, ফিরে এসেছে বিশ্বাস: আছে আছে জীবন আছে উত্তাপ আছে। সৌন্দর্য আছে। জয়-শুভ-বিশ্বজিৎ-শেখরের অস্তিত্বে মিশে যায় তৌফিক-দেবপ্রসাদের অবয়ব। আর সিলেটের শুভেন্দু ইমাম-লীনেন-বাবু-বান্না-দীনদের আস্তিত্বিক মূর্ছনা। জীবনের সংস্কৃতিই তো বাঙালির সংস্কৃতি: এই বার্তা উঠে আসে তাদের সমবায়ী উপস্থিতি থেকে।
এইজন্যে ‘বগুড়া থিয়েটারের কথা’ নামক ছোট্ট প্রতিবেদন পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আধুনিকোত্তর পিশাচ-সময়ে তিন ভুবনের বাঙালিরা তো যাত্রী একই তরণীর। ওরা আর আমরা—এই বিভাজন কে করে? এই বার্তা কি নয় প্রত্যেকের: ‘আমাদের জনগোষ্ঠীর মন মানসিকতায় যখন সামত্ত সংস্কৃতির অবশেষসমূহ শিকড় গেড়ে বসে আছে, যে মুহূর্তে সমাজের কর্ণধারেরা পুরনো বস্তাপচা প্রতিক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে লালন করে চলেছে, পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক জোয়ারে যখন দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে ঠিক সে মুহূর্তে শোষণ নিপীড়নই যে শেষ কথা নয়, যুগ যুগান্তরে সঞ্চিত বিক্ষোভের ঘনীভূত পরিণতিতে নতুন দিন আসছে, আসবেই, মানুষের মনের জমিতে নাটকের মাধ্যমে এ বিশ্বাসের শিকড় গাড়তে এবং দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সবার মাঝে তুলে ধরার মানসে তাদের আত্মপ্রকাশ। এবং সবার, সমস্ত সংস্কৃতিযোদ্ধার!
অতএব ইতিহাস-সংস্কৃতি-সভ্যতা-ব্রহ্মাণ্ড নয়, অভ্যাসের অবসাদ পুড়ছে। আগ্রাসী লোভ পুড়ছে ইন্ধনসহ। মানুষ নয়, মানুষের ছদ্মবেশ পুড়ছে। পুড়ুক। নিভন্ত এ চুল্লিতে সই আগুন ফলেছে।
২
অদ্ভুত আঁধার নেমেছে বাঙালির ভুবন জুড়ে। শুধু যে অন্ধজনেরা সবচেয়ে বেশি দেখার ভান করছে এখন, তা-ই নয়। আত্মঘাতের মাদক ব্যবহারের কত রকম বিধি রপ্ত করছে বাঙালি। একুশ শতকের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভাবছি, উদীয়মান এ-শতকে আমাদের সামূহিক সত্তার সমস্ত অভিজ্ঞানই ধূসর স্মৃতির মহাফেজখানায় মূঢ় অবহেলায় জমা দিয়ে এলাম নাকি? বিশ শতকের গোড়ায় জোর ঝটকা লেগেছিল বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে। তখন না হয় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন! বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার মন এক হোক, এই ইচ্ছে জানিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। আর ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, অকালপ্রয়াত হওয়ার আগে তিনি বাঙালির জন্যে স্বরাজের নতুন তাৎপর্য বয়ে এনেছিলেন। জাতীয় মনন ও স্বপ্ন জাগানোর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে নিঃশব্দ চরণে পেরিয়েও গিয়েছিল! জীবনানন্দ ওই মুহূর্তের স্বপ্নসম্ভব পাঠসংহতি তৈরি করেছিলেন রূপসী বাংলার কবিতাসন্দর্ভে। ছিলেন নতুন পথের দিশারি ঘুম-ভাঙানিয়া নেতাজী সুভাষ। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির ভূখণ্ড নয় কেবল তার ঐতিহ্য সংস্কৃতি, তার স্মৃতি ও বিবেক পর্যন্ত বিভাজিত হয়েছিল। উপনিবেশগ্রস্ত মন দিয়ে রাজনৈতিক ঠিকাদারেরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ঢোল-শহরৎ করেছিলেন তখন। অসহায় সাধারণ মানুষ, ক্লাইভের আমলের মতোই, জেগে ঘুমোচ্ছিল। সবাই বলেছিলেন পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার মধ্যে বাঙালি সত্তার দ্বিধাবিভাজনের কথা। কেউ ভেবে দেখেননি, এ আসলে ত্রিধা কিংবা বহুধা বিভাজন। দেখেননি, প্রান্তিকায়িত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা আরও ব্রাত্য হয়ে গেলেন। এবং, স্বাধীনতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্যের অনন্বয় দিনানুদিন তীব্রতর হল কিনা সংকীর্ণ আঞ্চলিক চেতনার