সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/চরিত্র-সমালোচনা

চরিত্র-সমালোচনা

ক্রিস্টোফার কলম্বাসের তিরোধানের পর প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর পেরিয়ে গেছে···তবু আজও তাঁর বিজয়কেতন জগতের চোখে সমুদ্ভাসিত হয়ে আছে।

 কিন্তু মানব-চোখের এই হলো একটা দিক্ মাত্র। যাঁরা এ-দিক্‌টা দেখছেন···তাঁরা শুধু দেখতে পাচ্ছেন... কলম্বাসের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অপূর্ব্ব কৃতিত্ব আর বিশ্বজয়ী খ্যাতি ও সুনাম! এ ছাড়া মানব-চোখের আরো একটা দৃষ্টি আছে। সে দৃষ্টিতে যাঁরা চক্ষুষ্মান্,...তাঁরা দেখেন কোথায় গলদ, কোথায় ত্রুটী ও কোথায় কোন্ অপূর্ণতা জলজ্যান্ত হয়ে রয়েছে!

 তাঁরা কলম্বাসের চরিত্র সম্পর্কে গুটিকয়েক এমন কথা বলেছেন, যে সব কথার জবাব দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

 তাঁরা বলেন, কলম্বাসের অদম্য উৎসাহ ছিল বটে কিন্তু সে উৎসাহের ভিত্তি ছিল কাল্পনিক—অনেকাংশে কবির কল্পনার মতই নিছক মিথ্যা ও অলীক!

 চমৎকার তাঁদের যুক্তি! কলম্বাস উৎসাহী...সে কথা তাঁরা অস্বীকার করেন নি। কিন্তু তাঁর অপরাধ এই যে···বাস্তবের ওপর তা প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কিন্তু তাই কি সত্যি?···বাস্তবের সঙ্গে তার কি কোন সম্পর্কই ছিল না?

 ভারতবর্ষের···তথা এসিয়ার এক সোনায় মোড়া দেশের তিনি রঙিন্ স্বপ্ন দেখে...উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন! দুঃখ-দারিদ্র্য···বাধা-বিঘ্ন···বিপদের আশঙ্কা ও পরাজয়ের গ্লানি···কিছুই তিনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না,...য়ুরোপের দুয়ারে-দুয়ারে তিনি ভিক্ষা চেয়ে বেড়াতে লাগলেন শুধু তাঁর সেই রঙিন্ স্বপ্নকে সার্থক করে তুলবার জন্য।

 কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, সোনায় মোড়া দেশের··· গজমোতির পাহাড় বা হীরের ফুলের যে স্বপ্ন দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন, সে স্বপ্ন তাঁকে দেখালো কে? সে কি নিছক ঘুমন্ত মানুষের স্বপ্ন বা কবির কল্পিত পক্ষিরাজ ঘোড়া?

 এর উত্তর হচ্ছে, না।...সে স্বপ্ন দেখবার আগে ভারতবর্ষের তথা এসিয়ার নাম কারো অজানা ছিল না... অজানা ছিল শুধু তার পথ। সে অজানা পথের খোঁজ নেবার আগে···কতদিন যে তিনি তপোমগ্ন ঋষির মত সাধনায় কাটিয়েছেন···কত বিনিদ্র রজনী যে তিনি কেবল মানচিত্র অঙ্কন আর মানচিত্র পর্য্যবেক্ষণ করে কাটিয়েছেন,—কে তার হিসাব রাখে?

