সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/সাগর-জলে
সাগর-জলে
যেদিন কলম্বাস সাগর-জলে ভাসলেন, সেদিন যদি কোনও উপায়ে তিনি দেখতে পেতেন যে, সামনে তাঁর ভাগ্যে কি মহাদুর্দ্দৈব সব জমা হয়ে আছে, তাহলে —তিনি যেই হোন্ না কেন,—কখনই এই অভিযানে এক পা অগ্রসর হতে সাহসী হতেন না।
প্রথম দুদিন এক রকম নিব্বিঘ্নেই কাটলো। তৃতীয় দিন থেকে গণ্ডগোল দেখা দিতে লাগলো। তিনখানা জাহাজের ভেতর প্রথমে ‘পিন্টা’ জাহাজখানা গোলমাল শুরু করলো।
কলম্বাস লক্ষ্য করে করে দেখলেন যে, যে-লোকটার কাছ থেকে জাহাজখানি কেনা হয়েছিল, লোকটী বদমায়েসী করে তার কতকগুলো অংশ এমন যা-তা ভাবে জোড়াতাড়া দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল যে, সে নিশ্চয়ই অনুমান করেছিল, জাহাজখানি কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হবে।
মার্টিন পিন্জোন্ ছিলেন এই অভিযানে পিন্টার ক্যাপ্টেন। তিনি নিজে একজন খুব সুদক্ষ নাবিক ছিলেন। যখন তিনি দেখলেন যে পিন্টা গোলমাল শুরু করেছে, তিনি সমুদ্রের মাঝখানে কোন রকমে তাকে মেরামত করে চালাতে লাগলেন; কিন্তু ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত কোনমতে এসে, পিন্টা আর চলতে চাইলো না। কলম্বাস দেখলেন, সে জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের ভেতর আর অগ্রসর হওয়া নিরাপদ নয়। কাজেই ক্যানারী দ্বীপ থেকে পিন্টার বদলে আর একখানি জাহাজ জোগাড় করবার জন্যে তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন; কিন্তু সেখানে থাকতে-থাকতেই তিনি খবর পেলেন যে, তাঁকে ধরবার জন্যে পর্ত্তুগালের রাজার আদেশে সৈন্য নিয়ে পর্ত্তুগালের জাহাজ ছুটে আসছে।
পর্ত্তুগালের রাজা যখন শুনলেন যে কলম্বাস স্পেনের হয়ে অভিযানে বেরিয়েছেন, তখন প্রতিবেশীর হিংসায় তিনি মাঝপথে কলম্বাসকে বাধা দেবার জন্যে একদল সৈন্য দিয়ে জাহাজ পাঠিয়েছিলেন।
এই সংবাদ শুনে কলম্বাস ক্যানারী দ্বীপে আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। বিশেষ করে, তিনি আশঙ্কা করলেন, তাঁর সহযাত্রীরা যদি এই সংবাদ জানতে পারে, তাহলে তারা তো আর অগ্রসর হবে না—সমস্ত আয়োজন সূচনাতেই বিনষ্ট হয়ে যাবে! তাই আর কালবিলম্ব না করে, ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে সেই ভগ্ন-দেহ পিন্টাকে নিয়েই তিনি সমুদ্রের ভেতর ঢুকে পড়লেন।
কিছুদুর অগ্রসর হয়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে, পর্ত্তুগালের জাহাজ আর তাঁর নাগাল পেতে পারে না। তিনি কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করলেন।
এতক্ষণ পর্য্যন্ত কিন্তু তাঁর তট-ভূমি থেকে সমুদ্রের মধ্যে বেশী দূরে অগ্রসর হন নি···তট-ভুমি দৃষ্টি-সীমানার মধ্যে রেখেই তাঁরা অগ্রসর হচ্ছিলেন; কিন্তু ক্রমশ তট-রেখা অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে বাতাসের চেহারাও বলাতে লাগলো।
এতদিন শান্ত বাতাসে এক রকম নির্ব্বেঘ্নেই তাঁরা অগ্রসর হয়ে আসছিলেন। যাত্রা করবার সময় তাঁর সহযাত্রীদের মনে যে আশঙ্কা ছিল, তা ঐ ক’দিনের সুবাতাসে কথঞ্চিৎ বিদূরিত হয়ে আসছিল; কিন্তু তটরেখা থেকে তারা যতই সমুদ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলেন, বাতাসের শান্ত মূর্ত্তি ততই পরিবর্ত্তিত হয়ে যেতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর সহযাত্রীদের মনে আবার আতঙ্ক মাথা তুলে জেগে উঠতে লাগলো।
ক্রমশ বাতাস ঝড়ে পরিণত হলো, ঝড়ের সঙ্গে-সঙ্গে তরঙ্গের চেহারা বদলাতে লাগলো···সমুদ্র উন্মাদ নর্ত্তনে যেন লাফিয়ে চলেছে আকাশের মেঘকে স্পর্শ করবার জন্যে! যেদিকে চাও, সেদিকেই সেই মেঘস্পর্শী তরঙ্গের দল···তার মধ্যে তিন টুকরো তৃণখণ্ডের মত তিনখানি জাহাজ ঢেউ-এর মাথায় উঠছে আর নামছে...