আগ্রাসনে—এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না কোথাও। উগ্র আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের অনিবার্য পরিণামে বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছিল বাঙালির ভাষিক স্বাতন্ত্র মুছে ফেলার চেষ্টা। বারবার তাই ছিন্নমূল হতে হয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিকে। দেশবিভাজনের ফলে কয়েক পুরুষের বাড়ি-জমি তো শুধু ছাড়তে হয়নি, তারা উৎখাত হয়েছিলেন বিশ্বাস-সংস্কৃতি-মানবিক সম্পর্কের প্রত্যয় থেকেও। এর বিষক্রিয়া কত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এর প্রমাণ অহরহ পাচ্ছি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিদের মধ্যে মৌলবাদী ভাবনার প্রাধান্যে। যাঁদের কোনোদিন ভিটেমাটি ছাড়তে হয়নি, তারা কোনোদিন বুঝবেন না কেন এইসব ছিন্নমূল মানুষের চেতনায় ইতিহাস নিছক খলনায়কদের তৈরি জঞ্জালের স্থূপ মাত্র। এরা জীবন ধারণের তাগিদে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ত্রিপুরায়, আসামে, মেঘালয়ে। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করতে করতে সবেমাত্র যখন পা রাখবার এক চিলতে জমি খুঁজে পাচ্ছেন—ঠিক তখনই তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদীরা। আর, সর্বস্ব খুইয়ে নতুনভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছেন তাঁরা।
বহির্ভারতের অন্যান্য অংশ তো দূর অস্ত, পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা এসব খবর কি রেখেছেন কখনো? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে খোলাখুলি লিখছি, ত্রিপুরায় বাঙালি আছে—এটা জানলেও আসাম মেঘালয় সম্পর্কে অনেক বিচিত্র সব ধারণা নিয়ে রয়েছেন তারা। আসামে বাঙালির সংখ্যা কতটা এবং বরাক উপত্যকা যে মূলত বঙ্গীয় সংস্কৃতির শেষ আউটপোস্ট—এ বিষয়ে এঁরা কিছুই জানেন না এবং জানতে চান না। বহু উপভাষায় বিন্যস্ত বাংলা ভাষা সম্পর্কে, বলা ভালো, উপভাষা-অঞ্চল সম্পর্কে কৌতুক ও তাচ্ছিল্য আছে—এইমাত্র। সবাই সুকুমার সেন বা সুনীতি চাটুজ্যে পড়ে মাতৃভাষার সমৃদ্ধি বিষয়ে অবহিত হবেন, এতটা আশা করি না। কিন্তু অস্তেবাসী বাঙালিরা কিছুমাত্র ‘কম’ বাঙালি নন তাদের তুলনায়, এইটুকু অন্তত জানবেন তো! বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে এবং বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা করার বিচিত্র সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত হয়েও যাঁরা লড়াই করছেন, তাদের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। আমরা ইহুদিদের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করি, কিন্তু বাঙালির তৃতীয় ভুবনে অহরহ কী ঘটছে, সে বিষয়ে অণুমাত্র আগ্রহ দেখাই না। বরাক উপত্যকায়, মেঘালয়ে তো বটেই, আসামের অন্যান্য অঞ্চলে, নাগাল্যাণ্ডে, মণিপুরে বাঙালিদের ধোপানাপিত যে কবেই বন্ধ হয়ে গেছে—সে-খবর রাখি কেউ? আমরা জানি, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা ভাষার জন্যে শহিদ হয়েছিল বরকত-সালাম-জব্বারেরা। কিন্তু, এখনও আমরা অনেকে জানি না ১৯৬১ সালের ১৯মে শিলচর শহরে (দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকার সদর শহর) একটি তরুণী সহ ১১টি তরুণ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইতে শহিদ হয়েছিল। শিলচর রেলস্টেশনে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর আসাম পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল। দশ ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন প্রাণ দিয়েছিল কেননা বাংলা ভাষায় কথা বলত। ওরা। স্বাধীন ভারতবর্ষে এমন ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে কি?
