সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/সাগরের ডাক
সমুদ্রজয়ী কলম্বাস
সাগরের ডাক
জেনোয়া শহরে সমুদ্রের ধারে,—আজ নয়, কাল নয়,— আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে, একদিন বিকেল বেলায় তিনটী ছেলে আর একটী মেয়ে, অবাক হয়ে চেয়ে ছিল। তীরে ছোট-বড় নানান ধরণের নৌকো এসে জমা হয়েছে—শিশুরা অবাক হয়ে তাই দেখছে।
রোজ বিকেল বেলা তারা বাড়ী ছেড়ে সেই সমুদ্রের ধারে ছুটে আসে, সেই নৌকো দেখবার জন্যে। শাদাশাদা পালগুলো বাতাসে দুলতে থাকে, সেই সঙ্গে দোলে শিশুদের মন,—কোথা থেকে এরা আসে, আর কোথায় বা যায় তারা চলে! আজ যাদের আসতে দেখলো, কাল এসে দেখে তারা নেই, চলে গিয়েছে···কোথায় গেল তারা?
সেই শিশুদের মধ্যে একটী ছেলের কৌতূহল সকলের চেয়ে বেশী। নৌকোগুলো যেন তাকে আকর্ষণ করে! নৌকোগুলো যখন অগাধ নীল জলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, ছেলেটীর মনও সেই সঙ্গে-সঙ্গে চলে যায়! চলেযাওয়া নৌকোর দিকে এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে,—সে চেয়ে থাকে, যতক্ষণ না দিক্চক্ররেখার আড়ালে একটা ছোট্ট পাখীর মতন হয়ে, নৌকোগুলে। অদৃশ্য হয়ে যায়!
ক্রমশঃ তার কৌতূহল এত বেড়ে উঠতে লাগলো যে, সে গায়ে পড়ে সেই সব নৌকোর নাবিকদের সঙ্গে ভাব করতো; জানতে চাইতো—কোথা থেকে তারা আসে, কোথায় তারা যায়? সমুদ্রের ওপারে কি আছে...শুধুই কি জল, আর জল? এ জলের কি শেষ নেই? ওপারে কি কোন দেশ নেই?
নাবিকরা গল্প করে, সমুদ্রের মধ্যে নানান দেশের কথা, নানান্ বিচিত্র দেশ, বিচিত্র সেখানকার লোক, বিচিত্র তাদের আচার-ব্যবহার! ছেলেটী অবাক হয়ে শোনে... সর্ব্বদেহ দিয়ে শোনে... শুনতে-শুনতে তার মনে হয়, সাগরের ওপার থেকে কে যেন তাকে ডাকছে!
এই কৌতূহলী ছেলেটীর নাম কলম্বাস, আর তার সঙ্গীরা হলো তার ভাই-বোন—তারা তিন ভাই আর এক বোন্।
ইতালীর বিখ্যাত বন্দর জেনোয়া শহরে এক ঘর তাঁতি বাস করতো। সেই তাঁতির এই তিন ছেলে আর এক মেয়ে। তিন ভাইএর নাম হলো, যথাক্রমে ক্রিষ্টফার কলম্বাস, বার্থোলমিউ এবং দিয়িগো। সেদিন জেনোয়া শহরের সেই সামান্য তাঁতি কল্পনাও করতে পারেন নি যে, তাঁর ঘরে এমন এক ছেলে জন্মগ্রহণ করেছে—যে জগতে অক্ষয় কীর্ত্তি রেখে যাবে, এই পৃথিবীর আধখানার সঙ্গে অপর আধখানার পরিচয় করিয়ে দিয়ে, বর্ত্তমান সভ্যতার প্রকৃত প্রসারের সহায়তা করে যাবে।
তাঁতির ছেলে তাঁতি হবে, এই হলো চিরাচরিত বিধান। সেই তাতির ছেলের লেখাপড়া শেখার বিশেষ কোন উদ্যোগ কলম্বাসের বাড়াতে ছিল না। তবে হিসেবটা রাখা, নামটা সই করা, এগুলো দরকার—তাই কলম্বাসের বাবা ছেলেকে তাঁতশালায় ঢোকাবার আগে, কিছুদিনের জন্যে পাঠশালায় ভর্ত্তি করে দিলেন।
পাঠশালায় কিছুদিন পড়বার পর, সকলেই দেখলো যে, ছেলেটীর অসাধারণ গুণ। হাতের লেখা এত সুন্দর যে, দেখলে মনে হয় না যে, ছোট ছেলের লেখা। পাড়াপড়সীরা কলম্বাসের বাবার কাছে এসে বলে, তোমার ছেলে যদি বই নকল করে দিন চালায়, তাহলে দেখবে, সে বড়লোক হয়ে যাবে।
সে সময় হাতের লেখা নকল করার কাজের খুব চাহিদা ছিল। শুধু হাতের লেখা বলে নয়, অঙ্ক এবং ছবি আঁকাতেও কলম্বাস সব ছেলেকে ছাড়িয়ে গেল। সে সময় যারা বেশী লেখাপড়া শিখতে চাইতো, তাদের ল্যাটিন ভাষা পড়তে হতো; কারণ সে সময় য়ুরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যা কিছু ভাল বই, তা ল্যাটিন ভাষাতেই লেখা হতো। কলম্বাস সে অল্প বয়সে ল্যাটিন ভাষা এত তাড়াতাড়ি এবং এত ভাল রকম শিখে ফেল্লেন যে বুড়োরাও অবাক হয়ে গেল।