 বাস্তব মানচিত্র শতভাবে পরীক্ষার পর...তিনি সোনার দেশের রঙিন পথের যে আভাসকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছিলেন,···আজন্ম ভারতবর্ষ তথা এসিয়ার ধনৈশ্বর্য্যের কথা শুনে···যে সোনার দেশের উজ্জ্বল ছবি, তিনি তাঁর বুকে এঁকে নিয়েছিলেন,—সে কি শুধু অলীক —নিছক মিথ্যা কল্পনা? ভারত বা এসিয়ার বাণিজ্য ও পণ্যের খ্যাতি কখনো মিথ্যা ছিল না, ভৌগোলিক মানচিত্র সে সময় অসম্পূর্ণ হলেও···চঞ্চল শিশুর হিজিবিজি কালির আঁচড়মাত্র ছিল না। তাহলে···যে স্বপ্নের পেছনে ছিল কলম্বাসের উৎসাহ,···তাকে কখনো নিছক মিথ্যা বা অলীক বলা যায় না।

 কলম্বাসের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ—তিনি নেতা হবার উপযুক্ত লোক ছিলেন না—নেতার পক্ষে যে সব গুণ থাকা দরকার, কলম্বাসের তা ছিল না।

 এই সমালোচনা যাঁরা করেছেন···তাঁদের মনে রাখা উচিত,···কলম্বাস কখনো কোন নেতৃত্বের দাবি করেন নি। তিনি একজন আবিষ্কারক...অধ্যবসায়ী আবিষ্কারক। আবিষ্কারের নেশায় তিনি বেরিয়েছিলেন বিভিন্ন চরিত্রের লোক নিয়ে;···ন্যায়ের বিচারে সাজা পেয়ে যারা জেলখানায় স্থান পেয়েছিল, সেই সব জেলভাঙা কয়েদী পর্য্যন্ত ছিল তাঁর অনুচর।

 একই ধর্ম্মের···একই মতের দশটি অনুচর থাকলে, তাদেরও বশে রাখা কত কঠিন! আর কলম্বাসের যারা অনুচর ছিল, তারা তো কত রকমের···কত পন্থার পথিক! কেবল তাইই নয়···তাদের অনেকেই ছিল সমাজের বিশিষ্ট মহাপুরুষ—জেলের কয়েদী! শৃঙ্খলা বা অনুবর্ত্তিতা তাদের কাছে আর কতটুকু আশা করা যেতে পারে? কাজেই তাদের চোখে মাঝে-মাঝে বিদ্রোহের ফুল‍্কি জ্বলে উঠেছে,···কলম্বাসকে ভূমিতলে অকৃতী নেতার আসনে বসিয়ে, তারা সমালোচকদের কাছে পঙ্কিল করে দেখিয়েছে। পৃথিবীর যে কোন শ্রেষ্ঠ নেতাকেও যদি একদল বিভিন্ন মতাবলম্বী কয়েদীর নেতৃত্বে বসানো হয়, তাহলে আমরা আশঙ্কা করি···তাঁর সেই নেতার গৌরবও অতি অল্পকালের ভিতরেই ধূলোয় মিলিয়ে যাবে!

 কলম্বাসের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ,···তিনি সৎ ও ধার্ম্মিক হলেও,...বড্ড কোপন-স্বভাব ছিলেন, তারই ফলে দয়া ও উদারতার অভাব ছিল যথেষ্ট।

 সমালোচকরা সম্ভবত বলতে চান... বিদ্রোহ দমনে কলম্বাস নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন, পাদ্রী বয়েলকে পর্য্যন্ত মজুরের মত খাটিয়ে নিয়ে তিনি অনুদার স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন,···তাঁর কোপন-স্বভাবের পরিচয়ও এতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত···সে-যুগ আর এ-যুগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক।

 কলম্বাস বেরিয়েছিলেন তাঁর সোনার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে···তাঁর দুঃখ-কষ্ট ও সাধনাকে সার্থক করে তুলতে। সেজন্য কোন দুঃখ-কষ্টকেই তিনি গ্রাহ্য করেন নি, কোন বিপকেই তিনি বিপদ বলে গণ্য করেন নি। কিন্তু এতটা সত্ত্বেও...তবু যদি কেউ দাঁড়ায় তাঁর মুখোমুখি শত্রুর মত,···সে তাহলে কতটা দয়া আশা করতে পারে? সফলই যদি তারা হতে পারত...তাহলে কোথায় থাকত আজ কলম্বাসের খ্যাতি,···আর কোথায় থাকত রাজা ফার্ডিন্যাও বা রাণী ইসাবেলার অনুগ্রহের মূল্য? হয়তো কলম্বাস নিষ্ঠুর ছিলেন···হয়তো ছিলেন তিনি অনুদার,···কিন্তু তাই বলেই তো এমন একটা কীর্ত্তি স্থাপন করতে তিনি পেরেছিলেন! নইলে সব-কিছুই যে আকাশ-কুসুমের উন্মাদ কল্পনা বলে আজও কুখ্যাত হয়ে থাকতো!

