সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/তিরোধানের পরে

তিরোধানের পরে

১৫০৬ খৃষ্টাব্দের ২০শে মে, জগতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। নূতন জগতের আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস সেদিন শ্রান্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে...ভগ্ন হৃদয়ে.. স্পেনের ভ্যালাডলিড্ (Valladolid) শহরে কবর-তলায় তাঁর শেষ বিশ্রাম খুঁজে নিলেন!

 আবিষ্কারের নেশায় উন্মত্ত হয়ে···নানা দুঃখ-বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে···মাটির পৃথিবীর এক নগণ্য সন্তান...১৪৯২ সাল হতে যিনি কেবলই সাগর-দোলায় দোল খেতে-খেতে শ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারপর কৃতঘ্ন মানুষ যাঁকে আঘাতের পর আঘাত হেনে মর্ম্মন্তুদ ব্যথা-বেদনায় জর্জ্জরিত করে ফেলেছিল, অবশেষে অভাব ও অনাহার যাঁকে চিরসঙ্গী করে আঁকড়ে ধরেছিল,···সেই হতভাগ্য কলম্বাসের এতদিনে হলো চিরমুক্তি!

 কোনো সম্রাট্ বা সম্রাজ্ঞীর অনুগ্রহ বা নিগ্রহ...স্বদেশবাসী বা স্বজাতীয়গণের ব্যঙ্গ বা ভ্রূকুটি...কিংবা অভাব ও দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ বা অনাহারের আতঙ্ক−সমস্তই আজ তাঁর কবরের বাইরে পড়ে রইলো··· নিরুপদ্রব কলম্বাস তাঁর শেষ-শয্যায় শান্তিতে শুয়ে রইলেন।

 কলম্বাসের অমর আত্মা শান্তিতে রইলো বটে, কিন্তু পৃথিবী?...তাঁর স্বদেশ?......স্বজাতি? .....তারা কেউ শান্তিতে রইতে পারলো কি?—না। পৃথিবীর জ্ঞানের ভাণ্ডার যিনি বাড়িয়ে গেলেন···পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য যিনি বাড়িয়ে গেছেন···মানুষের দৃষ্টিকে যিনি অনন্ত সাগরের অপর তীর পর্য্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন,···তাঁকে যারা উপযুক্ত মর্য্যাদা দানে কুণ্ঠিত হয়েছে,···শান্তি তাদের পক্ষে অসম্ভব! কাজেই কলম্বাসের মৃত্যুর পর···তাঁর সমাধিলাভের পর···নিয়তির চক্রে ঘুরে এলো পৃথিবীর হিসাবনিকাশের দিন।

 জগৎ সেদিন তার ভুল বুঝতে পারলো···জগতের কাছে কলম্বাস যে কি অসীম লাঞ্ছনাই সহ্য করেছেন, তাই ভেবে সারা জগৎ শিউরে উঠ‍্লো···কাজেই তখন থেকেই শুরু হলো অনুতাপ ও অনুশোচনার মূর্ত্ত বিকাশ! তার আতিশয্যে কলম্বাসকে জগৎ তাঁর নীরব নিভৃত কবরের নীচেও স্থির থাকতে দিলে না... কবর খুঁড়ে তাঁর দেহাবশিষ্ট বার করা হলো···তারপর ১৫১৩ খৃষ্টাব্দে অধিকতর সমারোহের সঙ্গে তাঁকে কবরে আবার সমাহিত করা হলো স্পেনের ‘সেভাইলী’ (Seville) শহরে।

 এরপর ২০।২২ বছর বেশ নিরুপদ্রবেই কেটে গেল।

স্পেনের রাজদণ্ড···পুরানো পৃথিবীর প্রভুত্ব···তখন নতুন জগতের অণু-পরমাণুতে কায়েমী হয়ে বসে যাচ্ছিল। স্পেন—তথা সারা য়ুরোপ, তখন আর কলম্বাসকে মর্য্যাদা দিতে কৃপণতা করতে পারে না···কারণ নতুন জগতের ঐশ্বর্য্য, নতুন জগতের পরিচয়···তাদের চোখের কাছে তখন এক নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে!