ছেলেবেলায় জেনোয়ার বন্দরে জাহাজগুলোর আসাযাওয়া দেখতে-দেখতে কলম্বাসের মনে দুরন্ত বাসনা হয়েছিল যে তিনি নাবিক হবেন, অমনি নাবিকদের মত দূর অজানা সমুদ্রে ঘুরে-ঘুরে বেড়াবেন। ভাল নাবিক হতে হলে, ভূগোল জানা চাই, আকাশের নক্ষত্রের বিষয়ও ভাল করে জানা চাই; কারণ, তখনও পর্য্যন্ত আকাশের তারা দেখে নাবিকেরা দিক্হীন সমুদ্রের মধ্যে দিক্ নির্ণয় করতো। তাই ছেলেবেলা থেকে নিজের চেষ্টায় তিনি ভূগোল এবং জ্যোতির্বিদ্যা শিখতে লাগলেন। কিন্তু বই পড়েই তো নাবিক হওয়া যায় না। জলে না নামলে যেমন সাঁতার কাটা শেখা যায় না, তেমনি জলে নেমে নৌকোয় না ভাসলে নাবিক হওয়া যায় না। স্কুলে পড়বার সময় যখনই সুবিধা-সুযোগ এসে জুটতো, কলম্বাস নৌকোয় চড়ে পাড়ি দিতেন। সে সব নৌকো অবশ্য বেশীদূর যেতো না, উপকূল ধরে-ধরেই চলতো।
তা ছাড়া তখন সমুদ্র-যাত্রার পথ এত ব্যাপক ও দীর্ঘও ছিল না। শুধু পালের ওপর ভরসা করে জাহাজ বা নৌকো সমুদ্রের ভেতরে বেশী দূরে যেতে সাহস করতো না। তখন য়ুরোপের লোকের কাছে, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা অজানা ছিল। আধখানা পৃথিবীর সঙ্গে বাকি আধখানার পরিচয় ছিল না। য়ুরোপের নাবিকেরা সমুদ্রের তীর ধরে ধরে য়ুরোপের সমুদ্রের ধারের বন্দরে যাতায়াত করতো। যে সময়ের কথা আমরা বলছি, সে সময় য়ুরোপে পর্ত্তুগীজরা খুব বড় নাবিকের জাত ছিল। তাদেরই মধ্যে দুঃসাহসী সব নাবিকেরা ছিল, যারা সমুদ্রের দূরপথে বাণিজ্যের জন্যে যাতায়াত করতো।
এই দূরপথের সীমানা ছিল, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার খানিকটা অংশ। দক্ষিণ আফ্রিকার অস্তিত্বই তখন তারা জানতো না। এই দূর-পথে যে-সব দুঃসাহসিক নাবিকেরা আসতো, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আর ফিরতো না। সেই জন্যে সাধারণ নাবিকেরা আর বেশীদূর অগ্রসর হতেও সাহস করতো না।
কিন্তু ভূগোল চর্চ্চা করে তখন বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একদল বলতে আরম্ভ করেছিলেন যে, পৃথিবী হলো গোলাকার। আগেকার লোকের ধারণা ছিল যে, আমাদের পৃথিবী হলো এক টুকরো বড় কাগজের মত সমতল। কিন্তু ক্রমশঃ লোকের ধারণা বদলাতে লাগলো। বৈজ্ঞানিকেরা একটার পর একটা প্রমাণ খুঁজে পেতে লাগলেন। তাঁরা বুঝলেন যে আমাদের পৃথিবীটা হলো একটা বলের মত গোল জিনিস! পৃথিবী যদি বলের মত গোলাকারই হয়, তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর যে-জায়গা থেকে যাত্রা করা যাবে, আবার মাত্রাশেষে সেইখানেই ফিরে আসা সম্ভব! বৈজ্ঞানিকেরা কাগজে কলমে অঙ্ক কসে বল্লেন, নিশ্চয়ই সম্ভব! কিন্তু কে তা কাজে প্রমাণ করে দেখাবে? এই কাল্পনিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে কে জীবন বিসর্জ্জন দিতে যাবে?
সেই সময়ে য়ুরোপের লোকের ধারণা ছিল যে, তাদের কাছ থেকে সব চেয়ে দূরের দেশ হলো, এশিয়া। তাদের ধারণা ছিল যে, য়ুরোপের তীর থেকে পশ্চিমমুখো হয়ে কেউ যদি আটলাণ্টিক সমুদ্র ধরে যাত্রা করে, তাহলে নিশ্চয়ই এশিয়ায় এসে পৌঁছবে। কারণ তখন তারা জানতো না যে, য়ুরোপ আর এশিয়ার মাঝখানে আমেরিকা বলে আর একটা মহাদেশ আছে। নানা বৈজ্ঞানিকদের লেখা থেকে লোকে এটা তখন স্থির সিদ্ধান্তে এসেছিল যে, আটলাণ্টিক মহাসাগরের ওপারে সমুদ্র-পথে এশিয়া আছে। কিন্তু আটলাণ্টিক সাগর পার হয়ে কে যাবে?