কলম্বাসের সহযাত্রীরা ভেঙে পড়লো...
কলম্বাস তাদের বোঝালেন যে সমুদ্রের এই অস্বাভাবিক অবস্থা বেশীক্ষণ স্থায়ী হবে না—কিন্তু তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণিত হবার কোন লক্ষণই দেখা গেল না... বরঞ্চ কলম্বাসের আশ্বাস-বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবার জন্যই যেন দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, সেই ঝঞ্ঝা আর সেই তরঙ্গে চল্লো উন্মাদ সংগ্রাম...
দূরে ফেলে-আসা তট-ভূমির জন্যে সহযাত্রী নাবিকদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনিই বিনির্গত হতে লাগলো ···সমুদ্রের এ রূপ তো তারা দেখে নি...
ঝড়-ঝাপ্টা যে তারা ভোগ করে নি, তা নয়, কিন্তু এ-রকম অবিচ্ছেদ ঝড় আর তরঙ্গের সংগ্রাম তারা কখনও কল্পনার চোখেও দেখে নি...
দুর্দ্ধর্ষ শক্তিমান সব পুরুষ, আতঙ্কে আর্ত্তনাদ করে কাঁদতে আরম্ভ করলো···
কলম্বাসকে ফিরে যাবার জন্যে তারা সকলে মিলে অনুরোধ করলো, কিন্তু কলম্বাস অটল। ধীর-স্থির ভাবে তিনি নানা প্রলোভন দেখিয়ে, নানা স্তোকবাক্য দিয়ে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন; তিনি বল্লেন, যাত্র। যখন শুরু হয়েছে, ফিরে যাবার কথা ভাবা বৃথা···সামনেই আছে এশিয়ার তট-ভূমি···সেখানকার ধূলোতে স্বর্ণ-রেণু...সেখানকার পাহাড়ে প্রস্তরখণ্ডের মত পড়ে আছে, মণিমাণিক্য···অজস্র ঐশ্বর্য্য...
ঐশ্বর্য্যের প্রলোভনে তারা কথঞ্চিৎ শান্ত হলো... পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে সাহসে বুক বাঁধবার চেষ্টা টা করতে লাগলো ...কিন্তু তারা কতদূরই বা এসেছে... আর কতদূরই বা যেতে হবে? আর কতদূরে আছে সেই স্বর্ণ-রেণুর দেশ, মণি-মরকতের পাহাড়?
