সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/বিশ্বাস ও উদ্যোগ
বিশ্বাস ও উদ্যোগ
সাগর যাকে ডাকে, পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারে না। এমনি দুর্নিবার সাগরের ডাক!
কলম্বাস যখন যৌবনে পা দিলেন, তখন থেকেই তিনি সাগর-জলের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত হতে লাগলেন। যখনি সুবিধা পেতেন সমুদ্র পথে যাবার, তখনই সে-সুযোগ গ্রহণ করতেন। এইভাবে একটু-একটু করে তিনি তখনকার প্রচলিত সব সাগর-পথের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলেন···উত্তর আফ্রিকার বাণিজ্যের জন্যে সে-সব জাহাজ যাতায়াত করতো, তাতে তিনি নাবিকের কাজ নিয়ে যাতায়াত শুরু করলেন।
সেই সময় উত্তর আফ্রিকা আর স্পেন-পর্ত্তুগালের মধ্যে সমুদ্র-পথে ছোটখাটো জলযুদ্ধ প্রায়ই লেগে থাকতো একবার তিনি এক যুদ্ধের জাহাজে আফ্রিকার টিউনিস্ শহরে গিয়ে উপস্থিত হন এবং এক জলযুদ্ধের মধ্যে পড়ে যান। সেই যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দেন। সেই থেকে ভূমধ্যসাগরে ছোটখাটো জলযুদ্ধে প্রায়ই তিনি যোগদান করতেন। এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি নাবিকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে অভিজ্ঞতা অর্জ্জন করছিলেন। যখন সমুদ্রে না বেরুতেন, তখন তিনি ম্যাপ তৈরী করে জীবিকা অর্জ্জন করতেন।
এই সমস্ত ম্যাপ সেই সময় নাবিকদের খুব কাজে লাগতো। এই ম্যাপ তৈরী করার কাজ শুধু যে তিনি জীবিকা অর্জ্জনের জন্যে গ্রহণ করেছিলেন, তা নয়, তিনি নিজেও ম্যাপের মধ্যে দিয়ে খুঁজলেন, সেই সমুদ্র-পথ... যে-পথ দিয়ে একদিন তিনি অজানা পৃথিবীর সন্ধানে বেরুবেন। এই ম্যাপ তৈরী করতে-করতে তাঁর ধারণা আরো স্পষ্টতর হলো যে, আটলাণ্টিক মহাসাগর ধরে পশ্চিম মুখে গেলে নিশ্চয়ই মাটির সন্ধান পাওয়া যাবে...
এই সময় তিনি সমুদ্র পথে আইসল্যাণ্ডে একবার যান। এই আইসল্যাণ্ডে এসে সম্ভবতঃ তাঁর মনের কল্পনা সঙ্কল্পে পরিণত হয়। কারণ, আইস্ল্যাণ্ডে এসে তিনি সেখানকার পুরাণো কাহিনী-প্রসঙ্গে সেই দেশের প্রাচীন তরঙ্গ-বিহারী দুঃসাহসিক লোকদের বিবরণের সঙ্গে পরিচিত হলেন; এবং সেই প্রাচীন নৌ-যাত্রার কাহিনী অনুসন্ধান করে এবং তা পড়ে তিনি জানলেন যে, একদা ইতিহাসের প্রথম যুগে য়ুরোপ আর একটি মহাদেশ এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তারপর কালক্রমে সেই দুই মহাদেশের মধ্যে এই আটলাণ্টিক সাগর মহা-বিচ্ছেদ রচনা করে। তারপর থেকে এই দুই মহাদেশের দেখা-সাক্ষাৎ আর হয় নি।
মাঝে-মাঝে সাগরের তরঙ্গের ওপার থেকে পাখীরা আসতো উড়ে, পায়ে তাদের তখনও লেগে থাকতো ওপারের মাটি। সেই মাটির সঙ্গে কখন-কখন ছোটছোট ফল-ফুলের বীজ লুকিয়ে থাকতো। য়ুরোপের মাটিতে উড়ে-আসা সেই সব পাখীর পায়ের মাটির স্পর্শে নতুন ধরণের সব গাছ ফুটে উঠতে।···মানুষ বিস্ময়ে সমুদ্রের ওপারে চেয়ে থাকতো···
মাঝে-মাঝে এমন সব কাহিনীর সন্ধান তিনি পেলেন যাতে তিনি দেখলেন যে, ইংলণ্ড বা ফ্রান্সের সমুদ্র-তীরের লোকেরা দেখতো সাগরের জলে বড়-বড় গাছ ভেঙ্গে কোথা থেকে তাদের তীরে এসে লাগছে! অনেক সময় সেই তরঙ্গে ভেসে-আসা গাছের ওপর অজানা পার্থীর দল আসতো য়ুরোপে...
আইস্ল্যাণ্ডে এসে কলম্বাস বিয়ার্ণি আর লীফের কাহিনী শুনলেন। বহু-বহু যুগ আগে তাঁরা নাকি সমুদ্রের ওপারে গিয়ে নতুন দেশের সন্ধান পেয়েছিলেন। এখনো আইস্ল্যাণ্ডের কবিরা তাঁদের সেই কীর্তির কথা গাথায়গাথায় অমর করে রেখেছে!