 ওদিকে···পশ্চিমে নতুন জগৎও বুঝতে পেরেছে... কোথায় তারা ছিল, আর কোথায় তারা এসেছে! অপাংক্তেয় লোকের মত...ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভিতর...ক্ষুদ্র পৃথিবীর ক্ষুদ্র অধিবাসী হয়ে তারা ঘৃণিত জীবন অতিবাহিত করছিলো, কিন্তু আজ তারা এক বিশাল পৃথিবীর অধিবাসী···সকলেই সমান মর্য্যাদার অধিকারী!

 পূর্ব্ব ও পশ্চিম···উভয়েরই মনে একসঙ্গে প্রশ্ন জেগে উঠুলে।···কে, কে এর মূল কারণ? পূর্ব্বের পুরানো জগৎ আর পশ্চিমের নতুন জগৎকে আজ সমসূত্রে...এক পংক্তিতে এনে দাঁড় করালেন কে? কৃতজ্ঞ চিত্তে সবাই অনুভব করলো—তিনি কলম্বাস!

 কাজেই অনুভবের সাথে-সাথে আবার এলো তার অভিব্যক্তি! কিন্তু এবার সাড়া দিলে পশ্চিমের নতুন জগৎ। পশ্চিমের···নতুন জগতের এক অংশ···কলম্বাস যাকে স্পেনের অনুকরণে নাম দিয়েছিলেন ‘হিস্পেনিয়োলা’ অর্থাৎ ‘ছোট স্পেন’ (—অধুনা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ‘হাইতী’ দ্বীপের অন্তর্গত), সেইখান থেকে দাবী এলো... আবিষ্কারক কলম্বাসের দেহাস্থি সেইখানে তারা সমাহিত করবে।

 তাই হলো। ১৫৩৬ খৃষ্টাব্দে কলম্বাস ও তাঁর ছেলের দেহাস্থি হিস্পেনিয়োলার স্যাণ্টো ডোমিঙ্গোতে স্থানান্তরিত করা হলো।

 প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ১৪৯২ সালে...যে দেশের ভূঁয়ে কলম্বাস প্রথম পদার্পণ করেছিলেন, আজ সেখানেই তাঁর অমর আত্মা শান্তিতে বিশ্রাম করতে লাগলো। প্রথম পদার্পণের দিন তাঁর যে অনুভূতি হয়েছিল···আশা-আকাঙ্ক্ষার যে উন্মাদনা সেদিন তাঁর বুকের ভিতর মহা আন্দোলন তুলেছিল, দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পরে সেদেশের জল-হাওয়ার ছোঁয়াচ্ লেগে, তাঁর ক্লান্ত আত্মা সেদিনও কোন অনুভূতিতে নড়ে উঠেছিল কিনা কে জানে?

 কত গৌরব আজ কলম্বাসের?... অনাবিষ্কৃত অপরিচিত পৃথিবীর এক নূতন দেশ...তাঁরই আবিষ্কৃত লীলাভূমি হিস্পেনিয়োলায়···অকৃতজ্ঞ পৃথিবীর লাঞ্ছিত সন্তান আবিষ্কারক কলম্বাস···শান্তিতে চির-নিদ্রিত! এতদিনে বুঝি সত্যই প্রমাণিত হলো···কলম্বাসের কৃতিত্ব ও সম্মান আজ সবাই বুঝতে পেরেছে···নূতন ও পুরাতন পৃথিবীর সর্ব্বত্রই উঠ‍্লো কলম্বাসের জয়-জয়কার!

 সুদীর্ঘ আড়াই শ’ বছর এমনি ভাবে কেটে গেল। নূতন জগতের ধনৈশ্বর্য্য, নূতন জগতের জীব-জন্তু ও সম্পদ তখন পুরানো পৃথিবীর—বিশেষতঃ য়ুরোপের বুকে কত আশার আলোর রঙিন স্পন্দন জাগিয়ে তুলছিল!···ভাবের আবেশে কলম্বাসের বিজয়-বৈজয়ন্তী ক্রমশ সকলেই অভিভূত হয়ে মেনে নিচ্ছিল! কলম্বাসের নাম ও ছোঁয়াচ্ পেতে সকলেই যেন লোলুপ হয়ে ওঠে! পশ্চিম-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম দ্বীপ-ভূমি ‘কিউবার’ বুকে তেমনি একটা আলোড়ন উপস্থিত হলো।