 পাদ্রী বয়েলকে মজুর খাটিয়ে নেওয়ার কথাটাই বড় হয়ে উঠেছে! কিন্তু সে কি খুব একটা অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত ব্যাপার···বিশেষতঃ দুর্দ্ধর্ষ পরিশ্রমী কলম্বাসের মত লোকের পক্ষে? কলম্বাস নিজে তখন অভিযানের নায়ক···সকলের পুরোভাগে তাঁর স্থান। তা সত্ত্বেও... তিনি কেবল হুকুমজারি করেই নায়কত্ব ফলানো অন্যায় মনে করেন,···দিনরাত পরিশ্রম করছেন উপনিবেশের উন্নতির জন্য। কিন্তু পাদ্রী বয়েল···কেবল তাঁর ধর্ম্মজীবনের ওজুহাতে কায়িক পরিশ্রম করতে নারাজ; এমন একটা বিসদৃশ ব্যাপার,···ধর্ম্মের ছলে কর্ম্মে অবহেলা,... অক্লান্ত কর্ম্মী কলম্বাসের পক্ষে ভালো লাগবে কেন?—আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে কর্ম্মবীর বলে যাঁরা পরিচিত হয়েছেন, নিশ্চয়ই তাঁরা কেউ কলম্বাসের ব্যবহারে কোন ত্রুটী ধরবেন না।

 যাঁরা একটু বেশী বুদ্ধিমান্, তাঁরা বলবেন···সময় ও লোক-বিশেষে···দু’রকম ব্যবহার করা আবশ্যক। পাদ্রীকে পর্য্যন্ত শারীরিক পরিশ্রমে বাধ্য করে,···কলম্বাস তাঁর শত্রু-সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন মাত্র,···লাভ তাঁর কিছুই হয়নি।

 তাঁদের সে কথা হয়তো অনেকাংশে সত্য। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কলম্বাস নীতিবিদ ছিলেন না... ‘পলিটিক্স’ বা ‘ডিপ্লোমেসী’ জিনিষটা তাঁর কাছে আশা করা যায় না। যে জন্য তিনি বিখ্যাত, সেই কাজের যা উপকরণ,···সাহস, উৎসাহ, কষ্ট-সহিষ্ণুতা ও অধ্যবসায়...সে জিনিষ তাঁর কতখানি ছিল, কেবল সেটুকুই বিচার্য্য।

 রঙিন স্বপ্নকে ফুটিয়ে তিনি বাস্তবে পরিণত করেছেন, তাই তিনি নমস্য। অজানার অন্ধকারে তিনি ভাস্বর সূর্য্যের আসন প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাই তিনি নমস্য। তরল মৃত্যুর অনন্ত সুনীল সীমানা পেরিয়ে তিনি ক্ষুদ্র পৃথিবীকে বিশাল করে গড়েছেন, তাই তিনি নমস্য।

 কলম্বাস দেখিয়ে গিয়েছেন সমুদ্রজয়ের উৎকট আকাঙ্ক্ষা···কলম্বাস করে গিয়েছেন আবিষ্কারের উন্মত্ত ইঙ্গিত! মেরু-সমুদ্রে, প্রশান্ত মহাসাগরে বা হিমালয়অভিযানে···তারই উদ্যম···তারই অভিযান···তারই সাধনা আজও বিকশিত হচ্ছে···দিনের পর দিন...প্রতি বছরে!

—শেষ—