১৯৬১ সালে থেমে যায়নি রক্তস্রোত। ১৯৭২ সালে আরও একজন আর ১৯৮৬ সালে দুজন শহিদ হয়েছে। বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা, কিন্তু খিড়কি দুয়ার দিয়ে ঢুকে পড়ছে অসমিয়া। এই মুহূর্তে বরাক উপত্যকায় আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত দুবছর ধরে ২৫ বৈশাখ উদ্যাপনে বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে প্রশাসন। এদের স্পর্ধা দিনদিন বাড়ছে। যেভাবে বঙ্গভাষাভাষী গোয়ালপাড়া জেলাতে ভাষিক সম্প্রসারণবাদীরা অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, তেমনি ওদের আগ্রাসন ইদানীং শুরু হয়েছে বরাক উপত্যকায়। ইতিহাসের নিয়মে যা ঘটে থাকে, ট্রয়ের ঘোড়া তৈরি হয়ে গেছে অনেক। তৈরি হয়ে গেছে ফেউয়ের গোষ্ঠী, ভাড়াটে কলমচি আর উচ্ছিষ্টজীবীর দল। একদিকে অসমিয়াকরণের জাল, অন্যদিকে নিকৃষ্ট হিন্দিয়ানির চাপ। তাছাড়া সব কিছুর উপরে রয়েছে বিশ্বায়নের মাদক। অসংখ্য চ্যানেল দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বিবেকশূন্য ভোগবাদের নীলস্বপ্ন। ভাষা-সংগ্রামের উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে উঠেছিল বরাক উপত্যকায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এক দশকেরও বেশি লড়াইয়ের পরে ১৯৯৪ সালের ২১ জানুয়ারি যদিবা জন্ম দেখলাম তার, ঐতিহ্যবিচ্যুত আত্মবিস্মৃত প্রজন্ম ভুলে যেতে বসেছে এই ঘটনার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে শোনা যায়, বাঙালি ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ফিল্মি হিন্দিতে বা ইংরেজিতে। চারদিকে শুধু ধূসর রিক্ততার ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়, জীবনানন্দের অনুপম ত্রিবেদী আর সুবিনয় মুস্তাফীরা বাঙালির তৃতীয় ভুবনের গভীর-গভীরতর অসুখের সূত্রে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এখনই।
বিশ শতকের বাঙালির অর্জন কি তাহলে নেতিবাদ ও আত্ম-নিরাকরণের বিস্তার? ১৯৪৭ সালে আমরা তো বাঙালি পরিচয়ে দাঁড়াতে চাইনি, দাঁড়িয়েছি হিন্দু ও মুসলমানের পরিচয়ে। আত্মপ্রতারণার শুরুও হল তখন। ভারতবর্ষ মানে হিন্দুদের বাসভূমি, একথা ঔপনিবেশিক ন্যায় অনুযায়ী মেনে নেওয়ার পরে বাঙালি ও ভারতীয় এই দুই অভিজ্ঞানের গৌরবই অনেকটা অস্তমিত হল নাকি? এর পরে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা অবিরাম করলাম বটে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর থলে থেকে বেড়াল তো বেরিয়ে পড়ল। অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও, বিভ্রান্ত ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতো, বাঙালির ভুবনেও তো কালো ছায়া পড়েছিল ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’র। কোথায় থাকল তখন আলাওল-নজরুল-ওয়ালীউল্লাহ-শহীদুল্লাহের উত্তরাধিকার? এর পরে বারো বছর যেমন গোটা ভারতবর্ষের জন্যে অন্ধকারে পিছলে যাওয়ার সময়, তেমনি বাঙালির পক্ষেও খুব উজ্জ্বল নয়। বিশেষত তৃতীয় ভুবনের অস্তেবাসী বাঙালিদের ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত জটিলতার জন্যে এসময় আত্ম-নিরাকরণের, ভেসে