যুগ-যুগান্ত ধরে এই আটলাণ্টিক মহাসাগরের ভেতরের দিকটাকে মানুষ এক বিরাট ভয়ের চোখে দেখে এসেছে। আর তার এই ভয় অহেতুক নয়। পৃথিবীর উপকূল ছাড়িয়ে যারাই এই সমুদ্রের ভেতরে বেশীদূর যেতে সাহস করেছে, তারাই তাদের মৃত্যু দিয়ে জগতে প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছে, এই মহাসাগরের ভেতরে আছে মৃত্যুর রহস্য-লোক, ঝড়-তুফান—জলদৈত্য আর ভয়ঙ্কর সব জলজন্তুর রাজত্ব। সেখানকার অজানা জলরাজ্য হলো ঝড়ের জন্মভূমি, তুফানের খেলাঘর! সেখানকার বাতাসে— মৃত্যু-নীল জলে আছে, ভয়ঙ্কর সব জলজন্তু, যাদের নিঃশ্বাসে সেখানকার বাতাস বিষাক্ত হয়ে আছে, যারা হাঁ করলে এক-একটা আস্ত জাহাজ মানুষ-শুদ্ধ গিলে খেয়ে ফেলতে পারে।
কোন-কোন নাবিক নাকি অনেক দূর থেকে সেই ভয়ঙ্কর জলজন্তুর শুধু একটু পুচ্ছ-আলোড়ন দেখে ফিরে এসেছে, কেউ-কেউ নাকি ঝড়ের দিনের মেঘচুম্বী তরঙ্গশীর্ষে দেখেছে নামহীন সেই রহস্য-লোকের অধিবাসীদের অস্তিত্বের অস্পষ্ট ইঙ্গিত!
এই ভাবে সমুদ্র-পথ থেকে আগত নাবিকদের কাহিনী থেকে, লোকের মুখে-মুখে, যুগ-যুগ ধরে, মানুষ এই মহাসাগরের অন্তর্দেশকে জেনে এসেছে, তরল মৃত্যুর রহস্য-লোক রূপে··· যেখানে মানুষ তার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে যেতে পারে না, গেলেও যেখান থেকে ফিরে আসবার আর তার কোনও সম্ভাবনা নেই!
আবার কোন-কোন দুঃসাহসী নাবিক ভেবেছেন, যদি পৃথিবী গোল না হয়,...যদি এই কাগজের মত সমতল আর চ্যাপ্টা হয়!···তাহলে তো নিশ্চয়ই বেশী দূর গেলে, কোথায় শেষ সীমানায় এসে পড়তে হবে···সেখান থেকে হয়ত জাহাজ পড়ে যাবে কোন্ অতলে!...
কলম্বাস যখন সমুদ্রের নীল জলের দিকে চেয়ে-চেয়ে বড় হচ্ছিলেন, তখন তাঁর আশে-পাশে সমুদ্রের এই ভয়াবহ মূর্তিও তেমনি ভয়াল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যে প্রশ্ন শুধু লোকের মনে ভীতি উৎপাদন করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো, তাঁর মনে সে প্রশ্ন স্থায়ী বাসা নিয়ে বসলো। পৃথিবীর চেহারা যদি গোল হয়, এবং ভূগোল বলে তা নিশ্চয়ই গোল···তাহলে এই মহাসাগরের ওপারে নিশ্চয়ই আছে মাটির পৃথিবী...এবং সে মাটির পৃথিবী হলো এশিয়া... যেখানে আছে ভারতবর্ষ···যেখানকার মাটিতে সোনা, নদীর জলে সোনা···স্থলপথে সে-ভারতে যাবার পথ আজ বন্ধ···কারণ যে-পথ দিয়ে যেতে হবে, সে-পথ দুর্দ্ধর্ষ আরবদের অধিকারে······তারা বিধর্ম্মী ক্রিশ্চানদের সহা করে না···ভারতে পৌঁছবার দ্বিতীয় পথ আছে, এই মহাসাগরের তরঙ্গের মধ্যে...এই আটলাণ্টিক মহাসাগর ধরে সোজা পশ্চিমমুখো গেলে নিশ্চয়ই মাটি পাওয়া যাবে···ভারতবর্ষের মাটি···কিন্তু কে যাবে এই সাগরের মধ্যে?
নিশিদিন তিনি আপনার মধ্যে সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন···তাঁর মনে হয়, সাগর-তরঙ্গের মধ্য থেকে কে যেন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! তাঁর অন্তর তারস্বরে চীৎকার করে উঠে সায় দেয়···আমি যাব... আমি যাব...