কলম্বাস বুঝলেন তার সহযাত্রীদের নিয়ে তাঁকে বিপদে পড়তে হবে। কারণ এ-কথাটা তিনি জানতেন যে, যে-পথটুকু আসা হয়েছে, যে-পথটুকু যেতে হবে তার তুলনায় তা কিছুই নয়। তখন তিনি চাতুরী করে দুটো লগ্-বই (Log-Book) তৈরী করলেন...একটা সত্যিকারের লগ্-বই, তাঁর নিজের জন্যে; তাতে তিনি লিখতেন, সত্যি-সত্যি কত মাইল আসা হলো, কোন্ দিকে জাহাজ যাচ্ছে, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয়। সেটা তিনি গোপনে রাখতেন। আর একটী লগ্-বই করলেন, সেটী প্রকাশ্যে সকলের দেখবার জন্যে থাকতো, তাতে তিনি মিথ্যা করে আশ্বাসজনক ভাবে সব-কিছু লিখতেন যখনই তাঁর সহযাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন করতো, তিনি দ্বিতীয় লগ্-বইখানি তাদের সামনে তুলে ধরতেন···
আরো কিছুদুর অগ্রসর হবার পর আর এক বিপদ দেখা দিল...মাঝে-মাঝে এমন নিবিড় কুয়াসা পড়তে লাগলো যে, তিনখানি জাহাজই কেউ কাউকে আর দেখতে পেতো না...সেই সময় কলম্বাসের ভয় হতো যে, হয়ত অন্য জাহাজ দু’খানা সেই কুয়াসার অন্তরালের সুবিধা নিয়ে উল্টো মুখ করে চলতে পারে···
ক্রমশ নাবিকদের ব্যবহারে তাঁর সন্দেহ ও আশঙ্কা দৃঢ়তর হতে লাগলো···তিনি লক্ষ্য করে দেখতে লাগলেন যে, যাদের হাতে জাহাজের গতি-নির্ণয়ের ভার ছিল, তারা রোজ একটু-একটু করে উত্তর-পূর্ব্বদিকে মুখ করে জাহাজগুলো চালাবার চেষ্টা করছে·· সেইজন্যে দিবারাত্রি তাঁকে সতর্ক হয়ে থাকতে হোতো।
জাহাজের প্রত্যেক কর্ম্মচারী যে-কোন মুহূর্ত্তে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে···বিরুদ্ধ প্রকৃতির মধ্যে এমন অনিচ্ছুক সহযাত্রীদের নিয়ে, অজানা পথে আর কাউকে কোন দিন এমন করে অভিযানে বেরুতে হয় নি··· অবশেষে জাহাজের কম্পাসের ভার তিনি নিজেই নিলেন।
এই সময় তিনি তাঁর ডায়রীতে এক জায়গায় লিখেছিলেন: চোখ থেকে নিদ্রা একেবারে চলে গেল···বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করা যায়, কিন্তু বিরুদ্ধ মানুষের সঙ্গে সংগ্রাম, আরো ভয়ঙ্কর···বিশেষ করে, যাদের সহায়ের ওপর নির্ভর করে পথ চলতে হবে, প্রতি মুহূত্তে যদি তারাই বিপথের চিন্তা করে...
এমনি করে দিনের পর দিন চলে গেল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ···চারিদিকে শুধু জল আর জল···লবণাক্ত নীল জল আর শুভ্র ফেনায় সমুদ্রের ক্রুর হাসি...
সেই লবণাম্বুধির একঘেয়েমীর মধ্যে মাঝে-মাঝে কদাচিং দু’একটি বৈচিত্র্যের দেখা পাওয়া যেতে লাগলে!···একদিন হঠাৎ দেখা গেল, ঢেউ-এ একটা ভাঙা মাস্তুল ভেসে চলেছে...
সেই ভগ্ন-তরীর নিদর্শন দেখে নাবিকদের মনে নতুন করে আবার আশঙ্কা জেগে উঠলে।···হয়ত একদিন এমনি ভাবে তাদেরও তরী ভেঙে তরঙ্গে ভেসে যাবে...
ভীত লোকের মনে আশার কারণও বিভীধিকার রূপ নিয়ে দেখা দেয়...এমনি আশঙ্কার মধ্যে হঠাৎ একদিন তারা এক জোড়া বিচিত্র পাখী মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলো...
কোথা হতে এলো এই পাখী? এই আশার শিখা জ্বলে উঠতে না উঠতে হঠাৎ আকাশে ধূম-পুচ্ছ ধূমকেতু দেখা দিল···সভয়ে নাবিকেরা দেখলো, ধূমকেতুর ল্যাজটা তাদের সামনেই আগুনের ঝাঁটার মত সাগর-জলে যেন নেমে গিয়েছে···
তখন ধূমকেতু সম্বন্ধে সাধারণ লোকের মনে এক ভয়াবহ ধারণা ছিল···ধূমকেতু হলো বিপদের অগ্রদূত... বিশেষ করে সেই দিক্হীন সমুদ্রের মাঝখানে তাদের ভীত, আতঙ্কিত মনে সেই ধূমকেতুর অকস্মাৎ আবির্ভাব যেন তাদের অচির-বিনাশের ভবিষ্যৎ বাণীর মত তাদের সামনে জেগে উঠলো...