যাওয়ার। কেননা বাঙালি ভুলে যেতে বসেছে কোথায় তার সাংস্কৃতিক গৌরবের মূল কারণগুলি নিহিত। বরং, বাঙালিত্ব মুছে নিয়ে প্রাণপণে হয়ে উঠেছে। আর্যাবর্তের পিছিয়ে-পড়া ভাবনার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের স্বদেশ-ভোলানো শেকড়-উপড়ানো চিন্তার লেজুড়। গত কয়েক বছরে ঘড়ির কাটাকে উল্টো পাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রান্তিক অঞ্চলে চোখে পড়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে শনি মন্দির প্রতিষ্ঠা, ধর্মগুরুদের উৎকট বিজ্ঞাপন-মুখর উৎসবের আয়োজন, অন্যদিকে মসজিদে-মোক্তবে বিচিত্র সব প্রচারকদের হঠাৎ বেড়ে-যাওয়া আনাগোনা। যাঁরা কিছুদিন আগেও শুধু বাঙালি ছিলেন, এখন তারা নিজেদের জুড়ে দিচ্ছেন হিন্দুস্রোতে কিংবা মুসলমানস্রোতে। এবং, এঁদেরই ঘরের ছেলেমেয়েরা ভর্তি হচ্ছে সাহেবি কেতার ইশকুলে। শিখছে কুইজ, শিখছে অত্যাক্ষরী। কিন্তু কেউ মাতৃভাষা শিখছে না। মা-বাবারা এদের তাড়না করছেন সব কিছুতেই প্রথম হওয়ার জন্যে। যে-কোনো মূল্যে সাফল্য চাই। এদের মানসিকতা জুড়ে প্রতিযোগিতা, অসহিষ্ণুতা, ঈর্ষা; সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মানিয়ে নেওয়া, মান্যতা ইত্যাদি এদের কাছে হয়ে উঠছে জীবনের পক্ষে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক আভিধানিক শব্দমাত্র। এরা যে বাংলা লিখতে পড়তে জানে না, এজন্যে অপরাধবোধ দূরে থাক, ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। এরা টিভির চ্যানেলে-চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়, মা-বাবার উপস্থিতিকে তোয়াক্কা না করে শরীরী মাদকের অমৃতফল খায়। এদের কোনো পক্ষীরাজ ঘোড়া বা বেঙ্গমা বেঙ্গমী নেই, আছে কেবল ভিডিও গেম বা কম্পিউটারের ইন্দ্রজাল। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-জীবনানন্দ নজরুল-সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াস-জয়নাল আবেদিনদের নিয়ে বিশ শতকের প্রত্নবস্তু হিসেবে রুদ্ধ হয়ে যাবে বাঙালির পরিচয়। একুশ শতকে কম্পিউটারইণ্টারনেট-উপগ্রহ-প্রযুক্তির চক্রব্যুহে স্বেচ্ছাবন্দী প্রজন্মগুলি আর যা-ই হোক বাঙালি থাকবে না। কিন্তু গণেশ দুধ খেতে থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, মোল্লাতন্ত্র জাঁকিয়ে বসবে আরও। এইসব সাধারণ সত্যের অতিরিক্ত বিশেষ কিছু সত্য রয়েছে উত্তরপূর্ব ভারতের প্রান্তিকায়িত বাঙালির জন্যে। তাদের পায়ের নিচে শক্ত জমি নেই, চোরাবালি আছে। আঞ্চলিক উপনিবেশবাদের কাছে স্বেচ্ছাসমর্পিত হওয়াতে ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে শিরদাঁড়া আর পায়ের নিচে অনবরত ঝুরঝুর করে সরে যাচ্ছে বালি।
