সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/নূতন জগৎ
নূতন জগৎ!
১২ই অক্টোবর, ১৪৯২, যখন সূর্য্য উঠলো—একশো কুড়ি জোড়া চোখ আদিম-বিস্ময়ের চোখে সামনে দেখলো ...বহুদূর বিস্তৃত ভূ-খণ্ড···সমুদ্র শান্ত···আকাশ নির্মেঘ, নির্ম্মল···চারিদিক প্রসন্ন, স্বচ্ছ, পরিষ্কার!
জাহাজ থেকে তাঁরা স্পষ্ট দেখতে পেলেন···সামনে তট-ভূমির বনের ভেতর থেকে মানুষেরা একদৃষ্টিতে তাঁদের জাহাজের দিকে চেয়ে আছে···কেউ-কেউ আবার লোকজনদের ডাকছে...বেশ যেন একটা কৌতূহল পড়ে গিয়েছে...
তীরের কাছাকাছি এসে, জাহাজগুলি সমুদ্রের বুকে রেখে, কলম্বাস একটা ছোট্ট নৌকোতে নামলেন। নামবার আগে, স্পেনের জাতীয় পোষাকে, রক্ত-রাঙা মখমলের পরিচ্ছদ্ ধারণ করলেন, সঙ্গে মার্টিন পিন্ জোন এবং তাঁর ভাই, তাঁদের দুজনের হাতে দু’টি পতাকা, পতাকায় আঁকা সবুজ রঙের ক্রস্, একটিতে ‘F’ লেখা, আর একটিতে ‘I’ লেখা, Ferdinand এবং Isabella-র আদ্য অক্ষর। এইভাবে স্পেনের রাজা ও রাণীর নাম-অঙ্কিত পতাকা হাতে তাঁরা তট-ভূমির দিকে অগ্রসর হলেন।
তীরে নেমে মাটিতে নতজানু হয়ে কলম্বাস ভগবানকে ধন্যবাদ জানালেন, তাঁর দু’চোখ দিয়ে তখন আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ছে; তাঁর দেখাদেখি তাঁর সঙ্গের লোকেরাও নতজানু হয়ে প্রার্থনা জানালে।
প্রার্থনা থেকে উঠে কলম্বাস নিজের হাতে সেই নব-আবিষ্কৃত দেশের মাটিতে স্পেনের পতাকা পুঁতে দিলেন এবং সেই অজানা দেশের নামকরণ করলেন ‘সান্ সাল্ভাডোর' (San Salvador)।
সঙ্গের নাবিকেরা সকলে সমস্বরে কলম্বাসের জয়গান গেয়ে উঠলো এবং যাত্রার সময় তাদের ব্যবহারের জন্যে তারা অনুতপ্ত হৃদয়ে কলম্বাসের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লো...এবং প্রতিজ্ঞা করলো, আমরণ পর্য্যন্ত তারা কলম্বাসের আনুগত্য করবে।
কলম্বাসের ধারণা ছিল যে তিনি ভারতবর্ষের মাটিতেই বা তার কাছাকাছি দেশেই পদার্পণ করেছেন! তাই তাঁর সহযাত্রীরা সেখানেই তাঁকে Admiral and Viceroy of the indies—এই উপাধিতে ভূষিত করলো। আনন্দের আতিশয্যে তারা পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করলো...তাদের চোখের সামনে, সকল বিপদ-অন্তে কলম্বাস দেবতার মত এক ঐশ্বরিক বিভূতিতে জেগে উঠলেন···
কলম্বাস আনন্দিত-চিত্তে তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানালেন···অতীতের ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি সেই বিরাট জয়গৌরবের মধ্যে নিমেষে বিলুপ্ত হয়ে গেল...
ইতিমধ্যে সেই দেশের লোকেরা শ্বেতচর্ম্ম এই অদ্ভুত লোকদের ক্রিয়াকাণ্ড দূর থেকে দেখছিল। যেহেতু কলম্বাসের ধারণা হয়েছিল যে তিনি ইণ্ডিয়ার মাটিতে এসে পড়েছেন, সেহেতু সেখানকার লোকদের তাঁরা Indian বলে পরিচয় দিতে লাগলেন এবং কলম্বাসের এই ভুল ইতিহাসে রয়ে গেল অক্ষয় হয়ে। আজও পর্যন্ত আমাদের দেশের নামে···আমেরিকার সেই আদিম অধিবাসীরা Indian বা Red-Indian নামেই পরিচিত হয়ে আসছে...কলম্বাস যে আমেরিকার মাটিতে পদার্পণ করেছেন, সেধারণা কলম্বাসের ছিল না...
ইণ্ডিয়ানরা প্রথমে ভয়ে কাছে আসতে চায় নি...ক্রমশ তাদের যখন ভয় ভেঙে গেল, তাদের ধারণা হলো যে, এই নবাগত লোকগুলি নিশ্চয়ই দেবতা, আকাশ থেকে ঐ ডানাওয়ালা জাহাজে করে নেমে এসেছে! কাছে এসে তারা কলম্বাসের লোকদের গায়ে হাত দিয়ে দেখে, তাদের গায়ের রঙ ও-রকম শাদা কেন!
