সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/তৃতীয় অভিযান ও লাঞ্ছনা
তৃতীয় অভিযান ও লাঞ্ছনা
১৪৯৮ সালে কলম্বাস তৃতীয় অভিযানে বেরুলেন। এবার তাঁর প্রধান আবিষ্কার হলো দক্ষিণ-আমেরিকার মূলভূমি। প্রধানতঃ এতকাল তিনি কতকগুলো দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেই তৃপ্তিলাভের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এবার তাঁর মনে হলো—না তা নয়...নতুন জগৎ কেবল এই নিয়েই সীমাবদ্ধ হতে পারে না...না জানি কোন্ এক অজানা জগৎ তার বিস্তৃত অবয়ব ও অনন্ত রহস্য নিয়ে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে!
কলম্বাসের যত্ন ও সাধনায় তাঁর অন্তরের সেই বিরাট ভবিষ্যৎ সত্যরূপে প্রকটিত হয়ে উঠ্লো...নূতন জগতের মূলভূমি যথার্থই একদিন তাঁর চোখে বাস্তবের সোনার কাঠি ছুঁইয়ে···কত অলৌকিক রহস্যের ভাণ্ডার নিয়ে, তাঁর চোখের সুমুখে এসে ধরা দিলে! কলম্বাস এবার আবিষ্কার করলেন দক্ষিণ-আমেরিকা···দক্ষিণ-আমেরিকার নিকটবর্ত্তী কোন দ্বীপ বা দ্বীপপুঞ্জ নয়...দক্ষিণ-আমেরিকার মূলভূমি!
এই তৃতীয় অভিযানের শেষভাগে কলম্বাস যখন ইসাবেলায় এসে পৌঁছলেন, তখন সেখানকার অবস্থা দেখে তাঁর মন একেবারে ভেঙে পড়লো। রোলডান্ বলে একজন লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করে কলম্বাসের জায়গায় নিজেকেই ‘ভাইসরয়’ বা রাজ-প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে···তার অত্যাচারে তখন চারদিকে আগুন জ্বলে উঠেছে...কলম্বাসকে ফিরে আসতে দেখে রোলডান্ প্রকাশ্য ভাবে তাঁকে অপমান করতে শুরু করে দিল... বিরক্ত হয়ে অধিকাংশ লোক তখন স্পেনে ফিরে গিয়েছিল এবং স্পেনে ফিরে এসে তারা সব দোষ কলম্বাসের ঘাড়ে চাপিয়ে, সমস্ত ব্যাপারকে উপহাসযোগ্য বলে প্রচার করতে লাগলো।
রাণী ইসাবেলা বিরক্ত হয়ে ফ্রান্সিস্ বোবাডিলা নামে তাঁর নিজের একজন লোককে রাজ-প্রতিনিধি করে পাঠালেন; তাঁর ওপর তিনি ক্ষমতা দিলেন যে, যদি তিনি দেখেন যে কলম্বাস সত্যই অপরাধী, সেই দণ্ডে সেইখানে তাঁকে শাস্তি দিতে...
জগৎ এই ভাবে বার-বার ভুল করে এসেছে···যার কাছ থেকে সে উপকৃত হয়েছে, তাকেই সে লাঞ্ছনা দিয়ে মেরে ফেলেছে...
স্পেন ত্যাগ করবার আগেই বোবাডিলা জানতেন, কলম্বাস সম্বন্ধে তিনি কি করবেন; কারণ, কলম্বাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন নেতা। ইসাবেলায় উপস্থিত হয়েই সেখানকার অরাজক অবস্থা দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ কলম্বাসকে বন্দী করলেন এবং যে বীরপুরুষ তাঁর স্পেনের হাতে অর্দ্ধ-পৃথিবীর সংবাদ এনে দিয়েছিল, শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় তাঁকে স্পেনে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো...
আজীবন রূঢ় সংগ্রামের শেষে এই নিষ্ঠুরতম পুরস্কারে কলম্বাস একেবারে ভেঙে পড়লেন···রাণী ইসাবেলার সামনে যখন তাঁকে উপস্থিত করা হলো, তাঁর আর সে চেহারা তখন নেই...এই নিদারুণ অপমানের আঘাতে তাঁর সারা দেহে অকাল বার্দ্ধক্য নেমে এসেছে...মুখের সে দীপ্তি নেই...
রাণী ইসাবেলা দেখলেন, বৃদ্ধ জরাজীর্ণ কলম্বাসের চোখে জল! তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। ভাবে অভিভূত হয়ে তিনি নিজের হাতে কলম্বাসের শৃঙ্খল খুলে দিলেন...
তারপর কলম্বাসের সমস্ত কাহিনী শুনে রাণী ইসাবেলা বুঝলেন যে, কলম্বাসের বিরুদ্ধে এক হীন ষড়যন্ত্র চলছে ...সেই মুহূর্ত্তে তিনি বোবাডিলাকে শাস্তি দেবার জন্যে লোক পাঠালেন এবং কলম্বাসকে আবার চতুর্থ অভিযানে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।