তারা সকলে হাল ছেড়ে দিয়ে সমস্বরে চীৎকার করে উঠলো, আর নয়!
সেই সময় হঠাৎ পিন্টা জাহাজ থেকে ইঙ্গিতে সংবাদ জানানো হলো,—সামনে তারা যেন একফালি জমি দেখতে পাচ্ছে...
চকিত উল্লাসে তাদের সকলের বুক দুলে উঠলো ...মুহূর্ত্তের মধ্যে সমস্ত আশঙ্কা দূরে ফেলে দিয়ে তারা আবার হাল ধরলো···উল্লাসে চীৎকার করতে-করতে তারা দিক্-রেখায় দৃশ্যমান সেই তট-রেখার দিকে জাহাজ ছুটিয়ে চল্লো— কিন্তু কিছুক্ষণ যাবার পর, তারা বুঝলো, তাদের দৃষ্টি-বিভ্রম! ও তট-রেখা নয়···দিগন্ত রেখার ধূসর মেঘ ·সমুদ্রে স্থলের মরীচিকা...
সমস্ত নাবিক এবার ক্ষেপে উঠলো···কিন্তু তাদের নায়কের মুখে ভয়ের রেখামাত্র নেই···দিনের পর দিন তিনি সেই এক আদেশ একই কণ্ঠস্বরে দিয়ে চলেছেন, ‘Westward always...বরাবর পশ্চিম দিকে···সোজা পশ্চিমমুখে। চল।’ ...
তারা বুঝলো যে একজন উন্মাদ লোকের পাল্লায় পড়ে তারা নিশ্চিত মরণের রাজ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে...কিম্বা সমুদ্রের মধ্যে যে মায়া-রাজ্যের কথা তারা শুনেছিল, তারই মধ্যে তারা এসে পড়েছে...মাঝে-মাঝে তারা যে জীবনের চিহ্ন দেখে,—ভেসে-আসা কাঠ, উড়ে-যাওয়া পাখী,—ও শুধু মায়ারাজ্যের যাদু...
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর সবাই তারা দেখলো, কেমন এক ধরণের সামুদ্রিক আগাছা ভেসে আসছে... এগিয়ে গিয়ে দেখে, এমন আগাছা-বন সমুদ্রের ভেতরে যে, তাদের জাহাজ অতি কষ্টে তা এড়িয়ে এগুতে পারলো...
হঠাৎ সমুদ্রের মাঝখানে কোথা থেকে এলো এমন আগাছার বন? এ নিশ্চয়ই কোন যাদুরাজ্যে তারা চলে এসেছে...
কলম্বাস তাদের অনেক বোঝালেন— আর বেশী দূর নেই···তারা এসে পড়েছে...
কলম্বাসের কথার সমর্থনের জন্যে কোথা থেকে তিনটী পাখী জাহাজের মাস্তুলের ওপর দুদিন ধরে বসে আপনার মনে গান গাইতে লাগলো...শান্ত সমুদ্রের মধ্যে সূর্য্যের রূপালি কিরণ ঝিকমিক করে উঠলো— নাবিকদের মনে আবার আশা জেগে উঠলো...
পাখীদের দেখিয়ে কলম্বাস আশ্বাস দিয়ে বল্লেন, ওরা হলো মাটির জীব...যদিও ওরা উড়ে আকাশে, কিন্তু মাটিতে গাছের ওপর থাকে ওদের নীড়...ওরা এসেছে সামনে মাটির বার্ত্তাবহ হয়ে...