প্রতিটি আগামীকালই তাই হয়ে উঠছে আরও একটু পঙ্গু, আরও একটু বিকৃত আগামীকাল। যেখানে বারুদ থাকার কথা ছিল, সেখানে শুধু পুঞ্জ পুঞ্জ ছাই। এই ছাই এমন যার তলায় ধিকি ধিকি আগুনের আঁচ নেই কোনো। নির্ভেজাল ধূসর ও কালো আখরে সময় লিখে চলেছে রূপহীন চরিত্রহীন কৃষ্ণবিবরের কথকতা। বাঙালির তৃতীয় ভুবনে যদিও সাহিত্য-সংস্কৃতির টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এখনো, লক্ষ্যশূন্য তাৎপর্যশূন্য উদ্যমের ফলে ওই আলোকেও গিলে খেতে চাইছে ছায়া ও প্রচ্ছায়া। রূপকের ভাষা এসে গেল বটে, কিন্তু আসলে এ ঘোর বাস্তব। প্রান্তিকায়িত বাঙালি সত্তা সমান্তরাল অপরতার মধ্যে সৃষ্টির উত্তাপসূত্র খুঁজে নেওয়ার পদ্ধতি ও প্রকরণ ভুলে যেতে বসেছে। ছোট পত্রিকাগুলি হয় মৃত নয়তো অর্ধমৃত। ব্যক্তিগত উদ্যমের পুঁজি কিছুতেই সামূহিক উদ্যমের সম্পদে রূপান্তরিত হচ্ছে না। তার ওপর নেই উদ্যমের ধারাবাহিকতা, নেই তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে গভীর কোনো উপলব্ধি। এক দশকের অনেক আগেই ভেঙে যাচ্ছে সংঘ, তেল ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ঝরে পড়ছে সলতে। ফলে সস্তায় বাজিমাত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিপুল ও অবিভাজ্য বাঙালি সত্তার সাংস্কৃতিক আয়তনে নিজস্ব বৈচিত্র্য ও জীবনানুভবকে প্রতিষ্ঠিত করার জরুরি কাজ উপেক্ষা করে এক ধরনের ভুল আঞ্চলিকতার ছোটো মাপ তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে। কূপমণ্ডুকতার সর্বগ্রাসী ছায়া সঞ্চারিত হচ্ছে সমস্ত কাজে লেখায় চিন্তায়, আন্তঃসম্পর্কের বয়ানে।
যখন ভাবি প্রথম ভুবনের কথা, দেখি যে, বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্বের ভুল দ্বন্দ্ব সম্পর্কে প্রবল ঔদাসীন্য অন্য-এক ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা তৈরি করেছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এমন-এক নব্য মুষলপর্বের লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠছে ক্রমশ, যার অভিঘাতে ভণ্ডামি, কৃত্রিমতা, অন্তঃসারশূন্যতা তৈরি করে চলেছে কেবল থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। লোক-দেখানো আনুষ্ঠানিকতা আর প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের বাইরে মনন ও সৃষ্টি যেতেই চায় না। একুশ শতকের ভেতরে পৌছাতে চাইছে বাঙালি নিছক প্রবাহ রক্ষার আয়োজন দিয়ে। কিছুদিন আগেও যা-কিছু ছিল বাঙালির ক্ষুরধার মেধা ও প্রতিস্রোতপন্থী মননের সূতিকাগার, সেইসব এখন দ্রুত শুচিতা হারিয়েছে। যে-কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনে বা গবেষণাকেন্দ্রে ইদানীং চোখে পড়ে কেবল অসূয়া, নির্লজ্জতা, প্রভু-ভজনা ও ফাপা আত্মম্ভরিতার চলমান প্রদর্শনী। জীবনানন্দের ভাষা অনুসরণ করে লিখতে পারি, যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা। তাই শেয়ালের ও শকুনের খাদ্য এখন মেধা ও স্বপ্ন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। যেভাবে আবহমানের ভাড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে, তাতে মনে হয়, অবক্ষয়ী আধুনিকতা ও বিশ্বায়নলব্ধ আধুনিকোত্তরবাদী সম্ভোগ-মাদকের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই বাঙালির সময়-মুদ্রা এবং এই মুদ্রাগীতির মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে তৃতীয় ভুবনেও। প্রান্তিকায়িত বাঙালির জন্যে উপাংশুকথনেও ক্ষয়ের বিলাসিতা, এই তার অস্তিত্বের অভিজ্ঞান। একুশে ফেব্রুয়ারির কৃষ্ণচূড়া যাদের চেতনার রঙে রঞ্জিত হয়ে বাংলা নামে দেশের জন্ম দিয়েছিল, দ্বিতীয় ভুবনের সেই