সাবাইস বুদ্ধি/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 সুশীলার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, অনুমানে ইহাই করিয়া, আমরা তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, কিন্তু সেই যে এই কার্য্যের প্রকৃত নায়িকা, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? যে পর্যন্ত তাহাকে ঐ জহুরি বা তাহার অপর কোন কর্ম্মচারী দেখিতে না পান, সেই পর্যন্ত কোন কথা নিশ্চয়রূপে বলা যাইতে পারে না।

 জহুরির সেই প্রধান কর্ম্মচারীর চিকিৎসা সেই হাসপাতালেই উত্তমরূপে হইতে লাগিল। ঐ স্থানের ডাক্তারগণের বিশেষ যত্নে তিনি ক্রমেই আরোগ্যলাভ করিতে লাগিলেন। চারি দিবস পরে তাহার হুস্ হইল, সেই সময় হইতে আস্তে আন্তে তিনি তাঁহার নিজের অবস্থা বিবৃত করিতে সমর্থ হইলেন। তাঁহার নিকট হইতে ক্রমে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবগত হইতে পারিলাম। তিনি আমাদিগের নিকট ক্রমে যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার কতক অংশ এইস্থানে বর্ণিত হইলেই পাঠকগণ জানিতে পারিবেন যে, তিনি কিরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া এইরূপ সাংঘাতিক আঘাত প্রাপ্ত হন, ও কিরূপেই বা তাঁহার নিকট হইতে অলঙ্কারগুলি অপহৃত হয়।

 তিনি বলিয়াছিলেন, আমি তাঁহাকে নিতান্ত সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক মনে করিয়াই প্রথমতঃ তাঁহার সহিত তাঁহার ব্রুহেম গাড়ীর একাসনে উপবেশন করিতে অসম্মত হই, কিন্তু পরিশেষে তাঁহারই ইচ্ছা অনুসারে সেই ব্রুহেম গাড়ীতে আরোহণ করিয়া তাঁহারই পার্শ্বে উপবেশন করি। গাড়ী চলিতে থাকে। গাড়ী চলিবার সময় তাঁহার বসিবার ভাব ভঙ্গি ও আমার সহিত যেরূপ ভাবে কথাবার্তা করিতে আরম্ভ করেন, তাহাতে তাঁহাকে চরিত্রবতী স্ত্রীলোক বলিয়া আমার বোধ হয় না। আমার সেই সময়ে মনে হয় যে, ইনি যদি সেই কৌন্সলির প্রকৃতই স্ত্রী হন, তাহা হইলে তিনি ইহাকে লইয়া কখনই সুখী নহেন। আমার মনে এইরূপ নানা প্রকার তর্ক আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল, আমি আমার মনের ভাব অনেক কষ্টে গোপন করিয়া তাহার সহিত গমন করিতে লাগিলাম। গাড়ী যে কোথা দিয়া কোথায় গমন করিতে লাগিল, রাত্রিকালে তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। গাড়ী ক্রমশই গমন করিতে লাগিল, ক্রমে অন্ধকারের মধ্যে একটা বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া ঐ গাড়ী থামিল। গাড়ী থামিবামাত্র তিনি আমাকে সেইস্থানে অবতরণ করিতে কহিলেন। সহিস গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল, আমি গাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। আমি যেমন গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম, সহিস ঐ দরজা অমনি বন্ধ করিয়া দিল, স্ত্রীলোকটা কিন্তু গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন না। আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করিবামাত্র কোচমান ঘোড়াকে কষাঘাত করিল, চাবুক খাইয়া ঘোড়া উদ্ধশ্বাসে ছুটিল, দেখিতে দেখিতে স্ত্রীলোকটীর সহিত ঐ গাড়ী নয়নপথের বহির্গত হইয়া পড়িল। আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, যে সময় আমি গাড়ীতে ঐ স্ত্রীলোকটীর সহিত গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় তিনি ঐ অলঙ্কারগুলি আমার নিকট হইতে কোনরূপে হস্তগত করিবার মানসে নানারূপ উপায় অবলম্বন করেন, কিন্তু আমি কোনরূপেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, নানা ওজর আপত্তি করিয়া কিছুতেই ঐ সকল অলঙ্কার তাহার হস্তে প্রদান করি না। যে সময় আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করি, সেই সময় সমস্ত অলঙ্কারগুলিই আমার নিকট রহিল।

 গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার পর আমি যে কোন স্থানে আসিয়াছি, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে পারিলাম না, কিন্তু ঐ স্থান যে সহরের মধ্যে নহে, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। ঐ স্থানে গ্যাসের আলোকমাত্র নাই, বহু দূরে দূরে একটা একটী তেলের আলো মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছে, ঐ আলোকে রাস্তা আলোকিত হওয়া দুরে থাকুক, আরও যেন কেমন একরূপ চক্ষে ঝাপসা ঝাপসা বোধ হইতে লাগিল। যে বাড়ীর সম্মুখে আমি অবতরণ করিয়াছিলাম, তাহাও অন্ধকারময়, উহার কোন স্থান হইতে একটা আলোকও দৃষ্টিগোচর হইতেছে না, অনুমান হয় ঐ স্থান একেবারে জনশূন্য। রাস্তার উপর একটা লোককেও যাতায়াত করিতে দেখিতে পাইলাম না। আমি এইরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া কি করিব বা কোথায় যাইব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। যেন অনন্যা পায় হইয়া একদিক অবলম্বন করিয়া চলিতে লাগিলাম, কোথা যাইতেছি, তাহা জানি না; কোন্ স্থানে আসিয়াছি, তাহা জানি ও কোন্ দিকে গমন করিতেছি, তাহা জানিতে পারিতেছি না, অথচ চলিতে লাগিলাম, কিন্তু একটা জনমানবকেও দেখিতে পাইলাম না। এইরূপ অবস্থায় আমি কিয়ৎদুর গমন

করিয়াছি, এরূপ সময়ে হঠাৎ পশ্চাৎদিক হইতে কে আসিয়া আমার মস্তকে সজোরে এক আঘাত করিল। কে যে আঘাত করিল বা কিসের দ্বারা আঘাত করিল, তাহার কিছুই বুঝি পারিলাম না। আমি অজ্ঞান অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া গেলাম; তাহার পর আমার যে কি দশা ঘটিয়াছে, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি। আমি বেশ বলিতে পারি যে, যে সময় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি, সেই সময় অলঙ্কারগুলি আমার নিকটেই ছিল। যখন আমার হুস হইল, তখন আমি দেখিলাম, আমি এই হাসপাতালের মধ্যে অবস্থান করিতেছি।

 ইহার কথা শুনিয়া আমরা বিশেষ কিছুই বুঝিয়া উঠিত পারিলাম না। সুশীলাই হউক বা অপর কোন স্ত্রীলোকই হউক, সে অলঙ্কারের সহিত ইহাকে সেই জহুরির দোকান হইতে নিজের গাড়ীতে করিয়া আনিয়াছিল, সে উহার নিকট হইতে সকল অলঙ্কার গ্রহণ না করিয়া, উহাকে ঐরূপ অবস্থায় অন্ধকারের মধ্যে একটা অপরিচিত স্থানে পরিত্যাগ করিয়া যাইবে কেন? ইহার এরূপ কার্য্যের ত কোনরূপ কারণ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আর যেরূপ স্থানে ঐ ব্যক্তি আঘাতিত হইয়া পড়িয়াছিল বলিতেছে, সেইরূপ স্থানে ত উহাকে প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই, সে স্থানই বা কোথায়?