এই সব অভিজ্ঞতা থেকে কলম্বাসের মনের বিশ্বাস ক্রমশঃ দৃঢ়তর হতে লাগলো···নিশ্চয়ই এই মহাসাগরের ওপারে আছে মাটির দেশ···কিন্তু তিনি দরিদ্র, অসহায়... কে শুনবে তাঁর কথা? যার কাছেই তিনি সে-কথা বলেন, পাগল বলে তারা তাঁর কথা উড়িয়ে দেয়।
তখন পর্ত্তুগাল ছিল, য়ুরোপের মধ্যে নৌ-বিদ্যার সব চেয়ে বড় আড্ডা! পর্ত্তুগালের রাজবংশে হেনরী বলে এক রাজকুমার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি আজীবন নৌবিদ্যার সাধনা করে যান। তাঁরই চেষ্টা এবং প্রেরণার ফলে পর্ত্তুগালের নাবিকরা তখন দূর-দূরান্তে সমুদ্র-তরঙ্গের মধ্যে নানান্ দ্বীপ আবিষ্কার করেন। নৌ-বিদ্যা শিক্ষার জন্যে তিনি নিজের অর্থে এক বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, সেই নৌ-বিদ্যার কলেজ সেই সময় য়ুরোপে খুব বিখ্যাত ছিল। তাঁর সেই সাধনার ফলে আজ ইতিহাসে তাঁর নাম ‘প্রিন্স হেনরী দি ন্যাভিগেটর’ (Prince Henry, the Navigator) নামে পরিচিত।
কলম্বাস নিজের জন্মভূমিতে কোন উৎসাহ না পেয়ে পর্ত্তুগালে আসবার মনস্থ করলেন। পর্ত্তুগালের নৌবিদ্যার খ্যাতি তাঁকে আকর্ষণ করলো···তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে তাই পর্ত্তুগালে চলে এলেন···যদি সেখানে তাঁর প্রস্তাবের সমর্থন কোথাও মেলে!
পর্ত্তুগালে এসে তাঁর জীবনের এক মহা সৌভাগ্য দেখা দিল। পর্ত্তুগালের রাজধানী লিসবন্ শহরে এসে তিনি সেখানকার এক অতি সম্ভ্রান্ত ও ধনী মহিলার পাণিগ্রহণ করেন! এই বিবাহের ফলে তাঁর বিশেষ সুবিধা হলো... পর্ত্তুগালের বহু সম্ভ্রান্ত লোকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হলেন এবং তখন সেখানকার বড়-বড় নাবিকেরা এবং বিশেষ করে নৌ-বিদ্যার শিক্ষার কলেজে ভূগোল এবং সমুদ্র-অভিযান সম্বন্ধে যে-সব গবেষণা চলছিল, তার সঙ্গে পরিচিত হলেন।
লিসবন্ শহরে এসে তিনি তাঁর পূর্ব্বগামী পথিকদের সব ভ্রমণ-কাহিনী পড়তে লাগলেন। ক্ষুধিত লোক তার সামনে খাদ্য এলে যেমন ভাবে খায়, কলম্বাস তেমনি আগ্রহের সঙ্গে সেই সব ভ্রমণ-কাহিনী পড়তে লাগলেন... আশৈশব তাঁর মনে যে স্বপ্নকে তিনি লালন-পালন করে এসেছেন, পর্ত্তুগাল তাঁর সেই স্বপ্নকে জাগ্রত চিন্তার মূর্ত্তিতে ফুটিয়ে তুল্লে।— তিনি নিজের ঘরে বসে দিনের পর দিন আটলাণ্টিক অভিযানের প্ল্যান তৈরী করতে লাগলেন।
যে-সময়ের কথা আমরা আলোচনা করছি, সে-সময় পুঁথিগত বিদ্যা আজকের মত এত প্রসার লাভ করে নি... তখন পুঁথি এত সুলভও ছিল না···তখন বিদ্যা ছিল জ্ঞানী বা অভিজ্ঞ লোকের মনে। যেখানে তাঁরা থাকতেন, সেখানে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব নিয়ে তবে সে বিদ্যা আয়ত্ত করতে হতো···বিশেষ করে ভূগোল বিদ্যা তখন, অতি শৈশব অবস্থায় ছিল···ভাল মানচিত্র পাওয়াই যেতো না...
কলম্বাস ঘুরে-ঘুরে সেই সব জ্ঞানী লোকদের সঙ্গে দেখা করতে লাগলেন···প্রত্যেককে এশিয়া সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন···সকলেই এশিয়া সম্বন্ধে এমন সব কথা বলেন, যাতে মনে হয়, সে-দেশ সোনা আর মরকত মণি দিয়ে তৈরী!