বাঙালিদের জন্যে ইদানীং বিশ্বায়ন এসেছে এন জি ওর মোহনবেশে। পোশাক পাল্টে পাকিস্তানি অপচেতনা দ্রুত ঢুকে পড়েছে সদর থেকে অন্দরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো সক্রিয় বলে তালিবানি সন্ত্রাস সত্ত্বেও সাহিত্য-সংস্কৃতির মননবিশ্ব আবিল হয়নি। কিন্তু সিঁদুরে মেঘের আনাগোনা দিনদিন নানাভাবে স্পষ্টতর হচ্ছে। একদিকে মৌলবাদের ক্ষিপ্ত অসহিষ্ণুতা, অন্যদিকেউপভাষাকেন্দ্রিক ভয়ংকর আঞ্চলিকতা। এদের পথ ভিন্ন, লক্ষ্য এক, যেন-তেন প্রকারেণ বাঙালিত্বকে ভেতর থেকে ভাঙো! ঐশ্লামিক পরিচিতিকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্বগত ন্যায়বৃত্তকে চূর্ণ করতে চায় মৌলবাদীরা। আর উপভাষা-স্বাতন্ত্রবাদীরা চায় বাঙালিকে আরও টুকরো করে দিতে। সম্প্রতি হাতে এল লণ্ডনে প্রকাশিত একটি বই, সিলেটি ভাষা’ও ওই ‘ভাষাগোষ্ঠীর পরিচিতি বিষয়ে। বিভাষাকে ভাষা বলে চালানোর মধ্যে কোনো সারবত্তা নেই—এই বলে উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু যাচ্ছে না। কারণ, বিশেষভাবে এই উপমহাদেশে এবং সাধারণভাবে বিশ্বের বহু স্থানে আঞ্চলিক পরিচিতিকে উসকে দিয়ে বিভাজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার প্রক্রিয়াটি খুব চেনা। হতে পারে, এটা মগ্নশৈলের চূড়ামাত্র। এরপর যদি চট্টগ্রামে এজাতীয় কিছু ব্যাপার শুরু হয়ে যায় (যেমন হয়েছে পশ্চিমবাংলায় তথাকথিত কামতাপুরি নিয়ে), একে তো হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, এর কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়তে পারে তৃতীয় ভুবনে। ওই বইটিতে দেখলাম, কয়েকজন উৎসুক ইংরেজ সিলেটি লিপি তৈরিতে সহায়তা করেছেন। একে তো কাকতাল বলে নিরুদ্বিগ্ন থাকা যাচ্ছে না। নয়া উপনিবেশবাদী চক্র এভাবেই তো,নানা ধরনের সহযোগিতার আড়ালে, কাজ করে থাকে চিরকাল। অজস্র কৌনিকতায় ঋদ্ধ বাঙালি অস্তিত্বের পক্ষে যা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য, তা-ই আবার বিচিত্র কূটাভাসের বশে নেতিবাচক বিভেদের সলতে হয়ে উঠতে পারে। তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে-র উত্তরাধিকার কোথায় থাকবে? সালাম বরকতরা ঢাকার উপভাষার জন্যে প্রাণ দেয়নি নিশ্চয়, কমলা-শচীনেরাও প্রাণ দেয়নি সিলেটি বিভাষার জন্যে। বাংলা ভাষার মৃত্যুহীন শহিদদের পতাকা এই ক্রান্তিকালেই তো নতুন মুঠোয় তুলে ধরা প্রয়োজন। তাদের মৃত্যুকে অবমাননা করতে চাইছে মৌলবাদ, অবক্ষয়ী আধুনিকতা, আধুনিকতার ভোগসর্বস্ববাদ ও আঞ্চলিক উপনিবেশবাদ। বাঙালি আবার এক জটিল সন্ধিক্ষণে পৌছে গেছে, তিন ভুবনে আলাদা-আলাদা ভাবে। যতক্ষণ এবিষয়ে অবহিত না হচ্ছি, আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিছক অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি মাত্র হবে—তা সার্বিক সত্তার পরিচায়ক হবে না।