যখন তাদের ভয় ভেঙে গেল, তারা তাদের গাছের ফলমূল যা ছিল, সব এনে উপহার দিতে লাগলো...কলম্বাস তাদের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করবার জন্যে লোকদের আদেশ দিলেন···সেই সরল আদিম অধিবাসীদের সামান্য কাঁচের গেলাস পেয়েই তখন কি আনন্দ! ক্রমশ তাদের যখন ভয় ভেঙে গেল, তাদের সাতজন লোককে নিয়ে কলম্বাস আবার জাহাজ ছেড়ে দিলেন···
‘সান্ সাল্ভাডোর্’ ত্যাগ করে তাঁরা ক্রমশ ছোট-ছোট বহু দ্বীপের মধ্যে এসে পড়লেন, কিউবা, হাইতি···যখন কলম্বাস এই সব দ্বীপ পরিভ্রমণ করছিলেন, সেই সময় পিন্টার ক্যাপ্টেন পিন্জোন একদিন রাত্রির অন্ধকারে তাঁর জাহাজ নিয়ে সরে পড়লেন···
কলম্বাসের জয়ে তাঁর মনে এক দুরাকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল···কলম্বাসের কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন, এই সব দ্বীপের কাছাকাছি কোন জায়গায় সোনার পাহাড় আছে···কলম্বাসও সেই সোনার দেশের সন্ধানে ঘুরছিলেন···পিন্জোন ভাবলো, সে নিজেই সে দেশের সন্ধান বার করবে এবং কলম্বাসের আগে দেশে ফিরে গিয়ে এই অভিযানের কৃতিত্ব সে সমস্তই নিজে নেবে···দুর্ভাগ্যক্রমে যদি সে পথহারা হয়ে পড়ে, তাহলে সে বলবে যে রাত্রির অন্ধকারের মত পথ হারিয়ে সে একলা চলে যেতে বাধ্য হয়। এই মতলব করে সে দল ছেড়ে পিন্টাকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
কলম্বাস কিউবা, হাইতি এবং আশে-পাশের সমস্ত দ্বীপ, পরিভ্রমণ করে তাঁর কল্পিত সোনার খনির সন্ধান কোথাও পেলেন না বটে, কিন্তু তিনি এত অপর্য্যাপ্ত নতুন ধরণের গাছ-গাছড়া, ফল-ফুল এবং জীব-জন্তু দেখলেন যে, তাঁর বিস্ময়ের অবধি রইলো না। এই অভিযানেই তিনি প্রথম দেখলেন যে, এই সব দ্বীপের অধিবাসীরা কি একরকম গাছের পাতা পুড়িয়ে তার ধোঁয়াটা খাচ্ছে...কলম্বাস বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সেই বিচিত্র গাছের পাতা কিছু তাঁর সঙ্গে তুলে নিলেন···এই পাতাই হলো তামাকপাতা···কলম্বাসের সঙ্গে তামাক-পাতা এইভাবে য়ুরোপে প্রথম প্রবেশ করলো।
অবিরত পরিভ্রমণ করতে করতে ক্রমশ জানুয়ারী মাস এসে গেল···আর বেশী বিলম্ব করলে হয়ত পিন্টা তাঁর আগে গিয়ে পৌঁছবে এই আশঙ্কায় কলম্বাস এতদিন পরে, আবার স্পেনের দিকে জাহাজের মুখ ঘোরালেন। ফেরবার পথে তাঁর লোকেরা যখন এক জায়গায় নেমে স্নান করছিল, সেই সময় হঠাৎ ঘোর কৃষ্ণবর্ণের একদল লোক তাদের আক্রমণ করলো।
এ পর্য্যন্ত সেখানকার কোন লোকই তাদের কোন আক্রমণ করে নি...কিন্তু এখন যারা আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো, সেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ লোকেরা হলো নরখাদক...বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কলম্বাসকে অস্ত্র ধারণ করতে হলো এবং যখন তাদের দুজন-চারজন লোক বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গেল...তখন তারা আবার বনের মধ্যে পালিয়ে গেল···শ্বেতাঙ্গদের কর্ত্তৃক নতুন জগতে এই হলো প্রথম রক্তপাত...
পথে ফেরবার সময় কলম্বাস দেখলেন পিন্টা দূরে তাঁর সামনেই চলেছে...এমন সময় তুমুল ঝড় উঠলো... পিন্টার ক্যাপ্টেন তাঁর কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলো; কিন্তু তখন ঝড়ের এ-রকম রুদ্র মূর্ত্তি যে তিনখানি জাহাজের একখানিরও রক্ষা পাওয়ার কোন আশাই রইলো না...
পাঁচদিন ধরে ক্রমান্বয়ে সেই ঝড় তেমনি ভয়ঙ্কর ভাবে বইতে লাগলো...কলম্বাসও যখন বুঝলেন যে, এ-যাত্রায় আর রক্ষে নেই...তখন তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনী, যা পথে লিখে রেখেছিলেন, একটা টিনের ক্যানাস্তারার মধ্যে পূরে, ভাল করে সীল্ করে জলে ভাসিয়ে দিলেন...তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যদি তাঁরা না বাঁচেন, হয়ত একদিন তাঁদের এই কাহিনী সভ্য জগতে গিয়ে পৌঁছুতে পারে...
কিন্তু কলম্বাসের সৌভাগ্য, দু’দিনের দিন ঝড় থামলো ...একটি প্রাণীও সেই ঝড়ে ডুবে যায় নি···তবে জাহাজ তিনখানিই ভেঙে-চুরে গিয়েছিল...কলম্বাস সেই জীর্ণ তরী নিয়ে অসহায়-ভাবে কোনমতে য়ুরোপের তট-ভূমি পর্ত্তুগালে এসে পৌঁছলেন...