নাবিকরা জাহাজের পাটাতনে বসে সেদিন সূর্য্যকরে শান্ত সমুদ্র থেকে জল তুলে কথঞ্চিৎ আশ্বস্তচিত্তে স্নান করতে লাগলে।···এমন সময় সেই নির্ম্মল নির্মেঘ আকাশ দেখতে-দেখতে কালো হয়ে গেল...শান্ত সাগর গর্জ্জন করে অশান্ত হয়ে উঠলে।···নিমেষের মধ্যে যে ছিল শাদা, সে হয়ে গেল কালো···যে ছিল শান্ত, সে হয়ে উঠলো, দুর্দ্দান্ত! কোথায় উড়ে গেল পাখা, চলে গেল সূর্য্যের আলো, সেই সঙ্গে ভেঙে ভেসে চলে গেল নাবিকদের মনে যেটুকু আশা বা আশ্বাস জেগে উঠেছিল—
তাদের বুঝতে আর বাকী রইলো না যে, তারা যাদুর রাজ্যে এসে পড়েছে···নইলে, এইমাত্র শান্ত সমুদ্র সূর্য্যের আলোয় ঝিকমিক করছিল...কোথা থেকে এলো মেঘ, এলো ঝড়, জাগলো তুফান!
কলম্বাস নিজেও বিস্মিত হয়ে গেলেন, এমন সূর্য্যকরোজ্জ্বল গগন থেকে যে এমন অতর্কিতে প্রাকৃতিক বিপর্য্যয় হতে পারে, সে অভিজ্ঞতা তখন পর্য্যন্ত তাঁর হয় নি···সমুদ্রের মাঝখানে মাঝে-মাঝে এই রকম অতর্কিত ভাবে প্রাকৃতিক বিপর্য্যয় ঘটে...
এবার আর তেমন জোরের সঙ্গে তিনি সহযাত্রীদের আশ্বাস দিতে পারলেন না···তখন প্রকাশ্যে তারা তাঁকে উপহাস করতে আরম্ভ করতে লাগলো...
ব্যঙ্গ আর উপহাসের প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশের তলায় কলম্বাস বুঝলেন, একটা গভীর ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে চলছে ...তিনি একা...আর তাঁর বিরুদ্ধে···একশো ঊনিশ জন...
নাবিকদের মধ্যে তখন সত্যই বিদ্রোহের শিখা মাথা তুলে জেগে উঠলো— তারা বল্লো, লোকটা পাগল... নিজে কবে স্পেনের রাজ-প্রতিনিধি হবে, সেই নেশায় লোকটা উন্মাদ···সেই উন্মাদের পাল্লায় পড়ে আমরাও বেঘোরে মরতে চলেছি···কিন্তু কেন? কেন আমরা তাকে মানবো? আজও, তবু যা হোক্ কিছু ক্ষিদের সময় মুখে দিতে পারছি, কিন্তু আর কয়েক দিন পরে, জাহাজে যা খায় আছে তা-ও তো শেষ হয়ে যাবে...তখন কি সমুদ্রের লোণাজল আর ভিজে বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকা যাবে? অতএব এসো, সবাই মিলে, তাঁকে ধরে, এই সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়ে, এখনো ফেরবার চেষ্টা করি।
কিন্তু কে কলম্বাসের গায়ে হাত দেবে? সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করতে-করতে লোকটার চেহারার মধ্যে খানিকটা যেন সমুদ্রের গাম্ভীর্য্য ঢুকে গিয়েছিল...একদল লোক আসে, মানুষকে শাসন করবার জন্যেই···তাদের কথা, তাদের দেহের ভঙ্গী, তাদের মুখের প্রত্যেকটী রেখা... তাদের এমন একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বে মণ্ডিত করে যে, তাকে স্পর্শ করা, তাকে আঘাত করা···সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব সহজ ব্যাপার হয় না! কিন্তু তবুও কলম্বাস জানতেন যে, আর বেশী দিন এভাবে তারা তাঁকে মানতে পারে না···ভয়ে আতঙ্কে এবং আশাহীনতায় তারা প্রায় সেই সীমানায় এসে পড়েছে, যেখানে আঘাত করা ছাড়া বাঁচবার আর কোন উপায় থাকে না!