সংকট তাকেই বলি যখন অন্ধ-বোবা-বধির জনতায় ভরে যায় চতুম্পার্শ্ব আর তাদের ধাতব কোলাহলে ও শীৎকারে গলে-গলে পড়তে থাকে অন্ধকার। ডিশ অ্যাণ্টেনা আর ইণ্টারনেটের যুগে উত্তরপূর্ব ভারতের অর্থাৎ বাঙালির তৃতীয় ভুবনে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন আপাতদৃষ্টিতে নেই। ভৌগোলিক সীমান্ত যখন ঝাক্স, চিন্তাবিশ্বের স্বাতন্ত্র্য মুছে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপ্ত প্রতাপের আগ্রাসনে—পিণ্ডাকার ভিড়ের মধ্যে ব্যক্তিরূপ নয়, সংখ্যাচিহ্নিত অস্তিত্বই ফুটে উঠছে, বুদ্বুদের মতো মিলিয়েও যাচ্ছে। তাহলে বাঙালিত্ব কিংবা বাঙালির বিভিন্ন ভুবন নিয়ে দুর্ভাবনা করব কেন? সময়ের দুরন্ত স্রোতে শ্যাওলার মতো ভেসে যাওয়াকে মানিয়ে নিই বরং। যদি দুর্ভাবনা না করি, যদি মানিয়ে নিই—তাহলে প্রতিবেদনও বিভ্রম মাত্র হবে। তবু যে প্রতিপ্রশ্ন উত্থাপন করছি, এতেই প্রমাণিত সাংস্কৃতিক রাজনীতি আলোচনার বৈধতা।
বাঙালিত্ব আক্রান্ত এই যথাপ্রাপ্ত বয়ানের সূত্রে আমরা পৌছে যাচ্ছি। শিলচর-ঢাকা-কলকাতার পরিসর থেকে সময়ের রাজনৈতিক মাত্রায়, তার জটিল অন্তঃস্বরে। বিশ্বায়নের দোসর আধুনিকোত্তরবাদ কল্পজীবনের হাতছানি দিয়ে সর্বত্র সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঐক্যবোধের কাঠামো ভেঙে দিচ্ছে একদিকে। অন্যদিকে সৃজনশীল সমান্তরালতা ও ইতিবাচক পার্থক্য-প্রতীতি মুছে দিয়ে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াকে অবান্তর করে দিচ্ছে। বাঙালির সামূহিক অস্তিত্বে এই দুটোই সমান বিপজ্জনক। কিন্তু মঞ্চসাজের লুব্ধতায় মোহগ্রস্ত আমরা, তলিয়ে ভাবছি না কিছুই। শনাক্ত করছি না বিশ্বায়নের কৃৎকৌশলে উৎপাদিত সত্যভ্রমগুলিকে, তাদের চিত্ত-অসাড়-করে-দেওয়া পদ্ধতিগুলিকে। যারা প্রান্তিক অঞ্চলের অধিবাসী বলে প্রত্যাখ্যাত অপরের অবস্থানে খানিকটা অভ্যস্তই, তাঁদের কোনো প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা নেই বলে সবচেয়ে আগে তারা মুছে যাবেন। কিন্তু অজগর সাপের ভয়াবহ ঐক্যনীতি শেষ পর্যন্ত কাউকে রেয়াত করবে না। একুশে ফেব্রুয়ারি ও উনিশে মে-র চেতনা থেকে যদি উত্তরায়ণমনস্কতা বিচ্ছুরিত না হয়, ছাই ও লাভার স্কুপে তৈরি হবে নতুন-এক পম্পাই নগরের দুঃস্মৃতি।
না, পুরোপুরি ঠিক বলা হল না। কেননা একুশ শতক হলো স্মৃতিহীনতার শতক। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার দুর্নিবার দাপটে সব ধরনের সত্য উৎপাদিত হচ্ছে যন্ত্রদানবে। আমরা এখন তবু যাদুঘরে গিয়ে আদিম মহাসরীসৃপদের প্রস্তরীভূত কঙ্কাল দেখি, অদূর ভবিষ্যতে কম্পিউটার দিয়ে পুনর্নির্মিত বাঙালি সংস্কৃতির অশ্মীভূত রূপ দেখার জন্যে আগ্রহী দর্শক পাওয়া যাবে না। এ কোনো দুঃস্বপ্নের অতিকথন নয়, এ হল আত্মবিস্মৃত বাঙালির অনিবার্য ভবিতব্য। সম্ভাব্য অমরতার সোনার হরিণ বা সাময়িক লাভ-লোকসানের হিসেব যাদের অবক্ষয়ী আধুনিকতার প্রতি সমর্পিত করছিল, তাদের পথ ধরে চলতে চলতে পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্বায়নের মাদকে ঝুঁদ হয়ে রয়েছে। বাঙালিত্ব এদের কারো অ্যাজেণ্ডায় ছিল না। আত্ম-অবলুপ্তির ঘনায়মান আশঙ্কার মুখখামুখি হয়েও তাই এরা নির্বিকার, তাদের প্রতিবেদনে শুধু ধ্বংসগোধূলির ম্লানায়মান ছায়া।
কোথায় একুশে, কোথায় উনিশে আজ? নিভন্ত চুল্লিতে আগুন ফলাবে কোন হাঁসজারু-বকচ্ছপদের ভিড়! এই প্রশ্নের মুখোমুখি আজ সহস্রাব্দের ভ্রামণিক সত্তা, নির্বাক বিষয় বিধুর।
নিভন্ত এই চুল্লিতে সই একটু আগুন দে!