 তাহার জ্ঞান হইলে সে আমাদিগকে যাহা বলিয়াছিল, তদ্ব্যতীত আমাদিগের সন্দেহ দূর করিবার মানসে তাহাকে নিম্নলিখিত আরও কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।

 আমি। যে স্ত্রীলোেকটীর সহিত তুমি গমন করিয়াছিলে, ইহার পূর্বে তাহাকে আর কখন দেখিয়াছ কি?  কর্ম্মচারী। না, ইতিপূর্বে তাহাকে আমি আর কখন দেখি নাই।

 আমি। যে স্থানে তিনি তোমাকে তাঁহার গাড়ী হইতে নামইয়া দিয়াছিলেন, ইতিপূর্বে তুমি আর কখন সেইস্থানে গমন কর নাই?

 কর্ম্মচারী। না, সেইস্থান ইতিপূর্বে আমার জীবনে আর কখন দেখি নাই।

 আমি। ঐ স্থান দেখিলে পুনরায় চিনিতে পারিবে কি?

 কর্ম্মচারী। তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারিতেছি না।

 আমি। গড়ের মাঠ তুমি চেন?

 কর্ম্মচারী। খুব চিনি। গড়ের মাঠ দিয়া প্রায়ই আমাকে যাতায়াত করিতে হয়।

 আমি। যে স্থানে তুমি আঘাত প্রাপ্ত হও, সেইস্থানটী গড়ের মাঠের মধ্যস্থিত কোন স্থান, কি তাহার নিকটবর্তী কোন স্থান নয় তো?

 কর্ম্মচারী। না। উহা গড়ের মাঠও নহে বা তাহার নিকট বা কোন স্থানও নহে।

 আমি। যে তোমার মস্তকে আঘাত করে, তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারিবে?

 কর্ম্মচারী। না, তাহা পারিব না। তাহাকে তো আমি ভাল করিয়া দেখিতে সমর্থ হই নাই।

 আমি। তাহারা কয়জন ছিল, তাহা তুমি বলিতে পার?

 কর্ম্মচারী। না, তাহাও আমি বলিতে পারি না। সেই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে আমি কাহাকেও দেখিতে পাই নাই।  আমি। যে সময় তুমি আঘাতিত হইয়া অচৈতন্য অবস্থায় পতিত হও, সেই সময় সমস্ত অলঙ্কার গুলি তোমার নিকটেই ছিল, ইহা তোমার বেশ মনে আছে?

 কর্ম্মচারী। তাহা আমার ঠিক স্মরণ আছে, গাড়ীতে উঠিবার পর হইতেই ঐ অলঙ্কার আমি কাহারও হস্তে প্রদান করি নাই।

 আমি। তুমি কি করিয়া বলিতে পারি যে, তোমাকে গাড়। হইতে নামাইয়া দিবার পূর্বে অলঙ্কার গুলি সেই স্ত্রীলোকট আত্মসাৎ করে নাই?

 কর্ম্মচারী। তাহা আমি বেশ বলিতে পারি। কারণ, অলঙ্করগুলি আমি গাড়ীর ভিতর রাখিয়া দেই নাই। উহা আমার চাদরে বাঁধিয়া আমার বগলের নীচে করিয়া রাখিয়াছিলাম ও সেই অবস্থাতেই আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করি। যখন আমি চলিতে আরম্ভ করি, সেই সময়ও আমি উহা আমার বগলের নীচে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম, ইহা আমার বেশ মনে আছে।

 এরূপ অবস্থায় ঐ ব্যক্তিকে আর অধিক কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইল না। কিন্তু এখন বিশেষরূপ চিন্তা করিয়া দেখা উচিত যে, কি কারণে বা কিরূপ ষড়যন্ত্রের বশবর্ত্তী হইয়া ঐরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটী উহাকে তাহার গাড়ী হইতে নামাইয়া দিল। আরও অমাদিগের স্থির করা কর্ত্তব্য যে, সে ময়দানে উহাকে আঘাতিত অবস্থায় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, সেই ময়দান কি অপর কোন স্থানে এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে। আর যদি অপর কোন স্থানে তিনি আঘাতিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে সেই স্থানটাই বা কোথায়, এবং কাহাদিগের দ্বারা এই কার্য্য সাধিত হইল ও অলঙ্কারগুলিই বা কোথায় গেল?