একদিন যখন বুঝলেন যে তাঁর জাহাজের নাবিকেরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবার জন্যে সমবেত হয়েছে, তিনি একা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ভাবে তাঁদের মাঝখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন···গম্ভীর ভাবে তাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে চেয়ে তিনি বল্লেন, আমি জানি, তোমরা কেন এখানে সমবেত হয়েছ···আমাকে এই সমুদ্রের জলে ফেলে রেখে তোমরা ফিরে যাবে? কিন্তু ভেবেছ কি যাবে কোথায়? কে তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে? আর আমাকে বাদ দিয়ে দেশে ফিরে গেলে ভেবেছ, রাজা তোমাদের খুশী হবেন...? তোমাদের প্রত্যেকের হবে মৃত্যু-দণ্ড ...অতএব, শান্ত হও...জানি তোমাদের মন উদ্বেল হয়ে উঠেছে···কিন্তু তবুও আমি বলছি···যেমন প্রত্যক্ষ সত্য এই আমি তোমাদের সামনে রয়েছি···তেমনি সত্য, তোমাদের সামনে আছে মাটির তীর-ভূমি···আমি উন্মাদ নই···তোমাদের মত আমারও ঘর-সংসার আছে...নিজের জীবনের প্রতি মায়া-মমতা আছে...
সহসা তারা সকলেই যেন অস্ত্রহীন হয়ে পড়লো! সত্যই তো, ফিরে কোথায় যাবে? আর ফিরে গেলেই কি মৃত্যুর হাত এড়ানো যাবে? আবার তারা পড়লো, সন্দেহের মধ্যে···সামনেও মৃত্যু ···পেছনেও মৃত্যু···তারা যেন ক্রমশ জড় পদার্থের মত হয়ে এলো...
এমন সময় অগ্রগামী পিন্টা থেকে তার ক্যাপ্টেন আবার ইঙ্গিত করলেন, মাটি...মাটি সামনে মাটির পৃথিবী...!
পিন্টা থেকে সেই সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নাবিকেরা ছুটে জাহাজের ডেকে এসে নতজানু হয়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালো।
কলম্বাস অনুমান করেছিলেন যে তিনি জাপানের কাছাকাছি এসে পড়েছেন···কৌতূহল দমন করতে না পেরে তিনি জাহাজের মাস্তুলের ওপর চড়ে দেখতে লাগলেন···কিন্তু কোথায় মাটি? আবার মরীচিকা তাঁদের ছলনা করেছে···দূরে যা মাটির তাঁর বলে মনে হয়েছিল, তা আসলে হলো মেঘ..
কলম্বাস ঘোষণা করেছিলেন যে, যে-লোক জাহাজ থেকে প্রথম তীর দেখতে পাবে, তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে···সেইজন্যে প্রত্যেক নাবিকই উদ্গ্রীব হয়ে দূরের দিকে চেয়ে থাকতো...এবং যখনই যার মনে হতো যে তীর দেখেছে, অমনি সে চীৎকার করে উঠতো···তার ফলে জাহাজে প্রত্যেক লোকের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যেতো···কিন্তু প্রত্যেকবারই তারা ভুল করতো···তার ফলে প্রায়ই বিফলতার ব্যথার আঘাত প্রত্যেককেই ভোগ করতে হতো···সেইজন্যে তিনি নতুন করে ঘোষণা করলেন যে, একবার ভুল করে যে চীৎকার করবে, সে যদি পরে সত্যি-সত্যিই তীর দেখতে পায়, তাহলে ঐ ভুলের জন্যে সে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবে...
তখন থেকে নাবিকরা সাবধান হয়ে গেল...
পুরস্কার পাক আর নাই পাক, তীর কোথা? অবশেষে একদিন সেই মুহূর্ত্ত এলো···কলম্বাসের নিজের জাহাজে। নাবিকেরা সকলে একত্র হয়ে কাজ ছেড়ে দিয়ে কলম্বাসকে ধরলো, যদি এই মুহূর্ত্তে তিনি জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে স্পেনের দিকে না ফেরেন, তাহলে তারা নতুন ক্যাপ্টেন ঠিক করে, জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে যাবে...তারা আর কেউ অগ্রসর হবে না...
প্রকাশ্য বিদ্রোহ!