সেই সময় টসানেলী নামে একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ছিলেন, তিনিই ছিলেন সে-যুগের শ্রেষ্ঠ মানচিত্রকর। টসানেলী পৃথিবীর একটী মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। সেই মানচিত্র তিনি কলম্বাসকে দেখালেন। তাতে তিনি আটলাণ্টিক মহাসাগরের পশ্চিমে, যেখানে এখন আমেরিকা রয়েছে, সেখানে এশিয়ার মানচিত্র আঁকেন এবং কলম্বাসকে তিনিই প্রথম সায় দিয়ে বল্লেন, তুমি যদি আটলাণ্টিক মহাসাগর ধরে পশ্চিমমুখো যাও, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি মাটির সন্ধান পাবে···হয়ত ক্যাথে (চীন) নয় ভারতবর্ষ! তিনিই একমাত্র কলম্বাসের প্রস্তাব শুনে তাঁকে উৎসাহিত করে বল্লেন, তুমি যে কাজ করবে বলে ঠিক করেছ, তাতে অবশ্য চাই অমানুষিক সাহস, মৃত্যুজয়ী পণ...আর পর্ত্তুগালে সে রকম লোকের অভাব হবে না...
টসানেলীর উৎসাহ-বাণীতে কলম্বাস স্থির করলেন, জীবনে আর কোন কাম্য নেই, আর কোন লক্ষ্য নেই... যেমন করেই হোক, সমুদ্র পথে ভারতে পৌঁছতে হবে... সে সমুদ্র যদি আদি-অন্তহীন হয়··· তবুও...
সেইদিন থেকে এই এক চিন্তা, এই এক ধ্যান তাঁর সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রইলো...
যেখানে কোন নাবিককে দেখেন, তাকেই ডেকে তিনি আলাপ করেন এবং তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার অভিজ্ঞতায় কি বলে? আটলাণ্টিক মহাসাগরের ওপারে কি মাটি নেই?
কেউ বলে, একবার দূর থেকে যেন তারা দেখেছিল, দূরে দিক্-রেখার কাছে তীর-ভূমির মত কালো কি যেন দেখা যাচ্ছে···তাদের সাহস হয় নি এগিয়ে গিয়ে দেখতে...
কলম্বাসের মন বলে, হয়ত তাদের ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে তারা দূরে দিক্-রেখার মেঘমণ্ডলকে স্থল বলে ভুল করেছে।
একজন বৃদ্ধ নাবিক একবার গল্প বল্লো যে, সমুদ্রতরঙ্গে দুটী লোকের মৃতদেহ একবার ভেসে আসতে সে দেখেছিল···লোক দুটীর চেহারা, গায়ের রঙ, পোষাক-পরিচ্ছদ তাদের মতন নয়, সম্পূর্ণ আলাদা এক দেশের, আলাদা এক জগতের লোক হবে তারা...
কোন-কোন নাবিক আবার গল্প করলো, দূর-সমুদ্রের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে তারা ঢেউয়ে নানারকমের বিচিত্র লতা-পাতা ভেসে আসতে দেখেছে... সে-রকম লতা-পাতা তো তাদের দেশে হয় না—আর মাটি না থাকলে লতা-পাতা আসবেই বা কোথা থেকে?
ক্রমশ-ক্রমশ কলম্বাসের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল যে, এই সীমাহীন মহাসাগর ধরে একটানা পশ্চিমমুখো গেলে, তিনি নিশ্চয়ই মাটির সন্ধান পাবেন···এশিয়ার মাটি···ভারতবর্ষের মাটি! ধার্ম্মিক লোক যেমন বিশ্বাস করে ঈশ্বরের অস্তিত্বে, কলম্বাসের মনে তেমনি আটলাণ্টিক মহাসাগরের ওপারে নতুন দেশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিশ্বাস জেগে উঠলে।···কোন কিছুই তাঁর মনের এ-বিশ্বাস টলাতে পারলো না...
কিন্তু যতক্ষণ না নৌকো করে, তরঙ্গের লোণাজলে স্নান করে, সেই নতুন দেশে না পৌঁছতে পারছেন, ততক্ষণ তাঁর বিশ্বাসের তো কোন মূল্য নেই! কিন্তু সেই বিরাট বিশাল মহাসাগর পার হতে হলে, সঙ্গে বহু লোকজন দরকার, প্রত্যেক লোকটীই অভিজ্ঞ নাবিক হওয়া চাই, এবং তাঁরই মত প্রত্যেকের অন্তরে এই বিশ্বাস, এবং এই বিশ্বাসকে সত্যে পরিণত করবার উৎসাহ ও শক্তি থাকা দরকার, চাই এই দীর্ঘ যাত্রার উপযুক্ত নৌকো, খাদ্য···কিন্তু এই বিরাট অভিযানের জন্যে যে লোকবল এবং অর্থবল প্রয়োজন, তা একজন সাধারণ লোকের দ্বারা কখনই সম্ভব হতে পারে না; একমাত্র দেশের রাজা বা দেশের শাসকবর্গ এ উদ্যোগ করতে পারেন। তাই তিনি স্থির করলেন যে, তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে তিনি তাঁদেরই দ্বারস্থ হবেন..