 তারই ফলে···আড়াই শ’ বছরেরও কিছু বেশী দিন পরে ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে···কলম্বাসের সুপ্ত আত্মার হলো আবার এক নূতন জাগরণ!···নিদ্রিত কলম্বাসের দেহাস্থি ···আবার নূতন ভাবে সমাহিত করা হলো···কিউবার ‘হ্যাভানা’ শহর হলো এবারকার সমাধি-ভূমি।

 এর কিছুকাল পর···কিউবা এক ভয়ানক যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়লো···তার শান্তিপূর্ণ আবহাওয়া যুদ্ধের ধুমে পঙ্কিল ও বিষাক্ত হয়ে উঠলো...শত্রু ও মিত্র উভয় পক্ষের শিক্ষা ও সংস্কৃতি কোন্ অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল!

 তারপর লড়াই যখন শেষ হয়ে গেল...তখন শুরু হলো আবার এক নূতন উদ্দীপনা! পুরানো পৃথিবীর য়ুরোপ... বিশেষতঃ স্পেন···নূতন করে অনুভব করলো···কলম্বাস তো ছিলেন আমাদেরই একজন! আমাদেরই দেশের রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড আর রাণী ইসাবেলার সাহায্যেই তো কলম্বাস তাঁর বিজয়-বৈজয়ন্তী উড়িয়ে···এক নূতন জগৎ আবিষ্কারে উন্মাদের মত বেরিয়ে পড়েছিলেন!···কাজেই কলম্বাসের আবিষ্কার···সে তো আমাদেরই আবিষ্কার··· স্পেনের আবিষ্কার! কলম্বাসের বিজয়···সে আমাদেরই বিজয়···স্পেনের বিজয়! কলম্বাস নিজেও তা মেনে নিয়েছিলেন...আর তা মেনে নিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত ভূমির এক অংশের নামও দিয়েছিলেন ‘হিস্পেনোলিয়া’ বা ছোট স্পেন।...তাহ’লে তাঁর দেহ সমাহিত করবার যে গৌরব···সে গৌরবে স্পেনের দাবী হচ্ছে সর্ব্বাগ্রে।

 কাজেই···স্পেন স্থির করলো···কলম্বাসের দেহাস্থি তারা নিয়ে আসবে স্পেনে···তারপর আবার তাঁকে নূতন করে কবর দেওয়া হবে।

 ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে··· অর্থাৎ হ্যাভানায় প্রোথিত হবার প্রায় একশ’ বছর পরে···হ্যাভানার কবর-দুয়ার আবার একবার খোলা হলো···তারপর মহাসমারোহে তাঁর দেহাস্থি নিয়ে আসা হলো স্পেনের গ্র্যানাডা শহরে।

 গ্র্যানাডার কবর-তলায়ই কলম্বাস শুয়ে রইলেন কয়েক বছর···তারপর ১৯০২ খৃষ্টাব্দে শেষবারের মত আরএকবার তাঁর সুনিদ্রায় ব্যাঘাত করা হলো...তাঁর দেহাস্থি নিয়ে আসা হলো স্পেনের সেভাইলী শহরে!

 সেখানে সুন্দর এক স্মৃতি-মন্দির···অমর আবিষ্কারক কলম্বাসের দেহাস্থি ধারণ করবার মত হুবিস্তৃত—সমুন্নত; মায়ের মত পরম স্নেহে···সে মন্দির কলম্বাসের পুণ্যাস্থি বুকে নিয়ে···আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে!

 আকাশে সূর্য্য নিশ্চল···মর্ত্ত্যে নিশ্চল কত অভ্রভেদী পর্ব্বতরাজি! তেমনি সারা বিশ্বে আজ নিশ্চল সেই অমর-কীর্ত্তি কলম্বাসের যশোরাশি! পৃথিবীর জীবনে কোনোদিনই সে যশ ক্ষুণ্ণ হবে না—হতে পারে না.. সে যশ অমর···অক্ষয়।