ক্ষুধিত বন্য পশুর মত কলম্বাস দেখলেন, তাঁর সামনে সেই মৃত্যুভয়-ভীত মানুষের দল...কি বলে তাঁদের আশ্বাস দেবেন? আশ্বাস দেবার যা কিছু ছিল, তা সব শেষ হয়ে গিয়েছে! তবে কি এমনি ভাবে এতদিনের সঞ্চিত আশা স্বপ্নের মতই শেষ হয়ে যাবে? তবুও তিনি সেই ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী জনতার সামনে মাথা উঁচু করে বল্লেন, তীরে না পৌঁছনো পর্য্যন্ত আমি জাহাজের মুখ ফেরাবো না!
সহসা জনতার মধ্যে নীরবে যেন কিসের একটা তরঙ্গ বয়ে গেল! কলম্বাস একা দাঁড়িয়ে দেখলেন, আক্রমণ করবার আগে বন্য পশু যেমন ভাবে তার নখদন্ত ঘর্ষণ করে, তাঁর সামনে ক্রুদ্ধ জনতা তেমনি নখদন্ত ঘর্ষণ করছে···হয়ত আর কয়েক মিনিট পরে তারা সকলে মিলে তাঁকে আক্রমণ করবে...
সহসা তিনি করজোড় করে, কাতর কণ্ঠে তাদের ডেকে বল্লেন, বন্ধুরা, মাত্র আর তিনদিন সময় আমাকে দাও!
ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ জনতা এ ওর মুখ-চাওয়াচায়ি করে নীরবে আবার যে যার কাজে ফিরে গেল...মাত্র আর তিন দিন সময় বইতো নয়!
দেখতে-দেখতে দু’দিন কেটে গেল...কলম্বাসের চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে এলো...তাঁর দেহের ভেতর থেকে যেন প্রতি লোম-কূপে চক্ষু ফুটে উঠেছে—সেই লক্ষ-লক্ষ চক্ষু দিয়ে তিনি দিক্-রেখার দিকে চেয়ে আছেন.. এতদিনের আশা, সে কি এত বেদনার পর, এমনি ভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে?
তৃতীয় দিনের দিন, সকালবেলা হঠাৎ কলম্বাস দেখলেন, সমুদ্রের তরঙ্গে একটা গাছের ডাল ভেসে চলেছে ...তাতে কালোজামের মত ফল তখনও লেগে রয়েছে...
সেই সামান্য একটি ভাঙা ডাল···কি যে আশার আলো নিয়ে এলো···সেদিন রাত্রিবেলা কেউ আর ঘুমোলো না।
হঠাৎ রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে কলম্বাস যেন দূরে একটা আলো দেখতে পেলেন, তিনি তাঁর জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ডাকলেন···হাঁ, সত্যিই তো আলো একটু করে দেখা যাচ্ছে···আবার কিছুক্ষণ দেখা যাচ্ছে না...
একে-একে জাহাজের সব নাবিকেরাই দেখলো··· একসঙ্গে উন্মাদের মত তারা চীৎকার করে উঠলো, “আলো—আলো!”
আশা করতেও ভয় হয়, কতবার আশা ভেঙে গিয়েছে! তাই তারা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে দিগন্ত-রেখার দিকে চেয়ে রইলো···কেউ নড়ে না, চড়ে না, যেন সব পাথরের মানুষ···তাদের চোখের পাতা পর্য্যন্ত পড়ে না, যেন পাথরের চোখ...
ঘণ্টাখানেক পরে পিন্টা থেকে ছোট্ট নৌকো করে একদল লোক সাণ্টামেরিয়াতে এলো···আবেগে কাঁপতে-কাঁপতে তারা বল্লো, তাদের জাহাজে রডারিগো বলে একজন লোক আছে, তার চোখের দৃষ্টি খুব ধারালো.. সে দেখেছে, দূরে তট-ভূমি রয়েছে...
মানুষের মনের কাঁপনের সঙ্গে তাল রেখে কাঁপতে-কাঁপতে জাহাজ এগিয়ে চল্লো...
কিছুক্ষণ পরে কলম্বাস তার যন্ত্র দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলেন, সামনে তাঁর বহু-আকাঙ্ক্ষিত তট-ভূমি!
উল্লাসে, আনন্দে, আবেগে, তাঁরা সকলে চীৎকার করে উঠলেন! সে চীৎকার আকাশে প্রতিধ্বনি জাগিয়ে তুল্লো।